শতাব্দী দাশ
ঘটনা ১
একটি সাড়ে তিন বছরের শিশুর দশ দিনের জীবন-মরণ লড়াই শেষ হয়েছিল ২০১৭ সালের জুলাই-এ। পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে সর্দি জ্বরের উপসর্গ নিয়ে ভর্তি করা হয়েছিল শিশুটিকে। চিকিত্সা শুরুর পর একের পর এক এক্সরে রিপোর্টে হতবাক হয়ে যান ডাক্তাররা৷ শিশুটির দেহের অনেক হাড় ভাঙা, যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত৷ সবচেয়ে বড় কথা, এক্সরে রিপোর্টে শরীরের ভেতর সাতটি সূচ দেখতে পেয়ে ডাক্তাররা হাঁ-মুখ। শিশুর তরুণী মা তখনও চেষ্টা করছিল চিকিৎসকদের কাছে সত্য গোপন করতে। পরে সংবাদমাধ্যমের চাপে মুখ খোলে সে। জানা যায়, সনাতন ঠাকুর, মায়ের দ্বিতীয় স্বামী, দিনের পর দিন মায়ের অনুপস্থিতির সুযোগে মেয়ের উপর যৌন নির্যাতন করেছে। পুলিশে অভিযোগ করে চাইল্ড লাইন, পুরুলিয়া শাখা৷ পুরুলিয়ায় চিকিত্সার যথেষ্ট ব্যবস্থা না থাকায় শিশুটিকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় বাঁকুড়ায়৷ কিন্তু সেখানেও যথাযোগ্য চিকিত্সা সম্ভব হয়নি৷ পরে সরকারি উদ্যোগে শিশুটিকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে এসে অপারেশনও করা হয়৷ সাত সাতটি সূচ বের করা হয় শিশুটির কোমল শরীর থেকে৷ কিন্তু সূচের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল শিশুটির ফুসফুস৷ অপারেশন সফল হলেও ফুসফুসের সংক্রমণ ঠেকানো যায়নি। তারপর এক বছরও গড়ায়নি। সেই মৃত্যু আমরা ভুলিনি বোধহয়।
ঘটনা ২
একটি মোটামুটি প্রথম সারির বাংলা সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ছোট ভাসাভাসা খবরের জেরে বৃষ্টির দুপুরে কলকাতার এক সরকার অনুমোদিত স্কুলের বাইরে জড়ো হয়েছে কিছু সমাজকর্মী। খবরে প্রকাশিত, এই গার্লস স্কুলের একটি মেয়ের যৌননির্যাতন হয়েছে, করেছে বহিরাগত ইলেক্ট্রিশিয়ান।
অভিভাবকদের কাছে ওরা সঠিক তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সবার মুখে কুলুপ। শোনা গেল খেপে খেপে জরুরিভিত্তিতে গার্ডিয়ানস মিটিং হয়েছে স্কুলে, ঘটনার পর। তারপর থেকেই ‘আমরা ঠিক জানি না’ সমবেত রা হয়ে গেল কি? ক্লাস ইলেভেনের করেকজন সালোয়ার কামিজকে পাকড়াও করা গেল। তারা বলল, ‘মিথ্যে বলেছে ওই মেয়েটা। কিছু হয়নি স্কুলে।’ তাহলে খবর রটল কীভাবে? কেউ জানে না। মেয়েটির ক্লাস সিক্সের সহপাঠী বলল, ‘ও বেশ কিছুদিন আসছে না।’ আসছে না কেন? ‘জানি না।’ হেডমিস্ট্রেসের সাথে দেখা করা যায়? হ্যাঁ, যায়। কিন্তু ব্যস্ত আছেন। সময় হলে ডাকবেন। অনেকটা সময় গড়ালে দেখা গেল, হেডমিস্ট্রেস বাড়ি চলে গেছেন। পিছনের দরজা দিয়ে। সরকারি স্কুল, ছাত্রীটি দরিদ্র পরিবারের। সেই একটি ছোট ভাসাভাসা ‘স্টোরির’ পর হৈ চৈ থেমে গেল।
