তরুণ কবিরা যেন বালি খুঁড়ে জলাশয় টানে

অভীক ভট্টাচার্য

 

মৃতেরা কোথাও নেই, আছে?

আকাশজোড়া মস্ত চাঁদ উঠেছিল সেদিন। আর, সেই চাঁদের ওপিঠে মণিদাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে অনেক রাত্তিরে বাড়ি ফিরেছিল কয়েকজন। মাত্রই হাতেগোনা কয়েকজন, যারা, হয়তো সেই চাঁদের নিস্তব্ধতার মধ্যে, শেষবার মণিদার কবিতার আশ্চর্য সম্মোহনের সামনে চুপ করে কিছুক্ষণ বসতে চেয়েছিল। তারপর চাঁদ তার নিজস্ব নিয়মে ভোররাতের দিকে গড়িয়ে যায়, আমরা মণিদার অক্ষয় মালবেরি আর লাল স্কুলবাড়ির মায়াবাস্তব থেকে ধীরে-ধীরে আমাদের নিজস্ব ধোঁয়া আর ধুলোর দৈনন্দিনতার দিকে সরে আসতে থাকি…

সরতে-সরতে শেষ পর্যন্ত এই বসন্ত-বিকেলের সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে, এই বইমেলায়। খুব বেশিদিনের কথা নয়, এমন এক বইমেলার সন্ধেতেই আদম থেকে প্রকাশিত কবি মণীন্দ্র গুপ্তের কাব্যসমগ্র হাতে নিয়ে উড়তে উড়তে বাড়ি ফিরেছিলাম। বছরকয়েক আগের সেই সন্ধেটাকে আজকের মেলায় খুঁজতে গিয়ে হতাশ হতে হয়। গোটা বইমেলা জুড়ে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা ব্যাঙ্ক ও আচারের দোকান, গুঁড়োমশলা, বিমাকোম্পানি, রাজনৈতিক শিবির ও ধর্মব্যবসায়ীদের তাঁবুর কাছে প্রত্যাশা থাকে না কিছুমাত্র, কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের আপনার কোণটিতেও মণিদার না-থাকাটা ততদূর দৃশ্যমান নয় দেখে ভিতরে কোথাও ধাক্কা লাগে। বেশ কিছু কাগজে মণিদার লেখা… কিন্তু কোথাও একটা ছবি চোখে পড়ে না – একটা ফ্লেক্সও নয়। মাত্রই দিনদশেকের ব্যবধানে আমরা তাঁর স্মৃতির কাছে থেকে অনেকটা সরে আসতে পেরেছি বলে মনে হয়। একটা ছবি বা ফ্লেক্সে কিছু কি প্রমাণ হত? অবশ্যই নয়। তবু, অন্তত সেই ছবির মধ্যে থেকে বাইরে তাকিয়ে হয়তো আজকের মেলার মাঠটাকে খানিক দেখতে পেতেন মণিদা…

কিন্তু তারপর যখন চোখে পড়তে থাকে একের পর এক সদ্যপ্রকাশিত পুথি – দু’ফর্মার, চারফর্মার অসংখ্য নতুন পত্রিকা, সেসব পুথিপত্রিকার চারপাশে ঘিরে থাকা অনেক তরুণ-তরুণীর আলোকিত মুখ, অনেকের অনেক রাত্তিরের না-ঘুমনো পরিশ্রম ও স্বপ্নবুননের ক্লান্তি ও একেবারে শেষবেলায় নিজের বা নিজেদের পুস্তিকাটিকে মেলায় হাজির করতে পারার  সার্থকতা, তার মধ্যে কোথাও মণিদার আশ্চর্য সজীব চোখদুটোর কথা মনে পড়ে। মনে হয়, আজ সন্ধের সব আলো, সব কলরব ও উচ্ছ্বলতার মধ্যে, হয়তো বা না-জেনেই, মণিদারই তর্পণ করছেন ওঁরা। যেন, এইসব আপাত ভুলে থাকা আসলে ততদূর ভুলে থাকা নয় – যেন এর গভীরে কোথাও একটা মণিদার দিকেই যাওয়া আছে। তুমি তা জানো না কিছু… না জানিলে… আমার সমস্ত গান তবুও তোমারে লক্ষ করে। মনে পড়ে কবি অমিতাভ গুপ্তর সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া লাইন, “তরুণ কবিরা যেন তোমার সমস্ত মুখ জলে ধুয়ে দেয়…”, মনে হয় আজকের এই সাহিত্য-উৎসবের মধ্যে নিহিত সেই তর্পণের কথাই বলতে চেয়েছিলেন তিনি – আজকের লিটল ম্যাগাজিনের এই সামিয়ানার নীচে উপস্থিত সকলে যেন মণিদার সারা মুখ ধুইয়ে দিচ্ছে শেষশীতের শিশিরের জল দিয়ে…

