উৎপল দত্ত
সোনারপুর কৃষ্টি সংসদে উৎপল দত্তের বক্তৃতার অংশবিশেষ, নাট্যচিন্তা প্রকাশিত 'উৎপল দত্ত -- বিষয় থিয়েটার' বই থেকে নেওয়া
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হল মার্ক্সবাদ এবং অভিনয়কলা। অনেকে ভাবতে পারেন, মার্ক্সবাদের সঙ্গে অভিনয়কলার কী সম্পর্ক? মার্ক্সবাদ হল সামাজিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ। সেটা অভিনয়কে কীভাবে প্রভাবিত করল? করেছে। সারা পৃথিবীতে মার্ক্সবাদ অভিনয়ের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। মার্ক্সবাদ বুঝে অভিনেতারা যখন অভিনয় করতে গেছেন তখন তাঁরা বুঝেছেন যে আগেকার তুলনায় তাঁরা ক্রমশ একশো গুণ ভালো অভিনয় করছেন। কীসের ভিত্তিতে, কেন এটা হয় — সেটা আমাদের জানা উচিত। যে জন্য পৃথিবীর কয়েকটি শ্রেষ্ঠ নাট্যবিদ্যালয়ে মার্ক্সবাদ আজ অবশ্যপাঠ্য। আমি শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ বা চীনের কথা বলছি না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও হয়। স্ট্যান্ডার্ড বিশ্ববিদ্যালয়তে যে নাট্যশিক্ষার কলেজ আছে সেখানেও মার্ক্সবাদ পড়তে হয়। আস্তে আস্তে যাঁরা মার্ক্সবাদী নন, বা মার্ক্সবাদ বিরোধী তাঁরাও ক্রমশ হৃদয়ঙ্গম করছেন যে মার্ক্সবাদ এমন কতকগুলি জিনিস দিয়েছে যার ফলে অভিনেতা আরও ভালো অভিনয় করতে সক্ষম হন। সেগুলিকে আয়ত্ত করে, অবশ্যই আয়ত্ত করা খুবই কঠিন এবং সেটা দীর্ঘ অনুশীলনের বিষয়। অনেক পড়বার বিষয়, পড়ে চিন্তা করবার বিষয়। কারণ এটা হচ্ছে মার্ক্সবাদের দর্শনের দিক। মার্ক্সবাদ তো শুধু অর্থনীতি নয় বা শুধু রাজনীতি নয়। মার্ক্সবাদ, মার্ক্সবাদী দর্শন হচ্ছে আধুনিক এক দর্শন, যার পরে এখনও পর্যন্ত কিছু আবিষ্কৃত হয়নি। শুধু মার্ক্সের নাম করা ভুল হবে, হেগেল, মার্ক্স। এই দু’জনে মিলে যে দর্শন সৃষ্টি করেছিলেন ইউরোপে তারপরে এখনও আর কিছু হয়নি। দর্শনের দিকে আর কিছু হয়নি। হয়তো অ্যাট এ টাইম মার্ক্সবাদ মরে গেছে — অনেকে বলেছেন, সবচেয়ে বেশি চিৎকার করছেন মস্কো থেকে। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। মার্ক্সবাদ কোনওদিনই মস্কোর ওপর নির্ভরশীল ছিল না। বরং তা সারা পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল। প্রথমে গির্জার যে দর্শন ছিল সেই দর্শন শতাব্দীর পর শতাব্দী ইউরোপের চিন্তাধারায় সবচেয়ে অগ্রসর দর্শন ছিল। কিন্তু তার পরে হচ্ছে হেগেল এবং মার্ক্সের দর্শন। যেটাকে এক কথায় বলা হয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।
