বাল্মীকি-রামায়ণ-কাব্য-কথা

শামিম আহমেদ

 

রামায়ণ ভারতের প্রথম মহাকাব্য। এর রচয়িতা হলেন প্রচেতাপুত্র বাল্মীকি। তিনি চতুরানন ব্রহ্মার কৃপায় তমসাতীর্থে এই মহাগ্রন্থ নির্মাণে প্রয়াসী হন। সপ্তকাণ্ড রামায়ণের শেষে উত্তরকাণ্ডে বাল্মীকির একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী পাওয়া যায়। দস্যু রত্নাকর নারদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করতে উদ্যোগী হলে দেবর্ষি নারদ তাঁকে কয়েকটি প্রশ্ন করেন এবং রত্নাকর বুঝতে পারেন, তাঁর পাপের ভাগ স্ত্রীসন্তানরা নেবেন না। তখন তিনি প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করেন বলে কথিত। রত্নাকর এর পর সাধনায় বসে কবিত্বশক্তি অর্জন করেন, তাঁর নাম হয় বাল্মীকি।

দস্যুবৃত্তি করার সময় রত্নাকর এখানে ওখানে ঘুরেছেন বলে মনে করা হয়। তবে তাঁর ভ্রমণপথ কখনই উত্তরভারত অতিক্রম করেনি। কিন্তু যদি রামায়ণ পাঠ করা হয়, তাহলে বোঝা যাবে যে তিনি এমন সব স্থানের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন যে সব জায়গায় তাঁর পায়ের চিহ্ন পড়েনি। তিনি দক্ষিণ ভারত পার হয়ে সেতুযোগে শ্রীলঙ্কা পাঠালেন কাহিনির কুশীলবদের, এমনকি সমুদ্র নিয়েও বললেন নানা কথা। কীভাবে? ব্যাসদেব ছিলেন ঋষি, তাঁর ছিল নানা গুণ। বাল্মীকি প্রথম জীবনে দস্যু, পরে কবি। তাঁর কবিত্বশক্তি কীভাবে দেশকাল অতিক্রম করে রামায়ণকে একটি কালজয়ী মহাকাব্যে প্রতিষ্ঠা করল? নিশ্চয় চতুরানন ব্রহ্মার কৃপা ছিল প্রচেতাপুত্র বাল্মীকির উপর। কে এই চতুরানন ব্রহ্মা?

ভারত তথা পৃথিবীর বহু জায়গায় মানুষের অন্যতম প্রাচীন পেশা ছিল গল্প বলা। পুরাণকথক সৌতি ঠাকুর জনমেজয়ের সর্পসত্রে মহাভারত বর্ণনা করেছেন। তিনি সেই মহাকাহিনী শুনে এসেছেন শৌণকের বার্ষিক যজ্ঞে, নৈমিষারণ্যে; সেখানে কথক ছিলেন ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়ন। এখানে লক্ষ করার মতো বিষয়, ব্যাস যে আদি মহাভারত শিষ্যদের শোনান, তার নাম ‘জয়’— তাঁর যে শ্লোক সংখ্যা ছিল, তা বৃদ্ধি পেল নৈমিষারণ্যে বৈশম্পায়নের জবানে, আবার সৌতি ঠাকুর জনমেজয়ের সর্পসত্রে সেই সব শ্লোক সংখ্যা বাড়িয়ে ফেললেন অনেকখানি। বাল্মীকির লেখা বলে যে রামায়ণ পড়া হয়, ভাবা হয়, তার শ্লোকসংখ্যা ২৪ হাজার। পরবর্তীকালে আওয়াধি রামায়ণ যা রচিত হয় তুলসীদাসের কলমে কিংবা কৃত্তিবাস ওঝার বাংলা রামায়ণ যদি দেখা হয়, তাতে নানা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন খুঁজে পাওয়া যাবে। ভারতবর্ষের বাইরে বালিদ্বীপ কিংবা যবদ্বীপে এই পরিবর্তন অনেক বেশি।

