মণীন্দ্র গুপ্ত
রচনাটি ‘তাঁতঘর একুশ শতক’ পত্রিকায় ২০০৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়, এবং পরে মণীন্দ্র গুপ্তের ‘জনমানুষ ও বনমানুষ’ বইতে সংকলিত হয়।
উনিশ শতকের শেষার্ধ ও বিশ শতকের প্রথমার্ধ মিলিয়ে প্রায় শখানেক বছর আর্যাবর্ত জুড়ে বাঙালিরা যেমন বইয়ের ব্যবসা করেছিল এমন আর কেউ করেনি৷ একটা সময় ছিল যখন অবিভক্ত বাংলাদেশ, অসম, এমনকি মায়ানমার ও শ্রীলংকার ছেলেমেয়েরা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে৷ বাংলা অসম ৰিহাব় উড়িষ্যা তো বটেই, বাংলা ভাষা ও বাংলা বইয়ের বাজার আমাদের যৌবনেও ছড়ানো দেখেছি লাহোর-রাওয়ালপিন্ডি-পেশোয়ার পর্যন্ত। বিখ়্যাত বটতলার প্রকাশকেরা নিজেদের বই বিক্রির নানা রকম কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন৷ কালক্রমে বটতলার পাশাপাশি অভিজাত, সুরুচিসম্পন্ন প্রকাশনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কলেজ স্ট্রিটকে কেন্দ্ৰ করে একটা বড় অঞ্চল বহুদিন ধরে বই প্রস্তুত ও বই বিক্রির ব্যবসায়ে জড়িয়ে আছে৷ নমুনা-তথ্য হিসেবে তখনকার বইব্যবসার মূলস্রোতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম এখানে জানিয়ে রাখি — গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স, বসুমতী সাহিত্য মন্দির, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স, ডি এম লাইব্রেরি, প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি, বিশ্বভারতী, শ্রীগুরু লাইব্রেরি, ইণ্ডিয়ান অ্যাস্যোসিয়েটেড প্রেস, বিদ্যোদয় লাইব্রেরি, শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেস, ভারতী লাইব্রেরি, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স ইত্যাদি৷ এই প্রকাশনার বিস্তৃত খবর পাওয়া যাবে তখনকার বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে যে তিনটি মাসিক পত্রিক়া আসত সেই প্রবাসী, ভারতবর্ষ ও মাসিক বসুমতী থেকে। এই পত্রিকাগুলির মলাট খুলে প্রথমেই, পাঠ্যবস্তু শুরু হবার আগেই, দেখা যেত একগোছা ফ্লাই লিফ জুড়ে অজস্র বইয়ের বিজ্ঞাপন।
ভারতবর্ষের প্রধান বিজ্ঞাপনদাতা ছিল গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যাণ্ড সনস। গুরুদাসদের অজস্র বই এবং তাদের প্রধান গ্রন্থকার ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্র, প্রবোধ সান্যাল, রবীন্দ্রনাথ মৈত্র, আশালতা সিংহ, নরেশ্চন্দ্র সেনগুপ্ত, জগদীশ গুপ্ত, কেশবচন্দ্র গুপ্ত, অনুরূপা দেবী, চণ্ডীচরণ সেন, জলধর সেন, দিলীপকুমাব় রায়, শৈলবালা ঘোষজায়া, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র সেন, চরণদাস ঘোষ, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, কালিদাস রায় এবং আরও কত অজস্র লেখক ভারতবর্ষ পত্রিকার তথা গুরুদাস-প্রকাশনার।
মাসিক বসুমতী ও বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের স্বত্বাধিকারী ছিলেন সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের প্রকাশিত যাবতীয় বইয়ের বিজ্ঞাপন থাকত মাসিক বসুমতীতে৷
