কংক্রিট অরণ্যের পোস্টম্যান

সুনীল কর

 

বিধাননগরের সনি ওয়র্ল্ড বিপণির ঠিক সামনের ফুটপাথে হাত-কয়েক জায়গা জুড়ে সুনীলদার বইয়ের দোকান। অবশ্য শারীরিকভাবে পুরোদস্তুর দোকান বলতে যা বোঝায়, এটি তা নয়। একটি খাটো চৌকি, আর তার ওপর তিন-চারটি কাঠের সেল্ফ সাজিয়ে দুপুর থেকে সন্ধে আটটা-সাড়ে আটটা অবধি চলে এই পুস্তক-পসরা, আক্ষরিক অর্থে রোড শো। কিন্তু ওই সামান্য ভৌগোলিক পরিসরটুকু ছাপিয়ে ওঠে উষ্ণতায়, যখন কাজফেরতা পাঠক আটকে যান, আড্ডা জমে, হঠাৎ মনে পড়া বইটি কোনও জাদুবলে সেল্ফের ফাঁক থেকে বের করে আনেন সুনীলদা। ধুলো-ধোঁয়া-ট্রাফিক-চিৎকার ভর্তি ব্যস্ত উল্টোডাঙার মোড় সহসা এক নির্জন নিশ্চুপ অরণ্যের দরজা খুলে দেয়। চিন্তাশীল পাঠককে বেঁধে রাখার মতো গল্প-উপন্যাস, ইতিহাস, বিজ্ঞান, প্রবন্ধের বই, পত্র-পত্রিকা, লিটল ম্যাগ, অল্প কিছু ইংরেজি বই — মননশীল বইয়ের জরুরি সম্ভার মজুত রয়েছে এখানে। পছন্দের বই না থাকলে, অর্ডার দিলে, সুনীলদা দু-একদিনের মধ্যেই তা সংগ্রহ করে এনে দেন। এবং খুব সামান্য লাভ রেখে প্রতিটি বই বিশ শতাংশ ছাড় দিয়ে বিক্রি করেন। এই পরিমাণ ছাড় অধিকাংশ ক্ষেত্রে কলেজ স্ট্রিটেও পাওয়া যায় না। ব্যক্তিগতভাবে বিধাননগরে আমার নিজের কর্মজীবন শুরু হওয়ার পর থেকে এমন দিন খুব কমই গেছে, যেদিন বাড়ির ফেরার পথে একবার অন্তত এই দোকানে ঢুঁ মারিনি। তেমনই একদিনের অভিজ্ঞতা: সুনীলদার দোকানে দাঁড়িয়ে পছন্দমতো একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছি, হঠাৎ পাশ থেকে গম্ভীর ও মার্জিত স্বর কানে এল, ‘সুনীলবাবু, আমার বইটা পেয়েছিলেন কি?’ এই ঋজু কণ্ঠস্বরের মালিকের দিকে চোখ তুলে না তাকিয়ে উপায় ছিল না, দেখলাম বরাত দেওয়া কোনও এক বই মৃদু হেসে হাতে তুলে দিচ্ছেন সুনীলদা, যার হাতে তুলে দিচ্ছেন তিনি শঙ্খ ঘোষ। 

যাই হোক, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম মনে করে বাংলা বইয়ের বাজারে সুনীলদার মতো প্রান্তিক বিক্রেতারাও খুব গুরুত্ববহ এক ভূমিকা পালন করেন। তাই ওঁর অভিজ্ঞতা বৃহত্তর পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেবার উদ্দেশ্যে বসন্ত বিকেলে সুনীলদার সঙ্গে দু-ভাঁড় চা-সহযোগে এক নিবিড় আলাপচারিতায় বসা গেল।  

——————————-

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম – নমস্কার সুনীলদা। আপনি তো আমাদের আজকের এই সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য জানেন। তাই কথাবার্তা শুরু করা যাক। আপনি প্রথমে নিজের সম্বন্ধে অল্প কিছু বলুন। আপনার পরিচয়, বাড়িঘর, কোথায় বড় হলেন, পড়াশুনো এইসব আর কি।

সুনীলদা – নমস্কার। আমার নাম সুনীল কর। আমরা চার ভাই দুই বোন। আমি ও আমার ভাই গোপীনাথ দু’জনে মিলে এই ব্যবসা চালাই। আমাদের লেক টাউনে একটা খবরের কাগজের দোকান আছে। সকালে সেখানে থাকি। দুপুরের পর এখানে এসে এই বইয়ের দোকান খুলি।

চার নম্বর – আপনার বাড়ি কোথায়, সুনীলদা? লেক টাউনেই?