এই যে কথক, যাকে আরবি ভাষায় বলা হয় রাভিয়া কিংবা আশিক তাঁরা নানা দেশ পাড়ি দিয়ে গল্পের ফেরি করতেন। এক দেশ থেকে অন্য দেশে, অন্য সময়ে নানাভাবে সেই সব আখ্যানের পরিবর্তন হত। কোথাও তা সেই দেশের আকার ধারণ করত, আবার কখনও এক দেশ থেকে গল্প তার চেহারা বদল করে নিজের দেশে ফিরে যেত। এই কিসসা বা উপাখ্যান সাধারণত ছন্দ সুর অবলম্বন করে বলা গাওয়া রীতি ছিল। যেহেতু তখন কপিরাইট আইন সেইভাবে ছিল না, তাই কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগও ওঠেনি কারও বিরুদ্ধে। বরং একের রচনা (সেও আসলে বহুর রচনা) অন্যে নিয়ে ফেরি করেছেন, তাতে উপাখ্যান সমৃদ্ধ হয়েছে। সুতরাং শাহনামা-ই হোক কিংবা মহাভারত — সেখানে অনেক মানুষের অবদান আছে, আছে চতুরানন ব্রহ্মার কৃপা, প্রচেতাপুত্রদের শ্রম ও মেধা।

আচার্য সুখময় ভট্টাচার্য ‘রামায়ণের চরিতাবলী’ (আনন্দ, ১৪১৯ বঙ্গাব্দ)-র নিবেদনে লিখেছেন, “রামায়ণের উপক্রমণিকা হইতে জানা যাইতেছে — মহর্ষি বাল্মীকি রামের সমকালীন। তিনি দশরথের সখা ছিলেন। পক্ষান্তরে ‘রাম জন্মিবার আগে রামায়ণ’ এই প্রবাদ-বাক্যটিও বহুল-প্রচলিত। এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। ইহা অবশ্যই সত্য যে, রামায়ণের বিষয়বস্তু কবিকল্পিত নহে।’’ বাল্মীকি তো সেই অর্থে রামের জীবনীকার নন, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তিনিও ঘোরেনওনি, তবে কীভাবে এত নিখুঁতভাবে রামায়ণের অয়ন বা প্রতিপাদ্য হলেন রাম! এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই মানুষকেই ভাবায়।