প্রকাশনার জগতে বসুমতীর একটি বিরল কৃতিত্ব ছিল — তাদের দাক্ষিণ্যেই আমরা এই সেদিন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক বইগুলি এবং পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য অনুবাদ অভাবিত কম দামে পড়তে পেয়েছি৷ বসুমতীর নিজস্ব বই কম ছিল — তারা অন্যের বই সস্তায় প্রকাশ করে আপামর পাঠকের কাছে সাহিত্যের পৌঁছবার রাস্তা সহজ করে দিয়েছিল৷ আমরা ছেলেবেলায় বঙ্কিম গ্রন্থাবলী, শরৎ গ্রন্থাবলী বসুমতী সংস্করণেই পড়েছি৷ কত যে বই, কত যে বিচিত্র বই ছিল তাদের — শেক্সপীয়র গ্রন্থাবলী, কালিদাস গ্রন্থাবলী, ভারতচন্দ্রের গ্রন্থাবলী, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের গ্রন্থাবলী, সৎসাহিত্য গ্রন্থাবলী, কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত, তুলসীদাসের রামচরিত মানসের মূল ও বঙ্গানুবাদ। এবং তাছাড়াও দীনেন্দ্রকুমার রায়, জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, এবং আরও কত যে নামী-অনামী লেখকের গ্রন্থাবলী তাদের ছিল তার ইয়ত্তা নেই। এদের গ্রন্থাবলী সিরিজের বইগুলি ছিল পেপার-ব্যাক, সস্তা কাগজের, কিন্তু ছাপাটি স্পষ্ট৷ অনেক কাল আগেকার কথা, এখন আর অত খুঁটিনাটি মনে নেই, তবে এখনও স্মরণে আছে মধুসূদন দত্তের এক খণ্ডে সম্পূর্ণ গ্রন্থাবলী আমরা কিনেছিলাম এক টাকা চার আনায়।
প্ৰবাসীর সর্বপ্রধান লেখক ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্ৰবাসীর প্রায় প্রত্যেক সংখ্যাই রবীন্দ্রনাথের একাধিক কবিতা দিয়ে শুরু হত৷ তাছাড়া তার গদ্যেরও সিংহভাগ প্রবাসীতেই বেরোত।
প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ধর্মান্তরিত ব্রাহ্ম, রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ও বন্ধু, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচিন্তায় উদার ও আধুনিক; মনোধর্মে তিনি কিন্তু সাহিত্যিক ছিলেন না, ছিলেন সাংবাদিক। এই বৈশিষ্ট্যগুলি প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর প্রবাসী সম্পাদনায়। বন্ধ হয়ে যাওয়া ভারতীর লেখকেরা, ব্রাহ্মভাবাপন্ন লেখকেরা, বিশ্বভারতীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লেখকেরা অনেকেই প্রবাসীতে লিখতেন। অবনীন্দ্র-প্রবর্তিত নব্যবঙ্গীয় চিত্রকলা বা বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট একটা বড় মঞ্চ পেয়েছিল প্ৰবাসীতে এবং মডার্ন রিভিউতে। অবনীন্দ্রনাথের ভারতশিল্পের বিষয়ে প্রবন্ধ ‘মূর্তি’, নন্দলাল এবং বেঙ্কটাপ্পার চিত্রণ সহ ১৩২০ বঙ্গাব্দের পৌষ ও মাঘ সংখ্যার প্রবাসীতে বেরিয়েছিল। সেই লেখাই অনুদিত হয়ে মর্ডান রিভিউতে বেরোল সাম নোটস অন ইণ্ডিয়ান আর্টিস্টিক অ্যানাটমি নামে। এবং সেই অনুবাদ ১৯১৪ সালে চিত্রিত পুস্তিকা হয়ে বেরোল দি ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট থেকে। এসবই আজ ইতিহাস।
প্রবাসী এবং মর্ডান রিভিউর প্রত্যেক সংখ্যায় নব্যবঙ্গীয় চিত্রীদের আঁকা তিনটি করে বহুবর্ণ ছবির প্রতিলিপি থাকত। পরে, ষোলোখানা করে সেই ছবি নিয়ে প্রবাসী কার্যালয় চ্যাটার্জিস পিকচার অ্যালবাম নামে একটি সিরিজ প্রকাশ করেছিল। রামানন্দ-সম্পাদিত কৃত্তিবাসী রামায়ণের ছবিগুলিও ছিল নন্দলাল বসু প্রমুখের আঁকা। সত্যি কথা বলতে কী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ঐরকম সক্রিয় সহায়তা না পেলে নব্যবঙ্গীয় চিত্রকলা এত দ্রুত এবং এমন সফলভাবে আমাদের সামনে আসতে পারত না।
