বইমেলার নয়ের দশক : সে ছিল আমাদের শুভ অশৌচের কাল

বুবুন চট্টোপাধ্যায়

 

সে ছিল একদিন। বইমেলা এলেই আমাদের কারও কারও গোপন বাঁশী বেজে উঠত। টানা এগারোদিন কেমন এক মন্ত্রমুগ্ধ, ধর্মীয় অশৌচ পালন করার মতো আমরা সারাদিন মেলায় পড়ে থাকতাম। এ ছিল শুভ অশৌচ। তখন আমাদের বইমেলা ঘিরে ছিল সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তকাল। সোঁতা বলে আমাদের একটি কবিতার পত্রিকাও ছিল। তাকে ঘিরে ছিল যাবতীয় প্রেম, অপ্রেম, আশা-আকাঙ্ক্ষার জায়গা। মেঘের গায়ে ধুলো জমতে জমতে মেঘগুলো যেমন গাঢ় হয়। আমাদের বয়সের উপর দিয়েও বয়ে গেছে বোধহয় ঈষৎ ধূলিঝড়। সেই ঝড়ে কত প্রান্তরের, কত প্রয়োজনের ধুলো যে মিশে আছে। বইমেলা যাপন ছেড়ে আমরা যারা নয়ের দশক আস্তে আস্তে ঢুকে পড়েছি জীবিকার অন্ধ গলিতে। অথচ সেইদিন যেমন ইচ্ছে বাঁচাকে ভীষণভাবে প্রশ্রয় দিত ময়দানের ওই নিবিড় বইমেলা।

প্রতিক্ষণ তখন প্রতি বইমেলায় ভূমেন্দ্র গুহর সম্পাদনায় একটি একটি করে জীবনানন্দ সমগ্র বের করছে। পাতা উলটে বইগুলোর দিকে লোভীর মতো তাকিয়ে থাকি। যদি সবগুলো কিনতে পারতাম। কী নেই তাতে! জীবনানন্দের কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প, চিঠি। যদি সব একসঙ্গে কিনতে পারতাম। কে কিনে দেবে? টিউশানি আর হাতখরচের পয়সা জমিয়ে কতটুকুই বা পড়ে থাকত? তবু অগাধ সাধ। আমারও বইয়ের আলমারিতে শোভা পাবে ওই সার সার জীবনানন্দ। ইচ্ছে হত নিত্যনতুন হারিয়ে যাব তাঁর অতলে। কিন্তু পকেটের জোর ছিল না। তাই প্রতিক্ষণের ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবীদের কেমন দূর থেকে দেখা বড়লোক বাবুদের মতো মনে হত। তাঁরা  লাল ভেলভেটের পর্দা দেওয়া ঘরে বসে চা, বিস্কুট খেতেন। যে বই ইচ্ছেমতো আনিয়ে নিতেন আর হয়তো সেইসময় আমাদের মতো চালচুলোহীন, নবীন কবিদের মুণ্ডুপাত করতেন। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনওকালেই টগবগে নতুন লেখকরা এইসব তথাকথিত সাহিত্যিক বাগাড়ম্বরকে কোনওদিন পাত্তা দেয়নি। আজও দেয় না। বরং সুনীল যখন জংলা শার্ট পড়ে, শার্টের দ্বিতীয় বোতাম খুলে হেঁটে যেতেন সেই গর্বিত হেঁটে যাওয়াটা আমাদের শাসন করত খুব। মুগ্ধ বালিকার মতো তাকিয়ে থাকতাম কিং লিয়রসুলভ তাঁর সেই স্বেচ্ছাচারী হেঁটে যাওয়ার দিকে। পেছনে অগণিত ভক্তের দল। সুনীলদাকে দেখে যেমন মনে হত কবি এমনও হয়, জয়দাকে দেখেও মনে হত কবি এমনও হয়। তাঁর আসা ঠাণ্ডা বাঁচিয়ে, ধুলো বাঁচিয়ে, অগণিত ভক্ত বাঁচিয়ে চুপিচুপি নিজের কয়েকজন নির্জন মানুষের কাছে আসা। আবার সেইভাবেই সবার অলক্ষ্যে কোনও একটা সময় রাণাঘাট লোকালের জন্য বেরিয়ে পড়া। আমরা মানে আমি প্রসূন, সাম্য, সুদীপ, সুমন, রাজেশ যারা শহর কোলকাতায় থাকতাম তারা ছিলাম বইমেলার অতন্দ্র প্রহরী।

শক্তিদাও আসতেন। সন্ধের দিকে টলমল পায়ে। আর ভাস্কর চক্রবর্তী বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ কমিটির অদূরে দাঁড়িয়ে মুখে স্মিত হাসি নিয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যেতেন।