এর একটা সহজ উত্তর আছে। রামায়ণে দূর দেশের এবং দূর কালের যে সমস্ত বর্ণনা, তা আমাদের লোক পরম্পরায় ছিল। কবিগুরু বাল্মীকি সেই কাহিনিকে অসামান্য ছন্দে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর ছন্দ নিশ্চয় লৌকিক ধারাকে অতিক্রম করে গিয়েছে যার জন্য বাল্মীকির রচনা হয়ে উঠেছে দৈবত। ‘দৈব’ কথাটির নানা অর্থ রয়েছে। প্রথমত তা দেবসম্বন্ধী, দেবভাবসম্পন্ন ও সত্ত্বপ্রধান। দ্বিতীয়ত তা দিব্য ও মনোহর। সকলের এ কথা জানা, ‘দেব’ আসলে দীপ্যমান ও দ্যোতনাত্মক, তাই সে অমর। বাল্মীকিকে ব্রাহ্মণসন্তান বলা হয়েছে। তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন দস্যু। এখানেও একটি মজার তথ্য পাওয়া যায়। এ কথা সকলেই জানেন যে ব্রাহ্মণ ছাড়া পৌরোহিত্য সম্ভব নয়। মহাভারতে আছে, সাধারণ লোক পৌরোহিত্যকে অসম্মানের কাজ বলে মনে করত। পূর্ব জন্মের কুকর্মের ফলে ব্রাহ্মণ পৌরোহিত্য করে জীবন নির্বাহ করে থাকেন। যাজনও জীবিকা কিন্তু তা সম্মানের নয়। এতেন কর্ম্মদোষেণ পুরোধাস্ত্বমজায়থাঃ (অনুশাসনপর্ব ১০/৫৬)। তেজস্বী ব্রাহ্মণরা তাই পুরোহিত হতেন না। অধ্যাত্মরামায়ণেও বশিষ্ঠের কথায় আমরা তার প্রমাণ পাই। স্বয়ং রামচন্দ্রকে বশিষ্ঠ বলছেন, “পৌরোহিত্য যে গর্হিত ও দুষ্য জীবিকা, তা সম্যক জানি, কিন্তু তোমার আচার্য হতে পারব, এই আশায়ই গর্হিত কাজও স্বীকার করেছি।’’ পৌরোহিত্যমহং জানে বিগর্হাং দুষ্যজীবনম (অযোধ্যাকাণ্ড, ২/১৮)। দস্যু ও পরে কবি, রামায়ণ ও যোগবাশিষ্ঠের রচয়িতা, ব্রাহ্মণসন্তান বাল্মীকি কোনও দিন পৌরোহিত্য করেননি। রামায়ণে উল্লেখ আছে, বাল্মীকি হলেন প্রচেতার দশম পুত্র, কিন্তু কৃত্তিবাস ওঝার মতে, তিনি চ্যবনের পুত্র। মতান্তরে, তিনি ভৃগুবংশীয় মুনিবিশেষ। কৃত্তিবাসী রামায়ণে, রত্নাকর দস্যুই বল্মীক থেকে জন্ম হেতু ‘বাল্মীকি’ নামে খ্যাত হন। অধ্যাত্মরামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ‘বাল্মীকি’ নামের এমন নিরুক্তি আছে। নিরুক্ত হল নিঃশেষে ব্যাখ্যাত বা কথিত — নিরুক্তা প্রকৃতির্হ্যেষা (শব্দকল্পদ্রুম)। একে নির্বচন বা ব্যুৎপত্তিও বলা হয়ে থাকে। পদভঞ্জনও নিরুক্তের আর এক অর্থ। পদের অবয়বার্থনির্বাচক যাস্ককৃত গ্রন্থ নিরুক্ত, একে বেদাঙ্গ নামেও অভিহিত করা হয়। এই নিরুক্তকে পদ্ধতি করে বাল্মীকির রামায়ণে যে বিশেষ দেশকাল অতিক্রমণ, সেই সব উপাখ্যানের বর্ণনার অতিলৌকিক বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। তার আগে দেখে নেওয়া যাক, রামায়ণ কত রকমের। এই বিষয়ে একটি সুন্দর গল্প আছে। একবার ভগবান শ্রীরামচন্দ্র যিনি দশরথের পুত্র, তিনি সিংহাসনে বসে আছেন। এমন সময় তাঁর অনামিকা থেকে আংটি মাটিতে পড়ে যায় এবং সেই অঙ্গুরীয় একটি ছোটো ফাটলে সেঁধিয়ে গেল। রামচন্দ্র তাঁর অনুগত ভক্ত হনুমানকে বললেন ওই আংটি খুঁজে আনতে। হনুমান ইচ্ছেমতো রূপধারণ করতে পারেন। একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যেমন হতে পারেন তেমনি নিজের দেহকে বিশালাকারও করে তুলতে পারতেন। হনুমান নিজের দেহকে একেবারে ক্ষুদ্র করে ওই ছোট্ট ফাটলের মধ্যে ঢুকে গেলেন। চলতে চলতে তিনি অধোভুবনে পৌঁছলেন। কয়েকজন স্ত্রীলোক সেখানে বসেছিলেন। একজন তাঁকে দেখতে পেয়ে বললেন, দ্যাখ দ্যাখ, কতো ছোট বানর! নিশ্চয় উপরের ভুবন পৃথিবী থেকে নীচে পড়ে গিয়েছে। তাঁদের একজন হনুমানকে দুই আঙুলে একটি থালাতে রেখে দিলেন। অধোভুবনের রাজা নৈশাহারে শাক সবজি ও ফলমূলের সঙ্গে এমন জীব ভক্ষণ করে থাকেন।

