আশীষ লাহিড়ী
অতি সম্প্রতি আমাদের দেশে বিশিষ্ট মানুষজনের মর্মর মূর্তি ভাঙার একটা ঝড় বয়ে গেল। একে শুধু ঝড় বলা ভুল, দেশজুড়ে যেন ভাঙাভাঙির এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। শুরুটা হয়েছিল ত্রিপুরার বামপন্থী সরকারের পতনের পর, লেনিনের মূর্তি ভাঙার মধ্যে দিয়ে। ২৫ বছরের সিপিআইএম সরকারকে ত্রিপুরা থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে উৎখাত করাই যথেষ্ট ছিল না, বিলোনিয়ায় লেনিনের মূর্তি উপড়ে ফেলে নিজেদের বিজয় উল্লাস ও পেশীশক্তির প্রদর্শনও করলেন বিজয়ী বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা। এরপর একে একে গান্ধী থেকে শুরু করে আম্বেদকর, পেরিয়ার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত — যাঁদের আমাদের দেশের দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের মতাদর্শগত শত্রু বলে ভেবে নিয়েছেন, বাদ গেলেন না তাঁরা কেউই। মূর্তিভাঙা-র দরকার ছিল না, মূর্তি না ভাঙলেও সারা দেশ ইতিমধ্যে জানে বিজেপি-আর এস এস শিবির উচ্চবর্ণ হিন্দু প্রতিক্রিয়াশীল ছাড়া বাকি সবাইকেই নিজেদের শত্রু বলে মনে করেন। আবার এসবের পালটা প্রতিক্রিয়া হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মূর্তি ভাঙা হল, যদি ধরে নেওয়া যায় এক্ষেত্রে মূর্তি ভেঙেছেন তথাকথিত বামপন্থী বা প্রগতিশীলেরা, ভাবলে আশ্চর্য লাগে, কোন তলানিতে এসে ঠেকেছে তাদের ‘প্রগতিশীল’ চেতনা।
মূর্তিভাঙা-র সংস্কৃতি অবশ্য আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। আমাদের রাজ্যেই গত শতকের সত্তরের দশকে নকশালদের হাতে প্রথম এই মূর্তিভাঙা শুরু হয়। আমাদের দেশের স্মরণীয় মহাপুরুষ যাঁরা, যাঁরা আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রোল মডেল — যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ — তাঁদের মূর্তিভাঙা শুরু হয়। রাজনৈতিক অর্থে অত্যন্ত বালখিল্য ও ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কাউন্টার প্রোডাক্টিভ’ ছিল এই কাজ। তবে এটা করার পেছনে যে মূল ভাবনাটা ছিল, সেটা একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না। নকশালরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, এই যে আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষেরা, এঁরা এতখানি ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন, কিন্তু এঁরা আমাদের সমাজের সংখ্যাগুরু উৎপাদক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কখনও যুক্ত হতে পেরেছিলেন কি? যুক্তিবাদী দর্শনের দিক থেকে বিদ্যাসাগরের মতো এমন নির্ভীক ও অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মানুষ আমাদের দেশে — কোনও দেশেই — আর ক’টা জন্ম নিয়েছিলেন সন্দেহ আছে, কিন্তু তিনিও উনিশ শতকের কৃষক বিদ্রোহগুলির সঙ্গে কোনওভাবে সংযুক্ত হওয়ার কথা ভেবেছিলেন কি? সমাজের বৃহত্তম উৎপাদক শ্রেণির সঙ্গে তাঁদের এই ‘ডিসকানেক্ট’, এই সীমবদ্ধতা, তাঁদের মাহাত্ম্যকে কিছুটা মলিন করে দেয় না কি? নকশালরা সেদিন শ্রেণিগত দিক থেকে এই যে মৌলিক প্রশ্নটা তুলে দিয়েছিলেন, সেটা পরবর্তীকালে জ্ঞানচর্চার নিরিখে মান্যতা পেয়েছে, অনেক ইতিহাসবিদ এখন তাঁদের কাজে এই দৃষ্টিকোণকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। অর্থাৎ সেদিন নকশালদের তোলা সামাজিক প্রশ্নটি স্থায়ী মূল্য পেয়েছে, যদিও ওই তর্ক তোলার জন্য শারীরিকভাবে মহাপুরুষদের মূর্তি ভাঙাভাঙির কোনও প্রয়োজন ছিল না। বরং ওরই মধ্য দিয়ে বিপ্লবীরা মধ্যশ্রেণীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, সহানূভূতি হারিয়েছিল।