এটা অভিনেতা কী করে প্রয়োগ করবেন তাঁর কাজে? অভিনেতাকে কী জানতে হবে মার্ক্সবাদের, যেটা তাঁর অভিনয়কে সাহায্য করবে? মার্ক্সবাদের দ্বন্দ্বের তত্ত্ব, যেটা ডায়ালেকটিক্স — এটা প্রয়োগ করতে গিয়েই অভিনেতার উৎকর্ষ বাড়তে থাকে দিনের পর দিন। তিনি যদি তাঁর নিজের অভিনয় এবং যে চরিত্রে অভিনয় করবেন সেই চরিত্রের ওপর ডায়ালেকটিক্স প্রয়োগ করতে থাকেন সচেতনভাবে তাহলে তাঁর অভিনয় উন্নতি হবেই। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে বহুদিন থেকে বড় বড় অভিনেতারা ডায়ালেকটিক্স প্রয়োগ করছেন — তবে সচেতনভাবে নয়, সেটা তাঁদের মজ্জাগত ছিল। কোনও চরিত্র সামনে রেখে তাঁরা ডায়ালেকটিক্স দিয়ে, দ্বন্দ্বতত্ত্ব দিয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করেছেন। সেই জন্যই তাঁরা বড় অভিনেতা হয়েছেন। সারা পৃথিবীতে, সেই গ্রিক আমল থেকে আজকের আমল পর্যন্ত তাই হয়ে আসছে। কিন্তু তাঁরা সচেতনভাবে প্রয়োগ করেননি। অভিনয় করার সময় এঁরা এসব চিন্তা করতেন না। তাঁদের মাথায় প্রথম যা আসত তাই তাঁরা করতেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে ওঁরা যেটা করে এসেছেন সেটাই আসলে ডায়ালেকটিকাল, অর্থাৎ মার্ক্সবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্বে সেটাই সঠিক। ওইভাবেই করা উচিত। অর্থাৎ মার্ক্সবাদ প্রথম পৃথিবীকে বলল যে, একটা নাটক যে লেখা হচ্ছে সেই নাটকের বিষয়বস্তু ছাড়াও নিশ্চয়ই একটা শ্রেণীর প্রশ্ন আছে। সেটা কোন শ্রেণীর? কোন শ্রেণীর পক্ষে, কোন শ্রেণীর বিপক্ষে তা নাটকটা পড়লেই বোঝা যায়। মার্ক্সবাদ আরও খানিকটা এগিয়ে বলল যে, শুধু নাটকের বিষয়বস্তু নয়, নাটকের ফর্ম, আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও, আঙ্গিকটাও একটা শ্রেণীগত প্রশ্ন। আমি কীভাবে অভিনয় করব, কীভাবে মঞ্চ সাজাব, কীভাবে আলোকসম্পাত করব — তার ভেতরেও লুকিয়ে আছে আমার শ্রেণীগত অবস্থান, শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গি। আমি কোন শ্রেণীর মানুষ, কোন শ্রেণীর পক্ষে, কোন শ্রেণীর বিপক্ষে সেটা আমার প্রযোজনা দেখেই বোঝা যাবে। সেটা আমার অভিনয়ের কায়দা দেখেই বোঝা যাবে।
যখন মার্ক্সবাদীরা প্রথম এসব কথা বলতে শুরু করলেন, সেই ১৮৪৪ সালের পর থেকে, তখন অনেকেই এসব মানেননি। দূর, আমি কীভাবে অভিনয় করব, আমি টুপিটা ফেলে ওখানে যাব কিনা, কথা বলে একটু পিছিয়ে যাব কিনা, কথাগুলো কোন দিক থেকে বলব — তার মধ্যে শ্রেণীগত প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?
