বিজয় মাল্য, ললিত মোদি, যতীন মেহতা, নীরব মোদিদের অচ্ছে দিন

অমিত দাশগুপ্ত

 

কর্মসংস্থানহীন পরিষেবা ক্ষেত্র নির্ভর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কল্পকথা

আর্থিক সমাধান ও আমানত বিমা আইন (এফআরডিআই এ্যাক্ট) প্রণয়নের মাধ্যমে কেন্দ্রের ভারতীয় জনতা পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকার যখন ব্যাঙ্ক ও আর্থিক সংস্থা সমূহের রুগ্নতার দায় নিজের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে বেইল-ইন ধারা অন্তর্ভুক্ত করে সাধারণ আমানতকারীদের মাথার উপরে চাপাতে চাইছে, ঠিক তখনই ভারতীয় ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার আলমারি থেকে আরেকটি কঙ্কাল বেরিয়ে এল, নীরব মোদি-মেহুল চোকসির ব্যাঙ্ক জালিয়াতিতে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের (পিএনবি) ১১,৪০০ কোটি টাকার ঘোটালার মধ্য দিয়ে। ফোর্বসের অন্যতম ধনীদের তালিকায় থাকা হীরের ডিজাইনার নীরব মোদি নীরবেই পিএনবির তহবিল থেকে টাকা নিজের খাতায় নিয়ে যাওয়ার ফন্দি এঁটেছে। মনে রাখা দরকার এখনও সে অর্থে তেমন কোনও টাকাই পিএনবির তহবিল থেকে বেরিয়ে যায়নি। সম্ভবত ২৮০ কোটি টাকা দিতে নীরব মোদি অপারগ হয়েছে, যার জন্য পিএনবি সিবিআই-এর কাছে প্রাথমিক এফ আই আর করেছিল। বিজয় মাল্যের কিং ফিশার ঘটনা ও যতীন মেহতার সুরাজ ডায়মন্ডের ৭০০০ কোটি টাকা মারার পরে নীরব মোদির এই ব্যাঙ্কের টাকা মারা কেবল ভারতীয় ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার হিসাব নিয়ন্ত্রণের করুণ ও দুর্বিসহ অবস্থাকেই প্রকট করছে না, উপরন্তু ভারতীয় অর্থনীতির ফোঁপড়া বুদবুদকেও সামনে নিয়ে এসেছে। যদি কেবল কর্মসংস্থানহীন পরিষেবা ক্ষেত্র নির্ভর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কল্পকথাকে অচিরে বিনষ্ট না করা যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতেই অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। এব্যাপারে আলোচনার আগে নীরব মোদির (নীমো) ব্যাঙ্ক ঠকানোর পদ্ধতিটার দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক।

