শৈলেন সরকার
বাবার ধারণা ছিল ভদ্রলোকের ছেলেরা বাড়ির বাইরে যায় না। বাড়ি আর স্কুল। এমনকি পাড়ার মাঠেও নয়। মাঠের খেলতে থাকা ছেলেদের উপর বাবার রাগ ছিল খুব। ওর মতে, সবাই একেবারে বজ্জাত, হাভাতের বংশধর। ছোটলোক।
স্টেশন থেকে আমাদের বাড়ি তখন বেশ খানিকটা দূর। তবু, এখনকার মতো এত বাড়িঘর না থাকাতেই সম্ভবত কয়লার ইঞ্জিনের সেই ভোঁ কানে আসত ঠিক। সন্ধের আরও আগে তেমনি একটা ভোঁ কানে আসামাত্র বুঝে যেতাম, আসছে লোকটা। এমনকি আমার খেয়াল না থাকলেও মা মনে করিয়ে দিত ঠিক। আর টেরও পেত প্রতিদিন। এক একদিন নিজেই ছুটতে ছুটতে চলে আসত। দূর থেকেই ডেকে উঠত, ট্রেন এসে গেছে কিন্তু…।
কয়লার ইঞ্জিন একবার ছাড়ার দু-এক মুহূর্ত পরেই ঝকঝক ঝকঝক করে শব্দ করে উঠত। ঠিক তখনই ধোঁয়া উঠত আকাশে। প্রায় ছাতার মতো করে উঠে যাওয়া সেই কালো ধোঁয়া দেশবন্ধু কলোনির মাঠ থেকেও চোখে পড়ত আমাদের। আমার, রতনের, কৃষ্ণার — এমনকি আমার মায়েরও। বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে জেগে থাকা এই ধোঁয়া একসময় বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে যেত।
বাবাকে অনেকটা দূর থেকে দেখতে পেতাম। নীল শার্ট আর ধুতি। হাতে ছাতা। বড় রাস্তা থেকে কলোনিতে ঢুকছেন। হাঁটছেন হন হন করে। বেশ দ্রুত। একটু আগে আগে হাঁটতে থাকা লোকগুলিকে একের পর এক পেছনে ফেলে ঠিক ব্যানার্জিদের পুজামণ্ডপের সামনে এসে দাঁড়াবেন। হাতজোড় করে বলবেন কিছু ফিসফিস করে। তারপর ফের হাঁটা। আর বড়জোর মিনিট খানেক। বড়জোর পাঁচটা বাড়ি। গোটা দুয়েক মোড়। আমাদের জানলা থেকে সমুদের মুদিখানা স্পষ্ট চোখে পড়ত। সমুর বাবা, সেই দাঁড়িপাল্লা আর কেরোসিনের ল্যাম্প। কালো ধোঁয়া নিয়ে জ্বলতে থাকা আগুন। আর এলোমেলো নড়তে থাকা কিছু শরীর।
মা তখন যেন তৈরি হত। মনে হত আমার। রান্নাঘরে উনুনের সামনে বসে কড়াইয়ে হাতা নাড়াত। আর মাঝে মাঝেই চাপা গলায় নাম ধরে ডেকে উঠত আমাকে, বসেছিস? বই নিয়ে বসেছিস তো?