ঘটনা ৩
এনআরএসে ক্ষতবিক্ষত যৌনাঙ্গ নিয়ে ভর্তি হয়েছে যে মেয়েটি তার ধর্ষক নিজের মাসতুতো দাদা। মেয়ের বয়স নয়। মা হাউ হাউ করে কাঁদছেন। বলছেন, ‘নিজের দিদির ছেলে, কী আর বলব!’ ডাক্তার বলে গেলেন, বেঁচে যাবে। তবে যৌনাঙ্গ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘটনা ৪
ছেলেটিকে তার শিক্ষিকা বলেছিল, এটা বড় হওয়ার একটা ধাপ, শিক্ষার অঙ্গ। অথচ তার বয়স তখন আট-নয়। পালা করে ধর্ষণ করত শিক্ষিকা আর তার বোন। বেশ কিছু বছর ধরে নির্যাতন চলে। শেষপর্যন্ত ক্লাস ফাইভে বোর্ডিং স্কুলে সুযোগ পেয়ে পেয়ে প্রাণে বেঁচে যায় ছেলেটি। কিন্তু স্বপ্নে এখনও রক্ত টক্ত ঘুরে ফিরে আসে, ফিরে আসে যন্ত্রণা, হ্যালুসিনেশন হয়। মনে হয়, কী বড় আর কী ভারি দুটো শরীর… যেন চেপে বসছে তার উপর।
ঘটনা ৫
কলকাতার নামী বেসরকারি ইংরাজি মাধ্যম স্কুল। দুবছর আগে এখানেই স্কুল বাসের হেল্পার এক চার বছরের খুদেকে গায়ে পড়ে কোলে তুলে নিয়েছিল না? সে নাকি তাকে স্পোর্টসের মাঠে পৌঁছে দিচ্ছিল। অভিযোগ: বাচ্চাটির শ্লীলতাহানি করার অছিলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না সেটা। প্রধানশিক্ষিকা সেদিনও অস্বীকার করেছিলেন।
আর দু’বছর পরে একই স্কুলে ক্রীড়া-‘শিক্ষক’ বাথরুমে ডেকে নিয়ে গেল আরেক খুদেকে। অন্য এক ‘শিক্ষক’ থাকল পাহারায়। তারপর বাচ্চাটির ‘ছোট প্যান্ট’ খোলাল সেই খেলাধুলোর শিক্ষক। তার যৌনাঙ্গেও যথেচ্ছাচার চলল। মেয়েটির ‘নোংরা’ লাগল। ব্যথা লাগল। বাড়িতে জানাতেই সচেতন অভিভাবক স্কুলকে সরাসরি অভিযুক্ত করলেন। পকসোয় গ্রেপ্তার হল শিক্ষক। প্রিন্সিপাল এবারেও বলেছিলেন, ‘ছোট ঘটনা’।
আরও নানাকিছু করল স্কুল এরপর। উঁচু ক্লাসের একটি মেয়ে ঘটনায় স্কুলের ভূমিকার সমালোচনা করায় হেনস্থা করল তাকে। বাড়ি বাড়ি নিজেদের ‘নির্দোষ’ ঘোষণা করে যে নোটিশ পাঠাল স্কুল, সেখানে ভিক্টিম বাচ্চাটির নাম ঠিকানা স্পষ্ট ফাঁস করা। সংবাদমাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ক’দিন হৈ চৈ হল খুব। তারপর বিষয় থিতিয়ে গেল।
***********
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ২০১৭ সালের তথ্য অনুসারে, ভারতে ঘণ্টায় চারজন করে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। প্রতি পনেরো মিনিটে একটি শৈশব হত্যা। কিন্তু এই সরকারি পরিসংখ্যানই বা কতটা সত্য? শিশুটি যদি হয় ফুটপাথবাসী, বস্তিবাসী, তাহলে তার খবর রাখে কি এইসব পরিসংখ্যান? কিছুদিন আগে গঙ্গায় ভেসে ওঠা ভিখারি কন্যার লাশ খবর হয়েছিল। গড়িয়াহাটের ফ্লাইওভারের নিচে রাত বাড়লে যে হাতগুলো এসে পড়ে শিশুর গায়ে, তার হিসেব মেলানো কীভাবে সম্ভব?
