ইন্দ্রনীল মজুমদার
কলকাতার গুরুসদয় দত্ত সংগ্রহশালা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই অসামান্য সংগ্রহশালাটিকে বাংলার অবিনাশী মুখমুকুর ভাবলেও ভুল হয় না। কালীঘাট পট আর বাংলার গৃহবধুদের সৃষ্টি করা কাঁথার সম্ভারে এটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করা যেতে পারে, যাদুঘরের সংগ্রহের কথা মনে রেখেও। কাঁথার সূচিশিল্পে অনামী, স্বশিক্ষিত গৃহবধুদের কাজে সহজ বৈষয়িকতা ও সহজাত শিল্পবোধের যে লৌকিক মিশ্রন তারই মূল অন্বেষণ করেছিলেন গুরুসদয়। তাঁর ইংরাজি প্রবন্ধ The Art of Kantha এ ব্যাপারে একটি স্মরণীয় দিগদর্শন। এই লেখাটির প্রথম অংশ সেই প্রবন্ধের অংশবিশেষের অনুবাদ কোনও উদ্ধৃতিচিহ্ন ছাড়া। দ্বিতীয় অংশটি তাঁরই ভাবনাসূত্রের নিজস্ব বিস্তার ও চিত্ররূপ।
১
সুজনি কাঁথা বা বিছানার চাদর যেগুলি বিবাহের মতো অনুষ্ঠানে মান্যগণ্য অতিথিদের বসানোর জন্য ব্যবহৃত হত — এগুলি সাধারণত বড়, আয়তাকার এবং এগুলির গড় আয়তন ৬ x ৩১/২ ফুট।
একটু বড় আকৃতি আর কম পুরু হওয়ার জন্য এগুলি মহিলাশিল্পীদের সৃষ্টিপ্রতিভাকে পূর্ণ সুযোগ দিল অঙ্কনকাঠামোকে নতুনভাবে চিন্তা করে, সূচ দিয়ে রঙ ও রেখার সমন্বয়ে নতুন আশ্চর্য নকশা ফুটিয়ে তুলতে। তাই বাঙালি গৃহিণীদের সূচিশিল্পকলার চূড়ান্ত প্রকাশ এই সুজনি কাঁথা। কাঁথার মধ্যে বিভিন্ন ডিজাইনের সীমারেখা (আউটলাইন) আগে রঙিন সুতো দিয়ে চিহ্নিত করে তার পরেই জমি ভরাট হয় বিভিন্ন প্যাটার্নে। সেখানে ঘন সূচিকর্মের জন্য কাঁথাটিতে ছোট ছোট অনুচ্চ তল তৈরি হয়। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই কাঁথাটি টেঁকসই করে ব্যবহারের জীর্ণতা আটকানো। আবার সূচের দ্বারা বোনা নকশা করা ঘনতলগুলি কাঁথাটিকে নিবিড়ভাবে অলঙ্কৃত একটি বিস্তৃত ক্যানভাসের চেহারা দেয়। সেখানে অলঙ্করণের কাজে লাগছে গাছ, ফুল, পশুপাখি আর শিল্পীর বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ নিত্যকর্মে নিযুক্ত নারীপুরুষের দেহভঙ্গিমা। হাতি ময়ুর ঘোড়া বিশেষভাবেই প্রিয় মোটিফ। সঙ্গে আছে স্ত্রীপুরুষের মিলিত উপস্থিতিতে ও বিশিষ্ট দেহভঙ্গিমায় ধরে রাখা আকর্ষণীয় গল্পমালা।
