বল্লরী সেন
বৃহদারণ্যকের তৃতীয় অধ্যায় ষষ্ঠ ব্রাহ্মণে বিজ্ঞানসভার একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি গার্গী শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মজ্ঞানীর বিচারের প্রসঙ্গে যাজ্ঞবল্ক্যকে জানতে চেয়েছিলেন — ‘সবকিছু যখন জলে ওতপ্রোত, তখন জল কীসের আশ্রয়ে আছে?’ জল আছেন বায়ুতে, বললেন যাজ্ঞবল্ক্য। এইভাবে বায়ু কার মধ্যে, বায়ু অন্তরীক্ষে। অন্তরীক্ষ কোথায়? তা গন্ধর্বলোকে। গন্ধর্বলোক কোথায়? তা প্রজাপতিলোকে। শেষ পর্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে গার্গীকে বললেন, ‘মা অতিপ্রাক্ষিঃ’ — আর নয়, আর প্রশ্ন কোরো না। তপোবনাশ্রিত ভারতবর্ষ এই প্রক্রিয়ায় প্রশ্নের পরম্পরায় উত্তর খোঁজার প্রয়াস করেছিল, যেখানে প্রশ্ন ও প্রতিপ্রশ্নের মধ্যে আনুপূর্বিক যোগ আছে। কার্যকারণ তত্ত্বের ধারাভাষ্যের এ হেন বয়ান গদ্যরচনার আদিযুগে বাঙালিকে বিশেষ চর্চায় নানা ধর্মীয় ও সামাজিক বিতর্ককে সাহিত্যের মন্দিরে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। গুরু শিষ্যের, দুই প্রতিযোগী ব্রহ্মিষ্ঠের, সভাস্থ দুই পণ্ডিতের, ব্রাহ্মণ ও রোমান ক্যাথলিকের এ হেন তর্কের এই বিশেষ ঘরানা তৈরি ছিল। কিন্তু গল্পে বানানো সংলাপ বা উইলিয়াম কেরির ‘কথোপকথন’, রামমোহন রায়ের গোঁড়া হিন্দুর প্রতি বিদ্বেষ এবং ভিন্ন দর্শনের প্রচার — কোনওটাই সাক্ষাৎকার জাতীয় নয়। ধাপে ধাপে সিড়ি ভেঙে তৈরি হয়েছিল মহাবিশ্বের আসঙ্গ প্রতীতি। অর্ক দেবের সংকলনে ও সম্পাদনায় ‘কথাবার্তা’ বইটির প্রতিটি পাতাই এই আবর্ত-সঙ্কুল কথোপকথনরীতির অন্য এক উন্মীলন; কালের সামনে দাঁড়িয়ে লেখক যখন সৃজনের ভেতরে লুকনো রুসওয়াই সামান্য গিঁট খুলে দেন — ক্যামেরার নতুন চোখ দিয়ে অন্য এক ভুবনের চাবি খোলার পাকে তাঁর নগ্ন চোখের তারায় উঠে আসে আসমুদ্র ভূমার মধ্যে দ্বন্দ্বময় সময়কে পাওয়া, যে সময়, সরলরেখার হয়েও বৃত্ত রচনা করে চলেছে, প্রায় সিনেমার মতো। ‘অ্যাবসল্যুট টাইম’-কে ধ্বংস করে চলেছে এই সংলাপ-বিন্যাসটি, যাকে দূর থেকে নির্মীয়মাণ নাটকের মতো মনে হলেও, বহুস্তরের সমান্তরাল আদানপ্রদানের প্রগলভতাকে তা কোনওভাবেই থামিয়ে রাখতে পারেনি। বইটি ১০০ বছরের ইতিহাস-পুরাণ ও বিবিধ অনুসন্ধানের মধ্যে তাই বত্রিশটি সাক্ষাৎকারের এক দুরন্ত টেক্সট, যা জুলিয়া ক্রিস্তেভা কথিত ‘dialogism’-এর একটি বিরুদ্ধ প্রতিভাস গড়ে তুলেছে। ‘Contradiction’ এবং ‘Harmony’র যে দ্বন্দ্ব ক্রিস্তেভার ‘Intertextuality’-র প্রাথমিক এক গাফিলতি, যাকে আমরা প্রশ্ন করেছি ডস্টয়েভস্কির উপন্যাসের মধ্যে, ‘কথাবার্তা’ তাকেই সহজ প্রসন্নচিত্তে বুকপকেটে সঙ্গে করে রেখে চলেছে দ্বন্দ্ব ও ক্রম-অবতরণে। তাই বিভিন্ন চলমান মুহূর্তের সূত্রকে নতুন করে দেখানোর এ এক বহুমাত্রিক অভিযোজনা।
