অভিরূপ ঘোষ
আজ আবার মহাযুদ্ধ। ভাববেন না মোহন-ইস্ট লড়াই সন্ধ্যে ৭ টায় টেন-২তে শুরু হবে, যুদ্ধ এখন চলছে-দেওয়াল যুদ্ধ। ফেসবুক খুললে বোঝা কঠিন লড়াইটা কটকে হতে চলেছে। এই কঠিনতম বাক্যযুদ্ধের আমিও এক রণক্লান্ত সৈনিক, যে শেষ দু-তিন বছরে চিংড়িঘাটা পেরোয়নি-শিলিগুড়ি বা বারাসত তো সেখানে শিশু। তাই দেশদ্রোহিতার দায় মাথায় নিয়ে এই ফেসবুক সাম্রাজ্যকে ছোটো করে আমি টিআরপি কেনার চেষ্টা করছি বলে ভাববেন না একদম।
আমায় নূন্যতম চিনলেই জানবেন আমি অন্ধ ঘটি। ঘটিতে খোকা-ইলিশ ডোবানোর স্বপ্ন আজকেও দেখছি। সোনির হাতে ফেড কাপ না এলে দুঃখ পাবো খুব, কান্না আছড়ে পড়বে জুকারবার্গের দেওয়ালে। তবে এই পোস্ট টুটূ বসুদের পক্ষে গলা ফাটাতে নয়, প্রফুল্ল প্যাটেল নামক এক জগদ্দল পাথরে প্রতিবাদের দেওয়াল লিখন।
প্রফুল্ল বাবুরা উঠে পড়ে লেগেছেন কর্পোরেট হাওয়া থেকে কিছু লুফে নেওয়ার নেশায়। তেলা মাথায় তেল দেওয়ার অভ্যেস রাজনীতিবিদদের পুরোনো ব্যামো, ১৯৯১ সেখানে শুধুই প্রতীকী। নীতা আম্বানিকে গুরুপত্নী ভেবে ভারতীয় ফুটবলকে শেষ করার খেলা শুরু করে দিয়েছেন প্যাটেল সাহেব আর তার দলবল। আপনার অবশ্য ‘ভারতীয় ফুলবল’ শব্দটা শুনেই নাক সিঁটকে যেতে পারে, হয়তো গেছেও। ১৩১ কোটির দেশ একশো নম্বরে হলে সেটাই স্বাভাবিক। তবে ফুলবলটা কিন্তু শুধু জিত-হারের হিসাব নয়-তার থেকে অনেক অনেক বেশি কিছু।
আজাদ ময়দানে ব্যাট হাতে আসা ছেলেগুলো নীল জার্সির স্বপ্ন দেখে-ময়দানে বৃষ্টির দিনে একটা চামড়ার বলের পিছনে দৌড়ে চলা ছেলেগুলো দেখে না। ওদের মাথায় চিন্তা নেই, মনে আনন্দ আছে। এই আনন্দ আপনি অনেক প্রত্যন্ত গ্রামে খুঁজে পাবেন – সে পাহাড় হোক বা সমতল। এদের মধ্যে যারা একটু ভালো, তারা দেশের নীল জার্সির আগে গায়ে চড়ানোর স্বপ্ন দেখে লাল-হলুদ বা সবুজ-মেরুন জামা। পাহাড়ে গেলে জার্সির রংটা বদলে যায় ক্লাবের সাথে। ইস্ট-মোহন হয়ে যায় লাজং-আইজল। আবেগটা শুধু কমে না, বরং বেড়েই যায় উচ্চতা বাড়লে। এই আবেগটাই যে কোনো খেলার সম্পদ। যে লোকটা সারা সপ্তাহ ধরে একটু একটু জমিয়ে কোনো এক রবিবারে পাড়ি জমায় যুবভারতীতে, সে নম্বর বোঝেনা। মেহতাব বা বলবন্ত গোল মিস করলে উত্তেজনায় বিড়ি ধরিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় খিস্তি দেওয়ার সময় সে ভাবেই না এটা শুধু একটা খেলা, বাহুবলির সেট নয়। নিজের ছেঁড়া চটিটা কোনো এক প্লাজা বা কাৎসুমিকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দেওয়ার আগে সে ভেবেই দেখেনা যে আর একজোড়া চটি কেনার সামর্থ্য তার এই মুহূর্তে নেই। চটিটা রানিং ট্রেক পেরিয়ে মাঠে পৌঁছয় না, আবেগটা পৌঁছয়। সে ভুল করে। আর তার এই ভুলটাই মেশিন আর মানুষের মৌলিক পার্থক্য। এই পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা ঠান্ডা ঘরে বসে থাকা কর্তাদের নেই। তা বুঝতে গেলে একবার যেতে হবে শিলং বা আইজল,অবশ্যই কমপ্লিমেন্টারি পাস না নিয়ে। খাদের ধারে জীবন ঝুঁকি নিয়ে খেলা দেখার আনন্দ ভারতীয় ফুলবলকে বাঁচাক বা নাই বাঁচাক, কিছু মানুষের ভালোলাগার মুহূর্তগুলোকে জীবনের সম্পদ করে দিয়ে যাচ্ছে। এই আবেগ পয়সা দিয়ে কেনার জিনিস নয়।
ফেডারেশন কর্তারা ভুলে যাচ্ছেন এই আবেগটাই তাদের বাজার। এটা শেষ হয়ে গেলে গ্যারেজের ধারে পরে থাকা ভেস্পা স্কুটারের সাথে কর্পোরেট আইএসএলের কোনো পার্থক্যই থাকবে না। প্রফুল্ল বাবু ভুলে যাচ্ছেন এলাকাভিত্তিক কোটা মন্ত্রিসভায় হয়, খেলার মাঠে নয়। তার সাগরেদরা খবর নিলে জানতে পারবেন শুধু লন্ডন শহরেই সাতটা দল আছে লীগ খেলার, মাদ্রিদে চারটে, মাঞ্চেস্টারে তিনটে, মিলানে চারটে। যদিও এসব খবর নেওয়ার সময় ওনাদের নেই, ওনারা পকেট ভরাতে ব্যস্ত। তাই শেষ তিন বছরে একটাও ম্যাচ সেরার পুরস্কার মূল্য সোনি নর্দের কাছে পৌঁছয় না আর দেশের সেরা গোলকিপার জাতীয় দলের ২৫ জনেও সুযোগ পায়না।
এতটা পরে ভাববেন না এটা আরো একটা ভার্চুয়াল বিপ্লব। রিয়াল বিপ্লব ফেডারেশন দেখবে। মোহন-ইস্ট বঞ্চিত হলে দেখবে, আইজল বঞ্চিত হলে দেখবে। টুটূ বসু-নিতু সরকারদের কথা জানিনা, দরকারে একাই প্রতিবাদ করবো। আমার হাতে বন্দুক নেই, কলম আছে, চক আছে।ভারতীয় ফুলবলকে ‘ইস্ট-ইন্ডিয়া’ কোম্পানির হাতে বিক্রি করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে ওগুলোই আমার অস্ত্র। দেখি কার জিত হয়-অর্থ না আবেগের!!!