সোমদেব ঘোষ
না, নোবেলটা উনি পাননি।
ইস্কুলে স্টিফেন উইলিয়ামের ডাকনাম ছিল আইনস্টাইন।
যার নামে এই ডাকনাম সেই অ্যালবার্ট জন্মেছিলেন ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ, মারা যান ১৯৫৫ সালে ৭৬ বছর বয়সে।
হকিং মারা গেলেন ১৪ মার্চ, ২০১৮। জন্মেছিলেন ১৯৪২ সালে। মারা যাওয়ার সময় বয়স : ৭৬ বছর।
কিন্তু তা বলে মোৎসার্টের মতো চাইল্ড প্রডিজি ছিল না ছোট্ট স্টিফেন। বুদ্ধিমান ছাত্র, কিন্তু ক্লাসের ফার্স্ট বয় নয়। রেডিও ঘড়ি ইত্যাদি খুলে দেখে ভেতরের যন্ত্রপাতি ঘেঁটেমেটে দেখার বাসনা প্রবল, কিন্তু ফের তাকে লাগিয়েটাগিয়ে ইস্ক্রুপ এঁটে কাজ করাতে বললে সে ভ্যানিশ। খেলাধুলায় বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই, স্কিলও নেই। বন্ধু জেমস ম্যাক্লেনাহ্যান তো আরেক বন্ধু ব্যাসিল কিং-এর সঙ্গে বাজিই ধরে বসল। জেমসের মতে স্টিফেন বড় হয়ে কিস্যু হতে পারবে না, ওই আইনস্টাইন ডাকনাম স্রেফ ফক্কা। ব্যাসিলের মতে, না, স্টিফেন দেশের নাম উজ্জ্বল করবে, লোকে তার নাম জানবে। যে জিতবে সে এক প্যাকেট টফি-লজেন্স পাবে। স্টিফেন উইলিয়ামের বয়স তখন বারো।
কোনও এক অজানা কারণে আজও কিং (যদি বেঁচে থাকেন) সেই টফি-লজেন্সের প্যাকেটটা ম্যাক্লেনাহ্যানের কাছ থেকে কালেক্ট করতেই পারেন। বাজিটা বোধহয় জিতে গেছেন অ্যাদ্দিনে।
হয়তো এইজন্যই স্টিফেনের নিজের হুটহাট বাজি ধরার অভ্যেস। ভদ্রলোকের কেরিয়ারটাই (অন্তত ১৯৭৩/৪ সালে) পুরোটাই ব্ল্যাকহোলের ওপর দাঁড়িয়ে, এমন সময় হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই কিপ থর্নের (যিনি গত বছর LIGO-তে গ্র্যাভিটি ওয়েভ ডিটেকশনের জন্য নোবেল পেলেন) একটা বাজি ধরলেন। ব্ল্যাকহোল যদি সত্যিই না থাকে, তাহলে হকিং প্রাইভেট আই ম্যাগাজিনের চার বছরের সাবস্ক্রিপশন পাবেন, খরচ থর্নের। আর যদি থাকে, থর্ন পেন্টহাউস ম্যাগাজিনের এক বছরের সাবস্ক্রিপশন পাবেন, খরচ হকিং দেবেন। কয়েক বছর পরে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়াতে হকিং বাজি হেরেছিলেন, থর্নও পেন্টহাউস পেয়েছিলেন এক বছর ধরে।
প্রাইভেট আই পলিটিকাল স্যাটায়ার ম্যাগাজিন। পেন্টহাউস লাইফস্টাইল ও সফট পর্ন ম্যাগাজিন।
যাই হোক, বাজি রাখার যুক্তি হল, বাজিটা একধরনের ইনশ্যিওরেন্স পলিসি। ব্ল্যাকহোল যদি আদপে নাই থাকে তাহলে হকিংয়ের কেরিয়ার তো সোজা ধাপার মাঠে। তখন ৪৮খানা প্রাইভেট আই পেলে তাও কন্সোলেশন প্রাইজ।
১৯৮০ সালের ২৯ এপ্রিল। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবের ককক্রফট লেকচার হল। হলভর্তি লোক। লেকচার দেবেন কেম্ব্রিজের নতুন ল্যুকেসিয়ান প্রফেসর অফ ম্যাথেম্যাটিক্স। আইজ্যাক নিউটন ২৬ বছর বয়সে এই প্রফেসরশিপ পান। ওনার পরে চার্লস ব্যাবেজ, জর্জ স্টোক্স, লারমর, পল এড্রিয়ান মরিস ডিরাকের মতো দিকপাল গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ এই পদে বহু বছর কাটিয়েছেন। এখন ৩৮ বছর বয়সী একজন কসমোলজিস্ট এই পদে নিযুক্ত হলেন। হকিং আসায় পদেরই প্রেস্টিজ বাড়ল।
