ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
নববিজ্ঞানের প্রথম শহীদ জোর্দানো ব্রুনোর জন্ম কোপার্নিকাসের মৃত্যুর পাঁচ বছরের মাথায়। কোপার্নিকাসের সৌরমণ্ডলীয় তত্ত্বের প্রচারক এই ইতালিয় গণিতজ্ঞ ও দার্শনিককে পুড়িয়ে মারা হল উল্টো করে ঝুলিয়ে — বৈধর্ম্যের প্রচারের অপরাধে। কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল আজ থেকে ঠিক চারশো আঠেরো বছর আগে — ১৬০০ খৃস্টাব্দের ১৭ই ফেব্রুয়ারি।
অঙ্কিত সাক্সেনার খুনটাও এক ধরণের বৈধর্ম্যেরই শাস্তি। হিন্দুর ছেলে হয়ে মুসলমানের মেয়ের সঙ্গে প্রেম। মাঝে চারশো আঠেরো বছর পেরিয়ে গেছে, আর সেই নববিজ্ঞান আজ যথেষ্ট সাবালক — এটুকুই যা পার্থক্য।
আমি জানি না শেহজাদির বাবা, অন্যান্য পরিজন কী করতেন বা করেন। শুধু এইটুকু জানি, ঘরের মেয়ের এ-হেন পাপকে শাস্তি দিতে তাঁরা হাতে অস্ত্র তুলে নিতে একবারও দ্বিধা করেন না। ছুরি দিয়ে অঙ্কিত-এর গলায় কোপ বসাতে তাঁদের মানবধর্ম একবারের জন্যও জেগে ওঠে না — বাহিতধর্মকে প্রতিহত করে না। ট্র্যাডিশন সেই একই, শুধু মাঝে চারশো আঠেরোবার সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী। আমরা যতই চাই, ফলাফল ভিন্ন হওয়া প্রায় অসম্ভব, কারণ তাঁরা মারতে উন্মুখ তাঁদের নিজেদের সন্তানদের। অঙ্কিত-এর ক্ষেত্রে তাঁরা শেষ পর্যন্ত যা চেয়েছিলেন তা করতে পারেননি। অর্থাৎ শেহজাদিকে খুন। মাঝে অঙ্কিত-এর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গিয়ে সে কাজটা করা হয়ে উঠল না আর। ভিন্নধর্মী, প্রকারান্তরে বিধর্মী একটি ছেলের সঙ্গে প্রণয়সম্পর্ক পাতিয়েছে বলে বাপ-মা অস্ত্র হাতে উদ্যত হয়েছিলেন নিজেদের সন্তানেরই রক্তপান করতে। সে-ক্ষেত্রে অঙ্কিত-এর প্রতি তাঁদের নিষ্ঠুরতার কথা আমার কাছে মাত্রই এক তথ্যবিশেষ। হৃদয়বত্তার কোনও আশ্চর্য প্রকাশ নয় আর।
তবে, এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, আমার পরিপার্শ্ব আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিতে চেয়েছে — দেখো, আখলাক-আফরাজুলের হত্যার সময় যে জ্ঞানগর্ভ ভাবগম্ভীর বক্তৃতা করেছিলে, তার থেকে যেন সরে এসো না! তোমার ঘৃণা যেন শেহজাদির পরিবারের প্রতিও সমভাবে বর্ষিত হয়। কঠিন প্রতিজ্ঞা, সন্দেহ নেই। কারণ, এখানে আক্রমণের লক্ষ্য শুধুমাত্র অপরাধ বা অপরাধী নয়। অপরাধীর ধর্মও।
এ-হেন অবুঝ অন্ধ পরিপার্শ্বকে কে বোঝায়, এই দুই অপরাধের চরিত্র আলাদা। আখলাক-জুনেইদ-আফরাজুলের খুনের আড়ালে রয়েছে সংখ্যালঘুর ধর্মের প্রতি সংখ্যাগুরুর ঘৃণা আর অন্ধ অবিশ্বাস। অন্যদিকে অঙ্কিত-এর হত্যার কারণ এক অর্থে ধর্ম হলেও, আরও ব্যাপক অর্থে সংস্কৃতির একটা ভুল ধারণার বশ্যতা। অঙ্কিত-এর হত্যাকারীরা তাকে চিনত। অন্য ক্ষেত্রে খুনিরা আখলাক বা জুনেইদকে চিনত না মোটেই। অঙ্কিত-এর হত্যা তাই ‘অনার কিলিং’, যা এ-দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় সমধর্মী মানুষের ভেতরেই।
তবে এ-বিষয়ে সবথেকে বড় সাহায্য আর মনের জোর পেয়েছি অঙ্কিত-এর বাবা শ্রী যশপাল সাক্সেনার থেকে। এই উন্মত্ত সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে এমন গভীর শোকের সময়েও তিনি এক ধাক্কায় ছুড়ে ফেলেছেন পুত্রহত্যার ধর্মতত্ত্ব। স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, এ-কাজের জন্য তিনি সমগ্র মুসলমান সমাজের প্রতি ঘৃণা পোষণ করেন না। সাম্প্রদায়িক সমস্যার ভয়ে বিরত থেকেছেন অঙ্কিত-এর বিচারের দাবীতে পরিকল্পিত মোমবাতি মিছিলের থেকে। রামায়ণের অন্ধমুনি যা পারেননি, তা করে দেখিয়েছেন যশপাল। হিংস্র প্রলাপের মধ্যে এই হোক আমাদের সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী!