পত্রিকাণ্ডলির কথা এত যে সবিস্তারে বললাম তার কারণ চিরকালই সাময়িক পত্রগুলি ছিল আমাদের আধুনিক সাহিত্যের ঢেঁকিঘর, রান্নাঘর ও আঁতুড়ঘর। এখানে যা ছাপা হত প্রধানত তা থেকেই বাছবিচার করে নিয়ে প্রকাশকেরা বই বার করে ব্যবসা করতেন।
বই নিয়ে ব্যবসার কথা যখন উঠলই তখন বলি, তখনকার ঐ কাগজগুলি কিন্তু সাহিত্যনিষ্ঠ হয়েও অব্যবসায়িক ছিল না।
কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই কোনও গূঢ় সাহিত্যিক নিয়মে কালে কালে বিযয়বুদ্ধিহীন লেখকের জন্ম হয় — মৌলিক চিন্তাভাবনা ও প্রকরণপদ্ধতির জন্যে তাঁদের একলা পথ যেতে হয়। তারা নিজস্ব স্বপ্ন ও সাধনা নিয়ে নতুন নিজস্ব কাগজ বার করেন, অভাবিতপূর্ব লেখা নিয়ে নিজস্ব প্রকাশনালয় খোলেন। অর্থকরী, সফলতাপূর্ণ প্রকাশনার পাশাপাশি অনেক আশা নিয়ে এইসব সমম্ভেরাল প্রকাশনা শুরু হয়, চলতেও থাকে, সাহিত্যের পথে একটা গতি সঞ্চার করে তারপর একদিন নিস্তেজ হয়ে যায়। বড় ইন্ডাস্ট্রির পাশে এ যেন কুটিরশিল্প। এইসব সমান্তরাল প্রকাশনার কোনওটিতে ছিল অসীম সম্ভাবনা, কোনওটিতে ছিল কুঁড়িতেই ঝরে যাবার আশংকা তবু এই নিত্যধারা চলতেই থাকে।
বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় যখন রবীন্দ্রনাথের বই দিয়ে প্রথম শুরু হয়েছিল তখন তারও ছিল ঐ সমান্তরাল প্রকাশনার অবস্থা। সাধারণ হলদে কাগজের মলাট, তাতে রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরে বইয়ের নাম ব্লক অতি নিরলংকারভাবে ছাপা। দামও যথাসম্ভব কম। পরে অবশ্য শৌখিনভাবে কয়েকটি বই জাপানী ধরনে বেঁধে বা তসরের কাপড়ে শক্ত বাঁধাই করে শোভন সংস্করণ বেরিয়েছিল। তবু সব মিলিয়ে কত কপি বিক্রি হত সেইসব বই?
বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগকে যে আমি সমান্তরাল প্রকাশনার মধ্যে আনছি তা অকারণে নয়, এতদিন তারা যতই বাণিজ্য করে থাকুক না কেন, এখন রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থস্বত্ত্ব চলে যাবার পরে তাদের অবস্থা অতি দ্রুত শোচনীয় হয়ে পড়বে। সময়ে সাবধান না হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশন বিভাগের মতো তাদের গুদামও চলাচলহীন কিছু অতি পুরনো মুদ্রিত ফর্মায় ভরে উঠবে।
বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের দৃষ্টান্ত থেকেই বুঝছি, সফল সমান্তরাল প্রকাশনা তৈরি হয় এক বা একাধিক অপরিহার্য লেখককে কুক্ষিগত এবং প্রকাশিত করে।
এরকম প্রকাশনের নিখুঁত একটি নমুনা হল কথামৃত ভবন। শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, পাঁচ খণ্ডের গ্রন্থস্বত্ত্ব উদ্বোধন বা বেলুড় মঠকে না দিয়ে লেখক মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত বা শ্রীম সে-অধিকার আপন উত্তরাধিকারীদেরই দিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে ঐ পাঁচ খণ্ড বই নিয়ে কথামৃত ভবন পায় একশো বছরের কাছাকাছি একচেটিয়া ব্যবসা করেছে। গ্রন্থস্বত্ত্ব হারাবার পরে প্রকাশক হিসেবে এদের কোনও গুরুত্বই রইল না। অনট্র্যাপ্যানার হিসেবে নিজস্ব যোগ্যতার চেয়ে তাদের প্রতিষ্ঠা বেশি নির্ভরশীল ছিল রামকৃষ্ণ কথার চিরস্থায়ী চাহিদার উপর।
