জাদু শহরের জাফর ইকবাল

নিরুপম চক্রবর্তী

Z embla, Zenda, Xanadu:

A ll our dream-worlds may come true

F airy lands are fearsome too.

A s I wander far from view

R ead, and bring me home to you.

Salman Rushdie / Haroun and the Sea of Stories

১।

জাফর ইকবাল শুয়ে আছে। মাথায় ছুরির ক্ষত। ব্যান্ডেজ। সে জানে না যে আমি তাকে দেখছি। আরও হাজার হাজার মানুষের সাথে আমি তাকে দেখছি ইন্টারনেটে খবরের কাগজের পাতায়। আরও হাজার হাজার মানুষের মতো আমিও উদ্বিগ্ন; স্বস্তি এই ভেবে যে এ যাত্রা বোধহয় দুঃস্বপ্নের রেশ শেষ হতে চলেছে। ছুরিধারী দুই দুর্বৃত্তের হুরিপরীময় বেহেস্ত যাত্রার পথে এখন যৎসামান্য কাঁটা: একজন পলাতক দ্বিতীয়জন উপস্থিত ছাত্রদের হাতে ধরাশায়ী। হায়রে কি দিনকাল, পশ্চিমী শিক্ষার কী প্রবল কুফল: ঈশ্বরের সশস্ত্র সেবকদের দেখে নিরস্ত্র ছাত্ররা আজকাল ভয়টুকু পর্যন্ত পেতে ভুলে গেছে! এই দুই ফরিস্তার নিয়োগকর্তা হুজুর নির্ঘাত এই মুহূর্তে দেওয়ালে মাথা ঠুকছেন! মনুষ্য শরীরের এই অংশটিকে তাঁদের আবার বিরাট ভয়, কখন যে কী করে বসে কে জানে! ঠিক ওখানেই তো ছুরিটা বসিয়েছিল ওই দুই সাকরেদ, তাতে কী লোকটা হঠাৎ করে মালাউন হয়ে গেল! নতুবা তার অত দরদ কেন ওই মগজভর্তি জেহাদের ভুষি ঠাসা অর্ধমানব চাপাতিবাজটির প্রতি! ‘মেরেছ কলসির কানা, তা বলে কী প্রেম দিবো না’! এই ‘কুলাঙ্গার’ জাফর ইকবাল কী কলসির কানা আর কম্যান্ডো ছুরির তফাৎটাও বোঝে না!

‘আর কদিন বাদে জাফর সুস্থ হবে, ফিরে আসবে ইউনিভার্সিটিতে।’ টিভিতে ইন্টারভিউ দ্যায় ইয়াসমিন হক। ইয়াসমিন জানে না যে আমি তাকেও দেখছি! আসবে সে তো জানি আমরা সবাই। আর হুজুরদের শিরঃপীড়া বাড়িয়ে দিয়ে আবার বলবে:

“আমাদের পরের প্রজন্মকে শেখাতে হবে— পৃথিবীর সৌন্দর্য হচ্ছে বৈচিত্র্যে। সারা বিশ্বে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হচ্ছে ‘ডাইভারসিটি’। একটি দেশে যত বেশি ডাইভারসিটি, সেই দেশটি তত সম্ভাবনাময়। নতুন পৃথিবী আধুনিক পৃথিবী। আধুনিক পৃথিবীর মানুষেরা একে অন্যের সঙ্গে বিভেদ করে না। শুধু যে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করে না তা নয়; গাছ, ফুল, পশুপাখি সবাই মিলে যে একটা বড় পৃথিবী এবং সবার যে পাশাপাশি বেঁচে থাকার অধিকার আছে, সেটিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে।”

এই জাফর ইকবালকে আমি চিনি। একটা ম্যাজিক শহরে সেই অনেক অনেক অনেক দিন আগে আমি তার সাথে হেঁটে গেছি যে!