প্রেশারকুকার নিয়ে ইয়ার্কি নয়। প্রেশারকুকার দিয়ে প্রচুর ফিজিক্স শেখা যায়। সুপার্ব খিচুরিও রাঁধা যায়। প্রেশারকুকার ইজ ব্রিলিয়ান্ট।
সেদিন ককক্রফটে ব্যাসিল কিং এলে খুশি হতেন। টফি-লজেন্স পেতেন।
ল্যুকেসিয়ান প্রফেসরশিপ পাওয়ার প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে অক্সফোর্ডে পড়াশুনো করতে যান ইসোবেল ওয়াকার। তখনকার দিনে ব্রিটেনের এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। মেয়েদের ডিগ্রি দেওয়াই শুরু হয় ১৯২০ নাগাদ, যেখানে অক্সফোর্ড প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১০৯৬ সালেরও আগে, আর কেমব্রিজ ১২০৯ সালে। ইসোবেল অক্সফোর্ডে গিয়ে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনো করেন। তার কিছু বছর আগে ফ্র্যাঙ্ক হকিং ওই অক্সফোর্ডেই ট্রপিকাল মেডিসিন নিয়ে পড়াশুনো করে তারপর ফিল্ড রিসার্চ করতে ইস্ট আফ্রিকায় পাড়ি দেন। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে ফ্র্যাঙ্ক প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়ে লন্ডন ফিরে এসে মিলিটারিতে জয়েন করার জন্য অ্যাপ্লাই করেন। তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে তাঁকে মেডিকাল রিসার্চে অ্যাসাইন করা হয়। হ্যাপ্সটেডে একটা মেডিকাল ইন্সটিট্যুটে জয়েন করেন ফ্র্যাঙ্ক হকিং। সেখানে সেক্রেটারির কাজ করছিলেন ইসোবেল ওয়াকার।
বেয়াল্লিশ সালের শুরুতে যুদ্ধের অবস্থা বেশ খারাপ। জার্মান লুফটওয়াফা প্রায় রোজ ইংল্যান্ডে বম্বিং র্যেড করছে। লন্ডনে থাকা মানে প্রাণের সংশয়। হকিংরা তখন উত্তর লন্ডনের হাইগেটে থাকতেন। প্রেগনেন্সির শেষদিক চলে আসায় ইসোবেল অক্সফোর্ডে চলে এলেন। ইংল্যান্ডের যেমন অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ, জার্মানির তেমন হাইডেলবার্গ ও গটিঞ্জেন। ইউনিভার্সিটির শহর। পড়াশুনো ও গবেষণার শহর। ইংল্যান্ডের রয়্যাল এয়ারফোর্স কথা দিয়েছিল তারা এই দুই শহরে বোমা ফেলবে না। উলটে জার্মান লুফটওয়াফা অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বাঁচিয়ে তাদের বম্বিং রান করছিল। ইসোবেল তাই নিজের চেনা শহরেই মা হবেন বলে ঠিক করেন।
ইওরোপের মধ্যযুগকে এক বৈজ্ঞানিক ব্ল্যাকহোল বললে খুব ভুল বলা হয় না। চার্চের প্রভাব এতটাই যে ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়। গ্যালেলিও ক্ষমাটমা চেয়ে বেঁচে যান। ফিজিক্সের পাওনিয়ারদের মধ্যে একজন এই গ্যালেলিও গ্যালিলি। তিনি মারা যান ১৬৪২ সালের ৮ জানুয়ারি।
গ্যালেলিও গ্যালিলি
এর ঠিক ৩০০ বছর পর ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি রণক্লান্ত ইংল্যান্ডের মাটিতে জন্ম নেন আধুনিক ফিজিক্সের সর্বশ্রেষ্ঠদের অন্যতম স্টিফেন উইলিয়াম হকিং।