এদের পরে আছে আরেক রকমের সমান্তরাল প্রকাশনা, যেখানে পাণ্ডুলিপিগুলি বেছে নেবার পেছনে থাকে নিজস্ব পছন্দ ও আদর্শ, এবং বিশেষ বিষয়ের উপর প্রীতি ও কর্তব্যবোধ।
এই যথার্থ সমান্তরাল প্রকাশনাগুলির কাজের পিছনে সর্বদইি থাকতেন অন্তত একজন প্রাণপুরুষ। এই উদ্যোগগুলি কখনওই নেহাত মুনাফামুখী হতে পারত না কেননা শখ, ভালোবাসা, ইচ্ছে ও স্বপ্নের আবেগ এখানে উচ্ছলভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার — অর্থের অনটন, উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব, অব্যবসায়িক বুদ্ধি ইত্যাদি সত্ত্বেও এই প্রকাশনাগুলি বইয়ের নির্মাণে নতুন স্টাইল এনেছে, নিজেদের আদর্শ ও বিশ্বাস অনুযায়ী বইয়ের নতুন বিষয় নির্ধারণ করেছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলে এদের চরিত্র এবং কৃতিত্ব বোঝা সহজ হবে।
ধরা যাক কবিতাভবন বা বর্মণ পাবলিশিং হাউস বা পূৰ্বাশা বা অধুনা বা উৎস মানুষ প্রকাশনার কথা।
বুদ্ধদেব বসু তাঁর পত্রিকাটির নামেই বাসস্থানের নাম কবিতাভবন রেখেছিলেন। সেখানে তিনি ধীরে ধীরে ঐ নামেই একটি প্রকাশনাও গড়ে তোলেন। স্বভাবে-চরিত্রে কবিতাভবন ছিল সত্যিকারের সমান্তরাল প্রকাশনা। কবিতাভবন থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই বিখ্যাত ‘এক পয়সার একটি’ কবিতা-গ্রন্থমালা প্রকাশিত হয়েছিল। চার আনা দামে এক ফর্মার চটি বইগুলি অত্যন্ত নিরলংকার ও সুদৃশ্য ছিল। ঐ সিরিজে আমরা জীবানন্দ দাশের বনলতা সেন, অমিয় চক্রবর্তীর মাটির দেয়াল, অশোকবিজয় রাহার ভানুমতীর মাঠ ইত্যাদি অসামান্য বইগুলি পেয়েছিলাম।
বর্মণ পাবলিশিং হাউসের প্রতিষ্ঠাতা রেবতীমোহন বর্মণ ছিলেন প্রথম যুগের কমিউনিস্ট। মার্ক্সবাদী বই প্রকাশের উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমে ঢাকায় গণসাহিত্যচক্র নামে একটি প্রকাশনা এবং পরে কলকাতায় বর্মণ পাবলিশিং হাউস স্থাপন করেছিলেন। মুজাফফর আহমদের দেওয়া তথ্যে জানা যায় ন্যাশনাল বুক এজেন্সি স্থাপনের পিছনেও রেবতী বর্মণ সক্রিয় ছিলেন। বাংলা ভাষায় কমিউনিস্ট সাহিত্য সৃষ্টির প্রথম যুগে মার্ক্স, লেনিন, রুশ বিপ্লব, কৃষক ও জমিদার, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, সমাজের বিকাশ ইত্যাদি বিষয়ে বই লিখে বর্মণ পাবলিশিং থেকে নিজেই প্রকাশ করে তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ এবং সমাজবাদে শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছিলেন।
আতাউর রহমান ও দিলীপকুমার গুপ্ত তাঁদের প্রকাশন সংস্থার নাম রেখেছিলেন গুপ্ত রহমান অ্যান্ড গুপ্ত। জীবনানন্দ দাশের সাতটি তারার তিমির-এর প্রথম প্রকাশ সেই প্রকাশন থেকেই হয়েছিল।
