নিহিত কোমলগান্ধার : সিনেমা সঙ্গীত ও ঋত্বিক ঘটক — চার

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 

তৃতীয় পর্বের পর

 

মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) 

‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-র দু’বছর পর অবশেষে বাংলা সিনেমার ইতিহাসে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন ১৯৬০ সালের ১৪ই এপ্রিল কলকাতায় মুক্তি পায় ‘মেঘে ঢাকা তারা’। বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক শক্তিপদ রাজগুরুর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় ‘ঋত্বিক ঘরানা’র আর এক ব্যতিক্রমী অধ্যায় ‘মেঘে ঢাকা তারা’। আটান্ন সালের পর অবশ্য ঋত্বিক শুধু ‘মেঘে ঢাকা তারা’র পরিকল্পনা নিয়েই বসে থাকেননি। সাধ্যমতো তৈরি করেছেন — ‘কত অজানারে’ (১৯৫৯)-র মতো তথ্যচিত্র এবং ‘স্বরলিপি’ (১৯৬০)-র মতো সফল চিত্রনাট্য। কথিত আছে ঋত্বিক-ঘরানার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল প্রদর্শিত সিনেমা একমাত্র এটিই। একইসাথে বাণিজ্যিকভাবেও প্রবল সফলতা লাভ করেছিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’। এই ছায়াছবির প্রতিটি অংশই বাঙালি দর্শককে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। সিনেমার শেষ দৃশ্যে নীতার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা সেই অন্তিম হাহাকার — ‘দাদা! আমি বাঁচতে চাই…!’ আজ ‘মিথ’-এ পরিণত হয়েছে।

সর্বোপরি এই সিনেমাটির আরও একটি বৃহৎ অবদান — সঙ্গীত। ভারতীয় চলচ্চিত্র সঙ্গীতের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান ও ব্যতিক্রমী ধারা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’। মূলত হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধারে নির্মিত এর নেপথ্য/আবহ এবং গানগুলি আজও বাঙালি দর্শকদের প্রবলভাবে নাড়া দেয়। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র-র এক অক্ষয় কীর্তিরূপে আজও এটি প্রোজ্জ্বল। সঙ্গীতের বিশ্লেষণে যাবার আগে আরও একবার দেখে নেব এই ছায়াছবির বাকি কলাকুশলীদের। ছবিটির কাহিনীকার — শক্তিপদ রাজগুরু, চিত্রনাট্য — স্বয়ং ঋত্বিক, চিত্রগ্রহণ — দীনেন গুপ্ত, সম্পাদনা — রমেশ যোশী, নেপথ্য শব্দধারণ/সঙ্গীতগ্রহণ — সত্যেন চ্যাটার্জী, সহকারী — জ্যোতি চ্যাটার্জী, শিল্প নির্দেশনা — রবি চ্যাটার্জী, আবহ — ওস্তাদ বাহাদুর হুসেন খাঁ, লক্ষ্মী ত্যাগরাজন এবং মহাপুরুষ মিশ্র, নেপথ্য — পণ্ডিত এ. টি. কানন, দেবব্রত বিশ্বাস, গীতা ঘটক ও রণেন রায়চৌধুরী। সঙ্গীত পরিচালনায় — জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সহযোগী — মন্টু ঘোষ, অলক দে এবং রবি ব্যাঙ্কস্। ছবিটি প্রযোজনা করেন — চিত্রকল্প।