আসছে কমরেড, আমরা যদি একটু চিন্তা করি তাহলে দেখব, নিশ্চয়ই আসছে। নাটকের বিষয়বস্তুতে তো অবশ্যই শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারা যায়। একটা নাটক পড়লে বোঝা যায়, এটা কোন শ্রেণীর পক্ষে লেখা, কোন শ্রেণীর বিপক্ষে লেখা। কিন্তু শুধু তা নয়, কীরকম মঞ্চসজ্জা হচ্ছে, কীরকম আলোকসম্পাত হচ্ছে, আর অভিনয়ের কৌশলটা কী নিয়েছে তা থেকেও বোঝা যায় এটা কোন শ্রেণীর পক্ষে আর কোন শ্রেণীর বিপক্ষে। মার্ক্সবাদীরা বোঝাতে লাগলেন যে, দেখুন, শেক্সপীয়ররা একরকমের নাটক লিখেছেন, অভিনয় করিয়েছেন। কিন্তু তারপরে একটা এত বড় পরিবর্তন কেন? আমরা যখন বার্নার্ড শ, ইবসেন প্রমুখের যুগে এসে পৌঁছই তখন দেখি নাটকের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ পালটে গেছে। নাটকের মূল যে উদ্দেশ্য সেটাই পালটে গেছে। আগে শেক্সপীয়ররা যে উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক লিখতেন — শ, ইবসেনের সময়ে এসে সেটা সম্পূর্ণ অন্য উদ্দেশ্যে লেখা নাটক। এবং নাটকের উদ্দেশ্য নয়, সেই সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চসজ্জাও সমস্ত পালটে গেছে। এর কারণটা কী? এইটে তদন্ত করতে করতে ওঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, শেক্সপীয়রাও বাস্তববাদী ছিলেন নিশ্চয়ই, তাঁরা তো আর আকাশের পরী নিয়ে নাটক লিখতেন না। তাঁরা মানুষ নিয়েই লিখেছেন, তাঁদের সময়কার সমাজ নিয়েই লিখেছেন। আবার ইবসেন, বার্নার্ড শ, তাঁরাও তাই নিয়েই লিখেছেন, তাঁদের সময়কার সমাজ। কিন্তু সমাজটা এত পালটে গেছে যে নাটকের বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক — দুটোই পালটে গেছে। ওঁরা নাম দিয়েছেন, বড় বড় পণ্ডিতেরা, শেক্সপীয়র পর্যন্ত হচ্ছে ধ্রুপদী বাস্তবতা, ক্ল্যাসিকাল রিয়ালিজম।
যখন সারা পৃথিবীতে পুঁজিপতিরা বা বুর্জোয়ারা পুরোপুরি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন তাঁদের প্রয়োজনে নতুন নাটক যেমন লেখা হতে শুরু করল, ঠিক তেমনই নাটকের আঙ্গিকও পালটে যেতে লাগল। কোথায় প্রধান পার্থক্যটা আপনারা দেখুন — নিশ্চয়ই আপনারা পড়াশোনা করেন, শেক্সপীয়রের নাটক পড়েন নিশ্চয়ই। শেক্সপীয়রের নাটক না পড়ে কেউ অভিনয় করতে নেমেছেন এটা ভাবাই বাতুলতা। শেক্সপীয়রের নাটকে কোথাও মঞ্চসজ্জায় বোঝানো হচ্ছে না এটা কোন জায়গা। বা এখন দিন না রাত — এসব কিছু বোঝার উপায় নেই। মনে রাখবেন, তখন অভিনয় হত একই মঞ্চে, মঞ্চসজ্জা বলে কিছু ছিল না। বাঁধানো পাথরের মঞ্চে অভিনয় হচ্ছে। এবং যে কোনও নাটকই হোক, বা তার যে কোনও দৃশ্যই হোক — একই মঞ্চসজ্জা সব সময় দর্শকদের সামনে। অনেকখানি বড় জায়গা, বিশাল জায়গা। এবং সেই জায়গার তিনদিকেই দর্শক দাঁড়িয়ে রয়েছেন — সামনেও এবং দু’দিকেও। দর্শক দাঁড়িয়ে দেখবেন, দর্শকের বসার ব্যবস্থা নেই। দর্শকের বসবার ব্যবস্থা আছে প্রেক্ষাগৃহের পেছন দিকে এবং পাশে বক্স মতো করা আছে। সেইখানে বসেন শুধু বড়লোকরা। আর সমস্ত দরিদ্র মানুষ দাঁড়িয়ে নাটক দেখতেন।