পূৰ্বাশার সম্পাদনা ছাড়াও সঞ্জয় ভট্টাচার্য চর্চা করতেন সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদির। পূৰ্বাশা থেকে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তানায়কদের উপরে একটি গ্রন্থমালা প্রকাশের উদ্যোগ করেছিলেন। মনে আছে, ডারুইন, মার্ক্স ও ফ্রয়েডকে নিয়ে তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছিল।
‘উৎস মানুষ’ সংস্থার প্রগতিশীল, কল্যাণবুদ্ধিসম্পন্ন কাজকর্মের কথা অনেকেই জানেন। তাঁদের চর্চার বিষয়কে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য তারা বেশ কিছু বই ও পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন।
গল্প কবিতার সম্পাদক কৃষ্ণগোপাল মল্পিকের মাথায় বই বানাবার অনেক পরিকল্পনা ছিল। নরম মলাটে, আকর্ষক প্ৰচ্ছদে, ক্রাঊন মাপের কিছু বই বার করে উনি বাংলা সমান্তরাল প্রকাশনার জগতে একটা ঝকঝকে মসৃণ নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছিলেন। অসীম রায়ের গল্প, তুষার রায়ের শেষ নৌকা, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সমবেত প্ৰতিদ্বন্দ্বী, অমিতাভ দাশগুপ্ত সংকলিত কবিতার পুরুষ কৃষ্ণগোপালের অধুনা প্রকাশনের শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত।
যত দিন যাচ্ছে, সমান্তরাল প্রকাশনার সংখ্যা ও বৈচিত্র্য তত বেড়ে উঠছে। ছোট কাগজের সম্পাদকেরা কাগজ করে করে ক্রমশ ছাপা এবং প্রোডাকশনের কাজে পারদর্শী হয়ে উঠছেন। একসময় তাঁরাই তাঁদের প্রসারিত কাজকর্ম হিসেবে নিজেদের বইপত্র প্রকাশ করে, বইব্যবসার মূল প্রকাশনার পাশাপাশি অতি অকিঞ্চিৎকরভাবে হলেও, সমান্তরাল প্রকাশনার পত্তন করেন।
শরীর-মনের অভ্যাস, রুচি, প্রবৃত্তি এবং গূঢ় প্রয়োজন অনেক সময় এক দল মানুষকে মানুষের মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এই বিচ্ছিন্ন থাকা মানুষেরা নিজেদের কথা বলার জন্যে নিজস্ব বইপত্র প্রকাশের তাগিদ অনুভব করতে পারে। ইস্কোয়্যার, প্লেবয় যদি বেরুতে পারে তবে ফোর্মিনা, ইভস উইকলি-ই বা বেরুবে না কেন? যদিও এগুলি ব্যবসাদারদের করা তবু মেয়েদের নিজস্ব আন্দোলনের নিখাদ কাগজও তো আছে৷ সম্প্রতি দেখছি স্ত্রী নামক একটি প্রকাশনা — আমরা আশা করতে পারি এই রকম প্রকাশনা থেকে নারীদের কিছু বিশিষ্ট বই বেরুবে যেগুলি সমান্তরাল প্রকাশনার আওতায় পড়বে।
যৌনআকুতির বিভেদের জন্য মানুষ অনেক সময় আলাদা হয়ে যায়। মূলস্রোত থেকে এই বিচ্ছিন্নেরা নিজেদের নিয়ে গোষ্ঠী বাঁধে — পত্রিকা বার করে, পুস্তিকা বার করে, সাহিত্য সৃষ্টিও করে। সমকামী, হিজড়ে, যৌন কর্মীদের নিজস্ব সমিতি আছে। সেইসব সমিতির ছোটখাটো প্রকাশনও আছে। সেই প্রকাশনাগুলি আন্ডারগ্রাউন্ড নয়, প্রকাশ্য, এবং সমান্তরাল প্রকাশনারই অন্তর্গত। রূপাজীবা নারীরা বহুকাল ধরেই আমাদের সাহিত্য বেশ ভালোভাবেই দখল করে আছেন। হিজড়েদের নিয়ে সম্প্রতি কমল চক্রবর্তীর একটি উপন্যাস পড়লাম। সমকামী জীবন নিয়ে লিটল ম্যাগাজিনে নভেলেট লিখেছিলেন উভকামী লেখক। বাংলা ভাষায় সমকাম নিয়ে লেখার কমতি পুষিয়ে দিয়েছেন পারস্যের ওমর। বাংলা রুবাইয়া-ই-ওমর খৈয়ামের গুচ্ছ গুচ্ছ রঙিন ছবিতে শিল্পীরা সাকীকে যতই উদ্ভিন্ন যৌবনা মেয়ে সাজাক, সাকী কিন্তু আসলে কিশোর, পুরুষ।