১৯৮০ সাল, ২৯ এপ্রিল। পেছনে বিশাল বিশাল সবুজরঙের ব্ল্যাকবোর্ড, চেন-পুলি দিয়ে তাকে ওপর-নিচ বাঁদিক-ডানদিক করে ইকোয়েশন ও প্রুফে ভরিয়ে ফেলা যায়। তার সামনে হাতে চক ও ডাস্টার ছাড়াই হুইলচেয়ারে যে ৩৮ বছর বয়সী বসে আছেন, তিনি কিন্তু কথা বলছেন না। লেকচারটা পড়ে শোনাচ্ছে তাঁরই এক ছাত্র। কথা বলছেন না কেননা স্পষ্ট করে কথা বলার ক্ষমতা ততদিনে একেবারেই হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। অথচ এরকম কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না।
খেলাধুলোয় খুব একটা ইন্টারেস্ট না থাকলেও বিজ্ঞানের প্রতি ছোটবেলা থেকে স্টিফেনের একটা সহজাত আকর্ষণ ছিল। সেন্ট আলবানে হকিং পরিবারকে একটু অন্য চোখে দেখা হত। প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ও একটু খ্যাপাটে এই বাড়িতে গুচ্ছ গুচ্ছ বই ও ক্ল্যাসিকাল ম্যুজিকের রেকর্ড যত্রতত্র ছড়ানো থাকত। স্টিফেনের বন্ধুরা ডিনার খেতে এসে অবাক হত; হকিংরা সবাই ডিনারে বসে নিজ নিজ বইতে মুখ গুঁজে থাকতেন।
সেন্ট আলবানে স্টিফেন ও তার বন্ধুদের গ্রুপ দেখলে অনেকটা স্ট্রেঞ্জার থিংসের উইল ও তার বন্ধুদের কথা মনে পড়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়। ডাঞ্জন্স অ্যান্ড ড্রাগন্স বাজারে আসতে তখনও অনেক দেরি, তাই স্টিফেন অ্যান্ড কোং নিজেরাই নতুন নতুন বোর্ড গেম বানিয়ে দিনের পর দিন তাই খেলত। আজকালকার বাচ্চারা মোবাইলে নাক গুঁজে গেম খেলে, তাদের বোর্ড গেম খেলার কথা বললেই — নতুন গেম তৈরি করার কথা ছেড়েই দিলাম — তারা বোধহয় অক্কা পাবে।
এক্সট্রা-সেনসরি পার্সেপশন বা ইএসপি নিয়েও স্টিফেনের বেশ আগ্রহ ছিল। বোর্ডগেমে অনেক সময়ই লুডোর ছক্কার প্রয়োজন হত। হাত দিয়ে না ছুঁয়ে স্রেফ ব্রেনওয়েভ ব্যবহার করে পুটকে ছক্কা করার প্রচুর চেষ্টা করেছিল স্টিফেনগণ। সুখের বিষয়, তারা অসফল হয়েছিল। পরে, পনেরো বছর বয়সে একজন ইএসপি বিশেষজ্ঞের লেকচার শুনে স্টিফেন বিরক্ত হয়ে এইসব আজেবাজে ব্যাপারে মন দেওয়া বন্ধ করেন।
তার বদলে অঙ্কের শিক্ষক দিকরান তাহতার গাইডেন্সে স্টিফেন এবং আরও কয়েকজন সেন্ট আলবান স্কুলের ছাত্রছাত্রী মিলে পুরনো টেলিফোনের সুইচবোর্ড ও ঘড়ির পার্টস ইত্যাদি ব্যবহার করে LUCE (লজিকাল ইউনিসিলেক্টর কম্প্যুটার ইঞ্জিন) নামে একটা কম্প্যুটারও বানিয়ে ফেলে।
ডঃ ফ্র্যাঙ্ক হকিং চেয়েছিলেন বড় ছেলেও তাঁর মতো ডাক্তার হোক। এদিকে ছেলে তখন অঙ্ক ও ফিজিক্স নিয়ে মগ্ন। সে চায় কলেজে তাই পড়তে। হকিং সিনিয়রের তো চক্ষু চড়কগাছ। অঙ্ক করে পড়ানো ছাড়া কোনও চাকরিই তো নেই। তার চেয়ে বরং…
স্টিফেন স্টিফ হয়ে আছে দেখে ডাক্তারবাবু সুর নরম করলেন। বেশ, যা খুশি পড়ো, কিন্তু পড়তে হবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়তেই।
স্টিফেন পড়ল ফাঁপরে, কেননা অক্সফোর্ডে অঙ্ক পড়ানো হয় না। তবে এইটুকুতে দমে যাওয়ার পাত্র স্টিফেন নয়। ম্যাথস না হোক, অক্সফোর্ডে ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি তো পড়ানো হয়। বেশ, তাই নিয়েই সে পড়াশোনা করবে। সঙ্গে ম্যাথসটা নাহয় নিজেই পড়বে।
