সুস্নাত চৌধুরী
বাঙালির শুকনো নস্টালজিয়া আর ভালো লাগে না। নিজের ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখতে, অতীতকে সংরক্ষণ করতে তার মতো ব্যর্থ জাত আগে ছিল না। আজও নেই। সেই বাঙালিই যখন সাড়ে তেইশ ডিগ্রি কোণে ঘাড় বেঁকিয়ে, একটু উপর দিকে, ঠিক অনন্ত পর্যন্ত নয়, গিল্ড অফিসের দোতলার বারান্দা অবধি বড়োজোর, নরম দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বলে – ‘আহা, সে এক বইমেলা ছিল’ – তখন হাসি পায়! খুব হাসি পায়। বইমেলার কথা উঠলেই তার এই মুহুর্মুহু ‘ছিল-প্রবণতা’ আসলে এক পাতলা রোমান্টিসিজম মাত্র, যা অতীতকেও গুছিয়ে রাখতে পারেনি, ভবিষ্যমুখি হওয়ারও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিমাসিক ধ্যানবিন্দু বইপত্র-র সাম্প্রতিক সংখ্যা
অথচ এরই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবে আজ হাতে এল ‘দ্বিমাসিক ধ্যানবিন্দু বইপত্র’-র নতুন সংখ্যা। পুরানো সেই দিনের কথা বলতে তাঁরা নিছক স্মৃতিবিলাসে নিজেদের ভাসিয়ে দেননি, বরং আর্কাইভ ঢুঁড়ে প্রচ্ছদে তুলে এনেছেন প্রথম কলকাতা বইমেলার ফটোগ্রাফ। আলাপ হল চিন্ময় বিশ্বাসের সঙ্গে। ‘গল্পাণু’ পত্রিকার সম্পাদক। রসিক মানুষ। সত্তরোর্ধ্ব। লিটল ম্যাগাজিনের টেবিলে বসেন। আর বাড়ি ফিরে ডায়েরিতে টুকে রাখেন ক্রেতা বা পাঠকের বিবিধ ইন্টারেস্টিং মন্তব্য। প্রায় পনেরো বছর হল, এই কাণ্ড চলছে! তবে আর্কাইভিং-এর শ্রেষ্ঠ মানুষটি এবারের বইমেলায় নেই। অসুস্থতার কারণে আসতে পারছেন না সন্দীপ দত্ত। তাঁর ফেসবুক পোস্টগুলি দেখে বোঝা যাচ্ছে, ঘরে বসে ছটফট করছেন তিনি। বইমেলার কথা নয় হয়তো, তবু নিজেরই অভিজ্ঞতা নস্টালজিয়া আর ইতিহাসের আলোয় বাংলার মফস্সলগুলিকে ধরেছেন মৃদুল দাশগুপ্ত। এতদিন দৈনিকে ধারাবাহিক লিখেছেন – এবার মলাটবন্দি। ‘ফুল ফল মফস্সল’। মেলা ফুরোতে আর তিন দিন, তার মধ্যে বেরোবে তো?
‘গল্পাণু’-র টেবিলে সম্পাদক চিন্ময় বিশ্বাস
লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়নে দাঁড়িয়ে অনির্বাণদা, অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন – ‘এবার মেলার বিশেষত্বই হল, কেউ কিছু বের করছে না!’ পুরোপুরি না হলেও ব্যাপার কতকটা সেরকমই। রবিশংকর বলকে নিয়ে ‘তাঁতঘর’ পত্রিকার নতুন সংখ্যা এল সবে আজই। ‘একশো আশি ডিগ্রি’ আসার কথা শুক্রবার। ‘শুধু বিঘে দুই’ কবে বেরোবে? সম্পাদক সংগীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুশলী জবাব – উইকএন্ডে। মানে, বেরোতে বেরোতে মেলার শেষ দিন রবিবারও হয়ে যেতে পারে! নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি পত্রিকা তো কেবল ফেসবুকে বাজার গরম করেই গেল! শেষমেশ বলেই দিল – মেলায় বেরোচ্ছে না, কাগজ বেরোতে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ! এই অবস্থা হচ্ছে কেন? অনেক সুবিধের সঙ্গে কি ডিজিটাল প্রযুক্তি কিছু কুপ্রভাবও আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে? মানে, লেখক ও সম্পাদকদের মাইন্ডসেটই কি আজ এমন হয়ে যাচ্ছে যে তাঁরা জানেন, যন্ত্রের দাক্ষিণ্যে চাইলে একেবারে শেষবেলাতেও কাজ নামিয়ে দেওয়া সম্ভব? প্রোডাকশনের জন্য কি আমরা আর হাতে যথেষ্ট সময় রাখছিই না? আগ্রহী পাঠক-ক্রেতা কেন মেলার প্রথম বা দ্বিতীয় দিন থেকে পত্রিকা হাতে পাবেন না? যাঁরা দূরের জেলা থেকে বা ভিনরাজ্য ভিনদেশ থেকে একদিন কি দু-দিনের জন্য মেলায় আসতে পারেন, তাঁদের কথা কি আদৌ ভাবছি না আমরা? প্রশ্নগুলো কঠিন, আর উত্তরও আমার অজানা।
সন্দীপ দত্ত। এবার বইমেলায় অনুপস্থিত
এবারের বইমেলায় কত কিছুই তো অজানা থেকে গেল। জানা হল না, মেলা জুড়ে এত পুলিশ কেন? বিশেষত লিটল ম্যাগাজিন তাঁবুর চারপাশে। রাষ্ট্র ভীত, না কি খুচরো হুজ্জুত আটকাতে এই আয়োজন? তবে, ভাগ্য ভালো, পুলিশের সেই বলয় পেরিয়ে মেশিন-চা-কে বুড়ো আঙুল দেখাতে দেখাতে পাঁচ টাকার লেবু চা নিয়ে বার বার হাজির হতে পারছেন বনগাঁর সাগরলাল দাস কিংবা নৈহাটির মানিক কাঞ্জিলাল! তাহলে কি দয়াপরবশ হয়ে পুলিশ তাঁদের দেখেও দেখছে না? লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে জ্বালা গুট্টা আর অশ্বিনী পোনাপ্পা জুটির মতো মন ভালো করা দুই মহিলা পুলিশকর্মীকে অনেকেই যেমন না-দেখে দেখছেন, এ-ও তেমনই হয়তো! না, ওঁদের পরিচয়ও জানা হল না। কে জানে, পরে কখনও বইমেলার মাঠেই হয়তো ওঁদের কথা মনে পড়বে কারও…
কারণ, শীত ফুরিয়ে এলে বাঙালির নস্টালজিয়া বাড়ে। বইমেলার বারো দিন কাউকে বারো বছর কাউকে বাইশ বছর পিছিয়ে দেয়। এখানে মানুষ আসলে খুঁজতে আসে। কেউ বই, কেউ বন্ধু। কেউ নিজেকেই, আরেকবার। নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণার লাইভ টেলিকাস্ট হয়ে ওঠে বইমেলা। মাইকে সেসব শোনা যায় না। অজানা থেকে যায় সেই অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার শেষ কয়েক মিনিটের সম্প্রচার। মাঝখান থেকে অনুজ বন্ধু পৃথ্বী বসু লিখে ফেলেন চরম কয়েকটি পঙ্ক্তি –
‘আপনার সঙ্গী কি হারিয়ে গেছে? খুঁজে পাচ্ছেন না? যোগাযোগ করুন গিল্ড অফিসে’
পারবে গিল্ড? পারবে?
জানি, পারবে না।