প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
পঞ্চম পর্বের পর
সুবর্ণরেখা (১৯৬৫)
ঋত্বিক ঘটকের আরেক অমর সৃষ্টি ‘সুবর্ণরেখা’ বাষট্টি সালের গোড়ায় নির্মিত হলেও তা প্রকাশিত হয় উনিশশো পঁয়ষট্টির প্রথমার্ধে। জে জে ফিল্মস্ কর্পোরেশন প্রযোজিত এই ছায়াছবিটির গল্পকার যৌথভাবে স্বয়ং ঋত্বিক এবং তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু রাধেশ্যাম ঝুনঝুনওয়ালা। সাতচল্লিশ (১৯৪৭) সালের দেশভাগের পটভূমিকায় গ্রন্থিত পূর্ব পাকিস্তান থেকে উঠে আসা হিন্দু উদ্বাস্তু সমাজের দুঃখ দুর্দশা ও তাদের জীবন সংগ্রামের নানা ওঠাপড়ার ঘটনা নিয়ে তৈরি হয় ‘সুবর্ণরেখা’। সিনেমার অন্যান্য কলাকুশলীদের বিশেষ কোনও পরিবর্তন এই সিনেমায় চোখে পড়ে না। সম্পাদনায় — রমেশ যোশী, চিত্রগ্রহণ — দিলীপরঞ্জন মুখার্জি, শব্দগ্রহণে — সত্যেন চ্যাটার্জি ও শিল্পনির্দেশনায় — রবি চ্যাটার্জি উল্লেখনীয়। তবে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ পরিবর্তন লক্ষণীয়। এই প্রথম সঙ্গীত পরিচালনায় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র-র পরিবর্তে সুরারোপ করেন বিখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ বাহাদুর হুসেন খাঁ সাহেব। সঙ্গীতগ্রহণে — শ্যামসুন্দর ঘোষ এবং সহকারী এভেল কুলান, পাঁচু ঘোষ ও ভোলানাথ সরকার উল্লেখযোগ্য। এই প্রথম ‘ঋত্বিক শিবির’-এ নেপথ্য কণ্ঠ হিসেবে যোগদান করেন গায়িকা আরতি মুখার্জি, অবশ্য রনেন রায়চৌধুরী অপরিবর্তনীয়। ছবি মুক্তি পাবার আগেই অবশ্য অন্যান্যবারের মতোই এবারও ঋত্বিক যথেষ্টই ব্যস্ত। ’৬২ থেকে ’৬৫-র মাঝেই তিনি লিখে ফেললেন কুমারী মন (১৯৬২), দ্বীপের নাম টিয়ারঙ (১৯৬৩), এবং রাজকন্যা (১৯৬৫) নামক ছায়াছবিগুলির চিত্রনাট্য। এছাড়া বানিয়ে ফেলেছেন পুনে FTI-এর ছাত্রদের জন্য Scissors (১৯৬২), Fear (১৯৬৫), এবং Rendezvous (১৯৬৫)-র মতো স্বল্পদৈর্ঘ্যের ফিল্ম ও ডকুমেন্টারি। এই পর্যায়েই ‘বগলার বঙ্গদর্শন’ নামের একটি সিনেমা তৈরি করা শুরু করেও শেষ করতে পারেননি।
অবশেষে ঋত্বিক ধীরে ধীরে শেষ করেন তাঁর স্বপ্নের ‘সুবর্ণরেখা’। বাহাদুর খাঁ সাহেবের সঙ্গীত পরিচালনায় এই ছায়াছবির সঙ্গীত ও তার গান বঙ্গদেশের আপামর জনসাধারণের চিত্তহরণ করেছিল। ছবির টাইটেল পেজ ওঠার সময় সেতার, বাঁশি, ক্ল্যারিওনেট ও জলতরঙ্গের অর্কেস্ট্রা শোনা যায় এবং নেপথ্যে শঙ্করাচার্যের ‘মোহমুদগর’ থেকে নির্বাচিত শ্লোক পাই। কেদার রাগে আশ্রিত এই অংশবিশেষ ছবির শুরুতেই দর্শকদের মোহাবিষ্ট করে রাখে।
অবশেষে সিনেমা শুরু হয়।