এইসব ভেবেটেবে সে যখন এন্ট্রান্সের জন্য রেডি হবে, ডঃ হকিং-কে গবেষণার জরুরি কাজে ভারতবর্ষে আসতে হল। ইসোবেল হকিংয়ের ভাইবোনদের নিয়ে স্বামীর সঙ্গে চললেন। স্টিফেন ডঃ হকিংয়ের বন্ধু সাইমন হামফ্রির বাড়ি থেকে পরীক্ষার জন্য তৈরি হল এবং বেশ ভালোভাবেই পাশ করল। ইন্টারভ্যুতে ইউনিভার্সিটি কলেজের মাস্টার ফিজিক্সের ডঃ রবার্ট ব্যরম্যান স্টিফেনের সঙ্গে কথা বলে বুঝলেন, এ সাধারণ ছেলে নয়।
ব্যরম্যানের ট্যুটরশিপে চারজন ছাত্র ছিল : স্টিফেন, গর্ডন বেরি, ডেরেক পাউনি, আর রিচার্ড ব্রায়ান। একবার ব্যরম্যান এই চারজনকে তেরোটা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজমের প্রবলেম দিয়ে বলেছিলেন, হাতে সাতদিন সময়, যতগুলো পারো করে এসো।
এক হপ্তা বাদে অ্যাসাইননেন্ট জমা দেওয়ার দিন সকালে দেখা গেল ব্রায়ান ও ডেরেক দেড়খানা পেরেছে, বেরি পেরেছে একখানা। স্টিফেন প্রবলেম শিটটাকেই ভাল করে পড়েনি। সকালের প্রথম তিনটে লেকচার মিস করে স্টিফেন প্রবলেম সলভ করতে বসল। এদিকে বাকি তিনজন ভাবল, স্টিফেনের দফা ইজ রফা।
লাঞ্চে চারজনের দেখা হল। স্টিফেন মুখ চুন করে বলল, মাত্র দশটা হয়েছে।
২৯ এপ্রিল, ১৯৮০। ল্যুকেসিয়ান লেকচার। প্রফেসর ডঃ হকিং জুনিয়র টপিক হিসাবে বেছেছেন N = 8 Supergravity। টকের টাইটেল “Is the End in Sight for Theoretical Physics?” সেখানে উনি (ছাত্রের মাধমে) বলছেন যে আর কুড়ি বছরের মধ্যে, মানে ২০০০ সালের মধ্যে থিওরেটিকাল ফিজিক্সের হাতের মুঠোয় থিওরি অফ এভ্রিথিং চলে আসবে। গ্র্যাভিটির সঙ্গে বাকি তিনটে মৌলিক ফোর্সের মিলন ঘটবে। থিওরেটিকাল ফিজিক্সে করার আর কিছু থাকবে না।
আচ্ছা লোক মাইরি। নিজের ফিল্ডই শেষ হয়ে যাবে বলার মধ্যে কী অদ্ভুত আনন্দ খুঁজে পেতেন কে জানে।
২০১৪ সালে থিওরি অফ এভ্রিথিং নামে একটা হলিউড সিনেমা বেরোয়। সিনেমাটা হকিংয়ের বায়োপিক, হকিংয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে এডি রেডম্যেন বেস্ট অ্যাক্টর অস্কারও পেয়েছিলেন। সেই রেডম্যেন এখন হ্যারিপটার ইউনিভার্সে এসে ন্যুট স্ক্যামান্ডারের ভূমিকায় অভিনয় করছেন।
অভিনেতা রেডম্যেন একদিকে, বিজ্ঞানী হকিং অন্যদিকে
বিজ্ঞান বিষয়ক প্রোগ্রাম ছাড়াও টিভিতে জনপ্রিয় সিরিয়ালে হকিংকে মাঝেমধ্যে দেখা গেছে। ১৯৯৩ সালে স্টার ট্রেক : দ্য নেক্সট জেনারেশন টিভি সিরিয়ালে অ্যান্ড্র্যেড মিঃ ডেটা, আইজ্যাক নিউটন ও অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে পোকার খেলতে দেখা গেছে হকিংকে। ২০১২ সালে বিগ ব্যাং থিওরি নামে আরেকটি জনপ্রিয় সিরিয়ালে হকিংকে শেল্ডন কুপারের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। ব্ল্যাকহোল নিয়ে শেল্ডনের থিওরি শুনে তিনি বলেছেন,
What is common between Sheldon Cooper and a black hole?