তখনকার বাংলা বইয়ের নাম ছিল ‘কিশলয়’। এই একটা বইয়ের নামই মনে পড়ছে আমার। থ্রি, ফোর, ফাইভের সব ক্লাসের ওই একই নামের বই। কোনওটা প্রথম, কোনওটা দ্বিতীয়, কোনওটা বা তৃতীয় ভাগ। সম্ভবত সেটা থ্রি কি ফোরই। মোট কথা আমি তখন ছোটই। মানে, আমি তখনও কিছু বুঝি না। একেবারে কিছুই না। বাবা কেন রোজ মদ খেয়ে বাড়ি ফিরবে আর মা-ই বা কেন মার খাবে। আর মুখ বুঝে সহ্য করবে সব, এসব তখন আমার একেবারেই বোঝার কথা নয়।
পাশের বাড়ির প্রফুল্লকাকার একটা কথা বেশ স্পষ্ট মনে আছে আমার। পাড়ার কোনও এক ঝগড়াঝাঁটির মীমাংসার সময় বেশ চিৎকার করেই বাবার নাম উচ্চারণ করেছিল লোকটা। বলেছিল, হরেনদাকে দেখে শেখা উচিত সবার…। বলেছিল, ঘরের বউকে কীভাবে শাসন করতে হয়…।
আমার বাবার নাম ছিল হরেন সান্যাল। মানে, সান্যাল হরেন্দ্রনাথ — ভোটের লিস্টে এভাবেই লেখা থাকত সব ক’টা নাম।
বাড়ির দক্ষিণে মাঠ ছিল আরেকটা। পুব-পশ্চিমে বাবু আর রতনদের ঘর। উত্তরে রাস্তা। রাস্তার ওপাশে মন্টুরা। যে মাঠটার কথা বললাম, ওটা প্রায় একটা পুকুরই। মানে জুলাই-অগস্ট থেকে ডিসেম্বর-জানুয়ারি পর্যন্ত জল। তখন সেখানে সবুজ কচুরিপানা, শাপলার ফুল আর শাপলার ডাঁটায় হঠাৎ করে ঝলসে ওঠা পুঁটি মাছের শরীর। আমরা মাছ ধরতাম। পেয়ারা গাছের নীচে বসে কঞ্চি কেটে তৈরি করা ছিপ নিয়ে বসে পড়তাম। না, বাবাকে অবশ্য এসব মাছ দেওয়া যেত না। একবার যা ভুল হয়েছিল। পুঁটির চচ্চড়ি খেয়ে বাবা সেদিন কেন কে জানে খুশি খুব। ভাবলাম, সাবাস নেব। বাবাকে অবাক করে দেব একেবারে। মা কিছু বলার আগেই বলে উঠেছিলেন, আমি, আমি ধরেছি সব…। মুহূর্তের মধ্যেই পাল্টে গিয়েছিল লোকটা, তুই…? সব ছোটলোকদের সঙ্গে — তুই…?
এক সলিলকাকুই প্রশ্রয় দিত আমাকে। এমনকি মাছের ব্যাপারেও। মায়ের রান্না খেয়ে এমন ভাব করত, যেন এমন মাছ লোকটা দেখেইনি কোনওদিন।
সলিলকাকু আসলে ছোটকাকার বন্ধু। চোখে পুরু কাচের চশমা। ফরসা। ঢেউ তোলা চুল। বাবার সঙ্গে ভাব ছিল খুব। দরকার অদরকারে লোকটা বাবাকে সাহায্য করত। স্পষ্ট মনে আছে, মঙ্গলবার হলেই রেশন তোলার কথা মনে পড়ত বাবার। আর ঠিক তখনই যেন জানা যেত, টাকা নেই। মাকে ডেকে জানতে চাইতেন, সলিল আসবে তো আজ?
এই সলিলকাকুর জন্যই ছোটকাকু একসময় কথা বলা বন্ধ করে দিল সবার সঙ্গেই। এমনকি আমার সঙ্গেও। এক সেই ওর বিয়ের সময়ই মাকে এসে বলতে দেখেছিলাম। বলেছিল, দেখে যাবে একবার। সম্ভবত নতুন কাকিমার বাড়ির লোকজনের আসার কথা ছিল। মা সেদিন গেছিল কিনা মনে পড়ছে না। বিয়ের দিন অবশ্য গেছি। সবাই মিলেই। এমনকি সলিলকাকুও। মাইক বাজিয়েছি নিজের হাতে। বাবা অবশ্য সেই গানের কথা মনে রেখেছিল ঠিক, পরে কী নিয়ে একদিন শাসন করার সময় বলেছিল, সব টিকিট ব্ল্যাকারদের সঙ্গে থাকতে থাকতে নাকি ব্ল্যাকারই হয়ে যাচ্ছি। ওর মতে, নতুবা, ওইসব হিন্দি গান বাজায় কেউ। ছোটকাকুর বিয়ের সময় সেই সলিলকাকুই অবশ্য মাকে — কিছু তো দিতে হবে বৌদি…।