সাধারণত সুজনি কাঁথার চারপাশে দুই বা তিন থাকে সীমারেখা ধরে সারিবদ্ধ অলঙ্করণ থাকে যাতে চারদিকের বর্ডার শক্তপোক্ত হয়। আবার এই আয়তাকার সেলাইয়ের কোণে কোণে রাখা হয় কদম্ব গাছ বা কলকা। এই কলকা বা পত্রাকার ডিজাইন সবক্ষেত্রেই পৃথক এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পীর স্বকীয় সৃষ্টিকল্পনারই প্রকাশ। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল একজন শিল্পী কিন্তু কখনওই অন্যের অনুকরণ করছেন না। নিজের কল্পনা ও অভিজ্ঞতায় ভর করে তিনি এমন ডিজাইন বুনছেন যেটি ঐ গ্রামের বা ঐ পরিবারের সকলের পূর্ববর্তী ডিজাইন থেকে আলাদা।
সাধারণত কাঁথার শিল্পকলা দোরোখা হয় যাতে করে দুদিকেই ডিজাইনটি ফুটে ওঠে। ডিজাইনটি সুস্পষ্টভাবে সামনে এবং একটু অস্পষ্টভাবে বিপরীত দিকে। কিন্তু সবচেয়ে শিল্পিত উদাহরণে সেলাই এত নিঁখুত যে একই রঙে একই ডিজাইন বা ছবি দুদিকেই এতটাই পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে যে সোজা উল্টো বিচার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।
একটি প্রধান ও ঐতিহ্যগত রূপকল্প হল কাঁথার কেন্দ্রে এককেন্দ্রিক গোলাকার মণ্ডল ও সেটিকে ঘিরে বাকি জমিতে মানুষ, গাছ, পশুপক্ষী আর বিভিন্ন সামাজিক চিত্রণ। এই মণ্ডলের গঠনটি খুবই চিত্তাকর্ষক। মণ্ডলের কেন্দ্রে সর্বত্রই আছে শতদল পদ্ম। হয়ত সংখ্যায় নির্দিষ্টভাবে শতদল নয়, কিন্তু পদ্মের বা দলের সংখ্যা একাধিক করে শতদল পদ্মেরই রূপকল্পনা। এই কেন্দ্রীয় শতদল পদ্মটিকে ঘিরে উঠছে একাধিক এককেন্দ্রিক (concentric), সুতোয় তোলা অলঙ্কৃত বৃত্ত যেগুলি প্রতিটি একে অন্যের থেকে আলাদা। সবশেষে পুরো মণ্ডলটিকে কলস বা শঙ্খ শৃঙ্খলে পরিবৃত করা হয়ে থাকে।
এই সাধারণ রূপ — অর্থাৎ একটি মণ্ডল ও তাকে ঘিরে মানব ও পশুপক্ষী জীবন — ভারতের প্রাচীন দর্শনের উত্তরাধিকার, যে উপলব্ধিতে আছে জীবজগত ও প্রাণীজগতের নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য এক বন্ধন। আবার এটি বৈষ্ণব শাস্ত্রের রাসমণ্ডল তত্ত্বেরও কথা। সাযুজ্য আছে তন্ত্রের যন্ত্ররূপের (জ্যামিতিক নকশা) সঙ্গেও যেখানে সৃষ্টির আধ্যাত্মিক কেন্দ্রে রয়েছে একটি কেন্দ্রাতিগ বৃত্তের মধ্যে কেন্দ্রীয় সেই শতদল পদ্ম। বাঙালি হিন্দু স্ত্রীলোকের অবচেতন যে সুপ্রাচীন কাল থেকেই গভীরভাবে বৈষ্ণব ভাব ও তান্ত্রিক হিন্দু আচারের দ্বারা প্রভাবিত ছিল কাঁথার এই কেন্দ্রীয় মণ্ডল সেকথাই মনে করিয়ে দেয়। আবার এই মণ্ডল প্রতীক খুবই প্রাচীন ও সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক। বৌদ্ধ, বৈষ্ণব