চাঁদের বুড়ো
একটি দৃশ্য থেকে আমার জন্ম। একটি দৃশ্য থেকেই আমার জন্ম… দুপুরবেলা এটুকু ভাবলাম। তারপর মনে হল, ভেবে তো বসে আছি। কিন্তু, দৃশ্যটি কী? একটি অসহ্য উজ্জ্বল চিত্রগোলক, যার ব্যাসার্ধ মেরেকেটে পাঁচ সেমি, বনবন করে ঘুরছে, তার গা’টা মাকড়সার জাল। তাকে মাথায় করে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মহম্মদ মোহান্ত। গান গাইছে– নিলামওয়ালা ছ’আনা। গাইতে গাইতে পেরিয়ে গেল আমাদের গ্রাম তোমাদের শহর বন্ধুদের কারখানা। তার পিছনে, ওই গোলকটিকে দেখার জন্য ছুটে ছুটে আসছে মানুষ। এ ওর পায়ে জড়িয়ে উলটে পড়ছে। তবু দৌড় থামাচ্ছে না। তারা ওটি নেবেই। আগে আগে চলেছে মহম্মদ সিং ও মোহান্ত বাহাদুর। তাদের চোখগুলো মিথ্যের মতো দূষিত আলোকবিন্দু গেঁথে গেঁথে তৈরি… অথবা, দুপুরের উপর নতুন ক্ষুর হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেঘ। জন্মে গেল স্বপ্নপ্রণেতা। স্বপ্নপ্রণেতার জন্ম হল। বাড়ি হল। নিয়তি হল। তারপর মৃত্যু হল। আমরা তখন তার নাম দিলাম স্বপ্নবিক্রেতা। যেহেতু সে স্বপ্নবিক্রেতা, তাই সে মালিক। অর্থাৎ, সে পৃথিবীর প্রত্যেক ঘরের বিছানার ওপর থেবড়ে বসে থাকা অমীমাংসিত বাপ। তা, সে হাঁটতে বেরোল। পথে পড়ল রাস্তার কৃমিমাংসটীকা। সে উপেক্ষা করে গিয়ে বসল একটি বটগাছের তলায়। গাছের তলার সামনে তখন কারখানার হাবা হল্লা। বটগাছের পাশে পাপহীন রহস্যগুল্ম। তাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে অমীমাংসিত বাবা শুনতে পেল, তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করছে– স্যার, আপনার মাথার মাঝখানটা ফুটো করে রক্ত খেয়ে নিল কোন বাঞ্চোত?… সমতলের বাতাস গায়ে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে কাক। তার মাথাটা শিকড়জড়ানো। কাক সমতলের বাতাসকে ডানায় নিয়ে চলে যাচ্ছে গডউইন অস্টিনের দিকে। ঠোঁটে করে বিকেল নিয়ে পালাচ্ছে। বিকেলের মধ্যে একটা চড়ুইপাখি… এগুলো বড় দৃশ্য। ছোটগুলো হল– দিন ও রাতের একসঙ্গে চলে যাওয়া… আমার শরীরের ভিতরের নর্দমা দিয়ে রক্ত-সংবহনের কালো ধারা। একটু দুর্গন্ধও পেলাম… দেখলাম যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরে আসা কালো সৈনিকটি পোস্টকার্ড লেখা শুরু করছে hello dear দিয়ে… তুষারখণ্ডের উপর দিয়ে মিছিল চলেছে। গায়ে সোয়েটার। হাতে মানুষের পতাকা… গঙ্গার হাওয়ায় বেঁকে যাওয়া নৌকার ভিতর প্রেম। নৌকার বাইরে থেকে নৌকার জন্য প্রেম… শহিদমিনারের সামনে গণিকার স্ট্যাচু। তার গায়ে নাক খুঁটে লাগাল কেউ। জুম করলে নাকের পোঁটাকে গান্ধীর মুখ বলে মনে হচ্ছে… বঁটিতে বাড়ি কেটে ফেলে একটা নদীর দু’ধারে বসিয়ে দিল কেউ… তারপর দেখলাম, একটা মোবাইল ফোন… আরেকটা মোবাইল ফোন… বাইশটা মোবাইল…
বুড়িকেই প্রশ্নটা করেছিলাম। বুড়িকেই বলে গেলাম এইসব কথা। আমার দিকে দীর্ঘক্ষণ ধরে চেয়ে থাকল সে। তারপর বলল– অনেকদিন বাদে মুড়িঘণ্ট করেছি। এসো, খেতে দিই…