সলিলকাকুই হার বানাতে দিয়েছিল একটা। সোনার। মা বলেছিল, এ তুমি কী করলে ঠাকুরপো? স্পষ্ট মনে আছে। দুপুরের দিকেই। আমরা তখন খাওয়া সেরে সবে বিছানায়। তার মানে স্কুলে যাইনি কোনও কারণে। নীল রঙের ভেলভেট মোড়া বাক্স খোলামাত্র সেই উজ্জ্বল হলুদ।
সলিলকাকু বলেছিল, তনুর বিয়েতে তেমন কিছু একটা না দিতে পারলে…। বলেছিল, পুচন চাকরি পেলে না হয় ফেরত দিও। মানে টাকা। সোনার সেই হারের দাম। বাবা শুনতে পেয়ে বলেছিল, আমাকে দিলে তো অনেক কম পয়সায় করিয়ে আনতে পারতাম। কলকাতার কোন সোনার দোকানের মালিক নাকি বাবার চেনা।
মাকে বড় গলায় কথা বলতে শুনিনি কোনওদিন। এমনকি প্রায় রুটিনমাফিক বাবার মারধরের সময়টাতেও মা কী করে যেন সবকিছু সহ্য করে নিত। একেকদিন ঘুম ভেঙে গেলে বাবার সেই গালিগালাজ আর চড় বা লাথির শব্দই শুধু শুনতে পেতাম।
ছেলেবেলায় আমাকে কোনওদিন কেউ পড়ার কথা মনে করিয়ে দেয়নি। এমনকি বাবাও নয়। বড়জোর ঘুম ভাঙার পর লোকটা নাম ধরে চিৎকার করে উঠত, পুচন…। অর্থাৎ বাড়ি আছি কি না যেন জানতে চাইত। আমি অমনি তারস্বরে কবিতা মুখস্থ শুরু করে দিতাম। ধনধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা…। সেই ক্লাস থ্রি কি ফোরের। কিশলয়ের।
মনে আছে, পরীক্ষায় প্রশ্ন থাকত ‘কিশলয়’ কথার অর্থ কী? কচি পাতা। প্রাইমারি স্কুলের হরি মাস্টারমশাই বলতেন, পাতা দেখেছিস? নতুন…। আমরা ঘাড় নেড়ে চিৎকার করে উঠতাম, হ্যাঁ মাস্টারমশাই…।
বৃহস্পতিবার হলেই মা বলত, পঞ্চপল্লবটা নিয়ে আসিস তো পুচন। বসাকদের বাগানের পুকুরপাড়ের গাছে উঠে একেকটা ডালের মাথার দিকের পাতাগুলি গুনে গুনে দেখতান। এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ…।
সারাদিন ধরে মায়ের কী যে এত কাজ থাকত কে জানে? স্নান করতে করতে সেই বিকেল। আমি হয়তো পাশের মাঠ থেকে একছুটে ঘরে ফিরে জল খাব একটু, বাইরে বন্ধুদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছি, গোল্লা-ছু-ট, ধর-ধর-বিশু-রতন-বিমল…। দেখি, রান্নাঘরে মা বসে। ছোট একটা থালায় যত্ন করে কী সব মাখছে।
ছোটকাকা খেত সেজকাকাদের ঘরে। ওরা ছিল একদলের। যে কোনও ঝগড়ায়। ঝগড়া বলতে অবশ্য সেজকাকিমার কিছু না কিছু বলে যাওয়াই। কখনও বা ছোটকাকাকে মায়ের নামে কিছু বলা। বেশ জোরে জোরেই। এমনকি আমাকে দেখিয়েও। ওদের খাওয়ার সময় আমার তাকিয়ে থাকা নিয়ে, আমার লোভী লোভী চোখ আর ভিখারি সদৃশ চেহারা নিয়েও।
মায়ের এসবে কোনও তাপ উত্তাপ ছিল না কোনওদিন। অন্তত আমি দেখিনি। বিকেল হলেই মাঝেমধ্যে ফুলপিসিদের বাড়ি যেত। ওরা মাকে পছন্দ করত খুব। মাঝেমধ্যেই আমাকে ডেকে পাঠিয়ে তরকারি বা মাছ ধরিয়ে দিয়ে বলত, নিয়ে যা…। বাড়ি ফেরার পথে ঢাকনা তুলে দেখার ইচ্ছে খুব, গন্ধ নেওয়ারও। এক একদিন ফাঁকা রাস্তা হলে আঙুলে ঠেকিয়ে দু-এক ফোঁটা ঝোল জিভে ঠেকাতাম। মনে পড়ে কিন্তু, এখনও, সেই ঘ্রাণ সেই সব ফাঁকা রাস্তাঘাট। আর কোনও না কোনও আমের ডালে বসে থাকা সেই কোকিলের ডাকও। না দেখতে পাওয়া সেই পাখিটা হঠাৎ করেই কেন যে ডেকে উঠত? কেন যে, কু-উ-উ করে শব্দ করে উঠত?