ডিজাইনার’স এলওইউ

নীমো পিএনবি থেকে বিদেশ থেকে হীরে-মুক্তো আমদানির জন্য নিশ্চয়তা পত্র বা লেটার অফ আন্ডারটেকিং (এলওইউ) নিয়েছিল। এলওইউকে বিদেশি ব্যাঙ্কে বা ব্রাঞ্চে দেখিয়ে সেখান থেকে সেই দেশের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাল কেনার জন্য ঋণ পাওয়া যায়। সেই টাকা সেই দেশের ব্যবসায়ীকে ক্রয়মূল্য বাবদ দিয়ে দেওয়া হয়। পরে সেই আমদানি কৃত দ্রব্য দেশে এনে তা পণ্য প্রস্তুতের কাজে লাগিয়ে বা বিক্রি করে মুনাফা করার চেষ্টা করা হয়, ও এলওইউ প্রদানকারী ব্যাঙ্ককে মিটিয়ে দেওযা হয়, অন্যদিকে ব্যাঙ্ক বিদেশের ব্যাঙ্ক বা ব্রাঞ্চকে তাদের টাকা মিটিয়ে দেয়। এলওইউ প্রদানকারী ব্যাঙ্ক ওই এলওইউ চালু থাকার সময়ের জন্য ২-৩% সুদ নিয়ে থাকে, ও ঋণ প্রদানকারী বিদেশের ব্যাঙ্ক বা ব্রাঞ্চ যতদিনের জন্য ঋণ দেয় সেই সময়কালের জন্য ঋণের উপর চুক্তিভিত্তিক হারে সুদ নেয়। বিদেশের ব্যাঙ্ক বা ব্রাঞ্চ যে ঋণ দেয় সেটি তহবিল-ভিত্তিক ঋণ, যার জন্য ব্যাঙ্ককে টাকা দিতে হয় ঋণগ্রহণকারীকে। এলওইউ একটি তহবিল-ব্যতিরেক ঋণ যেখানে এলওইউ প্রদানকারী ব্যাঙ্ককে কোনও টাকা দিতে হয় না, কেবল ঝুঁকি নিতে হয়, কারণ যদি এলওইউ গ্রহীতা ঋণ শোধ না করে তাহলে ঋণ প্রদানকারী ব্যাঙ্ককে সেই টাকা মিটিয়ে দিতে এলওইউ প্রদানকারী ব্যাঙ্ক বাধ্য থাকে। যেহেতু এলওইউতে সেই ঝুঁকি থাকে তাই এলওইউ প্রদানকারী ব্যাঙ্ক এলওইউর জন্য সম্পত্তি বন্ধক রাখে। তবে সাধারণত ব্যবসায়ী বা শিল্পপতির সুনাম অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই এলওইউর পরিমাণের তুলনায় বন্ধকীকৃত সম্পত্তির (কোল্যাটারাল) মূল্য কম হয়, ওই পরিমাণ টাকাকে মার্জিন বলা হয়। আলোচ্য ব্যাঙ্ক তহবিল তছরুপের ক্ষেত্রে নীমো পিএনবির কাছ থেকে এলওইউ নেওযার সময়ে কোনো কোল্যাটারালই রাখেনি। ফলে পুরো এলওইউটাই ১০০% ঝুঁকি সম্পন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মেহুল চোকসির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নমোকেও গ্রেফতার করতে হবে

২০১১ সাল থেকে নীমো এই এলওইউ নিতে শুরু করেছে, কোনওরকম কোল্যাটারাল ছাড়াই। পুরো বিষয়টা অনেকটাই পঞ্জি তহবিলের ব্যবসার মত দাঁড়িয়েছে। যেখানে প্রথমে জমা টাকার দায় মেটাতে পরের জমা টাকা ব্যবহার করা হয়, আবার সেই দায় মেটাতে পরবর্তী জমার ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে নীমো তাই করেছে প্রথমে নেওযা এলওইউর দায় পরবর্তীতে নেওয়া এলওইউর মাধ্যমে করা ব্যবসার মাধ্যমে মিটিয়েছে, এভাবে ক্রমাগত এলওইউ নিয়ে গিয়েছে। এবং সাম্প্রতিক এলওইউগুলির দায় মেটাতে পারেনি। পরে নুতন করে এলওইউ নিতে গিয়ে বিষয়টা নজরে এসেছে। হিসেব করে দেখা যাচ্ছে প্রায় ১১,৪০০ কোটি টাকার এলওইউ বকেয়া রয়েছে পিএনবির কাছে। অঙ্কটা বাড়তে কমতে পারে পরের হিসেবে। অর্থাৎ পিএনবির অন্যান্য ব্যাঙ্কের কাছে কমবেশি ১১,৪০০ কোটি টাকার দায় তৈরি হয়েছে। এই সমস্ত বকেয়া এলওইউ অবশ্যই সাম্প্রতিক, অর্থাৎ, ১৬-১৮ সালের, কারণ পুরোনোগুলিকে ক্রমাগত মেটানো হয়েছে নুতন এলওইউ দিয়ে। ফলে পূর্বতন কংগ্রেস সরকার দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে না। এদিকে সেই ফর্বস তালিকার ধনী ব্যাক্তি যথাবিহিত বিদেশে চলে গিয়েছেন। এমনকি দাভোসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একসাথে ছবি তুলেছেন, নরেন্দ্র মোদিজি (নমো) যখন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাত করছেন তখন নীমো নমোর সাথে রয়েছেন, দাভোসে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গী যে ১০০ জন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের তালিকা পিটিআই ১৪ জানুয়ারি, ২০১৬ তে দিয়েছে তাতে নীমোর নাম রয়েছে। নীমোর মামা মেহুল চোকসির সম্পর্কে নমোর গুণগাণের ভিডিও দেখা যাচ্ছে। নমোর সঙ্গে নীমো ও তার মামার যে সম্পর্ক সামনে এসেছে তাতে সারদার মদন মিত্র বা ডেলো পাহাড়ে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে রোজভ্যালির গৌতম কুণ্ডু বা সারদার সুদীপ্ত সেনের মিটিংএর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। যে ভিত্তিতে মদন, সুদীপ, তাপসদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, সেই কারণে নমোকেও গ্রেফতার করা উচিৎ বলে মনে হচ্ছে।