শেক্সপীয়রের কোনও নাটকই তিন ঘণ্টার কম নয়। পাঁচ ঘণ্টার নাটকও আছে। হ্যামলেট আছে, অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রা আছে। ভেবে দেখুন, পাঁচ ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে দর্শক নাটক দেখতেন। সেরকম নাটকের, সেরকম দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখা খুব কঠিন।
সেই জন্য শেক্সপীয়রের নাটকে এত ঘন ঘন তলোয়ার খেলা হয়। মাঝে মাঝে ভূত আসে, ডাকিনীরা আসে। এবং এত খুন হয়, এত মৃতদেহ পড়ে যায় রঙ্গমঞ্চের ওপরে। তা না হলে পাঁচ ঘণ্টা ধরে ওদের মনোযোগ আকর্ষণ করার কী উপায় আছে একজন নাট্যকারের? কিচ্ছু নেই। কিন্তু এটা হল ধ্রুপদী বাস্তবতা।
বুর্জোয়া বাস্তবতা এর একেবারে উলটো। একেবারে অন্য থিয়েটার। এখন গরিবদের থিয়েটারে ঢোকা বারণ হয়ে গেল। কেননা টিকিটের দাম এমন অসম্ভব যে প্রথমেই ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণী থিয়েটারে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হল। দ্বিতীয়ত, সেখানে আইন চালু হল সান্ধ্য পোশাক ছাড়া কাউকে থিয়েটারে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এখন ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণীর সান্ধ্য পোশাকই নেই। সে যে পোশাক পরে থাকে সেই পোশাক পরে ওকে থিয়েটারে আসতে বারণ করে দেওয়া হল। সুতরাং বুর্জোয়া নাটকে দর্শক বুর্জোয়া শ্রেণী, আর কাউকে ওঁরা থিয়েটারে ঢুকতে দিতেন না। আগে ছিল সবথেকে সস্তা সিটগুলো সামনে। শেক্সপীয়রের নাটকে সব থেকে সস্তায় যাঁরা ঢুকতেন থিয়েটারে তাঁরা সব থেকে কাছে দাঁড়িয়ে নাটক দেখতে পেতেন। এই নতুন নিয়ম চালু হল বুর্জোয়া থিয়েটারে যে, সব থেকে সস্তা টিকিটগুলো হচ্ছে একেবারে পেছনে। যত বেশি দাম, তত বেশি সামনের দিকে বসবে। অর্থাৎ কিনা বড়লোকেরা থিয়েটারকে দখল করে নিল। ওরা সবথেকে সামনে বসে নাটক দেখছে, অভিনেতার সঙ্গে ওদের কমিউনেকিশন হচ্ছে সব থেকে বেশি।
ধূমপান বারণ হল থিয়েটারে — প্রেক্ষাগৃহে ধূমপান বারণ। এটা শেক্সপীয়রের যুগে কেউ কোনওদিন চিন্তাও করেনি। ধূমপান কেন সেখানে মদ্যপানও করত দর্শকরা। এখানে সব বারণ। যেন গির্জায় এসে বসেছে এরকম একটা গুরুগম্ভীর, কৃত্রিম আবহাওয়া সৃষ্টি হল।
যখন এই রঙ্গমঞ্চ এইভাবে সাজানো হল তখন নাটকের যে চরিত্র গোড়ায় ঢুকল, নাটকের শেষে সেই চরিত্রই আছে। এই কথাটাই নতুন আবিষ্কার হল যে, চরিত্র কী? এ কি নাটকের হিরো? না নাটকের ভিলেন? মার্ক্সবাদ আমাদের শেখাল যে মানুষ ভিলেনও না, হিরোও না। মানুষ হচ্ছে মানুষ। একটা বিশেষ অবস্থায় সে হিরো হয়, আবার একটা বিশেষ অবস্থায় সেই লোকটাই ভিলেন হয়। কে যে হিরো, কে যে ভিলেন, এখনও পর্যন্ত তা বলা যাচ্ছে না। পণ্ডিতদের এখনও তর্ক হয়। জুলিয়াস সিজার নাটক তো সবথেকে সহজ নাটক। তা কে এর নায়ক? নাটকের নাম জুলিয়াস সিজার, কিন্তু তিনি নায়ক হতে পারেন না। কারণ তিনি তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে মারা গেছেন। তারপরে নাটকটা আরও দু’ অঙ্ক চলেছে। এখন ব্রুটাস এই নাটকের নায়ক, না মার্ক অ্যান্টনি এই নাটকের নায়ক কেউ বলতে পারে না।