বাঁশের মাচার উপর টিনের সুটকেশ ছিল দুটো। তার উপর রাখা তোষক বিছানা, চৌকির ওপর পাতা থাকত তালপাতার পাটি। যখনকার কথা বলছি, তখন অনেকটাই ছেঁড়া। আমিই কাটতাম দাঁত দিয়ে। ভাঁজ করে ভাঙতাম। শব্দ উঠত পটাশ করে। আর কেন যে মজা লাগত খুব, এই শব্দ শুনতে কেন যে ভালো লাগত খুব।
সলিলকাকু একদিন ধমকে ছিল। এই পাটি নষ্ট করার জন্য। বলছিল, কিছুই কি বুঝিস না? বলছিল, একেবারে বাবার মতোই নাকি মাকে কষ্ট দেব আমি।
সলিলকাকু আসত দুপুর করেই। দরজা থেকে ডাকত মাকে, ‘বৌদি…’ বলে ডেকে এত বেলা পর্যন্ত কী করছে জানতে চাইত।
আমরা স্কুল যাওয়ার পরপর সেই গুঁড়িওয়ালা আসত। স্কুল যাওয়ার পথেই দেখতে পেতাম। ভ্যান-রিকসায় চাপানো গুঁড়ির বস্তা নিয়ে লোকটা জানতে চাইছে, গুঁড়ি নেবে গো মা…? গুঁড়ি অর্থাৎ কয়লার গুঁড়ো। স্কুল থেকে ফিরে জানতে চাইতাম, গুঁড়িওয়ালা এসেছিল? মা ঘাড় নাড়লেই বুঝতে পারতাম, পরদিন কাদা তুলতে হবে। তার মানে স্কুল ছুটি। যেতে হবে না। বালতির আংটায় পুরনো শাড়ির ছেঁড়া পাড় আটকে পুকুরে যেতাম। যতীনদের বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বালতিটাকে ছুঁড়ে মারতাম জলে। শব্দটা খেয়াল আছে এখনও। সেই ফাঁকা বালতির হুমড়ি খেয়ে পড়া, সেই ডুবতে থাকা। লাল রঙের কাপড়ের পাড়ে সেই হ্যাঁচকা টান, আর জলের সেই বুদ্বুদ। সেই বুদ্বুদের উপরে উঠে সেই ছড়িয়ে পড়া।
সলিলকাকু জানতে চাইত, কী এত রান্না করো তুমি?
–কেন?
–এত গুঁড়ি… এত গুল…?
গুঁড়িকয়লার সঙ্গে কাদা মাখিয়ে দলা পাকাবার মতো করে শুকোতে দিতে হত। আমরা বলতাম গুল। ফুলপিসিদের বাড়িতে মাঝেমধ্যেই গুলের বস্তা দিয়ে আসতে হত আমাকে। মাঝে মধ্যেই খবর পাঠাত, আজকেই লাগবে কিন্তু…।
সলিলকাকু জানতে চাইত, আর কি কবিতা নেই কোনও? যেদিন আসি সেদিনই শুনি, ধনধান্যপুষ্পভরা…। আসলে আমার ভালো লাগত খুব। সেই যে ‘তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে…’।
সলিলকাকুকে নিয়ে একবার অশান্তি হল খুব। দোষের মধ্যে মায়ের বিয়ের সময়কার বেনারসি শাড়ি চোখে পড়ে গেল বাবার। সেই টিনের ট্রাঙ্কেই তোলা থাকত শাড়িটা। মায়ের কোনও দাদুর দেওয়া। সঙ্গে ন্যাপথালিন এর ঘ্রাণ। বাবার ধুতি আর মায়ের এক আধটা শাড়ির নীচে ভাঁজ করা অবস্থায় রাখা থাকত ওটা। মা বলত, দামি খুব। একেকদিন আমার ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হত। ইস্ত্রির সেই মসৃণতা মনে পড়ে।
–সলিল এসেছিল?