সুনীলদা – না না, আমার বাড়ি হাতিয়ারা। বাগুইহাটি থেকে একটু ভেতরে।

চার নম্বর – আপনারা কি বরাবর এখানকারই বাসিন্দা? মানে মেসোমশাইয়ের সময় থেকেই…

সুনীলদা – না, আমাদের আদি বাড়ি বর্ধমান জেলায়। আমার বাবা ছিলেন সোনা রূপার কারিগর। পঞ্চাশের দশক থেকে বাবার দোকানের অবস্থা পড়তে শুরু করে। মা আমাদের নিয়ে এখানে চলে আসেন। এতগুলো ভাই বোন আমাদের, তখন প্রবল দারিদ্র্য। মা ঐ সময় প্রচুর কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন। আমি বড় ভাই, আমার পরের জন, আমরা নানা কাজে লেগে পড়ি। আমি বেশিদূর পড়তে পারিনি, ক্লাস এইট অবধি পড়েছি। তখন একটা কাজ জুটিয়ে সংসারের পাশে দাঁড়ানোটাই ছিল উদ্দেশ্য। আমার ভাই অবশ্য বি কম পাশ করেছে। আজ অবশ্য প্রত্যেকেই দাঁড়িয়ে গেছে। বাবা আগেই মারা গিয়েছিলেন। কয়েকমাস হল মা চলে গেলেন, আপনি জানেন তো..

চার নম্বর – হ্যাঁ, জানি। এই তো গত বছরই মাসিমা চলে গেলেন। আচ্ছা সুনীলদা, প্রথমেই কি এই দোকানখানা করলেন? মানে আপনার এই বইয়ের দোকানের বয়স কত?

সুনীলদা – আমার এই দোকান তিরিশ বছরের। তার আগে আমি অবিশ্যি কলেজ স্ট্রিটে একটা বইয়ের দোকানে কাজ করতাম। দত্ত এণ্ড কোম্পানি। এখন যেখানে মনীষা তার ঠিক উল্টোদিকে ছিল। ওখানে পাঁচ বছর কাজ করেছি।

চার নম্বর – কী ধরণের বই ছাপাতেন ওরা? 

সুনীলদা – ওরা ছিলেন রাশিয়ান বইয়ের ডিস্ট্রিবিউটর। বাংলায় ইংরেজিতে গাদা গাদা রাশিয়ান বই বিক্রি হত তখন। প্রগতি প্রকাশন। ভস্তক। সেইসব বইপত্র নিয়ে আমি জেলায় জেলায় গেছি। খুব কম দাম আর এত ভালো প্রোডাকশন। মানুষ সেইসব বই প্রচুর কিনতেন। 

চার নম্বর – আচ্ছা, সুনীলদা, ঐ বইগুলোই কি পরবর্তীকালে আপনি কী ধরণের বই বেচবেন তার ধাঁচ কিছুটা ঠিক করে দেয়? আপনার এখানে যে রাজনৈতিক বইগুলি থাকে, তা কিন্তু বেশিরভাগটাই প্রগতিশীল ও বামপন্থা-ঘেঁষা…!

সুনীলদা – তা বলতে পারি না। আদর্শগত ভালো লাগা তো ছিলই। তবে একথা ঠিক প্রচুর বামপন্থী মানুষ আমার দোকানের বইয়ের পাঠক। অভী মজুমদার, বিজ্ঞানী… যিনি মারা গেলেন, আমার কাছ থেকে বই কিনতেন। বামপন্থীরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন প্রচুর ছোটখাটো লাইব্রেরিতে আমি বই দিয়েছি। অবশ্য শ্রী পূর্ণেন্দু বসু, যিনি এখন শাসকদলের নেতা ও মন্ত্রী, তিনিও একসময় নিয়মিত আমার কাছ থেকে বই কিনতেন, প্রচুর বই পড়তেন।

চার নম্বর – দত্ত এন্ড কোম্পানির সেই চাকরিটা ছাড়লেন কেন? 

সুনীলদা – সোভিয়েত জমানার শেষের দিকে ওই সমস্ত বইয়ের সাপ্লাই কমে এল। বাজারও কিছুটা পড়ে গেল। তাছাড়া আমি নিজেও ভাবছিলাম এবার একটা অন্য কিছু করা দরকার। সব মিলিয়ে…।

চার নম্বর – আচ্ছা, আপনি যখন এই দোকান খুললেন, মানে তিরিশ বছর আগে… সেই সময়টার কথা একটু বলুন। তখন বিধাননগরের এই অংশটা কেমন ছিল? পাঠকের সংখ্যা কেমন ছিল?

