আকুল মাছুয়ার
গত জানুয়ারির আঠেরো তারিখে সাতাত্তর বছর বয়সে চলে গেলেন দরবারি ঝুমুরের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী মিহিরলাল সিং দেও। তাঁকে নিয়ে আলাপ করলেন আকুল মাছুয়ার, যিনি নিজেও এক যশস্বী ঝুমুরিয়া। আকুল নিজে যথেষ্ট বয়োবৃদ্ধ ও শারীরিকভাবে অসুস্থ। তবু তাঁর শ্রদ্ধার মিহিরদাকে নিয়ে কিছু কথা শোনাতে আগ্রহের অভাব দেখাননি। আলাপের কালে আমাদের প্রান্তের স্বরটি ছিল সুদীপ সিনহার।
মিহিরলালকে নিয়ে আলাপের সময় প্লেয়ারে বাজছিল মিহিরেরই গান। আর, আকুলের কথা বলার ভঙ্গিটুকু অবিকৃতই থাক।
চার – মিহিরদা তো চলে গেলেন। ওঁর সঙ্গে একযোগে কাজ করার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে আপনার। কিছু যদি আমাদেরও জানান…
আকুল – মিহিরদা রাজপরিবারের মানুষ। রাজপরিবারের ঝুমুর এবং অন্য গানবাজনাও উনি ভালো জানতেন। ওনার সঙ্গে অনেকগুলো প্রোগ্রাম করেছিলাম আমরা। সরকারী প্রোগ্রাম। অনুষ্ঠান গেছিলাম। তারপরে পুরুলিয়া থেকে পাঠিয়েছিল সল্টলেকে। আমি ছিলাম, শলাবতদা ছিলেন, মিহিরবাবু ছিলেন আর ঝালদার এক ভদ্রলোক। আমরা ওখানে গেছিলাম প্রোগ্রামে। সেই সময় ওনার একটু শরীর ঠিক ছিল না।
চার — এটা কত সালের ঘটনা মনে আছে? কত বছর আগেকার ঘটনা?
আকুল — এই বছর চারেক আগে। তো বিভিন্ন পুরুলিয়ার ঝুমুরের বৈশিষ্ট্য কী? ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছিল। সেখানে আমরা ওখানে একটা বিভিন্ন জায়গার ঝুমুরের সুরের… পুরুলিয়া ডিস্ট্রিক্টের কী ধরনের… ঝালদা… মেদিনীপুর বিভিন্ন জায়গার থেকে… এবং সেইগুলা আমরা চারজন নিয়েছিলাম। ক্লাস একটা হতো। শলাবতবাবু, আমি, ঝালদার এক ভদ্রলোক, মিহিরদা। সেই সময় বলেছিলেন পাঁচ-সাত জনের একটা গ্রুপ করে একটা কাজের কথা। তো আমরা দেখলাম অনেক ঝামেলা। আমাদের যাকে একে ওখানে জড়ো করা মহা সমস্যা। তো তারপরে এলাম। তারপর একবার গেছিলাম ওই সাইডে… রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলীর নাতি… ওই যো প্রভাস মুখার্জী না ব্যানার্জী জানি না… উনি ঝুমুর… রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলীর ঝুমুর গাইতেন…
চার — বাঘমুন্ডিতে ছিলেন?
আকুল — না উনি চান্ডিলে।
চার — চান্ডিলে পাতকুমের ওখানে?
আকুল – পাতকুম, হ্যাঁ।
চার — তো উনি বাঘমুন্ডিতে এসে ছিলেন না? থাকতেন না এখানে?
আকুল — না। তো উনি, মিহিরদা আমরা গেছিলাম হাজারিবাগ সেই সময় এখানে তথ্য অফিস থেকে পাঠিয়েছিলেন। আমরা তিনজনেই গেছিলাম। আমি শলাবতবাবু, মিহিরদা আর ওই প্রভাতবাবু।
তো মিহিরবাবু অমায়িক লোক। গুণেও তো ভীষণ গুরুদেব লোক। উনি আমাকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন, খুব ভালোবাসতেন। তো আমরা একসঙ্গে অনেকগুলা প্রোগ্রাম করেছি… অনেক জায়গায় গেছি… এবং ওখানে এই যে শলাবতভাই আছেন… ওনার সঙ্গে যে ঝুমুরের আমাদের ইয়া ছিল… সিন্ধুবালা দেবী… ওনাকে নিয়েও অনেক জায়গায় প্রোগ্রাম করেছি আমরা… তখন ওই ২৪ পরগণা ওই সাইডে আমরা গেছিলাম তখন।
চার — আচ্ছা এই যে বললেন না যে উনি রাজপরিবারের লোক ছিলেন… তো উনি কোথাকার মানে রাজবাড়ি সেটা আপনার মনে আছে?