সিনেমার শুরুতেই আমরা দেখতে পাই একটি উদ্বাস্তু কলোনি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছিন্নমূল হয়ে উঠে আসা কিছু উদ্বাস্তু মানুষ ভিড় জমায় সেখানে। সেই ভিড়ের মধ্যে আছে বাগদি বউ ও তার ছেলে। এমন সময় উচ্ছেদকারী পুলিশের বেশে ভাড়াটে গুণ্ডার দল সেখানে পৌঁছয়। তারা বেশ কিছু মানুষকে বলপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায় নাম না জানা ঠিকানায়। পেছনে পড়ে থাকে বাগদি বউ-এর ছেলে (পরবর্তীকালে যার নাম হবে ‘অভিরাম’)। সন্তান ও তার মায়ের এই বিচ্ছেদপর্বে আবহে বেজেছে ‘সেতার’। সেতারের দ্রুত অঙ্গের ঝালা পরিবেশনায় দৃশ্যটি বিশেষ গতি ও তীব্রতালাভ করে।
পরবর্তী দৃশ্যে আমরা দেখি কাহিনির মূল চরিত্র ঈশ্বর চক্রবর্তী, যে কিনা নিজেও উদ্বাস্তু এবং একমাত্র ছোটবোন সীতাকে নিয়ে ‘নবজীবন কলোনি’ নামক উদ্বাস্তু পাড়ায় বসবাস, মানবিকতার খাতিরে বাগদি বউ-এর ছেলেকে দত্তক নেয়। তার জীবন বলতে শুধু তার বোন ও অভিরাম। চাকরির খোঁজে বেরিয়েও ঈশ্বর কোনও চাকরি পায় না। এমন সময় হঠাৎই তার দেখা হয় তার একসময়ের কলেজ জীবনের মাড়োয়ারি অ-বাঙালি বন্ধু রামবিলাসের সাথে। রামবিলাস অবস্থাপন্ন, স্বচ্ছল ব্যক্তি। সে তার কলেজজীবনের বন্ধু ঈশ্বরকে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। সেখানে তার ‘গুরুদেব’ উপবিষ্ট। এক বিখ্যাত ওস্তাদ গুরুদেবের চিত্তবিনোদনের জন্য সরোদ পরিবেশন করেন। এই দৃশ্যে স্বয়ং সঙ্গীত পরিচালক বাহাদুর খান ওস্তাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ। রাগ শুদ্ধ কল্যাণের একটি দ্রুত গৎ এখানে শোনা যায়।
সরোদ বাদনের অব্যাহতিতে ঈশ্বর ও তার বন্ধু রামবিলাস বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলেন এবং রামবিলাস তার বন্ধুকে ঘাটশিলার নিকট রাঢ়বঙ্গে তার লোহার কারখানার খাজাঞ্চি (Accountant)-র চাকরি গ্রহণ করতে বলে। এই দৃশ্যের নেপথ্যে আবছাভাবে উঠে আসে সরোদের তার ও তবলা মেলানোর আওয়াজ। ঈশ্বর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলে পেছনে হালকা সুরে সরোদ বেজে ওঠে আবার। রাগ — চন্দ্রনন্দন।
এ ছবিতে বাউল গানও একটি বিশেষ স্থান দখল করে। পরবর্তী দৃশ্যে দেখা যায় কলোনিপাড়ায় এক বাউল গান গাইছে। গানের কথা হল — ‘দেহতরী ছাইড়া দিলাম/গুরু তোমারই নাম করে/আমি যদি ডুইব্যা মরি/(গুরু) কলঙ্ক কোরো বেনামে।’ রণেন রায়চৌধুরীর কণ্ঠে উপরিউক্ত গানটি সিনেমার বড় সম্পদ। এই গানের মধ্য দিয়েই ঈশ্বর তার ‘নতুন বাড়ি’তে যাবার সংকল্প স্থির করেন। তার সবচেয়ে বড় কারণ তার বোন সীতা ও ‘দত্তক’ ভাই অভিরাম। তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঈশ্বর এই সংকল্প নেন। কিন্তু এরজন্য তার একান্ত সুহৃদ বন্ধু হরপ্রসাদের বিরাগভাজন হতে হয়। হরপ্রসাদ তাকে ‘escapist’ (পলাতক) বলে ভৎর্সনা করেন। এত কিছু সত্ত্বেও একদিন ঈশ্বর নতুন ভবিষ্যতের মুখ চেয়ে সীতা ও অভিরামকে নিয়ে দূর পশ্চিমে পাড়ি দেন।