বাবা জানতে চেয়েছিল। তখন রাত নয় খুব একটা। সেজকাকিদের ঘরের রেডিও বাজছিল, যেন বা সংবাদ। দিল্লি থেকে তক্ষুণি খবর পড়বে কেউ। আমার সামনে তখন অঙ্ক বই। গলা শুনেই বুঝতে পারছিলাম গণ্ডগোল শুরু হবে এক্ষুনি। বুঝতে পারছিলাম, এক্ষুণি এমনকি সেজকাকাদের ঘরের রেডিওর আওয়াজ কমবে। ছোটকাকা বা সেজকাকাদের ঘরের জানালা বা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়বে কেউ। দূরে কীর্তনের গান হচ্ছিল কোথাও। মাইক ছাড়াই। মাঝেমধ্যেই ধুয়ো তুলছিল কারা।
মা বলছিল না কিছু। বাবা কি আশ্চর্য চুপ করে গেল একদম। হঠাৎ করেই। তখনও ঢিপ ঢিপ করছে বুকটা। এই বুঝি…, এই বুঝি…। শোয়ার আগে শুধু বলল, ওকে এ বাড়িতে ঢুকতে বারণ করে দিও।
ব্যস, আর কিছু নয়। এরপর আর কোনওদিনই সেই লাল আর সবুজের শাড়িটাকে বাইরে দেখিনি। মায়ের অবশ্য তখন ভালো শাড়ি বলতে সেই একটাই। সলিলকাকুকে মা কবে কীভাবে বলল কে জানে? তবে আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিল লোকটা। আর কোনওদিন দেখতে পাইনি সলিলকাকুকে। সেই ফর্সা গোলগাল মুখের ছোটকাকার সেই বন্ধুটিকে।
সেবার পুজোতে আর প্যান্টজামা হল না। ফুলপিসি একটা টাকা দিয়েছিল একদিন, আর মা। গুল বিক্রির টাকা থেকেই সম্ভবত। নাইট শোতে সিনেমা দেখলাম একদিন। সাড়ে পাঁচ আনা। বিমল, রতন আর আমি। সেই প্রথম। আর লুকিয়ে বিড়ি খাওয়ারও সেই শুরু। বিমল বুঝত অনেক কিছু। কোনও সিনে একটা ছেলে আর মেয়ের মুখের কাছে মুখ আসামাত্র ওর কী শিস!
জানালার ঝাঁপ নামিয়ে এরপর একাই ঘুমোতে হত আমাকে। বাড়িতে। দূর থেকে শব্দ আসত পুজোর। মাইকের। বাজির। আর ঢাকেরও। এক একদিন ঢাকের সেই শব্দ স্বপ্ন আর জেগে থাকার ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ত কোথাও। জেগে উঠে অবশ্য মনে পড়ত না কিছুই।
বিধানপল্লীর বড় স্কুলে ফাইভে দ্বিতীয়বার ফেল করলাম। আমার বয়সী লাল্টু মানে সেজকাকার ছেলে তখন এইট। মা শুধু বলল, ফুলপিসিকে কী বলব এখন? অর্থাৎ ফুলপিসিই। বাবা নয়। আমি তখন কোন ক্লাসে বাবা আদৌ জানত কি না সন্দেহ। শুধুমাত্র বাড়ি থাকছি কি না এটুকু জানা থাকলেই যেন সন্তুষ্ট।
একটা ক্লাসে তিনবার থাকতে কেমন লাগে বলুন তো? অসহ্য। বিরক্তিকর। বিশেষ করে আমার মতো ছেলের পক্ষে। অবশ্য উলটো করে বলতে গেলে আমার মতো ছেলেরই অবশ্য তিনবার করে এক ক্লাসে থাকার কথা। সেই তৃতীয়বার ফাইভে থাকতে থাকতেই স্কুল ছাড়লাম। আমার তখন অনেক কাজ। বাড়ির। পাড়ার। বন্ধুদের।
বড় রাস্তায় ঘেঁষ পড়লেই সারাদিনের জন্য কাজ পেয়ে যেতাম আমরা। আমাদের বয়সী প্রায় সবাই। ঘেঁষের স্তূপ থেকে ছোট ছোট কয়লার টুকরো বাছা। মা খুশি হত খুব। ফুলপিসি পয়সা দিতেন ঠিক। আর মাঝেমধ্যে খাবারও। এমনকি ওদের ঘরের জামা প্যান্ট।