লুই বুনুয়েলের আত্মজীবনীর এক জায়গায় বলা হয়েছে — “Some people dream of an infinite universe; others see it as finite in space and time. I suppose, I’m somewhere in between.” [My last breath, translated by Abigail Israel, pg173] এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সাক্ষাৎকারদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে যখন বিলুপ্ত সময় ও মহাবিশ্বের পরিসর নানাভাবে একটি বিশেষ বয়ানে ধরা পড়ে, প্রতিটা ব্যবহৃত শব্দ বা শব্দবন্ধই তখন কথক ও শ্রোতার মধ্যে দ্বিখণ্ডিত একটি আবিষ্কার ঘটায়। একটির সাপেক্ষে অন্যটির জন্ম এবং এইভাবে উত্তর প্রত্যুত্তরের কার্যকারণে নির্মিত হয় আর এক কণ্ঠস্বর।
স্বগতোক্তি বা ‘monologue’ এই দিক থেকে কথক হিসেবে ব্যক্তির স্বাধীন আত্ম-প্রতিবিম্বের পাঠ। কিন্তু তা অনেকাংশে ভ্রমাত্মক বা একপাক্ষিক হয় বলেই আরেকজনের নীরব উপস্থিতি সেখানেও ধরে নিই আমরা। ডায়ালগ বা কথোপকথনের ক্ষেত্রে এই আত্মপ্রক্ষেপের তীব্রতা কিছুটা বাধা পায় অন্য ব্যক্তির সরব চেতনার সক্রিয়তায়। ‘কথাবার্তা’ এই দিক থেকে একটু বিশেষ অনন্যতার দাবি রাখে। প্রথম সাক্ষাৎকারটির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলেছেন অতুলপ্রসাদ সেন ও দিলীপকুমার রায়। প্রধানত দিলীপকুমার রায়ের অনুলিখনে সমগ্র সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত তা নয়। বর্তমানে আমরা যেরকম বিন্যাস সাক্ষাৎকারে দেখি, এ তার চেয়ে কিছুটা স্বতন্ত্র। ৩১ ডিসেম্বর ১৯২৬ সকালবেলা থেকে আলাপচারিতার সূচনা, চলেছে ২ জানুয়ারি ১৯২৭ অবধি। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে অতুলপ্রসাদের অনুলিখনে ২১ মার্চ ১৯৩৮ জোড়াসাঁকোয় আলোচনাসভা বসেছে। প্রধানত দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গেই কবির এ পর্বের কথোপকথন গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ যেটা বলতে চাইছি, দ্বিজেন্দ্রলাল ও পুত্র দিলীপকুমারের সঙ্গে মতানৈক্যের যে ইতিহাস আমরা সকলেই একটু আধটু জানি, এখানে তারই তালিমে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে নিজের কথাকে নানা সূত্রে অন্য এক দৃষ্টিকোণে স্বচ্ছতা দিলেন, মত পরিবর্তনকে স্বাভাবিক বলে একরকম সাফ জবাবদিহি করলেন — এখানে সেই বক্তব্য সবচেয়ে স্পষ্ট ও সংশয়বর্জিত। বাংলা গানের দুই অনুজ দিকপালের সামনে এ এক অন্য রবীন্দ্রনাথকে পড়ার সুযোগ।
প্রকাশনা : নিষাদ