তুমি কে গা? এপাড়ায় কী মনে করে?

মাঠে ঘুরতে-ঘুরতে দেখা হয় কতজনের সঙ্গে। নিছক আরও একটি আইসক্রিম খাওয়ার জন্য অনেক দূর থেকে এসেছেন কেউ-কেউ, সেলফি-তে নিজের পুস্তক-অনুরাগ ইতিহাসে অমর করে রাখার জন্য অনেক কষ্ট করে এসেছেন কেউ-কেউ, কিংবা আরও একটি সন্ধে বন্ধুদের সঙ্গে কাটানোর উদ্দেশ্যকে যথেষ্ট ভাবগম্ভীর তথা সাহিত্যগুণমণ্ডিত করে তুলতে এসেছেন কেউ-কেউ। কেউ কেউ এমনকী এসেছেন আচার কিনতে, কলেজে ভর্তির ফর্ম তুলতে, এমনকী ব্যাঙ্কের দোকান থেকে প্রয়োজনীয় নানা কাগজপত্র নিতেও। এইসব কাজই মেলার বাইরে, পাড়ার মোড়েই অনায়াসে করা যেতে পারত কি না তা ভিন্ন (এবং অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত) প্রশ্ন; কিন্তু এই আসন্ন-বসন্তের সন্ধেয় যখন দক্ষিণ থেকে উষ্ণ ও সঞ্জীবনী বাতাস দেয় তখন বিলিতি বইয়ের দোকান ও বাংলা মেগা-প্রকাশনের বইপত্রের মাঝখানে নিজেকে আবিষ্কার করার মধ্যে একধরনের শ্লাঘা মিশে থাকে – সেই শ্লাঘার আলোয় নিজের অন্তরাত্মা আলোকিত হয়ে উঠলে যৎপরোনাস্তি আনন্দ হয় – যেদিকে তাকাই সেদিকেই আনন্দ জ্ঞান হয় – আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি।

এ এমন এক ইয়ে, মানে জনসম্মিলন, যেখানে বই কিনলে গাড়ি জেতার সুযোগ থাকে, যেখানে এসে সত্যিই মনে হয় আনন্দাদ্ধেব খল্বিমাণি ভূতানি জায়ন্তে – যেন প্রাণসকল এই আনন্দের মাঝখানে জন্ম নিয়ে পিপীলিকাবৎ খলবল করতে-করতে আনন্দের মধ্যে দিয়ে আনন্দের দিকেই চলেছে… কেবল মুখে ধরা চিনির দানাটি ততদূর চোখে পড়ছে না।

ভালবেসেছিনু এই ধরণীরে

এই আনন্দসাগর থেকে বাঁ দিকে মোড় ঘুরে দু’মিনিট, কিন্তু বস্তুত আনন্দ থেকে কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে থাকা সোঁতা-র দশ বাই দশ স্টলে সংহিতার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় খানিক পরেই। সে আমার সঙ্গে আমার ভাষায় কথা বলে। সেখানেই চোখে পড়ে অনীক রুদ্রর নির্বাচিত কবিতা, ধুলোমাখা, কিন্তু ধুলোমলিন নয়। ধানসিঁড়িতে সুদীপ বসুর অনিন্দিতা বাসস্টপ। আর সেখান থেকে দু’কদম এগোতেই, আর্জেন্টিনা-ফুটবলের প্রেমে পড়ার পরবর্তী জীবনে এই প্রথমবারের জন্য ভালো লেগে যায় লিটল ম্যাগাজিনের নীল-সাদা। আমি ফিরে আসি আমার নিজের ঘরটিতে, রাংতার টোপর-পরা শালিখপাখিটির মতো।