They both suck.
সেন্স অফ হ্যুমার আর উইট সাংঘাতিক ছিল হকিংয়ের। কথা বলার ক্ষমতা হারানোর পর ছিয়াশি সাল থেকে স্পিচ সিন্থেসাইজার ব্যবহার করতেন, মিনিটে ১৫ শব্দের বেশি স্পিড উঠত না। তাতেও যে লেভেলের ঠাট্টামজা করতেন তা অভাবনীয়।
অক্সফোর্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজে ফিজিক্সের ব্যাচেলর লেভেলের পড়াশুনো স্টিফেনের কাছে অত্যন্ত সহজ ও বোরিং লাগত। দিনে একঘণ্টা করে পড়ত। তিন বছরে সাকুল্যে বোধহয় ১০০০ ঘণ্টা পড়াশোনা করেছিল। শেষ পরীক্ষার আগে তাই বেশ টেনশনে পড়ে গিছল। এ তো আর ১৩টা দাঁতভাঙা ইএমের অঙ্ক নয় যে তিনটে লেকচার মিস করে ফুৎকারে করে দেবেন। এ হল অক্সফোর্ডের ফাইনাল পরীক্ষা। ফার্স্টক্লাস না পেলে অক্সফোর্ডেই থাকতে হবে, কেমব্রিজ আর যাওয়া হবে না। পরীক্ষায় টায়টায় নম্বর পেলেন। তাই ভাইভায় বসতে হল। পরীক্ষকদের বললেন, ফার্স্টক্লাস না পেলে তিনি অক্সফোর্ডেই থেকে যাবেন। অত্যন্ত ল্যাদস ও ফাঁকিবাজ ছাত্র হিসাবে স্টিফেনের নাম ছিল। ফের অক্সফোর্ডে রাখার চান্স নিশ্চয় পরীক্ষকরা নেবেন না, স্টিফেন এই আশাতেই সে’কথা বলেছিলেন।
পরীক্ষকরা অবশ্য অতটাও বোকা ছিলেন না। স্টিফেনের ক্ষমতার আন্দাজ তারা ভালোই পেয়েছিলেন। ডঃ ব্যরম্যান বলেছিলেন,
It was only necessary for him to know something could be done, and he could do it without looking to see how other people did it.