মাঝে একবার বেশ কদিন স্ট্রাইক হল। দোকানপাট বন্ধ সব। কোথায় যেন গুলি চলল। মারা গেল কারা যেন। সমুদের দোকানের সামনে তখন সকাল সন্ধে ভিড়। কাগজ রাখে ওখানে। একদিন ছবিও দেখলাম একটা ছেলের। ডেড বডি। শোয়ানো। সম্ভবত আমারই বয়সী। মুখটা হাঁ করা। প্রফুল্লকাকু চিৎকার করে বলছিল একদিন, এমন দাম তো মন্বন্তরের দিনগুলিতেও হয়েছে বলে শুনিনি।
আমরা গুলি খেলছিলাম তখন। আমগাছের নিচে। বড়রা তাস খেলছিল। কে একজন তাস রেখে কী বলে উঠেছিল। প্রফুল্লকাকুর সে কী রাগ! এই মারে তো সেই মারে। বলছিল, পঞ্চাশের… পঞ্চাশের…। বলছিল, তখন রাস্তাভর না খাওয়া মানুষ…। আর আর্তনাদ। এমনকি কান্নার জলও নাকি নেই আর তখন। কুকুর বেড়ালের মতো মানুষ। বাচ্চা বড়। এসব নাকি শোনা ওর। বলছিল ছবিও আছে অনেক।
আমাদের বাড়িতে তখন মাইলোর খিচুড়ি। আটার সঙ্গে মিষ্টি আলু সেদ্ধ মিশিয়ে তৈরি করা রুটি। রাত দেড়টা দুটো বাজতে না বাজতেই তখন বেরিয়ে পড়ছি। মুখার্জি অয়েল মিল। সাধুখাঁর দোকান। দু কেজি চালের জন্য তখন একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড। হ্যাঁ। আক্ষরিকভাবেই। এমনকি বাবার মতো লোকও একদিন বলে ফেলল, বাঁচা যাবে না আর। বলল, পুচনকে বল নিজের পেটখোরাকি নিজে জোগাড় করুক। আমি নাকি তখন অনেক ধেড়ে… আমি নাকি বড় অনেক।
রাস্তায় বেরিয়ে তখন সলিলকাকুকে খুঁজতাম খুব। এমনকি মায়ের কাছে জানতেও চেয়েছিলাম কোথায় বাড়ি গো সলিলকাকুর? মা শুধু বলেছিল, জানি না। আমি অবশ্য বিশ্বাস করিনি। হতে পারে কখনও? মা জানবে না? বা বাবা? ছোটকাকু? বাবা বা ছোটকাকুকে জিজ্ঞেস করার অবশ্য তখন আর উপায় ছিল না কোনও।
এর মধ্যেই একদিন ঘটনাটা ঘটে গেল। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে বাবা রেরিয়েছে। আর পাঁচটা দিনের মতো রাত করে ফিরবে। পাশের ঘরে আমি। ঘুমে। মানে, ঘুমিয়ে পড়েছি অনেকক্ষণ। ঘুম ভেঙেছে তখন বড়জোর সাড়ে এগারো। সাড়ে এগারোই… কেন না রঙকলের বারোটার ঘণ্টা বিছানায় শুয়ে স্পষ্ট শুনেছি। স্পষ্টই। পাশের ঘরে তখন আর কোনও আওয়াজ নেই। বেশ অনেকক্ষণ চুপচাপ। একটু আগের ‘ধপ’ করে তৈরি একটা শব্দ কানে লেগে আছে তখনও। যেন ভারি কোনও কিছু পড়ল কোথাও। মাটিতেই। যেন পাশের ঘরেই। মাকে মারধরের শব্দেই ঘুমটা ভেঙে গেছে। সম্ভবত অন্য দিনের থেকে কিছু বেশিই টেনে এসেছিল লোকটা। আমার বাবা। সলিলকাকুর নামে কী সব বলছিল যেন। অনেকদিন পর। অনেকদিন পর সলিলকাকুর নাম শুনছি সেদিন। মায়ের চুল ধরে বাবা তখন ঝাঁকুনি দিচ্ছে যেন। এরপর হঠাৎ করেই মায়ের কিছু বলে ওঠা। হঠাৎ করেই। মায়ের মুখ দিয়ে কেমন একটা অদ্ভুত আওয়াজ। যেন কান্না নয়। আবার রাগও নয়। যেন হাহাকার একটা। মুহূর্তের জন্যই। মায়ের শরীরও যেন ছাড়া পায় তখন। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অদ্ভুত সেই শব্দ। ধপাস। শব্দটা যেন এরপর ঝুলে থাকে কিছুক্ষণ। বা জ্ঞান হারিয়ে কেউ যেন নিঃসাড়।