পরবর্তী দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই ঈশ্বর, তার বোন সীতা ও অভিরাম ঘাটশিলায় তাদের নতুন বাড়িতে আসেন। নতুন জীবন, নতুন দেশ, নতুন আচার-আচরণ। অভিরামের হঠাৎই তার মায়ের কথা ভেবে দুঃখ হয়। সে কেঁদে ফেলে। সীতা তাকে সান্ত্বনা দিতে আসলে সে ছুটে পালিয়ে যায়। একটি জীবন শেষ ও আরেকটি জীবন শুরুর এই মাহেন্দ্রক্ষণে সুরকার পুনরায় ‘মোহমুদগর’ থেকে (রাগ কেদার) সেই শ্লোকধ্বনিকে নেপথ্যে ব্যবহার করেছেন।
এভাবেই অবশেষে উঠে এসেছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। দিন কাটতে থাকে। আমরা দেখি সেই ছোট্ট সীতা একটু একটু করে বড় হয়। গানের মাস্টারমশাই-এর কাছে সে গান শেখে। প্রকৃতি পর্যায়ের সেই গান — ‘আজ ধানের ক্ষেতে/রৌদ্র ছায়ায়/লুকোচুরি খেলা’। সিনেমাতে এই গানটির শিশুকণ্ঠে প্রয়োগ যেন ‘জীবন’ নামক ধানের ক্ষেতে সুখ (ছায়া) ও দুঃখের (রোদ) যে নিরন্তর আসা যাওয়া সেই গভীর দর্শনবোধকেই তুলে ধরেছে।
তালতন্ত্রের প্রয়োগও এই সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ। এমনই একটি দৃশ্যে সীতা ও অভিরাম হাত ধরাধরি করে এরোড্রামে দৌড়াদৌড়ি করে খেলা করে। একসময় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে গোরা সৈন্যরা এই এরোড্রাম তৈরি করেছিল। আজ সেখানে দুই বন্ধু খেলা করে। আনন্দঘন এই দৃশ্যে সুরকার ক্ল্যারিওনেট, সেতার ও তালতন্ত্রের এক অনবদ্য মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এই দৃশ্যের রেশ ধরে আমরা দেখতে পাই ‘বহুরূপী’ চৈতন্যকে। হঠাৎই কালীবেশে সে ক্রীড়ারত সীতার সামনে এসে পড়ে। সীতা ভয় পেয়ে যায়। বৃদ্ধ ম্যানেজারবাবু চৈতন্যকে মৃদু তিরষ্কার করলে সে লজ্জিত হয়ে চলে যায়। সীতার জীবনে এই প্রথম অদ্ভুত অভিজ্ঞতার নিরিখে আবহে বাঁশির মেঠো সুর বাজানো হয়েছে।
এরপরের দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, পরিণীতা সীতাকে। সে একটি টিলার উপরে বসে গান গায়। তার সামনে রুক্ষ মানভূম। নদী, জঙ্গল ও পাথর। নেপথ্যে ব্যবহৃত হয়েছে সরোদ ও মৃদঙ্গম। সীতা আপনমনে গান গায়। ভৈরব রাগের সেই বাদন — ‘এরি দেখো ভোর ভয়ি’। তার খেয়ালও নেই পেছনে তার দাদা ঈশ্বর তার গান শুনছে। এই গানের রেশ ধরেই ঈশ্বর পরবর্তীতে একটি মন্তব্য করে — ‘এত দুঃখের গান কেন? আনন্দের কিছু গাইতে পারিস না?’ কোথাও না কোথাও ভৈরবের মধ্যে বিষাদের মূর্ত রূপটি বেড়িয়ে পড়ে।
এরপরের একটি দৃশ্যে সুরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যন্ত্রাণুসঙ্গের সাথে প্রকৃতির আওয়াজকে এক গোত্রে মিলিয়েছেন। সেই দৃশ্যে ইতিমধ্যে অভিরাম ছুটিতে বাড়ি আসে। সে এখন কলেজ ছাত্র। সীতার সঙ্গে তার প্রণয়ের সম্পর্ক। বহুদিন পর দুই বন্ধু এক হয়ে শালবনের ভেতরে বসে গল্প করে। তারা দুজনেই আজ যথেষ্ট পরিণত।