২।

ফিরে আসে সেই জাদু শহরের স্মৃতি। সে শহরের নাম সিয়াটল। তার চারদিকই প্রায় নীল জলে ঘেরা, তার ওপারে বরফে ঢাকা পাহাড় চুড়াগুলোকে অলৌকিক মনে হয়। সদ্য আলাপ হয়েছে রসায়ন বিভাগের তুখোড় ছাত্র বিশ্বনাথ দের সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আচমকা সে পরিবর্তিত পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে কাকে যেন ডাকে ‘অরে, এই কী যেন বাল! এই দিকে শুইন্যা যা!’ যে ছেলেটি সাড়া দ্যায় তাকে আমি আগে দেখিনি: তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, ফরসা, পাতলা, চোখে চশমা, চেহারার সঙ্গে মানানসই বুদ্ধিজীবীসুলভ গোঁফ। বিশ্বনাথ বলে, ‘এই তেল মাখাইন্যা গাবুড়টার নাম নিরুপম! সদ্য আইছে!’ ছেলেটি হাত মেলায়। জাফর ইকবালের সঙ্গে আমার সেই প্রথম আলাপ। সালটা ১৯৭৯। ওদেশে আমার ততদিনে দু’বছর কেটে গেছে।

জাফর-এর সঙ্গে
সস্ত্রীক জাফর ইকবাল (ছবির ডানদিকে)-এর সঙ্গে সপরিবার লেখক (সামনের সারির বাঁদিকে), দুই বন্ধুর সঙ্গে ডায়মন্ড লেক, ওরিগনে, ১৯৮২

তার পরে আমাদের কয়েকজন বঙ্গভাষীর যৌথ যাপন। পাসপোর্টের তফাৎ, ধর্মীয় ব্যবধান এগুলোকে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে একটা ভাষাভিত্তিক আত্মীয়তা। আমরা মাউন্ট সাই বলে একটা অখ্যাত দুর্গম পাহাড়ে উঠতে যাই, ছুটিতে তাঁবু খাটাই ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের আনাচে কানাচে। পরিচিতি গভীর হয়েছে ততদিনে। জাফর শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্থান পাওয়া ছাত্র নয়, ওদেশেও ছাত্রমহল ওকে সম্ভ্রমের চোখে দ্যাখে; নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার একটা অতি জটিল পরীক্ষার সঙ্গে ও যুক্ত, সেখানেও ওর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। কথায় কথায় জানায় যে ও বাংলায় সায়েন্স ফিকশান আর ভূতের গল্প লেখে: ওর দুখানা বই আছে বাংলায়; একটার নাম কপোট্রনিক সুখ দুঃখ আর অন্যটার নাম প্রেত! ওর পরিবারের গল্প শুনি। দাদা হুমায়ুন আহমেদ তখন নর্থ ডাকোটার নন্দিত নরকে ডক্টরেট করছেন; জাফর তার বাবার গল্প বলে। সে গল্প তখনও টাটকা তাজা, বাংলা দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প:

“তারপর একদিন সকালে পাকিস্তানী আর্মি উনাকে উঠায়ে নিয়া গেল। দুপুর নাগাদ খবর পাইলাম উনি আর নাই, এক জায়গায় উনারে কবর দিয়া দিছে। মা কিছুতেই মানতে চান না, কেবল বলেন হইতেই পারে না, না দ্যাখলে আমি বিশ্বাস করুম না। কী আর করা, দুই ভাই লণ্ঠন নিয়া যাই সেখানে, মা সাথে আসেন। কবর খুইড়া লণ্ঠনের আলোয় মাকে দ্যাখাই অগত্যা…”

শুনতে শুনতে শিউরে উঠি: এ কোন রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে এসেছে এই নওল কিশোর! জাফরের চোখমুখ, অভিব্যক্তিহীন, ঘৃণা নেই তার কারুর প্রতি। হে বেহেস্তের পহেলবান জেহাদি হুজুর! এ বড় শক্ত ঘাঁটি, এ বড় শক্ত মনের মানুষ, আপনাগো চাপাতির ভয়ে এ পালায় যাবে এমন ভরসা কম! নাস্তিকের কথা, কইলাম একডা, পরে মিলাইয়া নিয়েন!