বিছানা ছেড়ে উঠে বেড়ার ফুটো দিয়ে তাকিয়ে দেখি, বাবা শুয়ে। মেঝেতে। মা কীসব করছে। বাবার বুকে কান রেখে যেন শুনতে চাইছে কিছু। নাকের সামনে হাত। এরপর সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে একটু দূরে বসে পড়ল একেবারে। বাইরে তখন পুজো হচ্ছে খুব। দূরে। আর ঢাক, আর কাঁসরও। অনেক দূরে বাজছে কোথাও। যেন আমার মতোই কেউ। বাজিয়েই যাচ্ছে। বাজিয়েই যাচ্ছে। একটানা। মা উঠে পড়ল একটু পরেই। বাবার শরীরের পাশে বসল। হাত দিল পকেটে। কোমরের গোঁজে। কিছু একটা টেনে বের করল। তারপর সামনে পেছনে তাকিয়ে একসময় কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হুড়কো খোলার শব্দ হতেই আমি ছুটে একেবারে বিছানায়। মট মট করা শব্দ। পুরোনো সেই চৌকি যেন দোলে। দোলনা হয়ে যায় যেন। সারাটা পৃথিবীতে তখন জেগে থাকার মধ্যে দূরের সেই কাঁসর বাজতে থাকা কোনও বালক। আর মা। আর কেউ নেই। আমার বিছানার পাশে মাচার উপর টিনের ট্রাঙ্ক যেন ফাঁক হয়। যেন বা মায়ের শ্বাসপ্রশ্বাস। এরপর ফের ঘুম। ঘুমই। দূরের সেই ঢাক আর কাঁসরের ধ্বনি স্বপ্ন আর জেগে থাকার ফাঁক দিয়ে সত্যিই ঢুকে পড়ে একসময়।
মুখার্জি অয়েল মিলের লাইনে রতনের কাকা যখন আমাকে খুঁজে বার করে তখন ভোর। পুবদিকের আকাশে তখন লাল রঙ লাগতে শুরু করেছে।
এরপর বড় রাস্তা ছেড়ে ছোট রাস্তা। ছোট রাস্তা ছেড়ে গলি। কলোনি পার হয়ে কলোনি। পুকুর ছাড়িয়ে পুকুর। শুনি পরীক্ষার পড়া করছে কেউ। সুর করে পড়ছে। কোনও বালক। সম্ভবত আমার বয়সেরই। ‘ধনধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা।’ একটা লাইন ছেড়ে আরেকটা লাইন। তারপর আর একটা লাইন। ‘তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে পাখির ডাকে জাগে।’
রতনের কাকা কী মনে করে যেন ঠিক তখনই বলে উঠেছিল, তোর বাবা মারা গেছে।
আজ এতগুলি বছর পর ফের সেই মন্বন্তরের কথা মনে পড়ল। সেই বাবা। প্রফুল্লকাকা। মা। ভোর থেকে সেই সকাল। বড় রাস্তা থেকে সেই ছোট রাস্তা। রাস্তা থেকে গলি। পুকুর থেকে সেই পুকুর। নারকেলের ছায়া।
ছোটবেলার সেই টিকিট ব্ল্যাক থেকে শুরু করে ওয়াগন ভাঙা, তোলা নেওয়া থেকে রাজনীতি, লোকাল এম এল এ-র ডান হাত, বাঁ হাত হয়ে অনেক ঘাটের জল খেয়ে এখন যখনকার যা — সেই প্রোমোটারির ব্যবসায় আছি। পাঁচ কাঠা একটা জায়গা। লোকগুলি উঠবে না কিছুতেই। স্টেশনের কাছাকাছি একটা বাড়ি। পুরনোই। দশঘরের ভাড়াটে। বস্তিই। আর বস্তি মানেই সেই মেয়েলি ঝগড়া, মদ খেয়ে মাতলামো, গুণ্ডামি, মস্তানি। প্রায় পাঁচ কাঠা জায়গার জমিটা অন্য সব দিক থেকে আকর্ষণের। কাঠা প্রতি সব মিলে বড়জোর সাড়ে তিন। সাড়ে তিন লাখ। পার্টির দু-পাঁচজন আর পুলিশ মিলিয়ে এলাকার ঝামেলা মেটাতে আরও অন্তত পঞ্চাশ নিয়ে সব মোট চার। মানে চার লাখই আমার বাজেট।
লোকগুলি বংশপরম্পরায় থাকা। আলো নেই বহুদিন। মানে বিদ্যুৎ। কাটা গেছে বছর পাঁচ। লোকগুলি নড়বে না কিছুতেই। বলছে, এত বছর ধরে আছি, যাব কোথায় বলুন?