সুনীলদা – তিরিশ বছর আগে তো আর সনি ছিল না। এখানে অন্য একটা বাড়ি ছিল। আমি ফুটপাথের অন্যদিকে বসতাম। এখনও যেমন ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আমার দোকান, তখনও তাই ছিল। একসময় অবশ্য সবদিন রাস্তার আলো জ্বলত না, সেইসব দিনের জন্য বালবের ব্যবস্থা থাকত। তখন অবশ্য বিধাননগরে এমন ওয়ান ওয়ে ছিল না, ডিভাইডারও ছিল না, রাস্তার ওপাশের মানুষ এপাশে আসতে পারতেন। তখনও বিধাননগরে প্রচুর সরকারি অফিস ছিল। লোকজন অফিসফেরতা আমার কাছ থেকে বইপত্র কিনতেন।

চার নম্বর – তখনও আপনি একইরকমভাবে কলেজ স্ট্রিট থেকে ঘাড়ে করে বই নিয়ে আসতেন? বিশ শতাংশ ছাড় দিতেন?

সুনীলদা – হ্যাঁ, বিশ শতাংশ ছাড়ের ব্যাপারটা প্রথম থেকেই ছিল। অবশ্য কিছু ম্যাগাজিন, যেগুলোতে আমি নিজেই কম মার্জিন পাই, সেখানে বিশ শতাংশ দিতে পারি না। এছাড়া আজ যা দেখছেন, কিছুটা অন্য ধারার বই, অফ বিট আর এই বিশ শতাংশ ছাড় — এই ব্যাপারটা আমি আগাগোড়া বজায় রেখেছি। তার জন্য অবশ্য শুরু শুরুতে ঝামেলাও পোয়াতে হয়েছে…।

চার নম্বর – ঝামেলা? কীরকম?

সুনীলদা – যেমন ধরুন, শিয়ালদায় একজন ছিলেন। আমার মতোই বই বিক্রি করতেন। তিনি পাঠক মারফত খবর পেয়েছিলেন যে আমি কুড়ি শতাংশ ছাড় দিই। উনি অনেক কম দিতেন। তা একদিন আমার ওপর এসে চড়াও হলেন। আমি নাকি বাজার খারাপ করছি। ওর কাস্টমার ভাঙিয়ে নিচ্ছি। আমাকে দোকান করতে দেবেন না এইসব। যা হোক, শেষ পর্যন্ত অবশ্য কিছুই করে উঠতে পারেননি। আমিও ভয় পেয়ে দোকান বন্ধ করে দিইনি।

চার নম্বর – আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো! এখানে দোকান করার জন্য আপনাকে কোনওদিন টাকা দিতে হয়েছিল? মানে তোলাবাজি, জুলুম… এইসব?

সুনীলদা – না, সেইসব কোনওদিন দিতে হয়নি। আমি যখন দোকান করেছিলাম, তখন বামফ্রন্ট আমল। তখনও কিছু দিতে হয়নি, আজও কিছু দিতে হয় না। শুধু আমরা সবাই মিলে একটা চাঁদা দিই ব্যবসায়ী সমিতিতে, সামান্যই, বছরের পুজোর চাঁদারর ঝামেলাগুলো সমিতিই সামলায়। এছাড়া কাউকে কোনও টাকাপয়সা দিতে হয়নি আজ অবধি।

চার নম্বর – বেশ। আচ্ছা, সুনীলদা, আপনি তো বরাবরই একটু অফ বিট বই রাখেন, তাই না? এই যে এই মুহূর্তে যেমন আমাদের সামনে রয়েছে জর্জ গ্যামোর ‘ওয়ান, টু, থ্রি… ইনফিনিটি’, আবার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বাজার সফর সমগ্র’, তেমনি রয়েছে প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের চিঠিপত্রের সংকলন, এমনকি ‘দ্য হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস’-এর একটা ঝকঝকে নতুন অনুবাদ। এই পছন্দগুলো আপনি ঠিক কীভাবে করেন? মানে আমি বলতে চাইছি আপনি কীভাবে সিদ্ধান্ত নেন যে কলেজ স্ট্রিট থেকে এইসব বই-ই আনবেন?