আইনস্টাইনই বটে।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন
১৯১৬ সালে আইনস্টাইন ফিজিক্স ও বিজ্ঞানের জগতে এমন এক আইডিয়ার জন্ম দিয়েছিলেন যার তুলনা খুব কমই আছে। নিউটনের সময় থেকেই আমরা মাধ্যাকর্ষণ বলের কথা (অঙ্কের ভাষায়) জানি। নিউটনের এই আপেল-মুণ্ডু মডেলে মহাবিশ্বের যেকোনও দু’টি ভরের মধ্যে গ্র্যাভিটি নামক এক ফোর্স আছে। এই টানের চোটে সেই ভরদুটি একে অপরের কাছে আসার চেষ্টা করে। দুটো ম্যাগনেটের নর্থ পোল কাছাকাছি রাখলে তারা একে অপরের থেকে দূরে ছিটকে যাবার চেষ্টা করে। গ্র্যাভিটি কিন্তু কখনওই এরকম রিপালসিভ নয়, অলওয়েজ অ্যাট্রাক্টিভ।
আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটির ইকোয়েশ্যন সলভ করে ১৯৫৫ সালে অমল কুমার রায়চৌধুরী (প্রেসিডেন্সি কলেজের কিংবদন্তী শিক্ষক AKR) অঙ্ক কষে দেখান কেন গ্র্যাভিটি সবসময়ই টানে, ঠেলে না।
অমল কুমার রায়চৌধুরী (AKR)
এই রায়চৌধুরী ইকোয়েশন ব্যবহার করে হকিং ও পেনরোজ মিলে ষাটের দশকের দ্বিতীয়ভাগে ব্ল্যাকহোল সিঙ্গুলারিটি থিওরেম আবিষ্কার করেন। আবার এই রায়চৌধুরী ইকোয়েশনই ব্যবহার করে হকিং সত্তর সালে প্রমাণ করেন যে ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রফল বা সার্ফেস এরিয়া কখনওই কমতে পারে না।
কার্ল শোয়ারৎসচাইল্ড
১৯১৬ সালেই কার্ল শোয়ারৎসচাইল্ড আইনস্টাইনের ইকোয়েশন সলভ করে দেখিয়েছিলেন যে ইভেন্ট হোরাইজন নামে স্পেস্টাইমে এমন একটা সীমানা থাকতে পারে যার ভেতরে কী হচ্ছে সেটা বাইরে বসে জানা অসম্ভব। এই কাজে পরে হাত লাগান এডিংটন, চন্দ্রশেখর, ওপেনহাইমার, স্নাইডার, ফ্রীডম্যান, পেনরোজ ও অতি অবশ্যই হকিংয়ের মতো দুঁদে ফিজিক্সের লোকজন।
আইজ্যাক নিউটন
নিউটনের থিওরিতে স্পেস, যার মধ্যে দিয়েই গ্র্যাভিটির ফোর্স ছুটে চলেছে, নীরব দর্শকমাত্র। আইনস্টাইন বললেন যে না, কোনও ভর থাকলে তার চারপাশের স্পেস্টাইম বেঁকেচুরে বক্রতা ধারণ করবে। আর এই জ্যামিতিক কার্ভেচারই আসলে গ্র্যাভিটির জনক।
এই আইডিয়ার সঙ্গে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আড়ি হয়ে আছে গত একশো বছর ধরে। কেননা কোয়ান্টাম মেকানিক্সে স্পেস্টাইমের কার্ভেচার থেকে গ্র্যাভিটি, এই কথার কোনও মানে নেই। ফোর্স মানেই কোনও না কোনও কণার ইধারসেউধার উধারসেইধার হতেই হবে। যেমন ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্সের ফোটন, বা ভরের হিগস বোসন। মুশকিল হল, গ্র্যাভিটন জিনিসটা আছে কিনা সেটা খুঁজতে গেলে LHC-তে শানাবে না, এত বড় ডিটেক্টর লাগবে যে সে নিজেই শোয়ারৎসচাইল্ড রেডিয়াসের চেয়ে ছোট হয়ে গিয়ে ব্ল্যাকহোল হয়ে যাবে।
জেনারেল রিলেটিভিটি ও গ্র্যাভিটির সঙ্গে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই ঝগড়া মেটানোর বহু চেষ্টা করেছিলেন হকিং। পারেননি। থিওরি অফ এভ্রিথিং এখনও সিনেমাটার মতোই বাস্তবের একটা কাল্পনিক স্বপ্নমাত্র হয়ে রয়েছে।