এখন, এই যে সাজিয়ে দিয়েছে ছোট্ট রঙ্গমঞ্চ, আর আমি রোজ যে ঘরটা দেখি সেই ঘরটা তৈরি করে দিয়েছে, একেবারে হুবহু তৈরি করে দিয়েছে, এমন একটা জায়গায় যে হয়েছিল ঘটনা, একটা দৃশ্যের কসাইখানা দেখানোর জন্য আস্ত গরু কেটে সেইগুলো কেটে কেটে ঝুলিয়ে দেখিয়েছিল — বাস্তবতা। শেক্সপীয়রের নাটকেও কিন্তু কসাই হত, কিন্তু দোকানশুদ্ধ নয়। কারণ শেক্সপীয়র খুব ভালোভাবেই জানেন যে আমি কসাইকে আনছি কসাই বলে নয়, কী কাজ করে সেটা গুরুত্বহীন আমার কাছে। কিন্তু এখন তা নয়। বুর্জোয়া থিয়েটারে এসে কে কী চাকরি করে সেটা মস্ত বড় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
মানুষকে এইভাবে লেবেল করে দিচ্ছে যেটা শেক্সপীয়ররা করতেন না। তাঁরা জানতেন, মানুষকে এভাবে লেবেল করা যায় না, মানুষ তার থেকে ঢের বেশি জটিল, ঢের বেশি আবেগপ্রবণ একটা জীব, যার কথাবার্তা আচরণ লজিকাল বলতে যা বোঝায় তা নয়। অনেক সময় দেখবেন, আমাদের নাট্য-সমালোচকরা লিখছেন: চরিত্রটির লজিক নেই। আরে, লজিক তো মানুষেরই নেই। মানুষের লজিক থাকলে আজ সোভিয়েত ইউনিয়নের লোকেরা বলতে পারে যে কমিউনিস্ট পার্টির আর প্রয়োজন নেই? বলছে তো! তো সেখানে লজিক খুঁজতে বসবেন আপনারা? লজিক নেই। মানুষের লজিক থাকে না। মানুষের আচরণে লজিক থাকে না। সমাজের কোনও পরিবর্তন নেই, মানুষের কোনও পরিবর্তন নেই, মানুষ চিরদিনই এরকম থাকবে — এইভাবে ব্যাখ্যা করা হত। নাটকের চরিত্রেও এইরকম লেবেল মেরে দেওয়া হত।
তো এই যেখানে অবস্থা সেখানে মার্ক্সবাদ আমাদের সামনে এসে বুঝিয়ে দিল যে এই বুর্জোয়া নাটক বর্তমানে সারা পৃথিবীর নাট্যশালাকে দমন করে রেখেছে। একে হঠাতে না পারলে, একে আধুনিক শক্তিতে জারিত করতে না পারলে থিয়েটার তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না। থিয়েটারের দৃঢ় শক্তি ছিল, গ্রিক থিয়েটারে, বা শেক্সপীয়রের আমলে, সেটা চাপা পড়ে গেল। এবার আহ্বান এল, থিয়েটারের এই বুর্জোয়া আর্ট সরাও, নতুন থিয়েটার তার নিজস্ব পথে এগোতে থাকবে, এবং তা অমিতশক্তির জন্ম দেবে। যারা মার্ক্সবাদী নাট্যপরিচালক, অভিনেতা, তাঁরাই সর্বপ্রথম আমাদের সামনে দেখালেন যে অভিনয় ব্যাপারটাই হচ্ছে ডায়ালেকটিকাল, যে ডায়ালেকটিক্সের ওপর মার্ক্সবাদ দাঁড়িয়ে আছে, দ্বন্দ্বতত্ত্ব। প্রতি মুহূর্তে অভিনেতাকে কতগুলি দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়, আর সেই দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করার নামই হচ্ছে অভিনয়। যেমন ধরুন অভিনেতাকে part-টা ভালো করে মুখস্থ করতে হবে এটা জানা কথা। ঝাড়া মুখস্থ বলবে সে রঙ্গমঞ্চে। কিন্তু প্রতিদিন তাকে একই কথা এমনভাবে বলতে হবে যে জীবনে আগে কখনও যেন এসব কথা শোনেনি। প্রতি মুহূর্তে প্রত্যেকটা কথা যেন স্বতস্ফূর্তভাবে এই প্রথম তার মনে পড়ছে, সেই প্রথম সে বলছে এমনভাবে উচ্চারণ করতে হবে। তাকেই বলে অভিনয়। অন্য লোকের লেখা কথাগুলো আবার এমনভাবে বলতে হবে যেন এটা আমার কথা, আমার নিজের কথা। প্রতি মুহূর্তে সেটা উপলব্ধি করতে হবে, অন্য লোককে বোঝাতে হবে, কার চরিত্র আমি? সে-ই লিখেছে। কিন্তু এমনভাবে কথাগুলো উচ্চারণ করতে হবে যেন সেগুলো আমার কথা। দ্বন্দ্ব, প্রতি মুহূর্তে দ্বন্দ্ব।