বিন্যাসের এক আজব তশবিব অবলম্বন করলেন সম্পাদক। প্রথমে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে, তারপর দ্বিতীয় এলেন জগদীশচন্দ্র বসু এবং তৃতীয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনটের বয়ানভঙ্গিমায় রইল আটপৌরে ঘরোয়া চাল; ‘উত্তর দিলাম’ ‘তিনি বললেন’ এই মুখে-বলা-গল্পের ন্যারেটিভ পৃথক মেজাজের, কিন্তু এর মধ্যে কুঁড়ির অন্তঃস্থ ঘ্রাণের মতো রইল এক সংশয় — আসলে বানিয়ে বানিয়ে বলা হল না তো? সংকলক এই মুদ্রাটি নিয়ে এভাবেই পাঠককে আলগাভাবে তছরুপ করতে করতে এলেন চতুর্থ সাক্ষাৎকারে। শরৎচন্দ্রের সঙ্গে আলাপে ছিলেন কমলকুমার, এবার তিনিই নায়ক। মসনদে বসেই যে ভাষা উঠে এল, তা কেবলমাত্র কমলকুমার বলেই সন্দেহাতীতভাবে চমকে দেয়।
এই তিনের প্রতি আরও একটি জটিল অবজারভেশন পাই। রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্রের মধ্যে রয়ে গেলেন জগদীশচন্দ্র। যা বললেন তার ওয়ানলাইনার সূচিতে প্রয়োগ করেছেন সম্পাদক — “রবি ঠাকুরকে নিয়ে টানাটানি কোরো না, ইচ ম্যান ইজ আ জিনিয়াস।” কী আশ্চর্য অবস্থানকেন্দ্র! ওদিকে থাকলেন ‘বড়দিদি’র লেখক, সবচেয়ে কম কথায় নিজের সংকটকে মানচিত্রে মেলে ধরতে পারেন ক’জন!
আর তাই অতি পরিমিত ব্লার্বের অনুদার কার্পণ্যকে সরিয়ে সংকলনটির মধ্যে আমরা পাঠকেরা যখন প্রবেশ করি, তখন বোঝা যায় না ফেরেববাজ কে — উটকো দর্শক না অন্ধ শ্রোতা! পাঠক আসলে শোনে না দেখে, নাকি দুটোই? ‘মুসাবিদা’ অংশে সম্পাদক লিখেছেন — “এও এক আনোখা লিটেরারি টেক্সট যা পড়া শেষ করে মানুষ দু’ দণ্ড ভাববে, হাহুতাশ করবে, কথায় কথায় হানাবাড়ির ভূতের মতো কথারা পিছু নেবে, পল অণুপল ঘুণে ধরা বিপন্ন মানুষের পাশে বসে থাকবে উবু হয়ে।” কিন্তু তিনি তো কোথাও বললেন না কী উপায়ে একশো বছরের এই raw file-টির সাজানোর তুরুপে স্রষ্টা তার কালিপড়া কড়াইয়ের পিঠ একটিবার দেখিয়ে ফেলেছেন! যেন আখোলা অন্দরের ঝুলভর্তি এক লহমা নিদাঘ। বসন্তের শস্যের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে উজ্জ্বল, প্রায় বিবেকের মতো। সেই কালোকোলো থ্যালিডোমাইড ভ্রূণের কথা না বললে সৃজনের যথার্থ আঁতুড়ে কি সত্যি পা রাখা যায়? অন্ধ শ্রোতা বোবা হয়ে দেখে এখানে ক্যামেরার চোখে সেই ছিলে-কাটা উপড়ে-নেওয়া মণি, ভয়ানক বীভৎসতার সামনে এনে ফেললেও সে কথা বলিয়ে নেয়। তাই সাক্ষাৎকার নেওয়ার উৎকর্ষ পৃথক এক মুনশিয়ানার পরিচয়। বলিয়ে নেওয়া, সেই কথা যা কোথাও বলেননি, সে ভাষায় যা পড়লে প্রতিটা শব্দ সংকেত করতে পারে। তাই, এ যেন এক উলটো পুরাণ। অন্তঃকরণের প্রতিক্রিয়া দিয়ে যিনি তাঁর কালকে শাসনের চাবুক দেখান, সেই