তুষার চক্রবর্তী
নাসিক থেকে ছয় দিনে ১৮০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে ৩৫ থেকে ৫০ হাজার কৃষকের শেষরাতে, ব্রাহ্ম মুহূর্তে, শহরবাসীকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত না করে মুম্বই শহরে নীরবে প্রবেশ করা, মুম্বই ও সারা দেশের নাগরিক হৃদয়কে যেভাবে স্পর্শ করেছে, স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার কোনও তুলনা নেই। লালঝান্ডাধারী দলবদ্ধ কৃষকদের সুভদ্র আচরণ, আত্মমর্যাদার বোধ, কষ্ট স্বীকারের ক্ষমতা, ঋজু মেরুদণ্ড, এ সব দেখে আপ্লুত হয়েছেন ছাত্রছাত্রীসহ আপামর জনসাধারণ। অন্নদাতা এই দেবতাদের অতিথির মতো দেবজ্ঞানে সেবা করেছেন বিখ্যাত ডাব্বাওয়ালাদের শ্রমজীবী সমবায় — যা কৃষকরা গ্রহণ করেছেন। নাগরিকেরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগিয়ে দিয়েছেন জল, পায়ের চপ্পল, কেননা অত দিনের দীর্ঘ যাত্রাপথে তাঁদের অধিকাংশের পাদুকা থাকলেও তা ক্ষয়ে গেছে। বিক্ষত হয়ে গেছে পদতল। চিকিৎসক স্বেচ্ছাসেবীরা যুগিয়েছেন প্রাথমিক চিকিৎসা। শঙ্কিত ও ভীত মুখ্যমন্ত্রী দাবিপত্র গ্রহণ করেছেন, তিনটি প্রধান দাবি লিখিতভাবে মেনে নিয়েছেন ও বাকিগুলি ন্যায্য বলে স্বীকার করেছেন ও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন বলে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মহারাষ্ট্রের আদিবাসী কৃষকেরা এই অভিযানের অন্যতম প্রধান শক্তি। এদের একটা বিরাট অংশ ভূমিহীন ক্ষেতমজুর। অরণ্যের অধিকার আইনের মাধ্যমে জঙ্গলের জমির দাবি ও অন্যান্য অধিকারের দাবি রাখা হয়েছে — এবং সেই দাবিও মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বিনা খরচে চাষিদের ট্রেনে নাসিকে ফেরবার প্রস্তাব দিলেও চাষিরা সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এই কৃষক জাগরণ যে জাতীয় স্তরে রাজনীতির পালাবদলের ইশারা দিচ্ছে — তা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও উপমুখ্যমন্ত্রীর আসনে উপনির্বাচনে বিজেপির নিদারুণ পরাজয়। বাংলা ও ত্রিপুরার নির্বাচনে বামপন্থীদের পরাজয় যে ভারতে বামপন্থার পরাজয়ের সমার্থক নয় — সেটাও এখন স্পষ্ট। কৃষি ও কৃষকের সুস্থায়ী অস্তিত্বের প্রশ্ন কি এবার সত্যিই রাজনীতির কেন্দ্রে উঠে আসতে চলেছে? এই আন্দোলন দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কীভাবে, কতটা বিস্তার লাভ করে সেখানেই এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত লুকিয়ে আছে।
আসলে, ভারতে কৃষি মানুষের প্রধান জীবিকা এবং তা সকল নাগরিকের অস্তিত্বের আধার হওয়া সত্ত্বেও কৃষকের দুর্দশা স্মরণাতীত কাল থেকেই চলে আসছে। ধরিত্রীর মতো কৃষককেও যেন সর্বংসহা হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা। এসব দেখেশুনে, কতকাল আগেই বঙ্কিমচন্দ্র চেতাবনি জানিয়ে রেখেছিলেন যে কৃষকদের আমরা যে অবস্থায় রেখেছি তার ফল সকলকেই ভুগতে হবে। একুশ শতকে এসে সেই দুর্ভোগ এখন বিপদসীমা (= কৃষক শ্রেণির ধৈর্যের অন্তিম সীমা) অতিক্রম করেছে। রাজনীতিবিদদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ধোঁকা আর কৃষক দরদের মিছে বুলি দিয়ে যাকে চাপা দেওয়া এখন প্রায় অসম্ভব।
সংকটের প্রধান লক্ষণ, কৃষক আত্মহত্যা এবং ঋণের দায়ে নিঃস্ব হয়ে চাষীদের চাষবাস ছেড়ে দেওয়া। দুটোর কোনওটাই সাময়িক নয়। নিরবচ্ছিন্নভাবে তা ঘটে চলছে ও প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে দিনে দিনে। প্রান্তিক আর ছোট চাষি শুধু নন, কোনও কৃষকই এই বিপদের আঁচ থেকে এখন আর দূরে নেই। আর ভারতব্যাপী এই সংকটের প্রায় কেন্দ্রে রয়েছে মহারাষ্ট্র, যেখানে, জিন প্রযুক্তি দিয়ে অলাভজনক কৃষিকে ম্যাজিকের মতো লাভজনক করে তোলা যাবে এই প্রতারণায় ফেঁসে, বিদর্ভ অঞ্চলের বিটি-তুলোর চাষিরা কৃষক আত্মহত্যার রাজধানীর শিরোপা তুলে দিয়েছেন মহারাষ্ট্রের মাথায়।