২৯ এপ্রিল ১৯৮০ সালে হকিং যা বলেছিলেন তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। N = 8 Supergravity বা স্ট্রিং থিওরি বা লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি কোনওটাই গ্র্যাভিটিকে কোয়ান্টাম আকারে লিখতে পারেনি।
সুব্রমনিয়ন চন্দ্রশেখর
তাও, চন্দ্রশেখরের তিরিশ সালের কাজের পর সম্ভবত হকিং প্রথম ফিজিসিস্ট যিনি জেনারেল রিলেটিভিটি ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স দুটোই একসঙ্গে ব্যবহার করে একটা থিওরেটিকাল প্রেডিকশন করেছিলেন।
কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ড শুনলেই আটশো-হাজার বছরের ইতিহাস ঘাড়ের ওপর বেতালের মতো চেপে বসে। এদের সবকিছুই এনশ্যেন্ট ব্যাপার। যেমন ধরুন দ্য বোট রেস। ১৮২৯ সালে শুরু হয়েছিল, তারপর ১৮৫৬ সাল থেকে প্রতি বছর হয়ে আসছে। নৌকোদৌড়। ১৮৫৬ সাল মানে বুঝতে পারছেন? সিপাই বিদ্রোহ হয়নি। প্রেসিডেন্সি কলেজ তখনও হিন্দু কলেজ। একদিকে আকাশি রঙের (কেমব্রিজ ব্লু) জার্সিতে কেম্ব্রিজের ছাত্রছাত্রী, অন্যদিকে নীল রঙের (অক্সফোর্ড ব্লু) জার্সিতে অক্সফোর্ডের ছাত্রছাত্রী। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান তো সেদিনকার ডার্বি।
তো এই নৌকো চালাতে পারা ব্যাপারটা অক্সব্রিজে খুব যাকে বলে সম্মানের ব্যাপার। এখান থেকে পড়েটড়ে ফিরলেন, কিন্তু নৌকো চালানো শিখলেন না, অনেকটা দুর্গাপুজোর থিমপ্যান্ডেলে গিয়ে সেলফি না তোলার মতো ব্যাপার। ১৯৫৯ সালে ১৭ বছর বয়সী স্টিফেন অক্সফোর্ডে বিএ পড়তে ঢুকে প্রথমে ওসব রোয়িংফোয়িঙের দিকে নজর না দিলেও, সেকেন্ড ইয়ার থেকে কোমর বেঁধে নৌকোচালনায় লেগে পড়ে। এমনকি একটা নৌকো টিমের কক্স বা পাইলটও হয় সে। থার্ড ইয়ার থেকে রোয়িং করতে গিয়ে স্টিফেন টের পায়, সামথিং ইজ রং। হাতে সে আর বল পাচ্ছে না। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে, কথা বলতে গিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। কী ব্যাপার? ডাক্তার দেখিয়েটেখিয়ে ডায়াগনসিস হল : মোটর নিউরন ডিজিজ, বা ALS। আয়ু দু’বছর।
তেষট্টি সালের সেই দু’বছর আয়ুকে টাইম ডাইলেশনে ফেলে হকিং টেনেবাড়িয়ে পঞ্চান্নটা বছর বেঁচে রইলেন। এই হাফসেঞ্চুরি অ্যান্ড ফাইভ ইয়ার্সে ব্ল্যাকহোলকে ফেয়ার-অ্যান্ড-লাভলি মাখালেন, বিগব্যাং যে পাতি ভাউয়া ব্যাঙ নয় সেটা বোঝালেন, আর এমন একটা গোলমেলে ছ্যারছিজিত টাইপের প্যারাডক্স রেখে গেলেন যে কসমোলজি ক্লাসের ফার্স্ট বয়রাও তাতে বিশেষ দাঁত ফোটাতে পারেননি অ্যাদ্দিনে।
এই ফেয়ার-অ্যান্ড-লাভলি ব্যাপারটাই সেই জেনারেল রিলেটিভিটি ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে একসঙ্গে কাজ করানোর ব্যাপার।
ব্ল্যাকহোল তৈরি হয় যখন সূর্যের চেয়ে তিনগুণ বেশি ভরের তারার জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। অত ভর আর নো জ্বালানি মানে সেই তারা কোল্যাপ্স করতে শুরু করে। ঘনত্ব বেড়ে গিয়ে আয়তন শোয়ারৎসচাইল্ড রেডিয়াস পেরোলেই হয়ে গেল, স্পেসটাইম এতটাই বেঁকে যাবে যে সেখান থেকে ইভেন্ট হোরাইজন পেরিয়ে বাইরের মহাবিশ্বে ঠিকঠাক স্পেসটাইমে বেরোতে গেলে এসকেপ ভেলোসিটি লাগবে সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি। তাই ইভেন্ট হোরাইজনের মধ্যে আলোও বন্দি।