নিবন্ধের শুরুতেই বলা হয়েছে যে মুলত হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নিরিখে রচিত এই সিনেমার সাঙ্গীতিক প্রেক্ষাপট। সেই হেতু সিনেমার প্রথম দৃশ্যে যেখানে দেখা যায় মফস্বল টাউনে সূর্যোদয় বা দিনের শুরু হচ্ছে। নেপথ্যে ভৈরব রাগে পণ্ডিত এ. টি. কাননের আলাপ। সিনেমার অন্যতম প্রধান চরিত্র নীতার দাদা যে কি না একজন প্রতিভাবান গায়ক এবং সিনেমার শুরুতেই ভৈরব রাগে আলাপ তাই এই সিনেমার গুরুত্বকে নতুন মাত্রা দেয়। নীতার introducing scene-এ আমরা দেখতে পাই মফস্বল রাস্তা দিয়ে আসতে গিয়ে তার চটি ছিঁড়ে যায়। নীতার এই ‘চটি ছেঁড়া’র দৃশ্যে উঠে আসে  পঞ্চাশের দশকে পূর্ববঙ্গ থেকে উঠে আসা উদ্বাস্তু মানুষদের দুঃখদারিদ্রের একটি ছবি। আবহে সেতার ও সরোদের যৌথ মিশ্রণ দৃশ্যটিকে সঠিক মূল্যায়ন করে। পরবর্তী দৃশ্যে সঙ্গীত পরিচালক একটি দৃশ্যে প্রয়োগ করেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। নীতার ছোট বোন কাপড় মেলতে মেলতে গান করে — ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে’। মফস্বলী উদ্বাস্তু জীবনধারায় রবীন্দ্রনাথের প্রেমপর্যায়ের এই গান শত দুঃখের মাঝেও একটুকরো বেঁচে থাকার আশ্বাস যোগায়। ঋত্বিক ঘটকের এই সিনেমায় বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে সরোদ। পরবর্তী দৃশ্যগুলিতেও এর ধারা অব্যাহত। একটি দৃশ্যে নীতা যেমন তার প্রেমিক সনৎ-এর লেখা একটি চিঠি/প্রেমপত্র লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে। আবহে সরোদ ও বাঁশির দ্বৈতবাদন দৃশ্যটিকে মনোময় করে তোলে। পরবর্তী দৃশ্যে সরোদের আরও একটি অনবদ্য প্রয়োগ আমাদের চোখে পড়ে যেখানে নীতার মা তার অভাব-দারিদ্রপূর্ণ সংসারের প্রতি তীব্র ভৎর্সনা করেন। এই দৃশ্যে সরোদের ‘ঠোক ঝালা’ ও ‘মীড়’-এর প্রয়োগ দেখবার মতো।

গান আর যন্ত্রসঙ্গীতের পাশাপাশি কবিতাও এই সিনেমায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়েছে। এই সিনেমার দু’টি দৃশ্যে ঋত্বিক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কীটস্ (John Keats, ১৭৯৫-১৮২১) ও ইয়েটস্ (W. B. Yeats, ১৮৬৫-১৯৩৯)-কে ব্যবহার করেছেন। সিনেমার সেই বিশেষ দৃশ্যে যেখানে নীতার বাবা, বৃদ্ধ মাস্টারমশাই তার মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে দিতে উচ্চারণ করেছেন ইয়েটস্-এর লেখা কবিতা, ‘At the Galway Races’ থেকে অমর চারটি স্তবক —

‘Breathed on the world with timid breath.
Sing on: Somewhere at some new moon,
We’ll learn the sleeping is not death,
Hearing the whole earth change its tune’

বৃদ্ধ বাবার মুখ থেকে শোনা এই লাইনগুলি নীতার মতো আমাদেরও ‘দিনবদল’-এর স্বপ্ন দেখায়।

ইয়েটস্-এর এই অসাধারণ কবিতাটির রেশ ধরে উঠে আসে আরও একটি বিখ্যাত কবিতার লাইন। এবারের কবি কীটস্। সিনেমার একটি দৃশ্যে  নীতার বাবা, তার মেয়ে ও ছেলে শঙ্করকে সাথে নিয়ে ঘুরতে যান দূরে একটি নদীর ধারে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গ্রামবাংলার মাধুর্যকে পরিচালক অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বৃদ্ধ মাস্টারমশাই-এর মুখনিঃসৃত কীটস্-এর অমর সৃষ্টি On the Grasshopper and Cricket-এর একটি লাইনে:

‘The poetry of earth is never dead’

সকলের জ্ঞাতার্থে এই কবিতাটির প্রথম চারটি লাইন উদ্ধৃত করা হল। আসুন আমরা রোমাঞ্চিত হই:

‘The Poetry of earth is never dead:
Where all the birds are faint with the hot sun,
And hide is cooling trees, a voice will run
From hedge to hedge about the new-mown mead;