চাষিদের ক্ষোভ সচরাচর ভোট-রাজনীতির ইঞ্জিনে জ্বালানি হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। এখন দিল্লির তখতে বসে থাকা বিজেপিও ২০১৪ সালের নির্বাচনী দাবি ও প্রতিশ্রুতিপত্র; যার পোশাকি নাম ইলেকশন মেনিফেস্টো; সেখানে চাষিদের ফসলের ওপর কমপক্ষে ৫০% লাভজনক দাম নিশ্চিত করবে বলে জানায়। কৃষিবিজ্ঞানী স্বামীনাথন ২০০৭ সালের কৃষি কমিশনের রিপোর্টে চাষিদের বাঁচাবার এটাই প্রধান উপায় হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু তাকে উপেক্ষা করে তখনকার UPA সরকারের কৃষিমন্ত্রী শারদ পাওয়ার ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং উন্নয়নের নাম করে জিন বদলানো জিএম বীজ চালু করার জন্যে উঠেপড়ে লাগেন। চাষিরা বিজেপির প্রতিশ্রুতি দেখে প্রলুব্ধ হয়েছিল। কৃষিসংকট যে সব রাজ্যে অত্যন্ত তীব্র, দেখা যাবে — মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল, পাঞ্জাব ও কর্ণাটকের মতো সেইসব রাজ্যেই ক্ষমতা দখল করেছে বিজেপি। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করেন যে ২০২২ সালের মধ্যে চাষীদের আয় তিনি দ্বিগুণ করে দেবেন। ক্ষমতায় তিন বছর থাকার পরেও স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ চালু করার কোনও উদ্যোগ কিন্তু সরকার নেয়নি। বরং বিমুদ্রাকরণের পর থেকে ফসলের বাজারমূল্য ও পাইকারি ক্রয় কমেছে। তাতে আরও ইন্ধন যুগিয়েছে কর কাঠামোর পরিবর্তন বা GST। বর্তমান বাজেট স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশের একটি বিকৃত রূপকে দাখিল করেছে। দুধের বদলে যেন পিটুলির গোলা।
নিরুপায় হয়ে, বিক্ষুব্ধ কিষান-রা আন্দোলন ও বিক্ষোভের পথে নামছেন। কিন্তু কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম তা চেপে যাচ্ছে। মধ্যপ্রদেশে গত পাঁচ বছরে কৃষি উৎপাদন জাতীয় কৃষি উৎপাদনের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে! অথচ তাতে চাষিদের দুর্ভোগ কমার বদলে বরং আরও বেড়ে গেছে। ফসলের উপযুক্ত দাম না পাওয়া যার প্রধান কারণ। চাষিরা এই নিয়ে বিক্ষোভ জানাতে রাস্তায় নামলে গতবছর মধ্যপ্রদেশ পুলিশ মান্দসৌরে গুলি চালিয়ে ছয়জন চাষিকে হত্যা করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে আত্মহত্যার মতো, চাষিরা শহিদ হলেও তাতে বিজেপি সরকারের টনক নড়ছে না। এমনকি দেশের শহরবাসী মানুষের কাছেও এইসব বার্তা পৌঁছে দেওয়ার তেমন কোনও উপায় নেই।
এর মধ্যে, কৃষিঋণ হিসেব করা ও বাতিলের জন্য তৈরি মহারাষ্ট্রের সেৎকারী সুকানু সমিতি বা স্টিয়ারিং কমিটি চাষিদের ৭৭ হাজার কোটি টাকার ঋণের হিসাব সরকারের কাছে পেশ করে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী মাত্র ৩৪০০ কোটি টাকা দিতে রাজি হয়েছেন। চাষিরা সঙ্গত কারণেই এই মুষ্টিভিক্ষা প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিজয় মাল্য, নীরব মোদিদের ব্যাংক তছরুপ, ধনী ব্যবসায়ীদের লক্ষ কোটি টাকা অনাদায় ঋণ মকুব, এসব হাসিমুখে করা হলেও দেশের অন্নদাতাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া থেকে সরকারের এই নক্কারজনক পিছু হটা চাষিদের সম্মিলিত সংঘবদ্ধ আন্দোলনের গুরুত্ব সামনে আনে।
হান্নান মোল্লার উদ্যোগে সারাভারত কিষান সভা প্রথমে নাসিক থেকে মুম্বাই কিষান অভিযান বা লং মার্চের সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতে অর্থনীতি, পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়নে রাজনীতির ও রাষ্ট্রের ভূমিকা ও কৃষক বিষয়ক নীতি কী হওয়া উচিত — সেই প্রশ্নটি এই কৃষক অভিযান গুরুত্বের সঙ্গে সামনে এনেছে। শুধু ঋণ বাতিল নয়, কৃষিনীতির অভিমুখ পাল্টানো ও দীর্ঘস্থায়ী ও সুস্থায়ী কৃষিনীতি নিতে সরকারকে বাধ্য করা যার লক্ষ্য। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরনের কিষান অভিযান এরপর ছড়িয়ে দেওয়া হবে। কৃষকদের সমস্যা এদেশের প্রধানতম সমস্যা, এটা যত তাড়াতাড়ি রাজনীতির কারবারিরা ও রাষ্ট্র বুঝে নেয় ও সেইমতো কাজ করতে শুরু করে, ততই মঙ্গল। মহারাষ্ট্রে কিষান লং মার্চ এই বুঝিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা শুরু করে দিল।
Khub bhalo lekha…