ব্যাঙ্কের টাকা মেরে ধনীরা চম্পট দেন, কৃষক ঋণের জ্বালায় আত্মহত্যা করে

কেবল নীমোই নয়, গত কয়েক বছরে একঝাঁক প্রভূত ধনী শিল্পপতি ব্যবসায়ীর রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীদের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে ব্যাঙ্কের টাকা তছরুপের পরে বা অন্যান্য আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার পর বিদেশে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। যেমন, বিজয় মাল্য, ললিত মোদি, যতীন মেহতা, মেহুল চোকসি, নীরব মোদি প্রমূখ। রহস্যজনকভাবে এদের গ্রেফতারের সম্ভাবনা দেখা দিলেই এরা খবর পেয়ে যান ও দেশ ছাড়েন। শাসক রাজনৈতিক দল বিজেপির সঙ্গে এদের নৈকট্যও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যথেষ্ট বেশি। বিজয় মাল্য ছিলেন বিজেপি সমর্থিত রাজ্যসভার সাংসদ, ললিত মোদি রাজস্থানের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার কোটারির লোক, আগেই লেখা হয়েছে মেহুল-নীতীশের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির জান-পেহচানের কথা। সুরাজ ডায়ামন্ড ওরফে উইনসাম ডায়ামন্ডের মালিক যতীন মেহতা ৭০০০ কোটি টাকা মেরে দিয়ে ভারত ছেড়ে সেন্ট কিটস দ্বীপের নাগরিক হয়েছেন। তিনিও গুজরাটের লোক। খুঁজলে গুজরাট মডেলের মাঝে তাকেও পাওয়া যাবে। অতি সম্প্রতি রোটোম্যাকের বিক্রম কোঠারি ও তার ছেলে রাহুলকে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা মারার জন্য ধরা হয়েছে, তারা এখনও দেশ ছাড়েননি। তবে বিক্রম কোঠারিরও বিজেপির সঙ্গে দোস্তি রযেছে। ভারতীয় রফতানি সংগঠনগুলির ফেডারেশন (এফআইইও) ও কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের যৌথ ভাবে প্রদত্ত সেরা রফতানিকারকের পুরস্কার পান তিনি তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর কাছ থেকে। ওদিকে ব্যাঙ্কের কাছে ঋণ করে সেই টাকায় ডলার কেনা বেচার সাট্টাও খেলতেন তিনি। তবে এসব করলে তো এদেশে সুনাম হয, তাই তিনি লায়ন’স ক্লাবের গুডউইল এ্যামবাসাডারও ছিলেন। বিজয় মালিয়ার মত না হলেও পার্টি দিয়ে টাকা ওড়ানো তার অভ্যেস। হিন্দুস্তান টাইমস-এর তথ্য অনুযায়ী গত রবিবার অর্থাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারীতেও তিনি একটি ‘অভিজাত’ বিবাহ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যান, যেখানে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। এভাবেই রাজনীতি-শিল্পপতি- ব্যবসায়ী আঁতাতে অর্থনীতির চক্র ঘুরছে। ফলে দেশের ধনীরা সাধারণ মানুষের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত অর্থে থাবা বসাবে, আর ব্যাঙ্কের লোকসান ভরাতে সরকার মূলধন সরবরাহ করবে বা আরও এক ধাপ এগিয়ে আমানতকারীর টাকায় ব্যাঙ্কগুলিকে বেইল-ইন করার ঘুঁটি সাজাবে। ওদিকে ঋণ করে কৃষিতে উৎপাদন করে ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে কৃষক ঋণ শোধ করতে না পারলে ব্যাঙ্ক কর্তারা তাদের বাড়ি পেয়াদা পাঠিয়ে উত্যক্ত করে তুলে তার সামাজিক মানমর্যাদা ধূলায় মিশিয়ে দেওয়ার ফলে কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবে। এভাবেই তৈরি হচ্ছে মহান ভারত।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রটির সমূহ বিপদ