সেই দৃশ্যে দেখা যায় অভিরাম ও সীতা পাশাপাশি শালবনে বসে। শালবনে হাওয়া ওঠে। পাতারা উড়ে যাবার আওয়াজ পাওয়া যায়। এইখানে সুরকার অদ্ভুতভাবে সেতারের মৃদু আলাপে শালবনের যাবতীয় আওয়াজকে capture এবং amalgamate করেছেন। নেপথ্যে মহিলা কণ্ঠে ভৈঁরোর সরগমও শোনা যায়।
এরপরের দৃশ্যে আবার সেই রাগাশ্রয়ী গান ঘুরে ফিরে আসে। আমরা দেখি নদীর পারে সীতা ও অভিরাম। দুজনেই দুজনকে পেয়ে খুশি। সীতার মুখ দিয়ে পরিচালক এখানেও একটি অনবদ্য রাগাশ্রয়ী গান গাওয়ালেন — ‘আজু কী আনন্দ/ঝুলত ঝুলনে শ্যামচন্দ/আজু কী আনন্দ!’
দৃশ্যের পর দৃশ্য ঘুরতে থাকে। আরও একবার সেতারের চমক লাগানো ব্যবহার আমাদের চোখে পড়ে। রাতের একটি দৃশ্যে মুখোমুখি হয় দাদা ও বোন — ঈশ্বর ও সীতা। সীতাকে দেখে ঈশ্বরের মায়ের কথা মনে পড়ে। এই কথায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে দুজনের মন। নেপথ্যে কল্যাণ রাগে করুণ সুরে সেতার বাজে। মূলত খরজের তারের ব্যবহার এখানে বিশেষ করে শ্রুতিমাধুর্যের কারণ হয়ে ওঠে।
ঋত্বিক ঘরানার ছবিতে বহুবার অনিবার্যভাবে উঠে এসেছে সরোদের আত্মিক ব্যবহার। একটি বিশেষ দৃশ্যে সরোদে ‘দরবারী’র মূর্চ্ছনা আমাদের মোহিত করে। সে দৃশ্যে ‘নবজীবন’ উদ্বাস্তু কলোনি থেকে ঈশ্বরের ভ্রাতৃসম বিনোদ হঠাৎই তার কাছে হাজির হয়। সে বড় ভয়ানক খবর নিয়ে এসেছে। উদ্বাস্তু কলোনি তছনছ হয়ে গেছে। বহুলোককে উচ্ছেদকারীরা ধরে নিয়ে গেছে। বহুলোক নিরুদ্দেশ। এমনকি ঈশ্বরের বন্ধু হরপ্রসাদও। হরপ্রসাদের বউ আত্মঘাতিনী হয়। তার দুটি সন্তানের ঠিকানা কেউ জানে না। এমন ভয়ঙ্কর খবর শুনে ঈশ্বর মুহ্যমান হয়ে পড়ে। কান্নায় ভেঙে পড়ে বিনোদ। সুরকারের অনবদ্য গুণে নেপথ্যে সরোদের ‘দরবারী’ দৃশ্যটিকে বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলে।
ঋত্বিকের এই ছবিতে পুনরায় ব্যবহৃত হয়েছে দেশজ গান/ছড়া (ইতিপূর্বে ‘অযান্ত্রিক’ ও ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবিতে ব্যবহৃত)। এই দৃশ্যের রেশ ধরে রাতে ঈশ্বর দেখেন যে তার বোন সীতা হরপ্রসাদের মর্মান্তিক পরিণতিতে মর্মাহত। সে ঘুমোতে পারে না। কেঁদে ফেলে। ঈশ্বর তখন পরম স্নেহে নিজের কোলে বোনের মাথা নিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়ানোর মতো ঘুমপাড়ানি গান — ‘সীতা ঘুমায়, সীতা ঘুমায়’ গেয়ে তাকে ঘুম পাড়ান। দৃশ্যটির আবহে অনবদ্যভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ‘সরোদ’। সরোদের গম্ভীর ধ্বনি ও ঘুমপাড়ানি গানটি দৃশ্যটিকে এক অসামান্যতায় নিয়ে যায়।