কিন্তু এই ব্ল্যাকহোলের ভেতর থেকে কিছু না বেরোতে পারাটা থার্মোডায়ানামিক্সের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। কেননা বেকেন্সটাইন বলেছেন যে ব্ল্যাকহোলের এনট্রপি থাকতেই হবে, আর হকিং নিজেই বলেছেন এনট্রপি থাকলে তার তাপমাত্রা থাকবেই, আর তা থাকলে তার থেকে রেডিয়েশন হতে বাধ্য। কিন্তু ব্ল্যাকহোল থেকে কিছু বেরোনো ইজ ইম্পসিবেল।
সমাধান বাৎলে দিলেন হকিং নিজে। রাশিয়ান গবেষক জেল্ডভিচ ও স্টারোভিনস্কির সূত্র ধরে প্রমাণ করলেন যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্য নিয়ে ব্ল্যাকহোলের জেনারেল রিলেটিভিটির সত্তা জলাঞ্জলি না দিয়েই প্রমাণ করা যায় যে তার ইভেন্ট হোরাইজন থেকে একরকমের বিকিরণ বেরোবে বৈকি। এবং বেরোলে ব্ল্যাকহোলের তাপমাত্রাও কমবে। অতএব ব্ল্যাকহোলের থার্মোডায়ানামিক সত্তাকেও জলাঞ্জলি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কোনও গ্র্যাভিটিক ও থার্মোডায়ানামিক সত্তাধারীর যে একটা কোয়ান্টাম মেকানিকাল সত্তাও থাকতে পারে সেটা থ্যাঙ্কস টু হকিং।
না, নোবেলটা উনি তাও পাননি।
নোবেলেরই লস।
পোস্টস্ক্রিপ্ট
পিএস : উড়ন্ত হুইলচেয়ার আবিষ্কার হলে উনি নির্ঘাত তাতে চেপে কেমব্রিজ-অক্সফোর্ড ফ্লাইং হুইলচেয়ার রেস চালু করতেন।
পিপিএস : নোবেল পাননি কেননা LIGO-র মতো এক্সপেরিমেন্ট করে কেউ এখনও হকিং রেডিয়েশনের খোঁজ পায়নি। পেলে নোবেলটা পেয়ে যেতেন।
সবচেয়ে ইয়ে ব্যাপার হচ্ছে, লাইগোরই ডেটা ঘেঁটে একটা গ্রুপ বলছে তারা হকিং রেডিয়েশনের সন্ধান পেলেও পেয়ে থাকতে পারে।
টূ লেট। মরণোত্তর নোবেল মেলে না।
নোবেলেরই লস।
পিপিপিএস : প্রেগন্যান্ট ইসোবেল প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বোরড হয়ে গিয়ে অক্সফোর্ডে হাঁটা দিতেন। স্টিফেন জন্মাবার দিনতিনেক আগে একটা বইয়ের দোকান থেকে উনি অ্যাস্ট্রোনমির অ্যাটলাস কিনেছিলেন। সেই ছেলেই যে বড় হয়ে নিজেই অ্যাস্ট্রোর অ্যাটলাস এঁকে ফেলবে সেটা তো আর ইসোবেল জানতেন না।
সোর্স
- Stephen Hawking : His Life and Work, by Kitty Ferguson.
- Stephen Hawking at Wikipedia.
- Gravitation, by C. Misner, K. Thorne, and J. A. Wheeler
- The Classical Theory of Fields, by L. Landau and E. M. Lifshitz
- General Relativity, by R. M. Wald
- Gravitation and Inertia, by C. Ciufolini and J. A. Wheeler
- The Large Scale Structure of Space-Time, by S. W. Hawking and G. F. R. Ellis
অসম্ভব ভালো লাগল পড়তে। অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং মনোগ্রাহী একটা লেখা। শেষ শব্দটা অবধি টেনে ধরে রাখল লেখাটা।
এই লেখকের আরো লেখা পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
আপনার কমেন্টের ওপরেই দেখুন সুচেতনা একটা কালো বক্সে ‘সোমদেব ঘোষ’ বলে ট্যাগ করা আছে। ওটাতে ক্লিক করলেই পড়তে পারবেন লেখকের আরও লেখা। বেশি অপেক্ষা করতে হবে না…
Crisp writing, nice reading