৩।

তা সেই জাদু শহরে সেদিন হুজুরই বা কোথায়, আর কোথায় তাঁর চাপাতি! আমার জাফর স্মৃতি ছেয়ে আছে জাফরের সুতীক্ষ্ণ ও বিচিত্র পরিহাসবোধে। আমরা আবার ক্যাম্পিঙে যাই, আমাকে একটা বুনো গাছ থেকে ফল খেতে দেখে হঠাৎ জাফর বলে ‘তুমি এইখানে মড়ার মতো শুইয়া থাকো, নড়বা না, আমি না বলা পর্যন্ত একদম উঠবা না!’ আদেশ পালন করি। একটু পরে দেখি উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসছে ইয়াসমিন, সঙ্গে ছন্দা: বৈধব্যের আশু সম্ভাবনা সত্ত্বেও যথেষ্ট সংযত! শুনলাম, জাফর  নাকি ওদের বলেছে যে বিষাক্ত বুনো ফল খেয়ে আমি মরতে বসেছি, এবং আপাততঃ অজ্ঞান!

এই পরিহাসবোধ ঢাকার হাসপাতালে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা বয়স্ক মানুষটিকে ছেড়ে গেছে বলে বিশ্বাস হয় না, হে জেহাদি হুজুর! আপনারা একদম ব্যর্থ! মানে মানে কেটে পড়ুন বরং!

তা সে যাই হোক, ইয়াসমিন রাষ্ট্র করে দ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি জাফরের জোক বলা বিখ্যাত ছিল! আমরা তার কিঞ্চিৎ নমুনাও দেখি। ওদের এক নিকট আত্মীয়া বেড়াতে আসেন। জাফর একটা ক্যাসেট টেপ রেকর্ডারে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ার শব্দ রেকর্ড করে চালিয়ে রাখে। ফলতঃ সারা রাত ভদ্রমহিলা ঘুমোতে পারেন না! অতএব সেই ম্যাজিক শহরে সরস্বতী পুজো আসে, অবধারিতভাবে জাফর সেখানে বিচিত্রানুষ্ঠানে হাস্যকৌতুক পরিবেশন করবার জন্য আমন্ত্রিত হয়। কনফারমড নাস্তিক, আমিও থাকি সেখানে, জাফরের বলা গল্পগুলো ওর নিজের মুখ থেকে না শুনলে আদ্ধেক মজা মাটি, তবু একটা বলি বরং, এটাও মুক্তিযুদ্ধের গল্প:

“তা একদিন খান সেনারা এক মুর্গিওয়ালার কাছে আইস্যা বলে, মিয়াঁ তোমার মুর্গিরে কী খাওয়াও? মুর্গিওয়ালা বলে, ছার আমি নিজে যা খাই তাই অরে একটু কইরা দিই! খান সেনার কম্যান্ডার কয় ‘কী! মানষে খাইতে পায় না আর সেই খাবার তুমি মুর্গিরে দিয়া নষ্ট করো!’ বলে তাকে বেদম পেটায়। পরের দিন কম্যান্ডার আবার আসে। কয় ‘এই মিয়াঁ তোমার মুর্গিরে আজ কী খাওয়াইলা?’ মুর্গিওয়ালা বলে, ছার আজ অরে অল্প এট্টু দানা দিছি। কম্যান্ডার কয় ‘অল্প এট্টু দানা খায়া এই এতবড় মুর্গির প্যাড ভরে কহনও?’ বলে তাকে আবার বেধড়ক পেটায়। তৃতীয় দিন কম্যান্ডারকে দেখে মুর্গিওয়ালা নিজেই ডাকতে থাকে ‘ছার! ছার!’ কম্যান্ডার বলে ‘কি কও? আজ মুর্গিরে কী খাওয়াইছো?’ মুর্গিওয়ালা বলে ‘ছার আজ অরে দুটা পয়সা দিয়া কইছি, বাজারে গিয়া তোমার যা লাগে কিনা খাও! তোমার জন্য রোজ রোজ এই পিটানি আমি সইতে পারুম না!’’