এখানে লেসবিয়ানদের এখনও কোনও প্রকাশনা নেই। বাঙালি মেয়েরা লেসবিয়ান চেতনার কবিতা লিখেছেন, এবং সে কবিতা মূলস্রোতের প্রকাশনাতেই সাদরে গৃহীত হয়েছে। হয়তো লেসবিয়ান গ্রিক কবি সাফো-র গৌরবের জন্যই এই কবিতাগুলির গায়ে কলঙ্ক লাগেনি।
বই লেখার মতো প্রকাশনাও একটি নেপথ্য কাজ। প্রকাশ পাবার পরে যা দৃষ্টিগোচর হয় তা হল দোকানে দোকানে বইয়ের সজ্জিত প্রদর্শন এবং বিপণন। এই দোকানগুলির অসহযোগিতা এবং অসাধুতার জন্য সমান্তরাল প্রকাশনার বই মার খেয়ে যায়। বই বেচাকেনার ব্যবসাদারেরা জানেন সমান্তরাল প্রকাশনাগুলির তেমন ব্যবসাবুদ্ধি নেই, কোনও পরিকাঠামো নেই, নিয়মিত তাগাদা দিয়ে বিক্রির টাকা আদায় করে নেবার মতো লোকবল নেই, সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে — মুনাফা করার জন্যে তেমন কোনও চেষ্টাই নেই। অতএব বইয়ের দোকানিরা এই শখের প্রকাশকদের ঘোরাতে থাকেন, যদি বিক্রির টাকা না দিয়ে পারা যায় তবে আর উপুড়হস্ত হন না।
এই অবস্থাকে বাধা দেবার কোনও পন্থা বা সহজ প্রতিষেধক আছে কিনা জানি না। খুব ছোট্ট একটা নিষ্কৃতির রাস্তা বছরে একবার খোলে — কলকাতায়, ৩৬৫ দিনের বছরে ১০ দিনের জন্য একটি বইমেলা হয়। কর্ণধারদের বদান্যতায়, এই মেলাপ্রাঙ্গণে লিটল ম্যাগাজিন তথা নিছক সমান্তরাল প্রকাশনের সদস্যেরা অতি অল্প মূল্যে কোনও এক ঝড়তিপড়তি কোণে একটু অবহেলার জায়গা পান। এ ব্যাপারে আমার নিজের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। টেবিলে টেবিলে বই সাজিয়ে, ঐটুকু জায়গা নিয়ে ঐ কটা দিনে আমরা যে দোকান-দোকান খেলি তাতেই সারা বছর আমাদের খুশি থাকতে হয়। সমান্তরাল প্রকাশনার জন্যে দশ দিনের বদলে সারা বছর ধরেই কি এরকম একটা ছোটখাট বন্দোবস্ত করা যায় না?
পুনশ্চ: বড় প্রকাশনা তার বই বিক্রির জন্যে অনেক কিছু করে — বইয়ের বিজ্ঞাপনের আগে, জমি তৈরি করার জন্যে সে লেখককে বিজ্ঞাপিত করে। আজকাল পুরস্কার, দূরদর্শনে সাক্ষাৎকার, মাঝে মাঝে দৈনিক পত্রিকায় কিছু ছুটকো খবর — এসব ছাড়া বোধহয় একজন লেখক বা লেখিকাকে যথেষ্ট সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব হিসেবে দাঁড় করানো যায় না। এসব হলে তাঁর বইয়ের কাটতির পথও মসৃণ হয়ে ওঠে। তাছাড়া আছে সপ্তাহের বেস্ট সেলার তালিকা, পুজো বা বইমেলার মরসুমে দলীয় বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে বইটিকে সে বছরের শ্রেষ্ঠ বই বলে ঘোষণা করিয়ে নেওয়া। এইভাবেই বড় প্ৰকাশকের বই তার সমকালকে জিতে নেয়।
এই অবস্থায় আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, এরিনায় ঢুকতে-না-পাওয়া সমান্তরাল প্রকাশনার ভালো বইগুলোর খবর পাঠককে জানানো। পাঠকেরও কর্তব্য হচ্ছে, পরের মুখে ঝাল না খেয়ে বই নিজে পড়ে দেখা। অতএব নিবন্ধটির শেষে, কর্তব্য হিসেবে আমি আপাতত কয়েকটি বইয়ের নাম জানাই —
মলয় রায়চৌধুরী : এই অধম ওই অধম (কবিতীর্থ), নামগন্ধ (সাহানা)
কেদার ভাদুড়ী : নির্বাচিত কবিতা (মহাদিগন্ত)
পুষ্কর দাশগুপ্ত : গিয়োম আপলিনের কবিতা (পলিফোনি)
সুনীলচন্দ্র সরকার : সাত মহাল (প্রকাশক — পুলিনবিহারী সেন)
কমল চক্রবর্তী : ব্রহ্মভার্গব পুরাণ (প্রকাশক — লেখক)
অমিয়ভূযণ মজুমদার : মহিষকুড়ার উপকথা (অন্বেষা)
তাঁতঘর ২০০৩