পরিচালক-ছবিকর-লেখক-কথাসাহিত্যিক-আঁকিয়ে-গাইয়ে-ঔপন্যাসিক-ক্যামেরাম্যান, তাঁদেরকেই অন্য এক দগ্ধ মানচিত্র বের করে দেখাতে হয়। শিবিরের আগুন-লাগা অবস্থাটাই যে সারসত্য, ইনার-রিয়েলিটির সেই নিরক্ষর জিভের অপরিহার্য জবান, মঞ্চের এক কোণে লুকিয়ে দেখার এ এক সৌভাগ্য। সেঁধিয়ে থাকে নিরবধিকালও। বহুমাত্রিক কালপ্রবাহের ভার্টিকাল ও হরাইজনটাল অ্যাক্সিসের ভেতর থেকে সাক্ষাৎকার নেওয়ার ক্ষমতা অনুসারে, প্রশ্নের আবর্তবান স্পন্দনের মুখে একেকজন স্রষ্টার দৃষ্টান্তমূলক বিকল্পসত্তাকে কলার পাতায় মুড়ে পরিবেশন করা হল। মোড়কটি ইচ্ছে হলেই আপনার কাছে সমস্ত বলে দেবে। আমি যে লুকিয়ে তোমাকে পড়ে নিচ্ছি, তার কোনও প্রমাণ থাকছে না, অথচ আমার দীর্ঘশ্বাস, ছটফটানি আলো দিয়েই তো নির্মিত হল ব্যাকস্টেজের এই রেডবুকটি। সংকলক ও সম্পাদক এখানে বিনা অনুমতিতে ডাক্তারের গ্রিনরুমে সম্মোহনের প্রক্রিয়া, উৎস, আত্মবিকলন, স্বীকারোক্তি সমস্ত জানতে পেরে তবে সমগ্রের পরিকল্পনা করেছেন। ‘রামানন্দ সেনগুপ্তের শেষ সাক্ষাৎকার’ এই ধরতাই প্রকৃতপক্ষে সংকলকের। যদিও এখানে তিনি স্বয়ং সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। অন্যগুলির মতো এখানে সূচিতে বক্তার কোনও উত্তুঙ্গ ঘোষণা রইল না। পথ আগলে দাঁড়ালেন সম্পাদকমশাই। নির্লিপ্ত জিজীবিষা কখনও সামান্য কম হলেও পারত!
‘নিশীথে’ গল্পের সেই দক্ষিণাচরণকে মনে পড়ে? প্রথমা স্ত্রীর অসুস্থতার স্বেচ্ছা-অবসান ঘটিয়ে মনোরমাকে যিনি ভালোবাসবার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে দিতে ” ও কে, ও কে গো?” শুনতে পাচ্ছেন। মধ্যরাত্রে তাকেই দেখছি ‘ডাক্তার! ডাক্তার!’ বলে ছুটে যেতে। মনস্তাত্ত্বিক দ্বিখণ্ডনের শিকার হয়ে দক্ষিণাচরণ চিকিৎসকের কাছে নিজের অপরাধের স্বীকারোক্তিতে হয়তো স্বস্তিবোধ করেছেন, কিন্তু এ বইয়ের পাঠকের সে সুযোগ নেই। রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, ওভাবে যেমন প্রথাগত সূচি মেনে পড়া যায়, তেমনি সময়কে বইয়ের মতো উলটে ধরেও। কিংবা মাঝবরাবর, যে কোনও বিন্দু থেকে ডাইনে বামে। তাই যতই x-y অ্যাক্সিস বলি, বইটি আসলে জ্যামিতিক বহু নির্মীয়মাণ বৃত্তপথ, সময় নিয়ন্ত্রণ করছে না আপনাকে — বরং এক একজন সাক্ষাৎকারদাতাই আসল অশ্বারোহী। গতিপ্রাণ ধারাবাহিকতাকে মাংসের মতো টুকরো করে বইয়ের পুস্তাকির মতোই এক আধটা ভুল করে ফেলেছেন কারুবিন্যাসের ক্রমে। সময়কে ভাঙা সাঁকোর পাথরের ওপর দিয়ে পিছলে ঠেলে দিয়েছেন হঠাৎ। তুঘলকি কৌশলবাজদের মন্ত্র ভুলে সেই গোড়ালিতে পিছলানো জল চলকে পড়ল বুঝি আমাদেরও দিকে। গার্গীকে তবু কি থামানো যায়? শেষ হয় এর কোনও?