ওদিকে রাম বসে আছেন অযোধ্যার সিংহাসনে। এমন সময় কাল অর্থাৎ সময় (মতান্তরে, বশিষ্ঠ ও ব্রহ্মা) সাধুর বেশে রামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। রামকে কাল বললেন, তিনি মহর্ষি অতিবলের প্রেরিত দূত। অতিবল হল ব্রহ্মার ছদ্মনাম। কাল জানালেন, তিনি যখন রামের সঙ্গে কথা বলবেন তখন যেন সেই স্থানে কেউ প্রবেশ না করে। যদি কেউ সেখানে ঢুকে পড়ে তাহলে তাকে রাম বধ করবেন। দাশরথি রাম এমন প্রতিজ্ঞা করার পর একটি বদ্ধ ঘরে কাল ও নরচন্দ্রমা কথা বলতে শুরু করলেন। বদ্ধ দরজার অন্য দিকে প্রহরী হিসাবে রইলেন লক্ষ্মণ। কাল বললেন, হে রাজা, আপনার সময় ফুরিয়ে এসেছে, আপনাকে এই বার মর্ত্যলোক ছেড়ে দেবলোকে যেতে হবে। রাম তাতে সম্মতি জানালেন। দুজনে যখন কথা বলছেন তখন দুর্বাসা (মতান্তরে, বিশ্বামিত্র) মুনি রামের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। লক্ষ্মণকে তিনি বললেন, এক্ষুনি রামকে তাঁর আগমনের সংবাদ দিতে। লক্ষ্মণ একটু অপেক্ষা করতে বললে তিনি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন, এই মুহূর্তে তাঁর আগমনের খবর রামকে না দিলে তিনি গোটা অযোধ্যা সবংশে বিনষ্ট করে দেবেন। লক্ষ্মণ ভাবলেন, গোটা রাজ্য এবং তার মানুষ ধ্বংস হওয়ার চেয়ে তাঁর একার বিনাশ মঙ্গল। লক্ষ্মণ রামের কাছে গিয়ে দুর্বাসা মুনির আগমনের সংবাদ দিলেন। কাল বিদায় নিলেন। দুর্বাসা রামকে বললেন, তাঁর দীর্ঘকালের উপবাস শেষ হয়েছে, তিনি খাদ্য চান। তাঁকে নানা প্রকার সুখাদ্যে তুষ্ট করার পর রাম ভাবলেন, লক্ষ্মণকে বধ করাই হল সত্যধর্ম। বশিষ্ঠ বললেন, অনুজকে পরিত্যাগ করা মানে তাঁকে বধ করা। ত্যাগ ও বধ সমান। লক্ষ্মণ রামের দ্বারা ত্যাজ্য হয়ে সরযূতীরে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। রাম পুত্রদ্বয়কে সিংহাসনে অভিষিক্ত করে মহাপ্রস্থানের উদ্যোগ করলেন। সরযূ নদীতে তিনিও প্রাণ বিসর্জন দিলেন।

ওদিকে অধোভুবনে হনুমান রয়েছেন ভূতের রাজার নৈশাহারের থালায়। তিনি একমনে রামনাম জপ করে যাচ্ছেন। তাই শুনে রাজা বললেন, তুমি কে হে বাপু?

হনুমান।

এখানে এসেছ কেন?