রাঢ় বঙ্গের পটভূমিকায় সিনেমা এবং সাঁওতালী সঙ্গীত ছাড়া তা হতে পারে না। এখানে একটি নবান্নের দৃশ্য দেখা যায়। সেই দৃশ্যে ছড়ানো ধানের ওপর দিয়ে সাঁওতালী রমণীরা গান গাইতে গাইতে হেঁটে এগিয়ে আসে। তাদের মুখে নতুন ধান ভানার গান। অবশেষে দেখা যায় সাঁওতালী হাট। সীতা ও অভিরাম সেখানে ঘোরে। নেপথ্যে সাঁওতালী গান, বাঁশি ও ধামসা বাজে। অভিরাম সীতাকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে সে তাকে ছেড়ে যাবে না। আবহে আবারও শোনা যায় সেতার। আনন্দধ্বনির মতো তার মূর্চ্ছনায় দিকবিদিক ভরে ওঠে।
মৃত্যুকালীন সঙ্গীতের প্রভাবও এই সিনেমায় বিদ্যমান। মরিচঝাঁপি থেকে দণ্ডকারণ্যে যাবার সময় রেল কর্তৃপক্ষ কিছু উদ্বাস্তুকে স্টেশনে নামিয়ে যায়। তার মধ্যে এক মহিলার প্রায় শেষ অবস্থা। এই সেই হারিয়ে যাওয়া অভিরামের মা। বাগদি বউ। শেষ সময় অভিরাম তার মাকে চিনতে পারে। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। বাগদি বউ অনাহারে ও রোগে ভোগার ফলে মারা যায়। নেপথ্যে ট্রেনের ভোঁ সশব্দে বেজে ওঠে। অভিরামের বিলাপের সুর যেন তাতে মিশে যায়। মৃত্যুর সাথে ট্রেনের হুইসলকে আশ্চর্য দক্ষতায় মিলিয়ে দেন সুরকার।
অভিরামের আসল পরিচয় (সে সমাজের নিচুশ্রেণির মানুষ) সবার সম্মুখে চলে আসায় এবং অভিরাম ও সীতার গুপ্ত প্রণয়ের কথা জানতে পারায় ঈশ্বর সীতার বিয়ে অন্যত্র ঠিক করেন। পাত্রপক্ষ সীতাকে দেখতে আসলে সীতা তা প্রত্যাখ্যান করে। রেগে গিয়ে ঈশ্বর সীতার গায়ে হাত তোলেন। সীতার মাথা ঠুকে যায় তানপুরায়। সীতার কষ্ট ও ঈশ্বরের রাগের কথা মিশিয়ে সুরকার সেতারে বাগেশ্রী রাগে একটি করুণ সুর compose করেন যাতে দাদা ও বোন — দুজনের অসহায়তা ফুটে ওঠে।
অবধারিতভাবে এরপর আবার গান ওঠে আসে সিনেমায়। আমরা দেখি বিরহী সীতা একা একা এরোড্রামে বসে গান গায়। আরতি মুখার্জির কণ্ঠে সেই রাগাশ্রয়ী গান — ‘মোর দুখুয়া কা সে কহু/মোহন বিনা জিয়া নাহি লাগে/ দেখ ভোর ভয়ি/দশদিক জাগে’ — (ভৈরব রাগে) সমস্ত শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করে রাখে।
অন্য দৃশ্যে সুরকার ঘুঙুর ও বাঁশির একটি দ্বৈতসত্তা রচনা করেছিলেন। এমনই একটি দৃশ্যে সামগ্রিক পরিস্থিতির উপর বিচার করেও অবিবেচকের মতো ঈশ্বর তার বোন সীতাকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন। এমনকি তার মৃত্যুকামনা পর্যন্ত করেন। নেপথ্যে বেজে ওঠে বাঁশি ও ঘুঙুর একসাথে। সীতার অসহায়তার সাথে বাঁশি ও ঘুঙুরের সুরযাপন চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
