স্বাতী ব্যানার্জীর লেখা

স্বাতী ব্যানার্জী

 

প্রায় দিনের মতোই স্কুলে এসে বড়দির রুমে সই করতে গিয়ে মেজাজ গরম হয়ে যায় দুর্গাদির। ক্লাস সেভেনের লক্ষ্মী বাউড়ির মা বাবা এসেছে তার বিয়ের সুখবর দিতে। এই বৈশাখেই বিয়ে। পাত্র ইসিএলের ডাম্পার চালায়, প্রথম বিয়ে, মাধ্যমিক ফেল, ননদের বিয়ে হয়ে গেছে অর্থাৎ এককথায় রাজপুত্র। অবশ্য রাজপুত্রের বয়স একটু বেশি, তাতে কী? হিরের আংটি আবার বাঁকা। লক্ষ্মী এককোণে দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের আঙুল দেখছে, বেচারি পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার শোকে মুহ্যমান। এই ক্ষয়াটে বাচ্চা মেয়েটি পড়াশোনা ছেড়ে একটা গোটা সংসারের সমস্ত চাপ সামলাবে আর একবছর বাদে নিজের মতোই আরেকটি অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেবে বা দিতে গিয়ে মারা যাবে। তাতে দেশের, সমাজের বা ওর নিজের কী উপকার হবে শুনি? খিঁচিয়ে ওঠেন দুর্গাদি। বড়দি আর অন্য সব দিদিদের অনেক বোঝানোতেও রাজি হয় না লক্ষ্মীর মা বাবা, কারণ তার আরও দুটো বোন আছে। পুলিশের ভয় দেখালে লুকিয়ে দেশের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দেবে। তারা শুধু জানতে এসেছেন এরপরেও কন্যাশ্রীর টাকাটা পাওয়া যাবে কিনা? বেশি বোঝাতে গেলে গণপ্রহারের ঝুঁকি আছে।

অসহায় রাগে গজগজ করতে করতে ক্লাস টেনে যান দুর্গাদি। অন্যদিনের মতোই লাস্ট বেঞ্চে বসে আছে পিংকি। ক্লাস এইটেই বিয়ে হয়ে গেছিল পিংকির। ছেলে হয়নি বলে সব গয়না কেড়ে শাশুড়ি তাড়িয়ে দেয়। ছেলের আবার বিয়েও দিয়েছে। একবছর ঘরে বসেছিল পিংকি। পরে ড্রপ আউট ফেরানোর প্রকল্পে দিদিরা বার বার বলে বুঝিয়ে পিংকিকে আবার স্কুলে ফিরিয়ে আনেন। পাশ করেই ক্লাসে উঠেছে সে। একটু বড় বয়সে পড়ছে, সেই লজ্জায় মেয়েটি কারুর সাথে মেশে না। মরা মাছের মতো বিবর্ণ চোখ নিয়ে বসে থাকে পিংকি বেগম। তাও পিংকি ফিরে এসেছে, স্কুল পালিয়ে দিকু ছেলেকে বিয়ে করা সুচিত্রা টুডু নিখোঁজ। শেষ কল ট্রেস করা গেছিল উত্তর প্রদেশে। এত করে ক্লাসে বলেন মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে, নিজেরা রোজগার করতে, কিন্তু বাচ্চারা বুঝলে তো। মোবাইলে প্রেম থেকে বিয়ে আর তারপর পাচার। পড়াশোনার পাশাপাশি মেয়েদের বিউটি পার্লারের কাজ, কাঁথা স্টিচের কাজ বা টিউশনি করাতে বলেন দুর্গাদি। খুব সামান্য কাজ হয়। শুধু হাসি আর গল্প করতে গিয়ে মোবাইল থেকে ফাঁদে পড়ে যায় মেয়েগুলি। নিজেকে বড় অসহায় লাগে দুর্গাদির।

Child Rights and You (CRY)-এর সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে সবথেকে বেশি নারী পাচারকারী পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ একটি। শুধু ২০১৬ সালে ছাত্রী পাচারের অভিযোগ ৪৪২টি। মুর্শিদাবাদ শীর্ষে। পিছিয়ে নেই বীরভূম বর্ধমানও। রাজ্যের ৫৪% ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যায় আঠারো বছরের ঢের আগে। এই বিষয়ে বিভিন্ন NGOগুলি কলকাতা বা সংলগ্ন অঞ্চলে যে হারে কাজ করে তার একশো ভাগের এক ভাগও হয় না জেলার মফস্বল বা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। রোলকল করতে করতে সদ্য পড়া এই তথ্যগুলি মনে পড়তে থাকে বারবার।

ক্লাসে মন বসাতে পারেন না দুর্গাদি। ঘণ্টা পড়লে বড়দির ঘরে গিয়ে লক্ষ্মীকে ডেকে নেন ইউনিট টেস্টের খাতা দেখার নাম করে। মা বলে ওঠে, “আর উ লম্বর লিয়ে কি করবেক দিদিমনি?” কন্যাশ্রী পেতে গেলে লাগবে বলে মেয়েটিকে সোজা স্টাফরুমে ডেকে আনেন দুর্গাদি। সব দিদিরা লক্ষ্মীকে বোঝাতে থাকেন নাবালিকা বিবাহের কুফল আর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুফল সম্পর্কে। মেয়েটির হাতে একটি কাগজে লিখে দেওয়া হয় লোকাল থানা, বিডিও আর চাইল্ড লাইনের ফোন নম্বর। আস্তে আস্তে আলো হতে থাকে লক্ষ্মীর মুখ। একসময় বলে, ‘মা যদি ফোন নম্বরগুলো দেখে ফেলে?’ “কোনও চিন্তা নেই, কবে বিয়ে আমাদের খবর দিবি, আমরা ব্যবস্থা করব, আর মুখস্হ করবি ১০৯৮ নম্বরটা। আমাদের জানাতে না পারলেও এখানে নিজে বা বন্ধুদের দিয়ে জানাবি। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।” লক্ষ্মীকে মা বাবার কাছে ফেরত পাঠিয়ে হাসিমুখে পরের ক্লাসে যান দুর্গাদি।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. একটি গুরুতর সমস্যা তুলে ধরার জন্য লেখিকাকে কুর্নিশ। কিন্তু একটা ব্যাপার বলার দরকার। লেখাটা পড়ে লক্ষ্মীর এবং সেই সূত্রে সমস্ত গ্রামীণ মা বাবাদের প্রতি একটা বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়ে যায়। এটা কি লেখিকার সচেতন প্রয়াস? মানে, উনিও কি তেমনটাই ভাবেন? যদি ভাবেন, তাহলে বলব উনি সমস্যাটির কিছুই বোঝেননি। আর যাদি না ভাবেন, এবং এটা অনিচ্ছাকৃত হয়ে থাকে, তবে আরও সতর্কতার দাবী করব। ধন্যবাদ…

আপনার মতামত...