ব্যাঙ্কের তহবিল তছরুপের যে কাহিনি তা কিন্তু এই তছরুপকারীদের পালিয়ে যাওয়াতেই বা তাদের ধরে আনার চেষ্টার লুকোচুরিতেই শেষ হচ্ছে না। এর একটা ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক দিক রয়েছে। মনে রাখা দরকার এই মুহুর্তে ভারতের ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্র, বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রটি সামগ্রিক বিপদের সম্মুখীন। দেশের মানুষের সচেতন আন্দোলনের উপরই নির্ভর করছে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কিং থাকবে কিনা। এর মধ্যেই সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের দাবিতে মুখ খুলেছেন, এ্যাসোচ্যামও সেই দাবির সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। মোদি-জেটলিরা অনুরূপভাবেই ভাবছেন না, বা মনোমোহন-চিদাম্বরমরা অন্যরকম ভাবছেন এমনটা ধারণা করার কোনও কারণ নেই। এই মুহুর্তে ভারতের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির প্রায় ৭ ভাগের ১ ভাগ ঋণ এনপিএ (নন পারফর্মিং এ্যাসেট বা খেলাপি ঋণ)-তে পর্যবসিত হযেছে। এ ছাড়া ২০১২-১৩ সাল থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৩ লক্ষ কোটি টাকার উপরে অনাদায়ী ব্যাঙ্ক ঋন ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে ফেলতে হয়েছে। এনপিএ, পুনর্গঠিত ঋণ ও মুছে দেওযা ঋণ ধরলে সামগ্রিকে প্রায় ১৫ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় সঙ্কটে পড়েছে। এর সিংহ ভাগই রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক কর্তৃক প্রদত্ত।

গত সাড়ে পাঁচ বছরের ব্যাঙ্ক ঋণ খাতা থেকে মুছে ফেলার পরিমাণ
বছর পরিমাণ (কোটি টাকায়)
২০১২-১৩ : ২৭২৩১
২০১৩-১৪ : ৩৪৪০৯
২০১৪-১৫ : ৪৯০১৮
২০১৫-১৬ : ৫৭৫৮৫
২০১৬-১৭ : ৭৭১২৩
২০১৭-১৮ (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) : ৫৫৩৫৬
মোট – ৩০০৭২২

