সিরিয়ার মেয়েরা

প্রতিভা সরকার

 

খাবার দেব, লু বাতাস তৃষ্ণার্ত করলে পানিও পাবে যথেষ্ট, পোশাক, অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী, সব দেব। শুধু একরাত কাটাও আমার সঙ্গে। আমাকে এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কর্তব্যপালনের সঙ্গে একটু আনন্দও দাও।

কাল্পনিক বক্তব্য কি? হবেও বা। ঠিক এই কথাগুলোই বলা হয়েছিল ত্রাণশিবিরের বাইরে দাঁড়িয়ে কেইই বা শুনতে গেছে! তবে সমীক্ষা বলছে সিরিয়াতে এমনকি জাতিসংঘের ত্রাণ বিলি করছে যারা, তারা কেউ এই নিচ মনোবৃত্তিমুক্ত নয়। ত্রাণের বিনিময়ে চলছে লাগাতার নারীনির্যাতন। আন্তর্জাতিক চ্যারিটিগুলিও ব্যতিক্রম নয়।

সিরিয়াতে লাগাতার বোমাবর্ষণে ধ্বস্ত শহরেও মেয়েরা ত্রাণবণ্টন কেন্দ্রগুলোতে যেতে চায় না। বিনা ঝামেলায় ত্রাণ মিললেও সবাই ভাবে ওগুলো দেহদানের ফলে পাওয়া। সাধ করে কপালে কে আর কলঙ্কের টিকা পরতে চায়। তবে অনাহার অর্ধাহারের সঙ্গে যোঝাও যে বড় কঠিন।

দি ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড (UNFPA) কৃত লিঙ্গহিংসার ওপর এক সমীক্ষায় (Voices from Syria) মেয়েদের ওপর এই যৌনহেনস্থার কথা বার বার উঠে এসেছে। কত অদ্ভুত এবং অমানবিক তথ্য সেখানে! পরিষ্কার বলা হয়েছে যৌন পরিষেবার জন্য ত্রাণকর্তারা স্বল্পকালীন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেও রাজি। ত্রাণবন্টনের সময়ই নিয়ে নেওয়া হয় অসহায় মেয়েটির ফোন নম্বর। তারপর ডাক যায় খুব তাড়াতাড়ি।

এই বদমাইশিটা সবচেয়ে বেশি চলে সেই মেয়েদের সঙ্গে যারা “রক্ষকহীন” — বিধবা, ডিভোর্সি বা আভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতরা (Internally Displaced Persons)। তাদেরই ত্রাণ আটকে রাখা হয়। ত্রাণসামগ্রীর পরিবর্তে লাগাতার ধর্ষণ করা হয় এবং খ মিটে গেলে ত্রাণ পাবার নিশ্চয়তাও অন্তর্হিত হয়।

যুদ্ধের সবচেয়ে বড় কোল্যাটেরাল ড্যামেজ হচ্ছে নারী এবং শিশু।

#

প্রাচীন সভ্যতার ধাত্রী সিরিয়ার জ্বলন্ত নরক হওয়ার শুরু কিন্তু একনায়ক আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পরেই। সে বিক্ষোভ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত কিনা, ভৌগোলিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ সিরিয়াকে তাঁবে রেখে ইরানকে টাইট দেওয়ার জন্য আমেরিকা ও তার তাঁবেদার সৌদি আরবের লোলুপতা কতটা দায়ী, এসব প্রসঙ্গে ঢুকে প্রসঙ্গান্তরে যাব না। তবে রাশিয়া ও খানিকটা চীনও পাশে না দাঁড়ালে আজ সিরিয়ার অবস্থা হত ইরাক অথবা লিবিয়ার মতো।