ও বিভিন্ন তান্ত্রিক চিন্তা যুগে যুগে মণ্ডলের মূল চিত্রকল্পটিকে অক্ষুণ্ণ রেখেই কিছু বাহ্যিক রূপান্তর ঘটিয়েছে মাত্র। কাঁথার মণ্ডল আলপনাও (যার সঙ্গে কাঁথার ডিজাইনের অঙ্গাঙ্গী মিল আছে) মণ্ডলের মতোই সুপ্রাচীন প্রাগার্য যুগেরই অবদান মনে হয়। বহুমুখী বঙ্কিম স্বস্তিক চিহ্ন মোটিফও বারবার কাঁথায় ব্যবহৃত হয়েছে। এটা হয়তো চতুর্ভুজ স্বস্তিক বা বৌদ্ধদের ধর্মচক্র চিত্রণের প্রভাব কারণ কাঁথায় কখনও কখনও স্বস্তিক চিহ্নের বাহুগুলি বৌদ্ধ ধর্মচক্রেরই মতো সোজা, বঙ্কিম নয়। আবার কাঁথার কুঁড়ি বা ফুলের চেরা রূপের (cross section) থেকেও আসতে পারে। এর স্বপক্ষের যুক্তি এই যে এই একই মোটিফ আলপনায় ব্যবহৃত হলে তাকে বলা হয় পেঁচানো ফুল অথবা সোজাসুজি চালতা ফুল।
একটি ঘন-অলঙ্কৃত সুজনি কাঁথা প্রায়শই একটি পরিবারের মহিলাদের বংশানুক্রমিক ক্রমান্বয়ী শিল্পসৃষ্টি। এত নিবিড় ও বিস্তৃত কাজ একজন তাঁর জীবদ্দশায় শেষ করতে পারতেন না বলে সেই সৃষ্টি তাঁর কন্যা বা দৌহিত্রীরা সম্পূর্ণ করতেন। তাই সুজনি কাঁথাকে একটি পারিবারিক উত্তরাধিকার বলেই সযত্নে রক্ষা করা ও প্রদর্শন করা হয়।
কাঁথার সৃষ্টিকলা তাই অন্তঃপুরবাসিনীদের এক শান্ত আনন্দের উদযাপন যার মধ্যে ধরা আছে মিতব্যয়িতা, সৌন্দর্যবোধ ও কলাকৌশলের এক অপরূপ মিশ্রণ। এর মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছে তাঁদের পর্যবেক্ষণ, আনন্দময় প্রকৃতি ও মানবজীবনের নিবিড় অনুভব — যেটি সন্তর্পণে এড়িয়ে যেতে শেখায় সবরকম বিলাস, জটিল আবর্ত বা রুচির গর্বিত ঘোষণা।
২
উপরের উদ্ধৃত অংশে শ্রী গুরুসদয় দত্ত বাঙলার কাঁথাশিল্পের মানসযাত্রার যে অসামান্য দিক নির্দেশ করেছেন তাকে একটু বড় করে ভাবা যেতে পারে। কাঁথার অবগুণ্ঠিতা শিল্পীরা তাঁদের শিল্পযাত্রায় যে গভীর নির্জন পথে চলেছিলেন সেখানে তাঁদের সাথী শুধু তাঁদেরই অবচেতনের নিহিত পাতাল ছায়া। সেখানেই অধিষ্ঠান সৃষ্টির অখণ্ড মণ্ডল যার বুকে বুকে ফুটে আছে সহস্রদল পদ্ম। ষটচক্র ভেদ করে চিৎশক্তির পূর্ণ প্রস্ফুটন সহস্রার পদ্মে। একটি একটি করে সেই পদ্মের দল ফুটে ওঠে একটি একটি বীজমন্ত্র (সংস্কৃত বর্ণমালার বর্ণে)। বাঙালি চেতনার গভীরে পুরাকাল থেকেই দুলছে এই পদ্ম, ধারণ করছে তার ধর্ম ও শিল্পের একক যাত্রা।
“হৃদপদ্মে প্রকাশিয়ে সহস্রারে মন রেখেছি
কুলকুণ্ডলিনী শক্তিপদে আমি আমার প্রাণ সঁপেছি।”