সানাইয়ের প্রয়োগও সিনেমায় গল্পের আবশ্যিকতায় উঠে এসেছে। সিনেমায় আমরা দেখতে পাই সীতার বিয়ে হতে চলেছে। ঈশ্বর কাজকর্ম তদারকি করছেন। নেপথ্যে নহবতে সানাই বাজে। প্রথমার্ধের সানাইয়ের সাথে দ্বিতীয়ার্ধে ব্যবহৃত সানাই-এ যথেষ্ট ফারাক। প্রথমার্ধে বিয়ের পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইমনকল্যাণ রাগে সানাই ব্যবহৃত হয়েছে। আনন্দের সঙ্গীত রূপে। দ্বিতীয়ার্ধে আমরা দেখি সীতা বিয়ের আসর ছেড়ে চলে গিয়ে অভিরামের সাথে মিলিত হয়। ঈশ্বর এই আঘাতে হতভম্ব হয়ে যান। আমরা দেখি সীতা তার বিয়ের ফুল ও মুকুট নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। নেপথে সানাইয়ের আওয়াজ অদ্ভুত করুণ রসের সৃষ্টি করে। কড়ি মধ্যম ও ধৈবতের আন্দোলন দৃশ্যটিকে পরিপূর্ণতা দেয়। শেষভাগে সুরমণ্ডলের মূর্চ্ছনা তাকে আরও চরিতার্থ করে।
সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধে দেখি বেশ কিছু বছর অতিক্রান্ত। সীতা ও অভিরাম কলকাতা শহরে একটি ছোট্ট বাসস্থান জোগাড় করে। তাদের একটি ছোট ছেলে হয় যার নাম বিনু। অভিরাম অনেক চেষ্টা করেও চাকরির সন্ধান না পেয়ে বাস ড্রাইভারি শুরু করে এবং সীতা কাগজের ঠোঙা বিক্রি করে জীবনধারণ করে। এই দৃশ্যে সুরকার পিঠোপিঠি দুটি গান ব্যবহার করেছেন। একটি দৃশ্যে সীতা একা একা তানপুরায় গান গায়। মেঘ রাগে সেই গান — ‘ঘনন আয়ে ঘোরি বরখা কে/ ঘন গগন ছায়ে দামিনী দমকৎ’। এই গানের মাধ্যমেই সে তার দুঃখদুর্দশার কথা নিভৃতে বলতে চেয়েছে। পরবর্তী ক্ষণেই ছোট ছেলে বিনুর মন ভোলাতে সে করতালি দিয়ে গেয়ে ওঠে — ‘ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা’। পাশাপাশি একটি রাগাশ্রয়ী এবং একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত দৃশ্যটিকে যথেষ্ট গভীরতা দান করে।
অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই এক ‘অন্য’ ঈশ্বরকে। সে ভারাক্রান্ত, ক্লান্ত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। সীতার ‘চলে যাওয়া’কে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। সীতার ঘরে ঢুকে উদভ্রান্তভাবে তিনি তানপুরায় হাত বোলান। বেসুরো শব্দে বেজে ওঠে তার। একই সাথে ফাঁকা ঘরে আছড়ে পড়ে চাবুকের শব্দ। ঈশ্বরের মানসিক অবসাদ ও বিপর্যস্ততার বর্ণনায় তানপুরার আওয়াজ ও চাবুকের শব্দকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রয়োগ করেন সুরকার। ঈশ্বর সমস্ত লজ্জা-গ্লানি ও পরাজয়ের ভারে পর্যুদস্ত হয়ে আত্মহত্যা করতে যান। এই সময় ঘরে প্রবেশ করেন ঈশ্বরের বহুদিনের বন্ধু হরপ্রসাদ। ভেসে ওঠে সেই শিহরণ-জাগানো সংলাপ — ‘রাত কত হল? উত্তর মেলে না’।
এরপরের দৃশ্যে পুনরায় উঠে আসে সেতার ও বাঁশির দ্বৈতবাদন। খালি এরোড্রামে ভগ্নমনোরথে বসে ঈশ্বর ও হরপ্রসাদ। তারা তাদের ‘পরাজয়’-এর গল্প করে। তাদের ‘আপোষ’, ‘দুঃখদুর্দশা’ ও ‘হেরে যাওয়া’-র গল্প করে। এই বিশেষ দৃশ্যের আবহে ব্যবহৃত হয় সেতার ও বাঁশির যুগলবন্দী (রাগ: মিশ্র কাফি) যা দৃশ্যটিকে justify করে।