চকচক করলেই সোনা হয় না

এই যে ঋণ খেলাপ, ঋণ মুছে দেওয়া এগুলি কিন্তু অর্থনীতির গভীর অসুখের প্রতি ইঙ্গিত করছে। একদিকে বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপ, অপরদিকে ঋণের চাহিদা না থাকার কারণে শ্লথ ঋণ বৃদ্ধির হার, ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রকে চূড়ান্ত সঙ্কটের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী গত জুন-সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ত্রৈমাসিকে সমস্ত বানিজ্যিক ব্যাঙ্কের বার্ষিক ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫%। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে ওই হার মাত্র ২.১%, বেসরকারি ক্ষেত্রে ১৯%। অনুরূপ সময়ে আমানত বৃদ্ধির হার রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক ক্ষেত্রে ৬.৯%, বেসরকারি ব্যাঙ্কে ১৪.৬% ও সামগ্রিকে ৮.২%। সামগ্রিকে ব্যাঙ্কের ঋণ-আমানত অনুপাত ৭৩.৩% যা ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ছিল ৭৯%। সুতরাং ব্যাঙ্কগুলির ঋণ চাহিদা আমানতের তুলনায় কম। এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের পরিচালকদের উপরে ব্যাঙ্ক ভালো চলছে এটা দেখানোর চাপ আছে মন্ত্রী শান্ত্রীদের তরফ থেকে। তাই অনাদায়ী ঋণ কম দেখানোর প্রবণতা আছে। সাম্প্রতিক কালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্কের ২০১৬-১৭ সালের হিসেব খতিয়ে দেখে জানিয়েছে যে, দ্বিশতাধিক বছরের পুরোনো ভারতীয় অর্থনীতির অন্যতম স্ট্যাটাস সিম্বল ব্যাঙ্কটি ওই বিত্ত বর্ষে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ২১% কম দেখিয়েছে ও মুনাফার পরিমাণ ৩৬% বাড়িয়ে দেখিয়েছে।

এটা অর্থনীতি বন্ধু

ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত হিসেবের দিকে যদি দৃষ্টি দেওয়া যায় তাহলে ব্যবস্থাটিকে ক্রমাগত কতটা দুর্বল করে তোলা হয়েছে সেটা বোঝা যাবে। আগেই বলেছি, ব্যাঙ্কের ঋণ-আমানত অনুপাত ৭৩.৩%। অর্থাৎ ১০০ টাকার আমানতের ৭৩ টাকা ঋণ দেওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে ঋণের অনাদায়ী ও পুনর্গঠিত অংশ যোগ করলে ঋণের সঙ্গে তার অনুপাত দাঁড়ায় ১৩-১৪%। ফলে ৭৩ টাকা ঋণ দিলে ১০ টাকার মত অনাদায়ী ঋণ রয়েছে। যদি ব্যাঙ্কগুলি ঝুঁকি না নিত বা কারচুপি না হত, তাহলে ওই ১০ টাকার ঋণ দেওয়া হত না। ফলে ১০০ টাকার আমানতের বিপরীতে নীট ঋণের পরিমাণ হত ৬৩ টাকা (৭৩ টাকা-১০ টাকা)। ঋণ-আমানত অনুপাত কমে হত ৬৩%। যদি, ব্যাঙ্কগুলির সাম্প্রতিক আমানতের উপর সুদের হারকে ৬.৫%-৭% ধরা হয়, তাহলে ১০০ টাকার আমানতে বার্ষিক সুদ দিতে হবে ৬.৫ টাকা। আর ৬৩ টাকা ঋণের মাধ্যমে কেবল ওই সুদের সম পরিমাণ সুদ আয় করতে ধার্য সুদের হার হতে হবে ১০%। এর সঙ্গে ব্যাঙ্কের আনুষঙ্গিক খরচা, কম হারে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলিতে ঋণ প্রভৃতি হিসেব ধরলে বাণিজ্যিক ঋণের উপর সুদের হার অনেকটাই বেড়ে যাবে। ফলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী বিনিয়োগ কম হবে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্যাঙ্কগুলি আমানতের উপর সুদের হার কমাবে। ফলে ব্যাঙ্কে আমানত কমবে। একদিকে সঞ্চয়ের প্রবণতা কমবে, অন্যদিকে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ বাড়বে। সঞ্চয়ের প্রবণতা কমায় পণ্য চাহিদা বাড়বে, এবং আমানত ও তৎসংশ্লিষ্ট ঋণের উপর সুদ কমায় ঋন চাহিদাও বাড়বে যা অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়াবে। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ বাড়লে ফাটকা বৃদ্ধি পাবে। বাজারে অচিরেই বুদবুদ তৈরি হবে ও পিএনবি পরিঘটনার পরে যেমন বাজারের পতনে মধ্যবিত্ত বিনিয়োগকারী লোকসান করেছে অনুরূপ লোকসানের সূত্রপাত হবে। যদি ব্যাঙ্কগুলি আমানতের উপর দেয় সুদের হার না কমায় তাহলে ঋণের উপর সুদের হার বেশি থাকবে। বিনিয়োগ ধাক্কা খাবে। ফলে কর্মসংস্থান কমবে। এমনিতেই তথ্য প্রযুক্তি ও টেলিকম ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান কমছে ও কর্মী সঙ্কোচন ঘটানো হচ্ছে। তার ধাক্কাও ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। গৃহঋণ, গাড়ি ঋণের মত খুচরো ঋণের বৃদ্ধি যথেষ্ট বেশি, বার্ষিক ১৫%র মত। সামগ্রিক ব্যাঙ্ক ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ খুচরো ঋণ। এই ঋণগুলিতে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণও অত্যল্প। ব্যাঙ্কগুলি তাই খুচরো ঋণের বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছে। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তি ও টেলিকম ক্ষেত্রে কর্মী ছাটাই খুচরো ঋণগুলিকেও যথেষ্ট ঝুঁকিবহুল করে তুলছে। তাছাড়া কর্মসংস্থান কমলে খুচরো ঋণের চাহিদাও কমবে। সব মিলিয়ে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রটি একটি তুমুল অস্থিরতার সম্মুখীন হচ্ছে। যার ধাক্কা সামগ্রিক অর্থনীতিতে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে।