–রামপ্রসাদ
আবার
“আটকুঠুরী নয় দরজা আঁটা মধ্যে মধ্যে ঝলকা কাটা,
তার ওপরে সদরকোঠা — আয়নামহল তায়।”
–লালন
[১]
[২]
[৩]
[৪]
কয়েকটি ছবিতে এটি দেখা যেতে পারে। ১ নং ছবিটি গুরুসদয় সংগ্রহশালার একটি অসামান্য সুজনি কাঁথার। মণ্ডলের কেন্দ্রে সহস্রার পদ্ম, সেটিকে ঘিরে আছে শঙ্খের বহির্মণ্ডল। আবার সেটিকে ঘিরে আছে নিটোল বৃত্তে একটি স্মরণীয় বাক্যবন্ধ। “এই সজনী শ্রীষুক্ত বরদাকান্ত বসুর কন্যা আমি শ্রীমতী মানদাসুন্দরী দাস্য মম হস্তে প্রস্তুতপূর্বক শ্রীযুক্ত পিতাঠাকুর মহাশয়কে এই সজনী প্রণামপূর্বক দিলাম। সভ্যগণ মহাশয়েরা যে ত্রুটি হয় মাপ করিবেন।” খুলনার গৃহবধু মানদাসুন্দরী। এই সুজনি কাঁথার বাকি অংশের অলঙ্করণ — উপরে ও নিচে সীমারেখা ধরে ভারতীয় ও ইংরাজ সৈন্যদের সারি, অন্দরমহলে মেয়েদের ব্রত অনুষ্ঠান, বহির্মহলে বাবু, গণিকা ও নর্তকী বিভিন্ন ভঙ্গিমায় আর প্রয়োজনমতো মাছ, পাখি, মকর মোটিফ। এই সবই লোকশিল্পের বহুব্যাপ্ত অভিমুখ, মন্দিরের টেরাকোটা ফলকেও। এই বিষয়টিও সবিশেষ আলোচনার অপেক্ষায় আছে। ২ নং ছবিটি আধুনিক শিল্পী গুলাম মহম্মদ রসুলের আঁকা কুণ্ডলিনী চক্র ও সহস্রার পদ্মের রূপকল্পনা। এটি ১৯৭৮ সালের সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার প্রচ্ছদ থেকে নেওয়া। ৩ নং ছবিটি একটি দুর্জানি কাঁথার (থলি বা ওয়ালেট বোনা) প্রথাগত পদ্ম কল্পনা। ৪ নং ছবিটি অষ্টাদশ শতকের একটি রাজস্থানী অনুচিত্রিত পুঁথিতে তন্ত্রের সহস্রার পদ্মের ক্রমবিস্তার ও দল অনুযায়ী মন্ত্রের পবিত্র আদ্যাক্ষর। এই ছবিটি পেয়েছিলাম বিদেশে প্রকাশিত, শ্রী অজিত মুখোপাধ্যায় প্রণীত KALI গ্রন্থটি থেকে। ছবিগুলি পরপর দেখলে (বিশেষত ৩নং ও ৪নং ছবি) বোধহয় বোঝা যাবে শ্রীষুক্ত গুরুসদয় দত্ত মশাই কতটা গভীরে ভেবেছিলেন।
এই আলোচনা হয়তো এক নিগূঢ় চিত্রকল্পের অতি সরলীকরণ হল। বলার কথা এইটাই যে কাঁথার অলঙ্করণে ও বিন্যাসে অনেক ভাবনা, অনেক গহনমনের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। মন্দিরগাত্রের বা লৌকিক অনেক শিল্পমাধ্যমের প্রকাশভঙ্গির মতোই। ভাবা যেতে পারে পদ্মের আরও অনেক রূপ। দেবদেবীর মূর্তি কল্পনায় অথবা কালী যন্ত্রে (মণ্ডলের মধ্যে ত্রিকোণ ও ত্রিকোণের মধ্যে আদিবিন্দু)। আমরা শুধু শোনার চেষ্টা করতে পারি এক গভীর গহন বাণীর দুরাগত প্রতিধ্বনি।
Beautiful,very nice.