তখন কবিদের কবিতা পাঠ শুনতে আমরা এস বি আই অডিটোরিয়ামে ভিড় জমাতাম। মাঝেমধ্যে গিল্ডের অফিসে গিয়ে বন্ধুদের নাম করে অনাবশ্যক ঘোষণা করে আসতাম। সেই বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে সেই নিয়ে দেদার খিল্লি হত। দেজ পাবলিশার্স আর মিত্র ঘোষের সামনে সেইসময় তারকাখচিত লেখকরা ভক্তকূল নিয়ে বসে থাকতেন। বুদ্ধদেব গুহর আপেলের মতো লাল গাল আর দামী কাশ্মীরি শাল বেয়ে কেমন একটা আধাভৌতিক জ্যোতি বেরোত। সেই জ্যোতির মধ্যে লুকিয়ে ছিল আমাদের গোপনে চানঘরের গান। সই শিকারিরা তাঁকে ছেঁকে ধরতেন। সেইসব সই শিকারির বেশিরভাগেরই প্রেমপত্রে তখন কোট, আনকোট প্রেমিক বুদ্ধদেব। আর ছিলেন নারায়ণ সান্যাল। তাঁর অজন্তা, ইলোরা ঘিরে তিনি তখন আমাদের কাছে ইতিহাস আর ভাস্কর্যের এক মাইলফলক। তাঁর মতো অজন্তা, ইলোরাকে কজনই বা দেখতে পেরেছেন।

পূর্ণেন্দু পত্রী, দেবেশ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, স্বপ্নাদিরা বসতেন প্রতিক্ষণের ভেলভেটের পর্দা দেওয়া ঘরে। একদিন সোঁতা নিয়ে সাহস করে ঢুকে গেলাম সেই ঘরে। বললাম আমাদের এক টাকার কবিতার প্যাম্ফলেট আপনাদের নিতে হবে এবং পড়ে মতামতও দিতে হবে। ওঁরা তখন স্টার লেখক। সামান্য এক টাকা ওঁদের কাছে নস্যি। সবাই সস্নেহে পত্রিকা নিলেন। মাঝখান থেকে পূর্ণেন্দু পত্রী বললেন, মতামত যে জানাব, ঠিকানা কোথায়? সেদিন রাত্তিরেই টেলিফোন। এত তাড়াতাড়ি শুভঙ্করের টেলিফোন আসবে কে জানত! বললাম যা বললেন, লিখে জানান। দিনদশেকের মধ্যেই পূর্ণেন্দুদার ছবির মতো হস্তাক্ষরে একটি ইনল্যান্ডও এল। তখন সত্যিই নিজেকে নন্দিনী মনে হচ্ছে। বেশ কিছুদিন চললও বটে চিঠিপর্ব। এইসব প্রাপ্তি আমাদের যৌবনের সেই মায়াবী ময়দানের বইমেলাই দিয়েছিল।

সেই যেবার দুপুরবেলা। সবে মেলায় ঢুকেছি হঠাৎ আগুন লেগে গেল। তারপর কবি, সাহিত্যিক মায় আমি শুদ্ধু লিখলাম বইমেলা আসলে সেই ফিনিক্স। সেবার ওই ঘোর আগুনের মধ্যেও নিজে বাঁচার চেয়েও বারবার মনে হয়েছিল আমাদের টিনের ট্রাঙ্কশুদ্ধু সেই পত্রিকা বাইরে আনতে পারব তো! যদি পুড়ে যায়। পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেবছরই হাজরা মোড়ে বিরোধী দলনেত্রী হিসেবে মমতার মাথা ভাঙল। তখন আমি মিত্র প্রকাশনে চাকরি করি। পত্রিকার বইমেলা সংখ্যা নিয়ে ইন্টার্ভিউ করতে নারায়ণ সান্যালের বাড়ি গিয়েছি। একদিন প্রস্তাব দিলেন মমতার উপর অগ্নিকন্যা নাম দিয়ে একটি বই লিখবেন। কো-অথর থাকব আমি। অর্থাৎ লেখার মালমসলা আমাকে যোগাতে হবে। নারায়ণ সান্যালের মতো লেখকের কাছ থেকে এহেন প্রস্তাব আমার কাছে স্বর্গের আপেলের মতো। আর আমার তো তখন লেখার মালমশলা জোগাড় করাই জীবিকা। তখন পুরোদমে সাংবাদিকতা করি। তো সেই সূত্রেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালিঘাটের টিনের চালেও বেশ কয়েকবার যাওয়া তাঁর এবং তাঁর পরিবারের লোকের সাক্ষাতকার নিতে। এও এক প্রাপ্তি তখনকার বইমেলা থেকে।

তারপর জীবনের ওপর জীবন ও জীবিকার অনেক টানাপোড়েন ঘটে গেছে। আমরা যারা নয়ের দশকের বইমেলার অশেষ প্রহরী ছিলাম। আমরা শুভ অশৌচের মতো পালন করেছি সমস্ত নিয়মাদি, শুধু ভাড়ের চায়ের উপরেই সেদিন যাদের সারাদিনের গ্রাসাচ্ছাদন ছিল, তাদের আজ বইমেলাময় ডিমের ডেভিল আর বিরিয়ানির গন্ধ বড় নাকে লাগে। অনেক রক্তজল করা লিটল ম্যাগের সোঁদা গন্ধ ছেড়ে যখন ফিসফিস করে বইমেলার মুক্ত মোচ্ছব পাড়িয়ে যেতে হয়। ভাবি কেন এলাম? কোথায় সেই চেনা মানুষগুলো? কোথায় আমাদের পত্রিকা, কোথায় সেই জ্বোরো উত্তাপ যার জন্য সারাবছর হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতাম!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো বুবুন।।ফিরে তাকানো আমাদেরও তরুণ সময়ের দিকে। সেই লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে ঝোড়ো হাওয়া… বইয়ের সম্ভারে জুলজুল তাকানো,অডিটোরিয়ামে কবিতার ভিড়….. সব সব ফিরে এলো।

আপনার মতামত...