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে এই সিনেমাতে রাগসঙ্গীতের অনবদ্য ব্যবহার। এই সিনেমার একটি দৃশ্যে নীতা দেখতে পায় তার দাদা শঙ্করকে। সে নদীর ধারে বসে নিবিষ্ট মনে গান গাইছে। এ.টি. কাননের কণ্ঠে ‘ভাটিয়ার’ রাগে দৃশ্যটি বিশেষ গুরুত্ব পায়। আরও একটি দৃশ্যে যেখানে নীতা ও সনৎ পাশাপাশি বসে কথা বলে। নৈসর্গিক দৃশ্যও এখানে একটি যথেষ্ট important element। সামনে নদী। পেছনে ট্রেন ছুটে যায়। আবহে করুণসুরে আবার বেজে ওঠে সরোদ ও বাঁশির যুগলবন্দি। সেতারের প্রয়োগও উঠে আসে অনিবার্য ভঙ্গিতে যখন নীতার বৃদ্ধ বাবা বয়স ও দারিদ্রের ভারে সন্ধেবেলায় রেললাইন ধরে হেঁটে আসতে আসতে ট্র‍্যাকের উপরেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। সেতারের ঝালা অংশে এইখানে উঠে আসে তার ছিঁড়ে যাওয়ার আওয়াজ। যেন একটি জীবনের তার ছেঁড়া হল।

রাগসঙ্গীতের ব্যবহার এবার আরও একবার অন্য দিশা পায় যেখানে দেখা যায় শঙ্কর নদীর চরে বসে গাইছে। ‘হংসধ্বনি’ রাগে বিলম্বিত বন্দিশ ‘গয় মা তে প্রীতম’। সকালবেলায় নদীর ধারে এই গানের দৃশ্যে আমরা আরও একবার চিনে নিই শঙ্কর-এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাঙ্গীতিক প্রতিভাকে এবং একইসাথে খুঁজে পাই দারিদ্রক্লিষ্ট একটি উদ্বাস্তু পরিবারের লড়াই করবার জ্বলন্ত স্পৃহা। এ লড়াই বেঁচে থাকার লড়াই। সময়ের বিরুদ্ধে, সময়ের সাথে।

বাংলার লোকসঙ্গীতকেও পরিচালক এখানে ব্যবহার করেছেন। সিনেমার একটি দৃশ্যে আমরা দেখি ভিড় পরিবেষ্টিত হয়ে এক বাউল একতারা বাজিয়ে গান গাইছে —
‘দুঃসময়ে দিনগুলি আইয়া/ অসময়েও মন শোন’

রণেন রায়চৌধুরীর কণ্ঠে গাওয়া এই বাউল গানটি সেই অস্থির সময়কে (পঞ্চাশ, ষাটের দশকের বাংলা) যথেষ্ট গভীরভাবে তুলে ধরে।

এরই পিঠোপিঠি আরও একটি দৃশ্যে উঠে আসে একটি বৃষ্টির রাত। নীতা ঘরের জানালা দিয়ে তার দাদা শঙ্করকে দেখে। ঘর অন্ধকার করে বসে শঙ্কর তানপুরা হাতে গান গাইছে। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি ও বজ্রপাত। মেঘ ডাকে। শঙ্কর ভ্রূক্ষেপহীনভাবে তন্ময় হয়ে ‘মিয়াঁ কী মল্লার’ রাগে একটি বিখ্যাত বিলম্বিত বন্দিশ — ‘করিম নাম তেরো’ গেয়ে চলে। অসাধারণ এই রাগটি এ.টি. কাননের বিখ্যাত গায়কী ও অনিল চ্যাটার্জীর (শঙ্করের ভূমিকায়) অনবদ্য অভিব্যক্তিতে (expression) দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে।

সরোদ ও বাঁশির পুনঃপ্রয়োগ আবারও চোখে পড়ে যখন নীতা তার প্রেমিক সনৎ-এর নিজের অক্ষমতা, দারিদ্র ও অভাবের কথা স্বীকারোক্তি করে। স্বীকারোক্তির সেই নিবিড় ভঙ্গিমায় সরোদ ও বাঁশির যৌথ আলাপে (রাগ: বেহাগ) এক দুঃখের পরিবেশ ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। এই দৃশ্যেরই continuation-এ দেখতে পাই নীতা টিউশন সেরে বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ সচকিতে দেখে তার বোন গীতা, তারই প্রেমিক সনৎ-এর সাথে ঝিলের ধারে আন্তরিকভাবে বসে গান গাইছে। গীতার মুখ দিয়ে গাওয়ানো ঝুমুর গানটি — ‘কাজল আঁখি কইন্যা রে/ মানুষ রে, তোমারি লাগিয়া রে’ কোথাও যেন অনিবার্যভাবে প্রেম ও প্রবঞ্চনার মাঝের সূক্ষ্ম বিভাজনটিকে চিনিয়ে দেয়।