সুনীলদা – প্রথমত অভিজ্ঞতা। এতদিন ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে থাকার পর এবং আমার পাঠকদের পছন্দ মোটামুটিভাবে জানার পর আমার তেমন কোনও অসুবিধে হয় না। নতুন বইয়ের খবর পেলে বা একটু নেড়েচেড়ে আমি বুঝতে পারি বইটি আগ্রহ তৈরি করবে কিনা। এছাড়াও পাঠক আমার কাছে অনেক বই আনতে দেন। সেগুলি এই খাতায় লিখে রাখি ও নিয়ে আসি। তার মধ্যে কোনও বইয়ের বিক্রি বেশি হলে, আরও কিছু কপি নিয়ে আসি। আর যেহেতু আমাদের খবরের কাগজের ব্যবসা, সপ্তাহে বইয়ের রিভিউ ও খবরাখবরের দিকে নজর রাখি। সাধারণত, গত সপ্তাহে বড় কাগজে রিভিউ হয়েছে এমন সব বইয়ের অন্তত এক কপি নিয়ে আসার চেষ্টা করি। কারণ পাঠকও গত সপ্তাহে সেই রিভিউগুলো পড়েছেন।

চার নম্বর – আচ্ছা, বুঝলাম। সুনীলদা, এই তিরিশ বছরে বাংলা বইয়ের পাঠক কতটা বদলেছে? আপনার ব্যবসা তুলনামূলকভাবে কেমন চলছে, আগে ভালো চলত না কি এখন বেশি ভালো চলছে?

সুনীলদা – ভালো চলছে তা বলতে পারি না। টিকে আছি। লড়াই করছি।

চার নম্বর – এমন বলছেন কেন? পাঠকের সংখ্যা মানে আপনার ক্রেতার সংখ্যা কি কমেছে?

সুনীলদা – পাঠকের সংখ্যা কমছে তা ঠিক বলা যাবে না। তবে আপনার বয়সী মানে যারা তরুণ পাঠকপাঠিকা তাঁদের আগের মতো সংখ্যায় পাচ্ছি না। আগে প্রচুর তরুণ নবীন পাঠক আমার কাছ থেকে বই কিনতেন, তাঁদের বয়স বেড়েছে, অনেকে রিটায়ার করে গেছেন। তাঁদের অনেকের ইচ্ছে থাকলেও তাঁরা আর বিধাননগরে এসে আমার কাছে বই কিনতে আসবেন না। কিন্তু তাঁদের পরের প্রজন্মকে আর সেভাবে বই কিনতে দেখছি না। অন্তত আমার কাছ থেকে কিনছেন না। হতে পারে তাঁরা অনলাইনে কিনছেন, আমার কাছে আসার দরকার পড়ছে না, ইন্টারনেটে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা বইও এখন প্রচুর পাওয়া যায় শুনেছি…। এছাড়া বাঙালির উৎসব-অনুষ্ঠানে যে বই উপহার দেবার চল ছিল, সে তো একেবারে উঠেই গেছে। তাছাড়া আমার নিজেরও কিছু সমস্যা আছে। আমাকে আগে টাকা দিয়ে বইপাড়া থেকে বই কিনে নিয়ে আসতে হয়। এখন বাংলা বইয়ের প্রোডাকশন অনেক ভালো হয়েছে, আগে হাতে গোনা কয়েকটা বড় হাউস ছিল, এখন প্রচুর নতুন ভালো ভালো প্রকাশক এসেছেন, গাঙচিল তো দেখতে দেখতে পুরনো হয়ে গেল…. এছাড়াও সহজ পাঠ, তালপাতা, চর্চাপদ, নিষাদ আরও কত নাম। বইয়ের দামও বাড়ছে। আমার ইচ্ছে থাকলেও অনেক বই আনতে পারি না। আরও স্টক বাড়াতে পারলে আরও বেশি পাঠককে সার্ভিস দেওয়া যেত নিশ্চয়ই। কিন্তু আমার জায়গার সমস্যা… পুঁজিও খুব অল্প..।

চার নম্বর – অনেক ধন্যবাদ, সুনীলদা। আরও অনেক কথাই হয়তো অজানা রয়ে গেল। তবে একটা কথাই আপনাকে বলবার, আপনি ও আপনার মতো বিক্রেতারা হয়তো এইরকম হাজার সমস্যা সত্ত্বেও নিজেদের অজান্তেই পাঠকের রুচি নির্মাণ করে চলেছেন, বাংলা বইয়ের সেবা করে চলেছেন, এটা একদম সামান্য ব্যাপার নয়। ভালো থাকবেন। আপনার সঙ্গে প্রায় রোজই দেখা হবে আমার। আর আমাদের কথাবার্তা চলতেই থাকবে…।

সুনীলদা –  নিশ্চয়ই। কথা হতেই থাকবে। আর আপনি কোন বইটা যেন আনতে বলেছিলেন….?

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...