বইমেলা ধুলো

কস্তূরী সেন

 

১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বাংলা টাইপের হরফ তৈরি হয়। করেছিলেন ত্রিবেণীর পঞ্চানন কর্মকার। আর ১৭৮৪তে ব্যাপটিস্ট মিশনের ছাপাখানার কম্পোজিটর শ্রী গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য নিজ উদ্যোগে ছাপিয়েছিলেন প্রথম বাংলা বই, সচিত্র অন্নদামঙ্গল। সন ১৮২৬। খুব সম্ভব বিক্রিবাটার উদ্দেশ্যে নিজেই একটি দোকান খোলেন তিনি। প্রথম বাংলা বইয়ের কেনাবেচা, প্রথম বাণিজ্যিকীকরণ। রেলপথ নেই। ডাকব্যবস্থা নেই। বেতার ভবিষ্যত। সোশ্যাল মিডিয়া ভিন্ন সৌরমণ্ডলের কল্পনা।…বই এল পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করার বেসিক লক্ষ্যের হাত ধরে। আঠেরো শতক, কলকাতার গ্রন্থনগরী হয়ে ওঠার মুখবন্ধ? একথা সত্য ৪২তম কলকাতা বইমেলায় একদিন ঘুরেটুরে স্রেফ নিজের কী মনে হল সেটুকুই লিখতে বলেছিলেন সম্পাদক। সেক্ষেত্রে ১৮ শতক কেন? ব্যাপটিস্ট মিশনের ছাপাখানাই বা কেন? হয়ত এই কেনর একখানি ব্যক্তিগত উত্তর হল ওই…কলকাতা। বই। বইবাণিজ্য।

বিনাদ্বিধায় ও তর্কে, বইয়ের বেচাকেনার প্রশ্নে গোটা বছরের কলেজস্ট্রিট, বছরের নানা সময়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক মেলা ইত্যাদিকে দশ কদম পিছনে ফেলে দেয় জানুয়ারি ফেব্রুয়ারির এই কলকাতা বইমেলা। পাবলিশার্স & বুকসেলার্স গিল্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বইপাড়ার প্রকাশকের সংখ্যা ৫০০রও বেশি। এবং আবারও বিনাদ্বিধায় বা তর্কে বাংলা বইয়ের বাজার অথচ স্রেফ সীমিত। বিশ্ববাজার বলতেও স্বাভাবিকভাবেই প্রবাসী বাঙালি এবং বাংলাদেশ মাত্র। এখানেই ফ্রাঙ্কফুর্ট বা লন্ডনের মত দুনিয়াখ্যাত বইয়ের মেলাগুলিকে পিছিয়ে দেয় আমাদের এই অধুনা প্রায় পরিযায়ী আন্তর্জাতিক বইমেলা। কেননা ওই, লন্ডন বা জার্মানির মতো গ্রন্থসত্ব বিক্রির মেলা নয় এটি, এখানে বই কেনেন স্বয়ং পাঠক। বইয়ের এই সরাসরি ও বিশাল বাজারের দশদিনে নামী স্টলের বিজ্ঞাপিত বইয়ের মতোই, কখনও তার বেশিই,লিটল ম্যাগের টেবিল থেকে বিক্রি হয়ে যায় প্রত্যন্তের প্রকাশকের সাধ্যাতিরিক্ত লগ্নি করে ছাপানো তরুণ কবির প্রথম ধারালো বই। কলকাতা বইমেলায়, আদতেই, শেষ কথা পাঠক।