আর নিমেষে সব আপনার লোক! আরশিনগরের টেবিলে দিলীপদার নতুন বই; রাবণ-এ অনির্বাণ, শুভাশিস; রক্তমাংসে গৌতমদা, শ্যামলকান্তিদা; কুবোপাখিতে অমিতাভদা; গোটা বইমেলা ধরে চেষ্টা করেও স্টলে কাগজ নিয়ে আসতে না-পারা বোধশব্দের সুস্নাত; বানানভুল শোধরাতে স্টল থেকে নিজের বই মরিয়া লুঠ করে নিয়ে আসা সার্থক – এতক্ষণে একটা ঘরে ফেরার বোধ তৈরি হয়ে উঠতে থাকে। এতজনের সঙ্গে এত কথা যে বাকি রয়ে গিয়েছিল এতদিন ধরে – মেলার শেষদিনে এখানে না-এলে জানতে পারতাম?

আমার বইমেলা অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছিল জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই, ফেসবুকে। অনেক পরিচিত-স্বল্পপরিচিত-অপরিচিতদের নতুন বইয়ের খবরাখবর পাচ্ছিলাম সেখানে। ফেসবুকেই খবর পাচ্ছিলাম কবিতা-আশ্রম ও কবিতা-পাক্ষিকের নতুন সংখ্যার, সেখানেই দেখছিলাম একঝাঁক নতুন কবির নতুন বইয়ের প্রচ্ছদ – মেলায় এসে সেই প্রচ্ছদগুলোকেই চোখের সামনে উবু হয়ে বসে থাকতে দেখতে পেলাম যখন, আমার ভার্চুয়াল এসে তোমাদের রিয়ালে মিশে গেল। ফেসবুকের ছবিতে দেখা ঝকঝকে মলাটগুলো এখানে হয়তো সামান্য ধুলোমাখা, কোনওটার হয়তো কোনা-মোড়া একটু, কোনওটায় হয়তো একটু হাতে নিয়ে উলটে-পালটে দেখার দাগ। ভাগ্যিস! একটু দাগ-ছোপ না-থাকলে সেসব কি আর বাস্তবের হত?

আবার আসিব ফিরে

ফিরব বলে ঘড়ি দেখছি যখন, দুটি প্রায়-কিশোর উত্তেজিতভাবে তাদের নতুন পত্রিকা বিক্রির হিসেব করতে-করতে চলেছে। কান পাতলাম ওদের কথায়। বাদুড়িয়া থেকে এসেছে ওরা। টেবিল নিতে পারেনি। এর-ওর-তার টেবিলে কিছু কাগজ রেখেছিল, বাকিটা হাতেই। সামনের বার আগেভাগে টেবিল বুক করতে হবে, তার জন্য টাকা জোগাড় করতে হবে, একেবারে প্রথম দিনেই কাগজ নিয়ে মেলায় পৌঁছতে হবে – এমনই সব উত্তেজক পরিকল্পনায় ডুবে ছিল ওরা। এক-পা ধুলো দুজনেরই। চুল উসকো-খুসকো। কিন্তু চোখেমুখে পৃথিবীজয়ের আনন্দ…

শুরুতে অমিতাভদার কবিতার যে লাইনটি মনে এসেছিল মণিদার কথা লিখতে গিয়ে – “তরুণ কবিরা যেন তোমার সমস্ত মুখ জলে ধুয়ে দেয়” – এই বালকদুটিকে দেখে আচমকাই তার পরের লাইনটিও তেমনই সত্যি হয়ে উঠল। “তরুণ কবিরা যেন বালি খুঁড়ে জলাশয় টানে…”

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...