ভগবান রামের আংটি একটি ফাটলে হারিয়ে যায়। সেই ফাটল ধরে আংটি খুঁজতে খুঁজতে এইখানে এসে পড়েছি।

ভূতের রাজা একটি প্রকাণ্ড থালায় কয়েক হাজার আংটি এনে বললেন, তোমার রামের আংটি এখান থেকে খুঁজে নাও।

হনুমান সহস্র সহস্র অঙ্গুরীয় দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, আমি ঠিক চিনতে পারছি না কোন আংটি আমার প্রভু রামের।

ভূতের রাজা বললেন, এখানে যত আংটি দেখছ, প্রত্যেকটি এক একজন রামের। তুমি যখন অযোধ্যায় ফিরে যাবে, তখন আর দশরথের পুত্র রামচন্দ্রকে দেখতে পাবে না। দাশরথি রামের কাল শেষ; তাই তাঁর আংটি অধোভুবনে। একজন রাম মারা গেলে তাঁর আংটি এখানে চলে আসে আর আমি সেগুলি নিজের সংগ্রহে রেখে দিই।

হনুমান ফিরে এলেন।

একজন রাম পিছু একটি করে রামায়ণ লেখা হয়েছে। কোনও রামায়ণই মৌলিকত্ব দাবি করতে পারে না। আবার কোনও ভাষ্যই পুনর্ভাষ্য নয়। এবং এই সব উপাখ্যানের যে যাত্রাপথ তারও শেষ নেই।

রামানুজন নামের এক পণ্ডিত তিন শত রামায়ণ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন যেটি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় পাঠ্য ছিল। খুব সম্প্রতি অনুভূতিতে আঘাত লাগছে ভেবে সেটি পাঠক্রম থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে লেখক রামায়ণ নির্মাণের একটি ইতিহাস বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে ২৫০০ বছর ধরে এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে এই রামকথা ছড়িয়ে পড়ে তার বিবরণও পাওয়া যায় ওই প্রবন্ধে। বাল্মীকির রামায়ণ নামক কাব্যের তুলনায় রামকথা যা আদতে গদ্য তা হল বেশি প্রাচীন, এমন একটা জোরালো মত ওই প্রবন্ধে পাওয়া যায়। প্রমোদ কুমার, দীননাথ বাত্রার মতো কয়েকজন এই প্রবন্ধের তীব্র বিরোধিতা করে কলম ধরেছেন এবং নানা অভিযোগ তুলেছেন। মুকুল কেশবন বছর দুই আগে কলকাতার একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে লেখেন, “Almost every sentence of this complaint is objectively, as old-school lefties used to say, untrue. Ramanujan, far from being malicious about the texts he discusses, obviously loves them. His language is neither abusive nor libellous. He does not distort, by scholarly consensus, the texts that he translates and the charge that in writing this essay he is trying to create communal differences is, in fact, the only part of this story that is truly libellous.”

ফলে এমন কথা ধরে নেওয়া যায় যে, বাল্মীকির রচনার পূর্বে রামকথা ছিল, এবং তা হয়তো ওই সুন্দর কাব্যের আকারে ছিল না, কিন্তু ছিল। শুধু রামানুজনের প্রবন্ধের যুক্তি এখানে বাল্মীকি রামায়ণের অপেক্ষাকৃত নবীনতা নিয়ে একমাত্র যুক্তি নয়। হনুমান ও ভূতের রাজার কথোপকথনও একটি জোরালো প্রমাণ। যেহেতু পৌরাণিক ইতিহাসের যুক্তির নিয়ম একটু অন্য ধারায় চলে, তাই এখানে ওই গল্পটিকে প্রমাণ হিসাবে নেওয়া সম্ভব। এমন যুক্তি মহাভারতের ক্ষেত্রে জৈন পণ্ডিতরাও দিয়েছেন। রামায়ণের তিন শো কেন, হাজার হাজার উপাখ্যানের মধ্যে বৌদ্ধ, কাশ্মীরি, ইরানি, যবদ্বীপীয় প্রভৃতি ‘কথা’ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আওয়াধি, বাংলা, অসমিয়া, কন্নড় নানা ভাষায় বিভিন্ন রামায়ণ। তাদের মধ্যে আছে অনেক ফারাক। মূল কাকে বলা হবে সে নিয়েও রয়েছে তর্ক। যদি বাল্মীকির রামায়ণকে মূল ধরা হয়, তাহলে আওয়াধি রামায়ণে তুলসীদাস তাকে সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ করলেন না কেন, কৃত্তিবাস ওঝা কিংবা অন্য ভাষার রামায়ণকাররা তাকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললেন না কেন, এমন প্রশ্ন ওঠে। যাকে আমরা বাল্মীকি রামায়ণ বলি সেখানে বাল্মীকির যে নিজস্ব পরিচয় তাও বদলে গিয়েছে তুলসীদাসের রামায়ণে।

