সুমন মাইতি
যেকোনও শহরের মাইক্রোকজম হচ্ছে সেখানকার ট্যাক্সিচালকরা। বেশ কয়েক মাস ধরে শহরের অন্যদিকে যেতে হচ্ছে একটা প্রজেক্টের কাজে, সপ্তাহে দু’বার। যাতায়াতে পার্কিং-এর ঝামেলা এড়াতে উবের বুক করে নিই -– প্রায় ত্রিশ মিনিটের মতো লাগে — সময় থাকলে মাঝে মাঝে গল্প হয় ড্রাইভারের সাথে। বিভিন্ন মানুষের সাথে আলাপ-পরিচয় ঘটে। এঁদের একটা বড় অংশ অভিবাসী । সেদিন গাড়িতে ঢুকে সবে দরজাটা বন্ধ করছি, কানে এল — “আপ হিন্দুস্তান সে হো?” চোখ তুলে দেখি পেছনে ফিরে সহাস্যমুখে ড্রাইভার আহমেদ উত্তরের অপেক্ষায়। আহমেদ আফগানিস্তানের ছেলে, কাবুলে বাড়ি। বছর দু’য়েক হল এখানে এসেছে। মার্কিন সেনার দোভাষীর কাজ করত — সেই সূত্রেই এখানে আসতে পেরেছে। মাস ছয়েক হল বিয়ে হয়েছে; ফুটফুটে বৌ, কিন্তু তাকে এখানে নিয়ে আসবে না। ট্রাভেল ব্যান নিয়ে গত কয়মাসে যতবার বল আদালতে গড়িয়েছে, ততবার স্ত্রীকে এখানে নিয়ে আসবার প্ল্যান বাতিল করেছে আহমেদ। বলল — এখানে আসার সময়, আগে দিল্লি হয়ে তারপর এখানকার বিমানে উঠেছে — ওর বিশ্বাস ইন্ডিয়া থেকে আসলে ওকে আটকাবে না। যদি এখানে টিকতে না পারে তাহলে বৌকে নিয়ে দিল্লির লাজপতনগরে সংসার পাতবে, সে প্ল্যানও করে রেখেছে। এখন পাঁচজনের সাথে একটা দুই কামরার ফ্ল্যাটে থাকে। ভারত ওর কাছে কাবুলের মতোই প্রিয়। ট্র্যাভেল ব্যান নিয়ে প্রচুর সমস্যা হয়েছে — মামলা গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। শেষ অব্দি একটা আপোষ রফায় সরাসরি ব্যান না করে একটু ঘুরপথে কড়াকড়ি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু অভিবাসীদের জীবনে এর প্রভাব পড়েছে অন্যরকম। আরেকটি ইরানি ছেলে অফিসে কাজ করে, সে তার দেশে যাওয়া পিছিয়ে দিয়েছে এই ভয় একবার ফিরে গেলে যদি আর এদেশে ফিরতে না দেয়। মাঝেমাঝেই আমাকে ফোন করে ডেকে নেয়। “চলে এস”। একটা লেবানিজ রেস্তোরাঁয় দু’জনে বসে বাবা-গানোশ আর ল্যাম্ব শ্যংক খেতে খেতে ফেলে আসা বাড়ির গল্প হয়। সেও চিন্তায় ছিল। শেষ পর্যন্ত সাতটি দেশের ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা তুলেই নিয়েছে সরকার। এখন যাবার বন্দোবস্ত করছে। নতুন ব্যবস্থায় সমস্ত ধরনের অভিবাসনের ওপর কড়াকড়ি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, বাড়তি অভিবাসীদের সংখ্যায় রাশ টানাটাই উদ্দেশ্য। কয়েকদিন আগেই মিডিয়া তোলপাড় হয়ে গেছিল, অভিযোগ ওঠে — হাইতি, এল-সালভদর, নাইজিরিয়া, ঘানা, সোমালিয়ার মতো কিছু কিছু দেশের অভিবাসীদের আমেরিকায় অনভিপ্রেত বলে মতপ্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট। যদিও পরে হোয়াইট হাউস থেকে বিবৃতি দিয়ে সে অভিযোগ খণ্ডন করেন প্রেস সেক্রেটারি সারা হাকাবি স্যান্ডার্স। কিন্তু এটা অভিবাসনের একটা দিক। আরেকদিকে রয়েছে এখানে বসবসকারী ‘অবৈধ’ বাসিন্দারা, যাঁরা দেশ ছেড়ে চলে আসার সময় শিশুদের নিয়ে এসেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এদের অনেকের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল না — এদিকে সেদিনের শিশু আজ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেছে। এই ছেলেমেয়েগুলির লিগ্যাল স্ট্যাটাস বৈধ না অবৈধ এই বিতর্কের চুলচেরা বিচারে বারবার কংগ্রেস অচল হয়ে পড়ছে, গর্ভমেন্ট শাটডাউন।