একথা ঠিক বইমেলায় ঢুকে ম্যাপ হাতে বুঝভুম্বুল যেতে হয় ও হয়েছে। ফুডকোর্টের দিকে স্টল খুঁজে খুঁজে সাধের জুতোর হিল ক্ষয়ে যায় ও ক্ষয়েছে, সমান আকুলতায় পিঠেপুলিপ্রেমিক কৃত্তিবাস সিগনেটের গলিতে দাঁড়িয়ে অভিশাপ দেন ও দিয়েছেন আজও। চারদিকের অজস্র ব্যাঙ্ক, গয়না আর টিভিচ্যানেলের স্টলের ফাঁকে ফাঁকে পাক খেতে খেতে, মুক্তমঞ্চের খোঁজ নিতে গিয়ে আজ যেমন তৃতীয়বার একই পুলিশকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং দুজনেই প্রবল প্রতারকের মতো চোখ সরিয়ে নিয়েছি। গতদিনের পথদুর্ঘটনার জেরে আটকে থাকা ভিড় আজ যেমন দুপুরের পর থেকেই জমজমাট, যেমন চেনা লাইন আনন্দ, দে’জ-এর সামনে, যেমন যথারীতি লিস্টে থাকা অনেক পছন্দের বই এখনও এসে পৌঁছয়নি স্টল কিংবা লিটল ম্যাগের টেবিলে, তেমনই আচমকা ঠিক ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খেয়াল করেছি কাঁধের ঝোলাব্যাগে নিজের লেখা হাসির গল্পের বই নিয়ে সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে কই এবার দেখা হল না তো, দেব সাহিত্য কুটীর কখন কোনদিকে আড়ালে পড়ে গেল, খেয়াল হল না তাও।

ছোটবেলার ধুলো নেই বইমেলায় অনেকদিনই, ঠিকানাবদল নিয়ে কমন অভিযোগ গা সওয়া হয়ে গিয়েছে, ৯৭-এর আগুনের পর সত্যিই বড় দুর্বিপাক ঘটেনি তেমন, এও আশার…।১৯৭৬-এ বিড়লা তারামণ্ডলের উল্টোদিকে তৎকালীন ফাঁকা মাঠে ১৪ কি ১৫ জন পাব্লিশারকে নিয়ে শুরু হওয়া মেলায় এখন অগণন স্টল, লক্ষাধিক বর্গফুটের পরিসীমা, মাইকে আকুল থিমসঙ্গীত — শুধু পাঠক এক। জোর দিয়ে এক। মাটির গয়না এবং পিঠের বাক্সের পাশেই উঁকি মারা নতুন বইয়ের প্যাকেটে এক। ভ্রাম্যমাণ কবিতাগাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে সদ্য কেনা বইতে কবির সই নেবার আগ্রহে এক। রোদে এক, ক্লান্তিতে এক, স্টলের মুখে লাইন দেওয়ায় এক। কেন বলব বাঙালি বই পড়েন না। কেন বলব না বইমেলায় বইয়ের সঙ্গে মিষ্টিও কেনা অপরাধ নয়, কেন বলব না সেই মগ্ন প্রৌঢ়ের কথা যিনি পকেটের সঙ্গে সমঝোতা করতে গিয়ে স্টলের ভিড়, প্রকাশনাকর্মীর বিরক্তি উপেক্ষা করে না কিনতে পারা বইটি পড়তে পড়তে আজ সন্ধেতেও পার করে দিয়েছেন অনেকটা সময়, অথবা সেই মেয়েটি,যে মনে মনে পুজো করা ছেলেটির প্রথম বই কিনতে এসে খেই হারিয়েছে লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নের আগুনে ভিড়ে। বইমেলা, ভালোবাসার শহরে ভালোবাসার আশ্চর্য মেলা এক, যেখানে অজস্র উচ্চকিত বিজ্ঞাপন, আত্মপ্রচার, যশোপ্রার্থনা, আছে সবই, শুধু আনন্দ এই যে শেষ পর্যন্ত সবই বইয়ের। লেখার। কলম, কাগজ ও ছাপার হরফের। এবং সেই পাঠকের যিনি আজ চতুর্থ দিনে ফেরার তাড়া এড়াতে নতুন বইয়ের প্যাকেট সমেত থেকে গেলেন মেলার কাছাকাছি কোনও পরিচিতের বাড়িতে। ৪২তম কলকাতা বইমেলায় লোকচক্ষুর আড়াল দিয়ে হেঁটে গেলে, আজও বড় গর্ববোধ করতেন ত্রিবেণীর পঞ্চানন, শ্রীরামপুরের গঙ্গাকিশোরেরা।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...