মেয়েদের চূড়ান্ত দুর্দশা নিয়ে যখন আলোচনা, এ কথা বলাই উচিৎ যে তথাকথিত সমাজবাদী রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব আসাদকে একনায়কের অভিধা মুক্ত করতে পারে না। যুদ্ধের আগেও মেয়েদের পক্ষে অবমাননাকর অনেক আইন লাগু ছিল সিরিয়ায়। অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া চাকরিও করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু গৃহযুদ্ধ তাদের যে বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে তা এক কথায় অভূতপূর্ব। জেলে পাঠানো, বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া, পণবন্দি রাখা, এমনকি পরিবারের পুরুষ সদস্যকে সবক শেখাবার জন্য নির্দোষ নারীসদস্যটির জেল হেফাজত এখন সিরিয়ায় জলভাত।

এই ধরণের অত্যাচারের ধরণই হল যে তা নারীপুরুষ বাছাবাছি করে না, কিন্তু পুরুষের ওপর অত্যাচারেও আরও বেশি অত্যাচারিত হচ্ছে নারী। বাড়ির পুরুষ সদস্য হাওয়া হয়ে গেলে মেয়েদের রাস্তায় বেরোতেই হবে। খাবার জোটানো, বৃদ্ধ ও শিশুদের চিকিৎসা, হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে খুঁজে বার করবার মরিয়া চেষ্টায় গুঁড়িয়ে যাওয়া এক শহর থেকে আর এক শহরে দৌড়োদৌড়ি, এমনকি সেই প্রচেষ্টার আইনি খরচা জোটানো, সমস্তই তখন সেই সিরিয়ান মেয়ের কাঁধে, নিরাপদ সময়ে যাকে অভিভাবকহীন অবস্থায় বাড়ির বাইরে বেরোতে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল কম। বাড়িতে ঢুকে অত্যাচার, রাস্তায় নামলে হেনস্থা, ত্রাণের বদলে ধর্ষণ — সত্যযুগ হলে সিরিয়ান নারী পরিণত হত অহল্যায়।

ভাগ্যের পরিহাসের এর থেকেও ভালো নমুনা আছে কি!

বেঘর সিরিয়ান মেয়েরা শ্রমবাজারে বঞ্চনা ও নিপীড়ন ছাড়া আর কিছু পায়নি। আর অত্যাচারের জোড়া ফলার একধারে রয়েছে স্থানীয় সম্প্রদায়ে পিতৃতন্ত্রের রমরমা। ফলে আশ্চর্য কি শরণার্থী, বাস্তুচ্যুত মিলিয়ে যে সংখ্যাটা দাঁড়ায় তার অর্ধেকই নারী।

#

সিরিয়া বা অন্য দেশে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে বলে এদেশের বামপন্থী রাজনীতি অহরহ খিল্লির শিকার। এ দেশ, মানে দেশভাগের ক্ষত যার সর্বাঙ্গ জুড়ে, যার শরণার্থী সমস্যা কোনওদিন মিটবে না, বরং রাজনীতির দাবাখেলায় সীমান্ত অনুপ্রবেশ দিন দিন হয়ে উঠছে এক চালে মাত করবার মতো নির্বাচনী পোক্ত ঘুঁটি, সে দেশে সিরিয়ার প্রতি তেমন সহমর্মিতা দূরে থাক, কজন সঠিক পরিসংখ্যানের খবর রাখে! পাঁচ বছর আগেই রেজিস্টার্ড রিফিউজির সংখ্যা সেখানে ছাড়িয়ে গেছে ৪৫ কোটি ৬০ লক্ষ। আর এর দ্রুত ভয়াবহ বৃদ্ধি চিন্তারও অতীত। বাস্তুচ্যুতির সমস্যা আলাদা। আভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতের সংখ্যাই ৭০ কোটি ৬০ লক্ষ। এই দুই সংখ্যা মিলিয়ে যা দাঁড়ায় সেই জনবিস্ফোরণের অর্ধেক নারী। অস্ত্রাঘাত, নির্বিচার বোমাবর্ষণ, লাগাতার নিপীড়ন, অত্যাচার, ধর্ষণ পেরিয়ে, শিশু ও স্বজন হারিয়ে যে মেয়েরা জীবন্মৃত অবস্থায় বেঁচে আছে তারাই সিরিয়া যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে জ্যান্ত হাতিয়ার হিসেবে। উদ্দেশ্যপূরণের জীবন্ত হাতিয়ার।

বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে বহুগুণ। উগ্রবাদী আই এস এবং আল-নুসরার উপস্থিতি মেয়েদের অবরোধ এবং যৌনদাসত্ব ছাড়া আর কি দিতে পারে পৃথিবী তা জানে ভালোভাবেই। আগেও পুরুষ সহচর ছাড়া বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল, এখন রাস্তায় একা মেয়েদের ব্যাভিচারিণী আখ্যা পাওয়া এবং সে জন্য বিচারব্যবস্থার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। অথচ ২৫০,০০০ এর বেশি সিরিয়ান পুরুষ মারা গেছে এই যুদ্ধে। স্বাভাবিকভাবেই নারীর কাঁধে এসে পড়েছে সংসার প্রতিপালনের ভার। কিন্তু সে যদি স্বচ্ছন্দে চলাফেরাই না করতে পারে তাহলে তার পরিবারের ভবিষ্যৎ কী? রিয়াধে বিরোধী গোষ্ঠী শান্তি প্রক্রিয়া আলোচনা করতে বসল, দেখা গেল মোট ১০৮ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে নারীর সংখ্যা ১০। বাল্যবিবাহের বাড়বাড়ন্ত, বাধ্যতামূলক বিবাহ, অনার কিলিং, যৌন নির্যাতন, লিঙ্গ-অসাম্যের মতো চূড়ান্ত সমস্যার কথা বলতে পারে এইরকম প্রতিনিধি যথেষ্ট সংখ্যক পাঠাতে অপারগ সিরিয়ান নারীকুল। এই একবিংশ শতকেও।

#

সব মেঘে যেমন থাকে রুপোলি পাড়, সিরিয়ায় তেমনি রোজাভা। সিরিয়ান গৃহযুদ্ধে উত্তর সিরিয়ায় আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রায় কব্জা করে ফেলেছে প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি (PYD)। মূলত কুর্দ জনজাতি অধ্যুষিত এই এলাকায় মেয়েরা সত্যিই অর্ধেক আকাশ। এখানে নারী যোদ্ধাদের অবদান — উইমেনস প্রটেকশন ইউনিটসের ব্যানারে সিঞ্জর পর্বতে আটকে পড়া ইয়াজিদিদের মুক্তি। ইয়াজিদি মেয়েদের ওপর যে ভয়ানক শারীরিক এবং মানসিক সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হয়েছিল তার কাহিনী এখন এই নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে সবাই জানে।

রোজাভাতে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নিজস্ব সংবিধানের জোরে। সিরিয়ান আইন এখানে বলবৎ, যদি না তার সঙ্গে ঠোকাঠুকি হয় সংবিধানের। যেমন সিরিয়াতে শরিয়া আইন চালু থাকলেও, রোজাভাতে চালু হয়েছে সিভিল ল’, নিষিদ্ধ হয়েছে বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহ। সবচেয়ে বড় কথা লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে রোজাভা আপোষহীন। ভিন্ন ধর্মে স্বেচ্ছাবিবাহ এখানে বৈধ। প্রশাসনের প্রত্যেকটি বিভাগে নারীর সমানুপাতিক উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। পুলিশ ফোর্সের প্রায় ২৫ শতাংশ সংরক্ষিত মেয়েদের জন্য। নারীকে পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় সম্মান রক্ষার ঠুঁটো প্রতীক হবার দায় থেকে মুক্তি দিয়ে রোজাভা তাকে পূর্ণ মানুষের মর্যাদা দিয়েছে।