নিরুক্তে ফেরা যাক। প্রাচীন ভারতবর্ষে আপাত অসঙ্গতি দূর করার জন্য নিরুক্তকে পদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করে অর্থ নিষ্কাশনের কথা বলা হয়েছে এবং নিরুক্ত হল বেদাঙ্গ।

বাল্মীকি হলেন প্রচেতাপুত্র। ‘প্রচেতা’ শব্দের অর্থ হল প্রকৃষ্ট জ্ঞান (ঋগ্বেদ ১.৪৩.১) — প্রকৃষ্ট চেতঃ যাহার। ‘পুত্র’ (পুৎ+ত্রৈ+অ (ক)-ক) এই প্রকৃষ্ট জ্ঞানবানকে ত্রাণ করেন এবং তিনিই বাল্মীকি। ‘চেতঃ’ বা ‘জ্ঞান’ শব্দটির তাৎপর্য গভীর। এই জ্ঞানের মধ্যে যেমন প্রত্যক্ষ-অনুমিতি-উপমিতি-শাব্দ-অর্থাপত্তি-অনুপলব্ধি আছে তেমনই আছে ঐতিহ্য ও পুরাণ। ফলত, বাল্মীকির চেতনা বা জ্ঞানের মধ্যে ঐতিহ্য ও পুরাণের ভূমিকা আছে বলেই অনুমান করা যায়। সেই ঐতিহ্য ও পুরাণ কোথা থেকে তিনি পেলেন? ‘বাল্মীকি’ শব্দটি এসেছে ‘বল্মীক’ থেকে। বাল্মীকি প্রচেতার দশম পুত্র। বল্মীক থেকে তাঁর উৎপত্তি। বল্মীক হল আগম (বঙ্গীয় শব্দকোষ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়)। শব্দটির একটি মানে হল, পণ্যদ্রব্যের দেশান্তরে উপস্থিতি, অর্থাৎ অন্য দেশে নিয়ে আসা, আমদানি (মনু ৮.৪০১)। অন্যান্য অর্থের মধ্যে রয়েছে পুরাণ, শব্দপ্রমাণ, আপ্তবচন, জনপ্রবাদ, প্রমাণসাধন সাক্ষী ও পত্রাদি। বাল্মীকি চতুরানন ব্রহ্মার কৃপা লাভ করেছেন বা অন্য মতে, বাল্মীকি ব্রহ্মার অবতার। তুলসীদাসকেও এমন অভিধায় ভূষিত করেছেন কেউ কেউ। যিনি চারদিকে দৃষ্টিই শুধু রাখতে পারেন না, অন্যান্য ইন্দ্রিয়ও তাঁর চতুর্মুখ। তিনিই ব্রহ্মা, অতি মহৎ, জ্ঞান — ইনি স্রষ্টা প্রজাপতি ও পিতামহ। এই পিতামহের কৃপা না থাকলে বাল্মীকি রামায়ণ লিখতে সক্ষম হতেন না।