কিন্তু সেদিনের মূর্তিভাঙা আর আজ দেশজুড়ে যা চলছে — দু’টো ঘটনা রাডিক্যালি আলাদা। নির্বাচনের মারফত গদি দখলের জন্য আজ বিজেপি-আর এস এস যা করছে তা পুরোপুরি এক সমাজবিরোধী কাজ। এটা করার পেছনে কাজ করছে শুধু বিরোধী রাজনীতির প্রতি একটা চরম প্যাথোজেনিক ঘৃণা। ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনীতির চাঁইরা প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ও ধান্দাবাজ হলেও, মৌলবাদী রাজনীতির ফুট সোলজার বা পদাতিকদের বুদ্ধ্যঙ্ক সাধারণত খুবই কম। এক্ষেত্রেও সেটাই ঘটছে, বিরোধীদের বার্তা দেওয়ার জন্য গান্ধী-আম্বেদকর-পেরিয়ারের মূর্তি ভাঙার মতো বোকামি আর কিছু হতে পারে না। প্রসঙ্গত বলি, আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রবীর মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি বাংলাদেশের যশোর থেকে ঘুরে এলেন। তিনি গিয়েছিলেন সেই সাগরদাঁড়ি গ্রামে, কপোতাক্ষ নদের তীরে। উনি বললেন, যে অপূর্ব যত্নে ওদেশে সংরক্ষণ করা হয়েছে মধুসূদনের পৈতৃক ভিটে, তা দেখলে রীতিমতো অবাক হতে হয়! বাড়িটি নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে, কিন্তু জোগাড় করা হয়েছে পুরনো ধরণের ইট, দেড়শো-দুশো বছর আগে বাড়িটি তৈরির সময় ঠিক যেমন ইট ব্যবহার হত, শুধুমাত্র বাড়িটির পুরোন ধাঁচ ও আবহকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য। আর এই দেশে আমরা কী করছি? মধুসূদনের মূর্তিতে কালি লেপে দিচ্ছি, নাক ভেঙে দিচ্ছি। আমি নিশ্চিত যে বা যারা এই কাজ করেছে, তারা জানেই না মধুসূদন আসলে কে ছিলেন। শুনেছে নামের আগে মাইকেল আছে, অতএব এই ব্যক্তি হিন্দু থেকে খ্রিস্টান হয়েছে, মানুষটি গত হয়েছেন, এখন তো আর গোবর খাইয়ে ঘর ওয়াপসি করানোরও সুযোগ নেই, অতএব মারো এঁকে। ঠিক একইভাবে মনে পড়ল, সেদিন সিলেটে যে মুসলিম মৌলবাদের মস্তানটি চাপাতি হাতে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে আক্রমণ করল, সে নিশ্চয়ই জানে না উনি আসলে কে, ওঁর লেখা কোনও বই চোখে দেখাও তো দূরস্থান।
অবশ্য কাকেই বা দোষ দেব? বিজেপি-আর এস এস যা করলেন, প্রগতিশীল বামশিবিরের লোকজন তো শ্যামাপ্রসাদের মূর্তি ভেঙে একই কাজ করলেন। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির আদর্শগত দেউলিয়াপনা টেনে নামাচ্ছে সংসদীয় বামপন্থীদেরও। বরঞ্চ আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা কী — তা নিয়ে দেশজুড়ে একটা তর্ক তোলা যেত। যেমন বলা যায়, শ্যামাপ্রসাদ যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, বাংলাভাষায় শিক্ষার প্রসারে উনি অত্যন্ত সদর্থক এক ভূমিকা পালন করেছিলেন। তেমনিভাবে, এমন একজন শিক্ষিত আধুনিক মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে বাঙালিদের রাজনীতির মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশের ভগীরথ বলা যেতে পারে। হিন্দু মৌলবাদী শিবির সবসময় এই যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে যে, শ্যামাপ্রসাদ না থাকলে পশ্চিমবঙ্গ নাকি পাকিস্তানে চলে যেত! এই একই যুক্তি কিন্তু শ্যামাপ্রসাদেরই বিরুদ্ধে যায়। তিনি শুধু পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবর্ণ হিন্দু বাঙালিদের কথাই ভাবলেন কেন? পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা কেন তাঁর কাছে ব্রাত্য? সেটা কি সেখানে মুসলমানরা সংখ্যায় অধিক বলে?