অবশেষে দুই বন্ধু তাদের ‘পরাজয়’-এর গ্লানি ভোলাতে এবং ‘সাত্ত্বিক’ ও ‘সৎ’ জীবনের যত ক্ষোভ তা মেটাতে বেড়িয়ে পড়েন শহরের উদ্দেশ্যে। এতদিন এই ‘আদর্শ’ ও ‘মূল্যবোধ’-এর ভারে তারা জর্জরিত। তাই চূড়ান্ত উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে তারা তাদের ফেলে আসা হারিয়ে ফেলা সুখ পুনরুদ্ধার করতে চায়। এই ক্ষেত্রে সঙ্গীতের তাৎপর্যও বিশেষ। তারা রেসের মাঠে পৌঁছয়। জুয়া খেলে। এই দৃশ্যে সুরকার রেসের মাঠের শতসহস্র মানুষের ডাক, ঘোড়ার দৌড়ের শব্দের সাথে সেতারের ঝালা অংশকে অদ্ভুত দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন।
সিনেমার একটি বিশেষ অংশে পাশ্চাত্য যন্ত্রানুসঙ্গ ও সঙ্গীতের আভাস মেলে। দুই বন্ধু পার্ক স্ট্রিটের আলো-আঁধারি রেস্তোরাঁয় গিয়ে প্রচুর মদ্যপান করেন। রেস্তোরাঁর দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই অদ্ভুত রংবেরং-এর মানুষদের। সেখানে ‘ক্যাবারে’ হচ্ছে। লাস্যময়ী নারীরা ছন্দে ছন্দে, দেহবিভঙ্গে নেচে চলেছে। এই দৃশ্যে স্যাক্সোফোন, চেলো, ড্রামস, ক্ল্যারিওনেটের সাথে বাঙলা ঢাক, ঢোল ও শিঙার আওয়াজ অদ্ভুত মানানসই হয়ে ওঠে। বলা যেতে পারে, সুরকারের এ এক অনবদ্য fusion treatment।
এরপরের দৃশ্যে সিনেমা অতি দ্রুততার সাথে conclusion-এর দিকে এগিয়ে চলে। ঈশ্বর মদের নেশার ঘোরে একটি পতিতাপল্লীতে ওঠেন এবং মুখোমুখি হন তার জীবনের সবচেয়ে বড় Tragedy-র। গণিকারূপে তার সামনে দেখেন সীতাকে। সীতা এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে লজ্জায়, ঘৃণায় আত্মঘাতী হয়। ঈশ্বর ভেঙে পড়েন।
সিনেমার শেষ দৃশ্যে ব্যবহৃত সঙ্গীত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অবশেষে ঈশ্বর তার একমাত্র ভাগ্নে, মা-মরা ছেলে বিনুকে নিয়ে ঘাটশিলায় সুবর্ণরেখার তীরে ফিরে আসেন। প্রথমদিকে বিনুকে মেনে নিতে না পারলেও পরে হঠাৎই বিনুর মুখে একটি গান — ‘আজ ধানের ক্ষেতের রৌদ্রছায়ায়…’ শুনে ঈশ্বর চমকে ওঠেন। বিনু তাকে নতুন করে বেঁচে থাকার, লড়াই করবার রসদ জোগায়। বিনুর মধ্যে ঈশ্বর যেন তার ‘হারিয়ে’ যাওয়া সময়কে খুঁজে পান। বিনুর হাত ধরে তারা তাদের ‘নতুন বাড়ি’-র দিকে এগিয়ে চলে। এই দৃশ্যের শেষে শোনা যায় শঙ্খধ্বনি, ঘণ্টাধ্বনি ও ‘মোহমুদগর’ থেকে সেই স্তোত্রপাঠ। বিনু তার মামার হাত ধরে নিয়ে চলে নতুন এক জীবনের দিকে। নেপথ্যে ‘চরৈবেতি’ ধ্বনি দৃশ্যটিকে দর্শকদের মানসপটে অম্লান করে রাখে। অলক্ষ্যে এক সাঙ্গীতিক রেশ মাথায় নিয়ে, সমাপ্তির দিকে হেঁটে যায় ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)