এর পরবর্তী দৃশ্যে আবার ফিরে আসতে হয় রাগসঙ্গীতের মার্গে। এমনই একটি দৃশ্যে শঙ্কর সন্ধেবেলায় গান গায়  — ‘না জাগাহো রাজা/ রাজা গয়ি দোরি রে’। ‘খাম্বাজ’ রাগে এই বন্দিশটিকে অসাধারণ রূপদান করেন পণ্ডিত এ. টি. কানন।

যন্ত্রসঙ্গীতের অনবদ্য পরিবেশন এ ছবির বিশেষ সম্পদ। এমনই একটি দৃশ্যে নীতা তার ছোট ভাইকে ভৎর্সনা করে। সে তার দাদা শঙ্করের বিরুদ্ধে কথা বলায় নীতা তার প্রতিবাদ করে। আবহে তানপুরা বেজে ওঠে। বেসুরো সুরে। যার রেশ কাটতে না কাটতে সুরশৃঙ্গার-এর গভীর চলন দৃশ্যটিকে আরও বেদনাবিধুর করে তোলে। সুরশৃঙ্গার-এর এই প্রয়োগ সঙ্গীত পরিচালকের যথেষ্ট মুনশিয়ানার দাবি রাখে।

পরের দৃশ্যে দেখা যায় নীতা, সনৎ-এর বাড়ি খোঁজে। সনৎ তার অতীতকে মুছে ফেলার জন্য পূর্ব ঠিকানা ছেড়ে নতুন বাসস্থানে উঠে আসে। নীতা তার খোঁজে বেরোয়। বাড়ি খুঁজে পেয়ে সে সনৎ-এর মুখোমুখি হয়। সনৎ-এর ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি তাকে কষ্ট দেয়। গীতা বুঝতে পারে তার জীবনে ‘প্রেম পর্যায়’-এর এখানেই ইতি। আবহে করুণ সুরে বেজে ওঠে — সেতার ও বাঁশি। কীর্তনের সুরে। যেন অভিসারী রাধার প্রেমভঙ্গের ইঙ্গিত এই সুর। ভাঙা মন নিয়ে নীতা, সনৎ-এর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে। তার মাথা ঘোরে। হঠাৎ পা টলে যায়। নেপথ্যে বেহালার করুণ সুর যেন আভাস দিয়ে যায় সবকিছু শেষ হয়ে আসার। জীবনে বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকু ছেড়ে নীতা বেরিয়ে আসে।

পরবর্তী দৃশ্যে সে মুখোমুখি হয় তার ছোট বোন গীতার। গীতা জানায় সে সনৎকে বিয়ে করছে। বজ্রাঘাতের মতো সে খবর নীতাকে আঘাত করে। সে হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে। নেপথ্যে শঙ্করের রেওয়াজ ভেসে আসে। একই সাথে বেজে ওঠে আবহে বিসর্জনের ঢাক। গীতার বিয়ে হয়ে যায়।

এর পরের অংশে অসাধারণ দক্ষতায় পরিচালক একটি রাগসঙ্গীতকে মিলিয়ে দিয়েছেন ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’-এর সাথে। সেই দৃশ্যে একটি বর্ষার রাতে শঙ্করকে দেখতে নীতা দাদার ঘরে ঢোকে। দু’জনে মিলে ছোটবেলার কথা বলে। তারপর একত্রে গায় সেই বিখ্যাত গান — ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’। রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের এই গানটিকে অসামান্য করে তুলে দিলেন দেবব্রত বিশ্বাস ও গীতা ঘটক। আজও আপামর বাঙালি দর্শকের কাছে এই গানটি তার ব্যবহার, গায়ন, ও অনবদ্য cinematic expression-এর জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