ভারত তথা এশিয়ায় গল্প-কাহিনি-উপাখ্যানের ঐতিহ্য দীর্ঘকালের। বাচ্চারা পিতামহ-পিতামহীর কোলে চড়ে বহু উপাখ্যান শুনেছেন। লিপি আসার পূর্বে এই ঐতিহ্য ছিল অনেক বেশি প্রবহমান। জ্ঞানের মতো গল্পেরও কোনও ভৌগোলিক সীমারেখা থাকে না। তারা এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে দ্রুত যাতায়াত করে। সব উপাখ্যান ও কাহিনি কোনও ব্যক্তিবিশেষের একক বা নিজস্ব নির্মাণ নয়। মানবসভ্যতার দীর্ঘ জ্ঞান বা চেতা উপাখ্যানের মধ্যে নিহিত থাকে। ঐতিহ্য ও পুরাণ ছাড়া কোনও সাংস্কৃতিক নির্মাণ সম্ভব নয়। বাল্মীকিও এর ব্যতিক্রম নন। এক সময় গল্প বলা ছিল মানুষের পেশা। মহাভারতের শুরুতে সূতজাত কথক সৌতি ঠাকুর জনমেজয়ের সর্পসত্রে গল্প শোনাচ্ছেন। তাঁর পেশাই হল পুরাণ কথন। তিনি সেই কাহিনি শুনে এসেছেন নৈমিষারণ্য থেকে, শৌণকের দ্বাদশ বর্ষব্যাপী যজ্ঞে বৈশম্পায়ন বলছিলেন সেই উপাখ্যান। বৈশম্পায়ন শুনেছেন গুরু ব্যাসদেবের কাছে। ব্যাসদেব আদিতে ১০ হাজার শ্লোকের ‘জয়’ রচনা করেন। কালক্রমে তা বৃদ্ধি পেতে পেতে এক লক্ষ শ্লোকে পরিণত হয়। এই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য ছিল এমন — যদি বাল্মীকির রামায়ণ পাঠ করা হয়, তবে অনুধাবন করা যাবে যে তিনি এমন সকল জায়গার আদ্যোপান্ত চিত্র দিয়েছেন যে সব স্থানে তাঁর পদচিহ্ন পড়েনি। বাল্মীকি দক্ষিণ ভারত পার হয়ে সেতুযোগে রাবণের স্বর্ণলঙ্কায় পাঠালেন কাহিনির বহু চরিত্রকে, এমনকি সমুদ্র নিয়ে, তার গভীরতা নিয়েও বললেন নানা তত্ত্বকথা। কীভাবে সম্ভব হল? বাল্মীকি প্রথম জীবনে ছিলেন রত্নাকর দস্যু। ‘রত্নাকর’ হল রত্নখনি। তিনি লুণ্ঠন করেন। কী লুণ্ঠন করেন? রত্ন বা উত্তমধন। তা কি গল্প না আগম নাকি ঐতিহ্যসম্পদ! নারদ এলেন, যিনি আত্মজ্ঞান দেন, যিনি পিতৃগণকে জল দেন, তিনি আগম। দস্যু রত্নাকর তাঁর সংস্পর্শে এসে কবি হলেন। সব সম্পদ তিনি ফেরত দিলেন তাঁর মহাকাব্যে। “ব্রহ্মা বলে, তব নাম রত্নাকর ছিল। আজি হইতে তব নাম বাল্মীকি হইল।” বাল্মীকি পণ্যদ্রব্য অন্য দেশে নিয়ে এলেন, আমদানি করলেন। তিনি হলেন মহাকবি। তাঁর কবিত্বশক্তি দেশকাল অতিক্রম করে রামায়ণকে কথা থেকে একটি কালজয়ী মহাকাব্যে প্রতিষ্ঠা করল।

প্রবন্ধটি Autumn Annual: Bicentennial Issue (Vol XLVI 2017-18) of the Alumni Association of the Presidency University তে প্রকাশিত, এবং সাধারণ সম্পাদক, প্রেসিডেন্সি এলামনি এসোসিয়েশনের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...