সম্প্রতি ক্যানাল রোডে ঘটে গেল এরকমই আরেকটি ঘটনা। কাগজকুড়ুনির তিন বছরের পিতৃহীন মেয়েটাকে ছিন্নভিন্ন করল কেউ। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বিধবার সংসার উত্তর কলকাতার ক্যানাল রোডে। বিকেলে খেলছিল মেয়ে এলাকায়। পঞ্চাশোর্ধ্ব বাসের খালাসি ডেকে নিয়ে যায় চকলেটের লোভ দেখিয়ে। পিঙ্কি ভিরানির শিশু যৌন নির্যাতন সম্পর্কিত যে বইটি সনাতন ভারতীয় সমাজ, পরিবার ও সংস্কৃতির ধারণাকে দুরমুশ করেছিল, অনেকরকম মুখোশ ছিঁড়েছিল অনেকের, সেই বইটির নামও ছিল — বিটার চকোলেট।
জীর্ণ মেয়ে রুপোলি কাগজে মোড়া চকলেটের লোভে প্রায় দাদুর বয়সী এক পুরুষের সাথে ফাঁকা বাসে ওঠে। তারপর বাসের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মেয়েটির আর্ত চিৎকার শোনে দাদা বাসের বাইরে দাঁড়িয়ে। বারবার দরজায় আঘাত করতে থাকে সে, কাকুতি মিনতি করতে থাকে, বোনকে ছেড়ে দিতে বলে। পঞ্চাশোর্ধ্ব তখন ব্যস্ত শিশ্ন প্রবেশ করাচ্ছে তুলতুলে যোনিতে। আর বাসের পিছনের সিট রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
মেয়েটির দাদা ছুটে যায় মায়ের কাছে। তিনি চিৎকার চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করেন। এলাকার লোকজন যখন বাসের উপর চড়াও হয়, দরজা ভাঙে, তখন মেয়েটির জামাকাপড় ছেঁড়া, রক্তের বন্যায় ভাসছে সে। প্রৌঢ়ের হাতে রক্ত, প্যান্টেও।
সরকারি হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মেয়েটির প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হয়েছে। প্রাথমিক বিপদ কেটে গেছে। প্রথাগত পরীক্ষানিরীক্ষার পর নিশ্চিতভাবে বলা যাবে, মেয়েটি ধর্ষিত, যদিও মৌখিকভাবে নির্যাতনের ইঙ্গিত দিতে বাধা নেই ডাক্তারদেরও। গণপ্রহারের পর দোষীকে তুলে দেওয়া হয়েছে পুলিশের হাতে। ঘটনাচক্রে সেটা ছিল আন্তর্জাতিক নারীদিবিসের ঠিক আগের দিন।
*********
অভিযুক্তর বিরুদ্ধে পকসোয় মামলা হবে নিঃসন্দেহে।
কিন্তু পকসো শাস্তি দিতে পারছে ক’জনকে? রিপোর্টেড হচ্ছে ক’জন? ধরা পড়ছে ক’জন? অথবা, শুধু শাস্তিবিধানেই কি স্বস্তি মিলবে?