ইন্টারনেটে দেখছিলাম, সারা পৃথিবীতে না কী বছরে পাঁচ হাজারের মতন অনার কিলিং হয়ে থাকে[[১]]। তার মধ্যে এক হাজারের মতন ঘটনা ঘটে ভারতে। প্রায় সমসংখ্যক ঘটনা ঘটে পাকিস্তানে। তুরস্কও এ-ব্যাপারে কিছু কৃতিত্ব দেখিয়েছে, তবে তা দুই-প্রধানের কাছে নস্যি।
অনার কিলিং-এর কারণ প্রত্যাশিতভাবেই একাধিক। তা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে এবং হয়ে চলেছে বিস্তর। কিন্তু যা হয়নি বলে আমরা নিত্য দেখছি, তা হল সাধারণ্যে এই সমস্ত আলোচনার কোনও প্রভাব। মেয়ে, যারা সাধারণভাবে ‘মেয়েছেলে’ বলে পরিচিত, সব ধর্মে ফলত সমস্ত ‘সভ্য’ সংস্কৃতিতে তাদের কী কী করণীয় তা দেগে দেওয়া আছে। সেই চৌহদ্দির বাইরে তারা পা ফেললে তাদের সঙ্গে যা যা ঘটে থাকে, অনার কিলিং তারই একটা চূড়ান্ত চেহারা। সেই মেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের হোক, বা উচ্চবিত্ত শহুরে। ‘রোগ’ যেহেতু এক, তার নিদানেও বিশেষ তারতম্য দেখতে পাওয়া যায় না। অঙ্কিত-এর খুন এ-ক্ষেত্রে নিছকই সমাপতন। কারণ আগেই বলেছি, হত্যার আসল লক্ষ্য ছিল শেহজাদি।
এই দায়সারা আলোচনার শেষে এই কথাই বলে রাখা ভালো — এই সমস্যার কোনও আশু সমাধান চোখে পড়ছে না। সুতরাং একের পর এক এমন ঘটনাই ঘটে চলুক। আমরা ঘরে বসে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলি। আর বাড়ির মেয়েকে আরও ভালো করে শেখাই — কেমন করে আরও আরও মেয়েলি হয়ে উঠতে হয়।
ব্রুনোর ছাই, যা ছড়িয়ে দেওয়া হয় টাইবার নদীতে, হয়তো আজও ভূমধ্যসাগরে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়নি। সেই ছাই উদ্বুদ্ধ করবে কাকে, হন্তারক না শিক্ষক, সময় তা এখনও ঠিক করে দিতে পারল না। অথচ, সারা দুনিয়ার শত শত নদী দিয়ে কম জল তো বয়ে গেল না সভ্যতার এই দীর্ঘ ইতিহাসে। বাকি ইতিহাসের চেহারা খুব বেশি বদলাবে, এমন আশা রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ছে দিনের দিন। তবু, ধ্বংসের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের ভরসা থাক যশপালে, কোনও সনাতন মৌলবাদীতে নয়।
তথ্যসূত্র