অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী
সপ্তম উপকথা, পর্ব — এক এখানে
গোণ্ড আদিবাসী কিংবদন্তী অনুসারে মহাকাব্যের বিকল্পপাঠ; মূল হিন্দি পাঠ -- বেদনসিং ধুর্বে, ‘কোয়া পুনেম গোণ্ডিয়ন গাথা’ (২০১৪)-এর ছায়া অবলম্বনে
আসলে সে যুগের পরাগতীর্থের সেই মেলায় তখনও প্রবল জনসমাগম হত, উপমহাদেশ ভূখণ্ডের সেই তিনটি অথবা দুইটি নদীর কোলে, নদীধৌত ঊর্বর সমতল জুড়ে জুড়ে অজস্র মানুষ বসবাস করত। সেই বিস্তীর্ণ জনাকীর্ণ অঞ্চলের বহু মানুষ জমায়েত হত সেই সঙ্গমের মেলায়। ভক্তিভাব ছাড়াও, ত্রিবেণী-সঙ্গমের জলের ওষধি গুণের কথা আজকের মতোই সেকালেও অবিদিত ছিল না বহু উপমহাদেশবাসীর। আজকের মতোই, সেদিনেও এই জনশ্রুতি তাই ছড়িয়ে পড়েছিল — পরাগতীর্থের কুম্ভমেলায় হারানো ভাইকেও খুঁজে পেতে পারে কোনও ভ্রাতৃহারা দুখীজন। তাই হারানো ভাই, বোন, পুত্র, কন্যা, বন্ধু, পরিজনদের খুঁজতে খুঁজতে সেই মেলায় পৌঁছে যেত বহু মানুষ। কুম্ভস্নানে হারানো ভাই ফিরে পাওয়ার জনশ্রুতি কানে এসেছিল বিন্দিয়ারও।
আসলে, কোনও নদীই কোনও বিশেষ ধর্মের সম্পত্তি হয় না, তাই নদীদের সঙ্গম আর সেই সঙ্গমে বসা মেলারাও তা হয় না। আজ আমরা কুম্ভমেলায় হিন্দুধর্মের ভক্তবৃন্দের জনসমাগম দেখি। কিন্তু সেদিনের সেই সেই প্রাগবৈদিক, প্রাগার্য ব্রোঞ্জ-যুগে সেইখানে দেখছি প্রাকৃতোপাসক তথা আদিধর্মাবলম্বী উপমহাদেশময় মূলবাসী মানুষের ঢল। সেই ঢলেই বয়ে চলল দেবনগরী-দ্বারকার সেকালের সেই দুই আদিবাসী চিফটেন-পরিবার।
এদিকে চলতে চলতে ধন রূপ যৌবন সর্বস্ব খোয়ানো ‘মদন’ খিদেতে, তেষ্টায়, শরীরের কষ্টে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ল। তার সারা শরীরে তখন রোগ ছড়িয়েছে। হেন গাড়োয়ান নেই যে তাকে গোরুর-গাড়িতে চড়তে দেবে। হেন সরাইখানা-ধর্মশালার মালিক নেই যে তাকে দু’দণ্ড রইতে-জিরোতে দেবে। পথশ্রমে তার হাত সরে না, পা সরে না। গাঁয়ের পথে চলার সময় তার গলিত অঙ্গ, কদর্য রূপ দেখে ছেলে-জোয়ানেরা তাকে ঢিল মারে, লাঠিসোটা বাগিয়ে রে-রে রোলে তাড়া করে। তাও প্রতিদিন একটু একটু এক ক্রোশ দুই ক্রোশ করে সে পরাগতীর্থের কাছাকাছি পৌঁছেই গিয়েছিল।
একদিন এইভাবেই তাড়া খেয়ে পালাতে পালাতে মদন উপস্থিত হল একটা পাতার ছাউনিতে। সে যুগে তীর্থযাত্রীদের বিশ্রামের জন্য মাটির কিছুটা সমতল করে, কখনও বা তাতে খড়-পাতা বিছিয়ে উপরে বা দুই-তিন দিক ঘিরে বাঁশ ডালপালা পাতা পোড়ামাটির দেয়াল-ছাদ-ছাউনি বানিয়ে রাখা হত। ঘটনাচক্রে, পরাগতীর্থের মেলায় যাওয়ার পথে ঠিক সেই ছাউনিতেই তার বাপ-মা-কে রেখে দানাপানির বন্দোপস্ত করতে বেরিয়েছিল বিন্দিয়া।
এদিকে ঢিল-তাড়া খেতে খেতে হাঁউমাউ বাঁচাও বাঁচাও পরিত্রাহী চিৎকার করতে করতে ছাউনির মেটে চাতালে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মদন। পিছন পিছন ধেয়ে এল লাঠিসোটা হাতে মারমুখী নির্দয় জনতা। যদিও দ্বারকার রাজারাণী তাঁদের ছেলেকে চিনতে পারেননি, তবু, ঘটনার হিংস্র অভিমুখ বিচলিত করে তাঁদের। তাই তাঁরা মদনের উপর চড়াও হওয়া জনতাকে নিরস্ত করলেন। লোকজন যারা এসেছিল তারাও প্রবীণ সম্ভ্রান্ত রাজারাণীর মধ্যস্থতা ও গম্ভীর অভিজাত আচরণের ফলে মদনকে ঠ্যাঙানোর অভিপ্রায় ও পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে যে যার কাজে ইতিউতি বেরিয়ে পড়ল।