৪।

ঈদ আসে। বিশ্বনাথ বায়না ধরে সে নামাজ পড়তে যাবে! অতএব জাফর তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। পরে শোনা যায় যে পাখিপড়া করে সবকিছু শেখানো সত্ত্বেও বিশ্বনাথ একেবারে কেলোর কীর্তি করে বসেছে। বসবার সময়ে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়াবার সময় বসেছে, প্রত্যেকবার উল্টো দিকে ঘাড় ঘুরিয়েছে! বেদম হাসতে থাকি আমরা: হিন্দু বিশ্বনাথ, মুসলমান জাফর আর নাস্তিক আমি। আমাদের কারুর জাত যায় না!

ঈদের কোরবানির জন্য একটা খাসি জোগাড় হয়। আমরা একটা সুন্দর বাগানে যাই সেখানে বিরাট বড়বড় আশ্চর্য সুন্দর শাদা শাদা রাজহাঁস ঘুরে বেড়ায়। মৃত পশুটির রক্ত গড়াতে থাকে। আমি দেখি, কিছুটা বিষণ্ণতা জাগে মনে। আর হঠাৎ একেবারে অবাক করে দিয়ে বিচিত্র আওয়াজ করে ছুটে আসে ওই রাজহাঁসগুলো, বয়ে যাওয়া রক্তস্রোত চেটেপুটে খেতে থাকে!

সমস্ত সুন্দরের আড়ালেও যে লুকিয়ে থাকতে পারে এক ভয়াবহ হিংস্রতা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিয়ে ওই শুভ্র রাজহাঁসগুলো আবার নিঃস্পৃহ হয়ে ঘুরে বেড়ায় ওই জাদু শহরের সবুজ ঘাসে!

৫।

হায় ফুলের দিন! সেও শেষ হয় একদিন। জাফর ও ইয়াসমিন পি এইচ ডি শেষ করে। জাফরকে তৎক্ষণাৎ টেনে নেয় ক্যালটেক, বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একটা। আমরাও যে যার মতো পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়ি। ক্যালটেক থেকে জাফর বিশ্বশ্রুত বেল ল্যাবে চাকরি নেয়। যোগাযোগ থাকে কিছুদিন, ধীরে ধীরে কালের নিয়মে আবছা হয়ে যায়। একদিন স্বেচ্ছায় সবকিছু ছেড়ে রেখে জাফর বাংলাদেশে ফিরে যায়। সে খবরও পাই। অবাক হই না। দেশ তার বড় কাছের। ফিরে যাবে এ কথাটা সে আমার মতোই বারবার বলে এসেছে!

জাফর লেখক হয়ে ওঠে। ছন্দা খবর আনে ইদানীং ওর জনপ্রিয়তা প্রায় চিত্রতারকাদের মতো! বিদেশে দুটি বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রী কথা প্রসঙ্গে শোনে যে আমি জাফরকে চিনি। পরেরদিন তারা আমাকে একটা বিশাল ইলিশ মাছ এনে খাইয়ে যায়! আমি জাফরের এক প্রকাশককে ধরে ওর ই-মেল জোগাড় করি। চিঠির উত্তর আসে “ছবি পাঠাও। মাথার চুল রং করবা না! যা এক্সট্রা ফ্যাট জমাইছো তা ঢাকবা না!”

বুঝি, কিছুই পাল্টায়-না; নদীর স্রোতের মতো যদিও অনেকটা সময় চলে গেছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...