এই দৃশ্যের  পিঠোপিঠি আরেকটি দৃশ্যে সকালবেলায় নীতার হাতে একটি চিঠি আসে। চিঠি পড়ে সে জানতে পারে মন্টু দুর্ঘটনাগ্রস্ত ও গুরুতর অবস্থায় আহত হয়ে হসপিটালে ভর্তি। নেপথ্যে ব্যবহৃত বাহাদুর খাঁ সাহেবের সরোদের অনবদ্য মূর্চ্ছনা এই দৃশ্যটিকে প্রাঞ্জল করে তোলে।

দৃশ্যের continuation-এ নীতা কিছু অর্থসাহায্য ও মন্টুর খবর জানাতে গীতার বাড়ি আসে। গীতা সনৎকে বিয়ে করে যথেষ্ট স্বচ্ছল। নীতা অবাক চোখে গীতার সাজানো সংসার দেখে। একই সাথে উঠে আসে তার বাড়ির দারিদ্রক্লিষ্ট রূপ। এই দৃশ্যে আবহসঙ্গীতে ব্যবহৃত হয়েছে — বেহালা। বেহালার ছড়-এর করুণ আওয়াজে নীতা আরও একবার খুঁজে পায় নিজের অবস্থান। নীতা বোঝে সে একা। এ লড়াই তাকে একাই লড়তে হবে।

সিনেমার অন্তিমলগ্নে এসে আমরা দেখতে পাই সংসারের হাল টানতে টানতে, প্রত্যেক মুহূর্তে নিজের ভাগ্যের হাতে প্রতারিত হতে হতে, অসম্ভব দারিদ্রের জ্বালা সহ্য করতে করতে নীতার দুরারোগ্য ব্যাধি হয়। তার টিউবারকিউলোসিস (T.B.) ধরা পড়ে। একটি দৃশ্যে সে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। জানালার বাইরের পৃথিবীকে দেখে। হঠাৎ দমকে দমকে কাশি ওঠে। ওঠে রক্ত। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায় নীতা। নেপথ্যে ভেসে ওঠে গান। গীতা ঘটকের গলায়। ‘জানি তোমায় পারিনি বুঝিতে’।

নীতা অফিস পাড়ায় একটি কাজের সন্ধান পায়। অফিসে যাবার পথে সে দেখতে পায় সনৎকে। তারা দুজনে নদীর ধারে বসে। পিছনে রেলগাড়ি আরও একবার ছুটে যায়। সনৎ নীতার কাছে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা স্বীকার করে। সে পুনরায় নীতার জীবনে ফিরে আসতে চায়। সাহায্য করতে চায় তাকে। নীতা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এ লড়াই তার একার। নীতা সনৎকে প্রত্যাখ্যান করে উঠে চলে যায়। সনৎ বিষন্নমুখে একা বসে থাকে। নেপথ্যে আছড়ে পড়ে চাবুকের শব্দ।

অন্য একটি দৃশ্যে অফিসে কাজ করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়ে নীতা। সে বোঝে, যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে সে আক্রান্ত তার হাত থেকে পরিত্রাণ নেই। তার মাথা ঘোরে। বারবার কাশি পায়। টলে ওঠে মাথা। এই দৃশ্যে পরিচালক একটি ‘তালতন্ত্র’ মাধ্যমে সম্পূর্ণ দৃশ্যটিকে এক অনন্য মাত্রায় বেঁধেছেন। এ যেন জীবনের ছন্দপতনের ছন্দ।

পরবর্তী দৃশ্যে আমরা দেখি শঙ্কর বাড়ি ফিরে এসেছে। বহুদিন বাড়ি ছেড়ে বম্বে গিয়ে সেখানে থেকে সে আজ নিজের মেহনতে সুপ্রতিষ্ঠিত গায়ক। নদীর পার ধরে হেঁটে সে আনন্দে গেয়ে ওঠে ‘হংসধ্বনি’ রাগে সেই বিখ্যাত গান। এ. টি. কাননের অনবদ্য কণ্ঠে — ‘লাগি লগন পতীসখীসন’। সরোদের পার্শ্ববাদন এই গানটিকে আরও মনোগ্রাহী করে তোলে। আজও তামাম বাঙালি দর্শককুলের কাছে এই সঙ্গীত বিশেষ অনুপ্রেরণা যোগায়।