জানি, শিশুকামীদের প্রতি সমাজের সম্মিলিত ঘৃণা স্বাভাবিক। কিন্তু শাস্তিবিধানই যদি উত্তরণের একমাত্র পথ হত, তবে এই অপরাধ উত্তরোত্তর বাড়ত না। যে হারে শিশুধর্ষণ, শিশুর যৌন নিগ্রহ হচ্ছে, তা বোধহয় সঙ্কেত দেয়, এ শুধু এক বিশেষ ধরণের বিকৃত কাম নয়। পিডোফিলদের মস্তিষ্কের গঠনে কিছু তারতম্য পেয়েছিলেন জার্মান বিজ্ঞানীরা ২০১২ নাগাদ। পিডোফিলিয়া একরকম ওরিয়েন্টেশন না বিকৃতি — তা নিয়েও গত এক দশক ধরে বহু চর্চা হয়েছে। কিন্তু সব চর্চা যেন একটাই অভিমুখে ধাবিত হয়। একটি অসহায় শিশু, যার যৌনতার বোধও জাগ্রত হয়নি, এমনকি নিজের শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গও যে চেনে না, তার যৌন নির্যাতন আটকানোই হোক পাখির চোখ। যদি পিডোফিলিয়া একরকম ওরিয়েন্টেশনও হয়, তবেও পিডোফিলের ব্রেনের গঠন নিয়ে আলোচনা শুধুমাত্র আকাদেমিক পরিসর থেকে মুক্ত হোক। তা ব্যবহৃত হোক পিডোফিলের সনাক্তকরণে। প্রয়োজনে এদের শিশুদের থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করা হোক।
কিন্তু শিশুর যৌন নিগ্রহের পরিসংখ্যান যা বলছে, সে অনুসারে ধরে নিতে হয়, সংখ্যাগুরু মানুষই তবে শিশুকামী। তাই কি? নাকি এ শুধু চরম অবজেক্টিফিকেশনের প্রকাশ, শিশুকেও যৌনবস্তু হিসেবে দেখার মানসিকতা? নাকি বড়দের থেকে শিশু যৌনবস্তু হিসেবে সহজলভ্য বলেই তারা শিকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে?
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো আরও বলছে — ভারতে শিশুর যৌন নির্যাতনের হার সর্বাধিক। বলছে — ২০১৬ সালে রেকর্ডেড কেসের সংখ্যা ১০৬৯৫৮। তার মধ্যে পকসোয় অভিযুক্ত হয়েছে ৩৬,০২২টি কেস। ২০০৭ সালের সার্ভে অনুসারে, ভারতের ৫৩% শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার। নির্যাতকদের মধ্যে আছে শিক্ষক, আত্মীয় এমনকি বাবাও। মেয়েদের ক্ষেত্রে নির্যাতিতর বয়স হতে পারে এমনকি কয়েক দিন! নিরাপদ নয় ছেলেরাও। প্রতি ছ’ জনে একজন ছেলেও নির্যাতনের শিকার। এতদসত্ত্বেও, পরিবারের পরিসরে শিশুর যৌন নির্যাতন নিয়ে দমবন্ধ করা গোপনীয়তা! মুখ না খোলার অভ্যাস মজ্জাগত। নীরবতা ভঙ্গ করার নজির খুব সম্প্রতি দেখছি আমরা, যা নিঃসন্দেহে এক ইতিবাচক পরিবর্তন।
শিশুর যৌন সুরক্ষার শিক্ষা, চাইল্ডলাইন সহ সরকারি ব্যবস্থাগুলিকে আরও কার্যকরী করে তোলা এবং নীরবতা ভঙ্গ করা — এই ত্রিমুখী প্রচেষ্টাই শিশুকে সুরক্ষিত করতে পারে। পকসোর মতো জোরালো আইন থাকুক, কিন্তু তার প্রয়োগ তো ঘটবে অপরাধ ঘটে যাওয়ার পর। আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হতে হবে কালো হাতগুলো শিশুর শরীরে, যৌনাঙ্গে, পিঠে, বুকে পৌঁছনোর আগেই ঠেলে সরিয়ে দেওয়া। এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যেতেই হবে।