শব্দ, যা আভিপ্রায়িক — সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে তার রূপান্তর আশ্চর্য বক্র ও তির্যক, সময়ের ঘটমানতায় তা জায়মান একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে। আবার বহুস্বরের বাচনে বলার সময়ে একজন বক্তা আর একজন শ্রোতা মাত্র নয়, অদৃশ্য থাকেন আরও একজন বক্তা আরও একটি অস্তিত্বের সম্পূরক হিসেবে। মনে পড়বে ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’র মধ্যে সম্রাট যখন জানতে চাইছেন সে প্রতি রাতে নতুন গল্প শোনাতে পারবে কিনা, তখন সে বলছে — হ্যাঁ, পারবে, কারণ তারপর জানা গল্প থেকে সে নতুন গল্প তৈয়ের করতে পারবে। ময়দার মণ্ডটুকু জানা, কিন্তু গল্প কোথায় পৌঁছুবে তা অজানা। এই নতুন গল্প প্রতি রাতে শোনার আকর্ষণে তারা একজন অন্যজনের সঙ্গে অনন্তকাল থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সাক্ষাৎকার বলতে আমরা প্রশ্নোত্তরপর্বের যে সরলরেখা বুঝি, তাকেই সংকলক দফায় দফায় কানমলা দিয়ে গলাধাক্কা মারতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। একটি সাক্ষাৎকার তো নয়, এ যে বত্রিশটি দাঁতকপাটি একযোগে লেলিয়ে দেওয়া। এর তাৎপর্য ভিন্ন, আবেদনও মিশ্র, অনেকটা চেতনাপ্রবাহের চলমান ফ্রেমে ‘moving image’-এর গ্রাফিক্স নভেল বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু, অতএব সেটি আপনি পড়বেনই, তারপর শরৎচন্দ্র তারপর কিছুটা বাদ দিয়ে ধরা যাক দেবেশ রায় পৃঃ ১৯৯-এ এসে পড়ে চোখ আটকে গেল — যেখানে “আমার মনে হয় কালচেতনা বিভিন্ন নিরিখকে সমগুরুত্ব দেওয়ার দরুণ, সমাজের অন্তর্লীন দ্বন্দ্ব ও বিরোধ, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-এ অনেক স্পষ্টভাবে ফুটে উঠতে পেরেছে। সেই দ্বন্দ্বের স্বাক্ষর পড়েছে ভাষায়… ভাষার এই সচেতন ভূমিকা নির্মাণ, বাংলা উপন্যাসের ধারায় এক নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে।” — এই অবধি পড়ার পর হঠাৎ জানলেন যে এ বক্তব্য আসলে যিনি ইন্টারভিউ নিয়েছেন তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে আপনি আনুপূর্বিক সমস্তটা গোড়া থেকে পড়তে চাইবেন আর সেই মুহূর্তে চকোলেট না স্ট্রবেরি কোনটা বেশি পছন্দ সেটা ভাবতে ভাবতে আপনি পাতা ওল্টাবেন আর কথা-বলার ভেতর থেকে না-বলা কথারা সুদূর সুড়ঙ্গের আলো দেখাতে ছুটে আসবে। কেবল ‘কথা বলা’ এই মিডিয়ামটাই পাঠককে একযোগে বক্তার এক নম্বর দু নম্বর মুৎসুদ্দি করে তাকে দিয়েও কত না-বলা কথা ভাবিয়ে নেয় তার ইয়ত্তা নেই। তাহলে এহেন ভাষা-সংলাপ ও স্বগতোক্তির হায়ারারকিতে ‘মুসাবিদা’ করার দুঃসাহসকে একটি কুর্নিশ না জানালেই নয়।