আকাশে আধভাঙা একটা চাঁদ। অল্প মেঘ। ট্রেনের হর্ন পড়ল। সম্ভবত লোকাল। মানে, লোকাল ট্রেনই। এক্ষুণি শব্দ হবে হুড়মুড় করে। বাইরে আমার গাড়ি দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার। আমার ব্যাগটাকে হাতে নিয়ে কার্তিক একটু পিছিয়ে। এখানকার ভাড়াটেদেরই একজন কানের সামনে বকে যাচ্ছে কীসব। মাথার উপরকার ভাঙা টালি আর দুপাশের মাকড়সার জাল বাঁচিয়ে আমি সবে বাইরে পা দিয়েছি, হঠাৎ শুনি, ‘তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে ওঠে, পাখির ডাকে জাগে।’ অন্ধকার মানে, পাশের ঘরের আধা অন্ধকার কোনও ঘর থেকেই কচি গলায় কোনও বালক থ্রি কি ফোর কি ফাইভ। মুহূর্তের জন্যই আমার থেমে পড়া। পেছন থেকে কার্তিক সম্ভবত জানতে চেয়েছিল, কী হল? পাশের লোকটি এগিয়েও গেছে তখন কয়েক পা। আমাকে দেখতে পেয়ে ড্রাইভার দরজাও খুলল যেন। শব্দ হল কোথাও। যেন বড় রাস্তা থেকে ছোট রাস্তা। ছোট রাস্তা থেকে কোনও গলি। কলোনি ছেড়ে কলোনি। পাড়া ছেড়ে পাড়া। পুকুর। আর ভোরের সেই আলোয় পুকুরের জলে অল্প কাঁপতে থাকা নারকেলের সেই ছায়া। আর পুকুরের জল। ‘ধপ’ করে তৈরি হওয়া সেই শব্দ। বাবা, বাবার শরীর। একটা ঘর ছেড়ে মায়ের সেই আরেকটা ঘরে ছুটে আসা। ট্রাঙ্ক। আর সেই ন্যাপথালিন। তোর বাবা মারা গেছে। তোর বাবা…। অন্ধকারে তখন একটা শরীরের পাশে আরেকটা শরীর। ছায়ার পেছন পেছন আর একটা ছায়া। মৃত্যু। মৃত্যুর পিছু পিছু আরেকটা মৃত্যু। মৃত্যুর মিছিল। মিছিলই।
গাড়ি ছাড়ার আগের মুহূর্তে ড্রাইভারকে থামতে বললাম। বস্তির ভাড়াটেদের মধ্যে দু-একজন তখনও জানালার কাছে দাঁড়িয়ে। কার্তিককে ধমকে উঠলাম। বললাম, কত? কত হলে উঠবে জিজ্ঞেস কর তো? ঘর প্রতি দশ, পনেরো, বিশ…? ছাড়বে? বললাম, এমাসেই, রাজি না হলে যেভাবেই হোক… কোথায় যাবে না যাবে তার আমি কী জানি?
পাঁচ কাঠার সেই জমি একেবারে ফাঁকা। এখানে ওখানে দু-একটা টালির টুকরো। ট্রাঙ্ক। কাপড়। ছবির ফ্রেমের ভাঙা কাচ। বড়জোর পুরনো বই বা খাতার উড়তে থাকা ছেঁড়া কাগজ। থ্রি-ফোর বা ফাইভের কিশলয়ের কোনও ছেঁড়া পাতা। মেয়েলি ঝগড়া বা মদ খেয়ে মাতলামো নেই। বা কোনও বালকের একঘেয়ে, ক্লান্তিকর ধনধান্যপুষ্পভরা…।
মোট কথা মন্বন্তরের চিহ্নমাত্র কোথাও আর অবশিষ্ট নেই।