শঙ্কর বাড়ি ফিরে আসে। এসেই সে তার আদরের বোন ‘খুকী’-র খোঁজ করে। ততক্ষণে নীতা নিজের অস্তিত্বকে বাড়ির সবার থেকে আলাদা করে ফেলেছে। দুরারোগ্য ব্যাধির ছোঁয়া সে পরিবারে ছড়াতে চায় না। শঙ্কর তার আদরের খুকীর ঘরে ঢোকে। নীতা তার রক্তে ভেজা রুমাল লুকোবার চেষ্টা করে। কিন্তু ধরা পড়ে যায়। আবহে গম্ভীর সুরে বেজে ওঠে সুরশৃঙ্গার। বাইরে ঝড় ওঠে। 

আরও একটি রূঢ় বাস্তব দৃশ্যে পাওয়া যায় সরোদের আশ্চর্য ব্যবহার। এ সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য যেখানে নীতার বাবা, অসুস্থ বৃদ্ধ মাষ্টারমশাই ঘুমন্ত নীতার ঘরে ঢোকেন। কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়ের মাথায় হাত রাখেন। অবিচলিত কণ্ঠে, অভিমানে তিনি তার মেয়েকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন। নীতা তার বাবার এ হেন বাক্যে পাথর হয়ে যায়। নিয়তির এত বড় অভিশাপ বোধহয় এর আগে সে কখনও টের পায়নি। বাবা ও মেয়ের সেই অনিবার্য জীবনসংঘাতের সাক্ষীরূপে বেজে ওঠে বাহাদুর খাঁ সাহেবের সরোদ। মিয়াঁ কী মল্লার রাগে। সরোদের এই গোঙানো সুর বুঝি চিরকাল বাঙালি দর্শককে ঘুমোতে দেবে না।

নীতা ঘর ছেড়ে চলে যায়। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে। দাদা শঙ্কর তাকে যেতে দেয় না। নেপথ্যে সাঁওতালী ঝুমুর গান — ‘আয় চলে আয়/ মা কোলে আয়।’ গানটির ব্যবহার এখানে এক সার্থক প্রয়োগ। যেন নীতাকে প্রকৃতি ফিরিয়ে নেওয়ার আকুতি। অসাধারণ দক্ষতায় দোতারার পার্শ্ববাদন এখানে গানটিকে যোগ্য রূপদানে সক্ষম হয়।

সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখা যায় নীতা একা একা পাহাড়ের কোলে বসে আছে। তার স্বপ্নের শিলং পাহাড়। সামনে জমাট কুয়াশা। দূরে পাহাড় ঘেষা রোদ। নীতা স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে থাকে। নেপথ্যে ভেসে আসে গাড়োয়ালী গান। নৈঃসর্গের সাথে, গাড়োয়ালীর পাহাড়ি ধুন মিলেমিশে এক হয়ে যায়।  এরপরেই শঙ্করের হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে নীতা।  চিৎকার করে বলে — ‘দাদা, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম’। সেই চিৎকার সারা পাহাড়ে ধ্বনিত হয়। আবহে মেঘ ডেকে ওঠে। কুয়াশা আরও জমাট হয়।

শেষ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই শঙ্কর ঘরে ফিরে আসে। একা। নীতাকে সে রেখে এসেছে শিলং পাহাড়ের স্যানিটোরিয়ামে। রাস্তায় চলতে চলতে নীতার মতোই দেখতে আরেকটি মেয়েকে সে দেখে। নীতার মতো তারও চটি ছেঁড়ে। কোথাও না কোথাও সমস্ত মেয়ের মুখ, মায়ের মুখ, শুভাকাঙ্ক্ষী দিদি-বোনেদের মুখ এক হয়ে নীতার মুখ ভেসে ওঠে। নেপথ্যে সেই আদিবাসী ঝুমুর গান — ‘আয় চলে আয়/ মা কোলে আয়’। শঙ্কর দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে। সিনেমা শেষ হয়। শেষ হতে হতে পরিচালকের অনবদ্য সঙ্গীত প্রয়োগে সেই গানটি সারা জায়গা জুড়ে পাক খেতে থাকে।  এরপর শুধুমাত্র স্তব্ধতা ছাড়া আর কোনও ভাষা থাকে না বিশ্লেষণের। শুধুই স্তব্ধতা।

এরপর আগামী সংখ্যায়

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...