কৌশিক দত্ত
সেইসব রোগীর কথাই চিকিৎসকেরা আলোচনা করেন, যাঁদের রোগ জটিল বা বিরল ছিল এবং তা সারানো সম্ভব হয়েছে। মূল উদ্দেশ্য, এর থেকে অন্যান্য চিকিৎসকেরাও যাতে ওরকম পরিস্থিতি এবং তার মোকাবিলা করার পদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে পারেন, পরবর্তীকালে সেই জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, এর সঙ্গে মিশে থাকে বাঁচাতে পারার আনন্দ আর কিঞ্চিৎ শ্লাঘা। অথচ দিনের শেষে চিকিৎসকের মনে ভারী হয়ে জমে থাকে সেই রোগীর কথা, যাঁকে বাঁচানো যায়নি বা সারানো যায়নি। এরকম রোগীর কথাও আমরা পড়াশুনার ফোরামে আলোচনা করি, সবাই মিলে মাথা চুলকাই, চুল ছিঁড়ি। কিছু ক্ষেত্রে একটু এগোই, কিছু ক্ষেত্রে সবাই মিলে আবার হেরে যাই রোগটির কাছে।
তবে এসব পরাজয়ের কথা সাধারণের কাছে বলতে নেই। ফেসবুকে তো একেবারেই পোস্ট করতে নেই। অথচ এই হেরে যাবার সব দিকগুলো তো চিকিৎসা বিষয়ক সেমিনারে আলোচনা করা হয়ে ওঠে না, কারণ সবটাই শারীরবৃত্তীয় নয়। সেইসব পরাজয় একেবারে নিজের বুকে লুকিয়ে রেখে নিজেকে খুব অভ্রান্ত, অপরাজেয় এক সেনাপতি হিসেবে তুলে ধরতে হয়, যে অনায়াসে যমকে হারাতে পারে রোজ দু’বেলা। রাতে খাবার টেবিলে ভাত বিস্বাদ লাগলেও জীবনসঙ্গী বা সন্তানকে, এমনকি মা-বাবাকেও বলার উপায় নেই, “আজ হেরে গেছি।” যেহেতু সোজা পথে হাঁটায় ক্লান্তি আছে, যেহেতু পরাজয় লুকোনোয় আর মজা পাই না, যেহেতু আমার অন্তত জীবনে আর হারানোর মতো খুব বেশি কিছু নেই, তাই সেইসব গল্প বলেই ফেলি।
আউটডোরে রোগী দেখছি। কয়েকজন পুরনো রোগী আজ পরপর এসে জানালেন, “ভালো আছি।” তার মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে এতটা উন্নতি নিজেও প্রত্যাশা করিনি। খুব আনন্দ। এমন সময় এক ভদ্রমহিলা এসে বললেন, “চিনতে পারছেন?” মুখটা চেনা লাগলেও তৎক্ষণাৎ পরিচয় মনে করতে পারিনি। তাঁর স্বামী আজ থেকে ছয় মাস আগে এক রাতের জন্য ভর্তি ছিলেন আমার কাছেই। বাঁচাতে পারিনি। ভোরবেলা তিনি মারা যান। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল অকস্মাৎ, যা আমার কাছেও ছিল অপ্রত্যাশিত। আমরা শুধু বিজ্ঞানের বলে দেওয়া নিয়ম মেনে কিছু বিষয় আন্দাজ করতে আর কিছু লড়াই লড়তে শিখেছি। এইসব হঠাৎ হেরে যাওয়া লড়াইগুলো আমাদের একেবারে হতভম্ব করে দেয়, তখন ডাক্তার একজন সাধারণ মানুষের চেয়েও অধিক বিস্মিত এবং বোকা। সেই মুহূর্তে নিজেকে সন্দেহ হবেই। আরও কি কিছু করা যেত? আরও কিছু বোঝা যেত কি? অমুকটার বদলে তমুকটা করলে কি ভালো হত? অথচ বিস্ময় আর গ্লানি লুকিয়ে পরের রোগীর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হয়, যিনি তখনও বেঁচে আছেন।
কথা হল, রোগীর মৃত্যুর সঙ্গেই গল্প শেষ হয় না। কিছু মানুষ পিছনে পড়ে থাকেন, যাঁরা যদি এসে প্রশ্ন করেন, “চিনতে পারছেন?” আর আপনি যদি চেনার পর প্রশ্ন করেন, “কেমন আছেন আপনারা?” তাহলে এমন সব গল্প বেরিয়ে আসে, যা সেমিনারে আলোচনা করা যায় না। এই ভদ্রলোক একটা ভালো চাকরি করতেন, আরও বছর পাঁচেক চাকরি ছিল। পেনশন ছিল না। পিএফ, গ্র্যাচুইটি ছিল, কিন্তু তা তো একটা সীমিত সংখ্যামাত্র। বড় কথা, তাঁর বৃদ্ধ বাবা আছেন। স্ত্রী বর্তমান। দুটি মেয়ে। বড় মেয়ে পিএইচডি করে। ছোট মেয়ে পড়ছে। অর্থাৎ একটি মানুষকে বাঁচাতে না পারা মানে একটা এত বড় পরাজয়, যা আমি বাকি পৃথিবীর কাছে লুকিয়ে রাখতেই পারতাম, কিন্তু রাতে অনেকক্ষণ অকারণে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতেই হত এই সদ্য জানতে পারা গল্পটা হজম করার জন্য।
ডাক্তার নায়ক হয় না। ডাক্তার নিজেকে নায়ক ভাবলে তার চেয়ে বোকা আর কেউ নেই। ডাক্তার হল গোলকিপার। সে সারাদিন, সারা মাস গোল আটাকাতে পারে, কিন্তু নিজে গোল করতে পারে না। মাসের শেষে একটা গোল খেয়ে গেলে ফলাফল তার বিপক্ষে “শূন্য-এক”। রোনালদো আর অলিভার কান ছয়বার মুখোমুখি হলেন, অলিভার জিতলেন চারবার, রোনালদো দুইবার। চূড়ান্ত ফল রোনালদোর পক্ষে “দুই-শূন্য”।
আমার চিকিৎসক বন্ধুরা সবাই কমবেশি এসব কথা জানেন নিজের মতো করে। এই মুহূর্তে যদি খুব বেশি সাফল্যের চাপে কেউ সেকথা সামান্য সময়ের জন্য ভুলে গিয়ে থাকেন, তবে তাঁকে মনে করিয়ে দিই…. মৃত্যুর বিরুদ্ধে এই অসম লড়াইয়ে অহংকারের কোনও স্থান নেই, আত্মতুষ্টিরও না।
কৌশিক স্যার, আপনার লেখা পড়তে পড়তে না মনের মধ্যে সাধ জেগে উঠে এই বলে যে, বেটা তুই ডাক্তারী এনট্রান্সের জন্যই প্রস্তুতি নে। আপনার লেখাগুলো পড়লে মনে হয় জীবনটা বিফলেই চলে গেলো। কিছুই করতে পারলাম না। লিখে যান, থামাবেন না।