শাসকের সীমাহীন দুর্নীতি

সব মিলিয়ে ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার করুণ অবস্থা এমন একটা দিকের প্রতি ইঙ্গিত করছে যা সামগ্রিক অর্থনীতির পক্ষে ভয়াবহ হতে পারে। ৬-৭% বার্ষিক বৃদ্ধির সংখ্যাটির সঙ্গে ব্যাঙ্কের ক্রমাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অনাদায়ী ঋণ, ঋণ খেলাপিদের ক্রমাগত বিদেশ পলায়ন বা কর্মসংস্থানের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা ঠিক মিল খাচ্ছে না। নোট বাতিল, জিএসটি ভারতীয় অর্থনীতির বেশ কিছু অংশকে যারপরনাই বিধ্বস্ত করেছে যার অভিঘাতগুলি সামনে আসতে শুরু করেছে। দেশের স্বঘোষিত চৌকিদার প্রধানমন্ত্রী মহোদয় এক পলাতক মেহুল চোক্সিকে শংসাপত্র ইস্যু করেছেন, অপর পলাতকের সঙ্গে ছবি তুলছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকেছে। তাঁর পার্টি কর্পোরেটদের কাছ থেকে বিপুল অনুদান নিচ্ছে, ১.৭০ লাখ বর্গফুটের পার্টি ভবন তৈরি করছে, অন্যদিকে অন্তত দু’কোটি মানুষের মাথার উপর ছাদ নেই। একদিকে কর্পোরেট সহযোগীরা ব্যাঙ্কের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দেশ ছেড়ে বিদেশে আয়েস করছে অন্যদিকে ঋণের ভারে প্রতি বছর গড়ে ১২ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করছে। তাই পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের থেকে মোদি-চোক্সির কয়েক হাজার কোটি টাকা তছরুপকে কেবল ব্যাঙ্কের ডেপুটি ম্যানেজারের সঙ্গে যোগসাজসে করা কারচুপি হিসেবে দেখা সঙ্গত হবে না। সারা দেশের অর্থনীতি রাজনীতির প্রেক্ষিতে শাসকের সীমাহীন দুর্নীতি হিসেবেই গণ্য করতে হবে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...