এদিকে প্রাণভয় দূর হওয়ার পর এতদিন পর হঠাৎ করে বাবামাকে দেখে হাউহাউ করে মাটিতে উছাড়িপিছাড়ি কান্নাকাটি আরম্ভ করল ‘মদন’। দুঃখ অভিমান ভয় আনন্দ সব মিলিয়ে মিশিয়ে তার ভিতরে এমন তোলপাড় শুরু হল যে সে মুখে কিছুই বলতে পারল না, শুধু হুহু করে কেঁদেই চলল। অচেনা অসুস্থ চিরপরিহত এইরকম এক মুমূর্ষুমুর্তি তাদের সামনে অসহায়ভাবে কেঁদে চলেছে দেখে অত্যন্ত বিব্রত ও বিচলিত হয়ে উঠলেন দ্বারকার রাজারাণী। সেই সময় সেইখানে প্রয়োজনীয় জল, খাবার ইত্যাদি সংগ্রহ করে ফিরে এল বিন্দিয়া। ভাইকে চিনতে পেরে আনন্দে জড়িয়ে ধরল। মা-বাবাও হারানো ছেলে ফিরে পেয়ে মহাখুশি। একত্রে আলিঙ্গনবদ্ধ হল সেদিনের দ্বারকার রাজপরিবার। তারপর বিশ্রাম সেরে হৈহৈ করা তারা রওনা দিল কুম্ভস্নানে। মা বোন বাবা মিলে স্নান করাল কুষ্ঠজর্জর অরুণকে। নিজেরাও করল।
আজকের দিনের হিমালয়ের বরফগলা নদীদের কোলে কোলে যে সমতল, তা লোকালয়-আকীর্ণ, দূষণের মাত্রা প্রবল। তাই আজ হয়তো কুম্ভপানি তার ওষধি গুণ হারিয়েছে। কিন্তু আমরা যে প্রাকৃত সময়কালের কথা বলছি, সেদিনের পরাগ-ত্রিবেণীর জলস্পর্শে একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠল অরুণ। কয়েক হপ্তা পর তাই মায়ে বাপে ছেলেতে মিলে রওয়ানা দিল দ্বারকা অভিমুখে, আর তাঁদের বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বিন্দিয়া রওয়ানা দিল পরাগ-মেলার ও সেখানে পৌঁছোনোর পথে তীর্থযাত্রীদের বিশ্রাম্ভালাপের যে তাঁবু-ছাউনিগুলো পড়েছিল, সেগুলোর দিকে। সেইরকমই এক ছাউনিতে খবর পেল সে, শ্রবণ কুম্ভস্নান সেরে, পরম আদরের সাথে বৃদ্ধ মাতাপিতাকে ডুলিতে বসিয়ে রওয়ানা দিয়েছে সমুদ্রের পথে — পুবদেশের মহাসঙ্গমতীর্থে, আর যাওয়ার সময় খবর করে গেছে, তাঁদের তীর্থে থাকাকালীন যদি বেয়াই-বেয়ান সুস্থ হয়ে ওঠে এবং বিন্দিয়া যদি তখন দেবনগরীতে প্রত্যাবর্তনের পরিবর্তে কুম্ভতীর্থে স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে মিলিত হবে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সে যেন কুম্ভে অপেক্ষা না করে পুবদেশে সাগরতীর্থের দিকে এগিয়ে যায়, পথিমধ্যেই দেখা হবে। তাই হলও।
খুশির ছোঁয়া লাগল সবার মনে। এদিকে সারা সকাল ছেলের কাঁধে ডুলিতে চেপে চলতে চলতে পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল জ্ঞানবতী-দেবসন্তান। ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমাকাশে বেশ কিছুপথ ঢল নিয়েছে। সন্ধে ঘনিয়ে এসেছিল। বিন্দিয়ার সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার পর তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, সেদিনের মতো সেখানেই বিশ্রাম নেবে দেবনগরীর তীর্থযাত্রী রাজপরিবার। বিকেলের মরা আলোয় বাবামাকে বউয়ের জিম্মায় রেখে শ্রবণ চলল গহন বনে — কাঠ-কুটো-খড়-পাতা-ডাল-পালা সংগ্রহ করতে হবে, রাতের জন্য ছাউনি বানাতে হবে, শীত এবং শ্বাপদের হাত থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য বেশ কিছু বড়সড় লকড়িতে সাবধানে আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হবে সারারাত — সাবধানে কারণ সেই শীতের হাড়-হিম উত্তুরে হাওয়ায় সামান্য অসতর্কতা-গাফিলতির ফলে দাবানল ছড়িয়ে পড়তেই পারে। বিন্দিয়া আর অন্ধ দেবসন্তান-জ্ঞানবতী সেই জনহীন অরণ্যে শ্রবণের ফেরৎ আসার অপেক্ষা করতে লাগল।