অথচ চিত্তরঞ্জন দাশের মধ্যে এর বিপরীত উদাহরণ আমরা পাই। চিত্তরঞ্জন ধর্ম ও জাতপাত নির্বিশেষে সব বাঙালির কথা ভেবেছিলেন। সুগত বসু লিখেছেন, ১৯২৩-এর ‘কোকোনাড়া কংগ্রেস … চিত্তরঞ্জন দাশের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’কে সমর্থন করিয়ে নিতে ব্যর্থ হল, যে-‘প্যাক্টে’ হিন্দু-মুসলিমের সমান ক্ষমতা ভাগাভাগির বন্দোবস্তর কথা বলা হয়েছিল। চিত্তরঞ্জনের রাজনৈতিক শিষ্য সুভাষচন্দ্র বসু দুঃখ করে বলেছিলেন, ওই চুক্তি ‘প্রত্যাখ্যাত হল এই তথাকথিত যুক্তির ভিত্তিতে যে ওতে নাকি মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে এবং জাতীয়তাবাদের নীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে।’ ১৯২৪-এর মে মাসে সিরাজগঞ্জের বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনে কিছু ‘প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুর বাধা’ অতিক্রম করে ওই চুক্তি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরে লালা লাজপত রায় প্রবর্তিত পাঞ্জাব লাইন চিত্তরঞ্জন-সমর্থিত বেঙ্গল লাইনকে হারিয়ে দিল। ১৯২৫-এ চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর মান্দালয় জেল থেকে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের দুই বিরাট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘সাংস্কৃতিক অন্তরঙ্গতা’র অভাব নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন:
ভারতের হিন্দু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধুর চেয়ে বড়ো ইসলাম-বান্ধব আর কেউ ছিলেন বলে আমার মনে হয় না। … হিন্দুধর্মকে তিনি অন্তরের অন্তস্থল থেকে গ্রহণ করেছিলেন; তাঁর ধর্মর জন্য প্রাণ দিতেও তাঁর বাধত না। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি সমস্ত রকম গোঁড়ামি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। সেই কারণেই তিনি ইসলামকে ভালোবাসতে পেরেছিলেন।
–সুগত বসু, দ্য নেশন অ্যাজ মাদার, পেঙ্গুইন, ২০১৭
সুভাষচন্দ্রর আজাদ হিন্দ ফৌজ তো ছিল জাতপাত, ধর্মীয়, ভাষাগত ও লিঙ্গ-বৈষম্য থেকে আশ্চর্যরকম মুক্ত। শ্যামাপ্রসাদ ঠিক এর বিপরীত স্রোতের মানুষ। আসলে তিনি সব বাঙালির প্রতিনিধি নন, সঠিক অর্থে তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গীয় উচ্চবর্ণ হিন্দু বাঙালিদের প্রতিনিধি। প্রথম থেকেই তাঁর মধ্যে কাজ করেছিল ধর্মীয় বিভেদের মতাদর্শ যা আজকের বিজেপি-আর এস এস-এর মূল বিচারধারা। মূর্তি না ভেঙে এসব নিয়ে গণপরিসরে আলোচনা-বিতর্ক চালানো যেত, তাতে জনগণ জানতে পারতেন ইতিহাসে কার অবস্থান কোথায়, সেসব না করে মূর্তি ভেঙে মুড়ি-মিছরি আমরা আর ওরা একই, ‘প্রগতিশীল’রা এই হঠকারী বার্তা দিয়ে বসলেন।