আকুল — ইচাগড়।
চার – ইচাগড়… মানে সেটা কি ঝাড়খণ্ডে পড়ছে? আচ্ছা, ওখানকার রাজবাড়ির লোক ছিলেন। তো ওনার যে ঝুমুরের যে গায়কি… আমি শুনেছি যে অনেকে ওনাকে বলেন ঝুমুরের ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য… এরকম একটা বলা হয়… বাংলা গানের ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে ওঁর গলার খুব মিল… তো সেটা আর কি… ওনার ঝুমুর নিয়ে যদি কিছু…
আকুল — উনি অরিজিনাল ঝুমুর গাইতেন। রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলীর ঝুমুর… অরিজিনাল সুর.. এখন তো বিভিন্ন সুরে বিভিন্ন যে যেমন করে গাইছে… তো দরবারী যে ঝুমুরটা উনি গাইতেন… ওনার গলার দরদ ছিল… উনি গানবাজনাও তো করেছেন… আর এমনি ঝুমুর হয়তো কেউ গাইছে… তাদের গান আর ওনার গানে তফাৎ ছিল।
চার — উনি দরবারী ঝুমুরটাই বেশি গাইতেন? ক্লাসিকাল ঝুমুর যেটা?
আকুল — হ্যাঁ.. হ্যাঁ..
চার — ঝুমুরকে ধরুন গোটা বিশ্বের কাছে যারা চিনিয়েছেন… যে কয়েকজন… তাদের প্রথম তিনজনের মধ্যে ওনার নাম থাকবে… তাই তো মনে করেন আপনি? মানে মিহিরবাবুর নাম?
আকুল – অবশ্যই।
চার — আর ঝুমুরের বিষয়ে মিহিরবাবুর একটা অসম্ভব অবদান সেটা আপনি সবসময় স্বীকার করেন।
আকুল — ভালো। আমরাও গাই… আমিও গাই নিজে ধরুন… তবু আমি নিজে বলছি যে উনি গুরুদেব লোক ছিলেন। মিহিরবাবু।
চার — তো মিহিরবাবুর যে এই আকস্মিক চলে যাওয়া.. এতে নিশ্চয়ই বিশাল একটা ক্ষতি হল?
আকুল – হ্যাঁ… কারণ আমি যত ক্যাসেট-ফ্যাসেট বাজাতাম… মিহিরবাবুর ক্যাসেট শুনে… কারণ ওনার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা থাকে… তো মিহিরবাবুর যে কোনখানে কতটুকু প্রয়োজন আর সে গলার কাজ… এগুলো সবার দ্বারা সম্ভব না…
চার — আচ্ছা। মানে আপনি বলছেন যে কোনখানে কতটুকু দিতে হবে সেটা উনি খুব ভালো জানতেন আর কি..
আকুল – হ্যাঁ… হ্যাঁ… আমি গাইতাম… উনি আমার কাছেও শিখেছিলেন দু’টো ঝুমুর। আমাকে বলত ভাই তুমি আমাকে এটা দাও, আমিও বলতাম আপনি আমাকে এটা দেন। আমার কাছ থেকে উনি নিয়েছিলেন।
চার — তো উনি গাইছেন আপনি বাঁশী বাজাচ্ছেন এরকম তো বহু প্রোগ্রাম হয়েছে? এই যে ধরুন উনি তো নিজেও বোধহয় প্রচুর ঝুমুর লিখেছিলেন? নাকি উনি সুর দিয়েছেন?
আকুল — না উনি লোকের ঝুমুর সুর দিয়ে গাইতেন। ওনার তো পাওয়া যায় না একটাও।
চার — আচ্ছা।
আকুল — আবার সেটা তো একটা খাতায় লিখেছিলেন। আর এখানে এসেছিলেন কলকাতা থেকে। বলল গম্ভীর সিং এর সাক্ষাৎকার একটা দরকার। উনি নিলেন। আর বলল সরকারের তরফ থেকে আমাকে পাঠিয়েছে। সেটা হচ্ছে সিন্ধুবালার আর আমার আর গম্ভীর। এই তিনজনের। তো প্রচুর লোক বাইরের লোক এলে তো সবাই এমন জায়গায় গাওয়ার তো কোনো ইয়া নেই। সবার জন্য আমরা আসিনি। আমরা এসেছি পদ্মশ্রী গম্ভীরবাবুর একটা সাক্ষাৎকার করার জন্য আমাদের পাঠিয়েছে। তো গম্ভীরদা করলেন এখানে।
চার – অনেক ধন্যবাদ আকুলদাদা। আপনি শারীরিক কষ্ট নিয়েও আমাদের সময় দিলেন, মিহিরবাবুর কাজ নিয়ে জানালেন এ জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
(এর পরে কথা চলেছিল আরও অনেক কিছু নিয়েই, যার মধ্যে ছিল মৃণাল সেনের ‘মৃগয়া’ ছবিতে ওঁর, মানে আকুলের, কাজের কথা, বাঘমুন্ডির কথা, আরও এটা-সেটা)
মাটির স্বর শুনতে পেলাম। মিহিরবাবুর কথা জানলাম। ভালো লাগল।