অভিবাসন হচ্ছে মেডুসার মাথা, একাধিক সমস্যা; একটা কাটলে আরেকটা গজিয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গ উঠলেই বহুধাবিভক্ত ট্রাম্পের অ্যামেরিকার রাজনীতি। যেমন ধরুন, হোয়াইট কলার অভিবাসন — এখানে আবার এশীয়দের একাধিপত্য। মজার ব্যাপার এইচ-ওয়ান বির বিরুদ্ধে অধিকাংশ ব্লু-ডগ ডেমোক্র্যাট বা সেন্টার রাইট রিপাবলিকরা এককাট্টা। মূলধারার মার্কিন সমাজে এর জন্য সেরকম জোরালো কোনও সমর্থন নেই — অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেসুন এইচ-ওয়ান বি পুরোপুরি তুলে দেবার পক্ষপাতী। তাহলে এই ভিসাটা টিকে গেল কী করে? কারণ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো এই ভিসা চায়। এদের মধ্যে আবার একটা বড় অংশ ডেমোক্র্যাট ডোনার আর রিপাবলিকান সমর্থকও! অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে একদিকে যেমন রিপালিকানরা বিব্রত, কিন্তু গ্রামীণ রিপাবলিকান ফার্মারদের দরকার সস্তার অদক্ষ শ্রমিক, যার জোগান দেবে মেক্সিকানরা, এবং তাঁদের নাগরিকত্বের সমর্থন করে ডেমোক্র্যাটরা; অন্যদিক কোম্পানিতে কাজ করতে আসা এইচ-ওয়ান বি হোল্ডারদের নিয়ে লেবার নেতারা অসন্তুষ্ট, এদিকে ট্র্যাডিশনাল রিপাবলিকান লবির প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে যাতে এই ভিসা বলবৎ থাকে, যাতে উন্নত দক্ষ শ্রমিক সহজলভ্য হয়। আরেকদিন উবেরে যাচ্ছি, মহিলা ড্রাইভার অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতেন; এখানকার নেটিভ; কর্মী-সংকোচনের জন্য লে-অফের আওতায় পড়েছেন। আমাকে কথায় কথায় বললেন — “কিছু মনে কোরো না, তোমাদের জন্য আমাদের রোজগারে টান পড়ছে, প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল আমাদের মাইনে বাড়েনি — তোমরাই ওই সব কাজ অর্ধেক বেতনে করে দিলে আমাদের জন্য আর কী থাকবে বলো তো!” ওনাকে বললাম — “আপনি লোকাল রিপ্রেজেন্টেটিভকে বলুন না, দেখুন তিনি যদি বিল পাস করিয়ে এটা আটকাতে পারেন। পার্টির স্টেট কমিটিতে জানান আপনার এই অভিযোগ।” ওনার আর দোষ কী! প্রচুর মানুষের এরকম ধারণা যে অভিবাসী-রা সাধারণ জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দিচ্ছে। স্টেম অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলিতে পড়া শেষ করবার পর বৃত্তিমূলক কাজের জন্য অভিবাসী ছাত্রদের থাকবার মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবে পাবলিক ফোরামে এই তিক্ততা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। তবে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত অভিবাসন নীতিতে সুদক্ষ, মেধাবী অভিবাসী-দের সুবিধা হবে — পক্ষান্তরে সেটা আমেরিকার আর্থিক সমৃদ্ধির সহায়ক হবে বলে অনেকেই মনে করেন, কিন্তু মোট অভিবাসী-র সংখ্যা অনেকটাই কমানো হবে। যদিও পরিকল্পনা রূপায়ণে এখনও প্রচুর ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। তবে আগামী কয়েক বছরে এইচ-ওয়ান বি বাতিল হয়ে গেলেও অবাক হব না। এখনকার রাজনৈতিক, সামাজিক চাহিদা, নব্বইয়ের দশকের যখন এই নীতি চালু হয়েছিল, সে তুলনায় বহুগুণে পালটে গেছে। সে কারণেই পরিচিত একজন ডুপ্লেক্স কেনার আগে নিষ্ঠাভরে স্বামীনারায়ণে পুজো দেয় যাতে ভিসার মেয়াদ বাড়ে! কাজের সূত্রে প্রতিদিন প্রচুর অভিবাসী-দের সঙ্গে কথা হয়। একটা লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে — ট্রাম্পের প্রস্তাবিত পয়েন্টভিত্তিক অভিবাসন নীতির পক্ষে বহু অভিবাসী-রও প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। রিফিউজি বা শরণার্থী সমস্যার তুলনায় এখানকার অর্থনীতির পক্ষে লাভদায়ী হবে এইরকম নীতির সমর্থক সাধারণ নাগরিকরা তো বটেই, বহু অভিবাসী-ও এতে সহমত। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, আর্মেনিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়ার মতো দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসী-রা কট্টর অভিবাসন নীতির সমর্থক। একই চিত্র খানিকটা কিউবান, আর্জেন্টাইনদের মধ্যেও রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই পালসটা ক্যাপচার করে নিয়েছেন। বিশ্বায়িত অভিবাসন নিয়ে যে কোনও সমাজে দু’টো চোরাস্রোত খেলে, কিন্তু এখন সেটা অনেকটাই কেন্দ্রাভিমুখী — বাইরের মানুষের জন্য অবাধ প্রবেশাধিকার সর্বত্র সংকুচিত হয়ে আসছে। এলিস আইল্যান্ডের স্ট্যাচু অফ লিবার্টি বেদিতে খোদিত এমা ল্যাজারাসের কবিতার লাইনগুলো যেন অনেকটাই নিষ্প্রভ এই নতুন পৃথিবীতে। “একটা দেশের জন্য অভিবাসন কতটা জরুরি?” এই প্রশ্নটা এক জার্মান বন্ধুকে করায় উত্তর পেয়েছিলাম হিরন্ময় নীরবতা — ইওরোপের উদার ইমেজের দায় সারতে বন্ধুটি মুখে খোলাখুলি বিরোধিতা করেনি, কিন্তু এই “খোলা দ্বার” অভিবাসন নীতি যে তার সমর্থন হারিয়েছে সেটা বেশ বুঝিয়ে দিয়েছিল। এক সাউথ কোরিয়ান বান্ধবী বলেছিল — “আমরা যে এত প্রতিযোগিতা করে এখানে আসি, সেটা কি এখানকার অন্যান্য লোকেরা কোনওদিন বুঝবে? এর থেকে শরণার্থী হলে বেটার ছিল — সরকার থেকে মাসকাবারি মাসোহারা, থাকার জায়গা, জব ট্রেনিং, মেডিক্যাল চেক-আপ, সমস্ত ব্যবস্থা করে দিত।” বেশ কিছুদিন আগে কাতারে কাতারে, একেকবারে প্রায় পঞ্চাশ–ষাট হাজার ছেলেমেয়েরা (এদের অধিকাংশই মাইনর) সাউথ বর্ডার দিয়ে আসছিল। মূলত সেন্ট্রাল এবং ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশগুলো থেকে, ওখানকার বাড়তে থাকা গ্যাং ভায়োলেন্স এড়াতে, একটা সুস্থ জীবন পাবে এই আশায় অনিশ্চিতের হাতে ছেড়ে দিত শিশুগুলোকে বাবা-মা। একবার টেক্সাস পেরিয়ে ব্রাউন্সভিলে ঢুকে পড়তে পারলে নিশ্চিন্ত — এটাই আশা ছিল। কিন্তু একটা উল্টোস্বরও শোনা যাচ্ছিল — অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের জন্য স্কুল-কলেজ-স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় মারাত্মক চাপ পড়ছে; স্থানীয় করদাতারা বঞ্চিত হচ্ছেন নাগরিক পরিষেবা থেকে — এরকম একটা ক্ষোভ জমছিল। সমাধান হিসেবে একটি কলোসাল বিল্ডিং প্রোজেক্টের প্রস্তাব দিয়েছেন ট্রাম্প। মেক্সিকো-অ্যামেরিকার সীমানা বরাবর প্রায় দুই হাজার মাইল ব্যাপী দেওয়াল তুলে দেওয়া, যাতে অবৈধ অনুপ্রবেশ আটকানো যায়। সেটা করতে কংগ্রেসের সাহায্য লাগবে, টাকার দরকার। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় এলে মেক্সিকো দেবে দেওয়াল তৈরির খরচ; শর্ত না মানা হলে নাফটা বাণিজ্য চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে মেক্সিকোর পণ্যের ওপর চড়া হারে আমদানি শুল্ক বসিয়ে সেই খরচ তিনি তুলে নেবেন। এবছরের মাঝামাঝি নাফটা নিয়ে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে এ প্রসঙ্গ উঠছেই। মেক্সিকো থেকে আমদানি হয় অধিকাংশ সবজি আর ফল; শুল্ক বসলে খাবারের দাম বাড়বে, গৃহস্থের মাসকাবারি বাজারে টান পড়বে। বাজারের প্রসঙ্গে মনে পড়ল এখানকার একটা গ্রসারি স্টোরে একজন চেনা কর্মচারী রয়েছেন — এলাইজা। এলাইজার কাজ হচ্ছে পার্কিংলটে ঘুরে ঘুরে শপিং ট্রলিগুলোকে কালেক্ট করে কোরালে জড় করা। এলাইজার মুখের একদিকে চোখের নিচ থেকে গালের মাঝামাঝি অবধি গভীর ক্ষত, দেশের স্মৃতি। সুদান থেকে পালিয়ে এসেছিল এলাইজা। একদিন নিয়ে গেছিল ওর পার্ক করা ১৯৯৭ শেভি সাবার্বানের সামনে — বলিউড মুভির ভক্ত, রাতে কাজের পর সিনেমা দেখে। ড্যাশের ওপরে শাহরুখ আর অমিতাভ বচ্চনের ছবির পাশে ওর বাবা, পেছন দিকে পুঁটলি করা জামাকাপড়। এভাবেই ভেসে আছে এলাইজা — ফেলে আসা দেশ আর নতুন দেশের স্বপ্ন নিয়ে।
“Give me your tired, your poor, your huddled masses yearning to breathe free, The wretched refuse of your teeming shore.”
Beautifully articulated the bitter sweet experiences in classy বৈঠকী ambience…
বেশ হয়েছে লেখা-খানি