এই রোজাভা বিপ্লব আরব বসন্তের শেষ রেশটুকু ধরে রেখেছে। এবং সে কাজে সিরিয়ান মেয়েদের অবদান অনস্বীকার্য। ঐতিহাসিকভাবে অত্যাচারিত কুর্দদের পক্ষে উপজাতীয় আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হত না, যদি না মেয়েরা দলে দলে সেকাজ করতে এগিয়ে না আসত। আই এসের পিছু হটা ভালো লাগেনি সাম্রাজ্যবাদ-সমর্থক টার্কির। তাদের পাঠানো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে টক্কর নিতেও পিছপা হয়নি কুর্দ মেয়েরা। কুর্দ সামরিক বাহিনী পেশমার্গার সক্রিয় সদস্য তারা। এই কারণেই সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে একজন কুর্দ মহিলা সেনানীর মৃতদেহের সঙ্গে কদাচাররত ন্যাটোর সামরিক বাহিনীর বর্বরতা বিশ্বের শুভমানসকে ব্যথিত করেছে।

#

সিরিয়ান মেয়েরা যে অন্ধকারে ডুবে আছে তার আশু নিরসন নজরে আসে না। কারণ একনায়ক খলনায়ক কিনা সে প্রশ্নের ফয়সালা করতে মাঠে এখন অনেক খেলুড়ে। ট্রাম্পসাহেব নিজের দেশ থেকে একটি রপ্তানিযোগ্য গণঅভ্যুত্থান তৈরি করে সিরিয়ার মানুষকে তা গেলাতে চান। ন্যাটো তার ছায়াসঙ্গী। ইসলামিক মৌলবাদীরা ঘোলাজলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছিল। রাশিয়া, চীনের যৌথ চাপে তাদের রমরমা পড়তির দিকে। আর রয়েছে উজ্জ্বল উপস্থিতি নিয়ে কুর্দদের মতো গণতন্ত্রপ্রেমীরা, যারা সংখ্যায় লঘু, আদর্শে গুরুভার। আসাদের হাতে যারা এখনও মরেনি সেই বামপন্থী ও কমিউনিস্টদের অবশিষ্টাংশ এখন লড়ছে কুর্দদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে।

এত প্রতিপক্ষের হানাহানি সিরিয়াকে স্থিত হতে দেবে না অনেককাল এ কথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

তবে মেয়েদের দাবিয়ে রাখা অতি শক্ত কাজ সেটা জানা আছে বলেই না ধর্মতন্ত্র এবং পিতৃতন্ত্র এত নিগড়ে বাঁধার চেষ্টা করে। সিরিয়ার এই সব গিলে খাওয়া অন্ধকারের মধ্যেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, শ্রমের বাজারে মেয়েদের পরিবর্তিত ভূমিকার কথা না বললেই নয়। আগে পুরুষ অধ্যুষিত কর্মক্ষেত্র এখন অনেকটাই মেয়েদের দখলে। সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নির্মাণে গুরুত্ববহ ভূমিকায় খুব দ্রুত উঠে আসছে তারা। আগের পরম্পরাসম্মত ভূমিকা ঝেড়ে ফেলে নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে সিরিয়ান মেয়েরা। সচেতন হচ্ছে নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে।

কয়েকটি পরিসংখ্যান এই দাবির পক্ষে দাঁড়াবে। ২০০৯-এ মহিলা কর্ত্রী এইরকম পরিবারের সংখ্যা ছিল ৪.৪%। এক সমীক্ষা অনুযায়ী এ বছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২.৪%। সংগঠিত শ্রমক্ষেত্রে মেয়েরা এখন ১৫%, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেমন কৃষি। সিরিয়ার কিছু অঞ্চলে কৃষিশ্রমের ৯০% মেয়েদের দখলে। ফ্যাক্টরি, রেস্টুরেন্ট, হস্তশিল্প সর্বত্র এখন সিরিয়ান নারী চেনা মুখ। মিডিয়ার ৫৪% নারীকর্মী। স্বনির্ভরতা ও দায়িত্বপালনে কোনও আপোষ করবার জায়গায় এখন নেই সিরিয়ার মেয়েরা। যুদ্ধের আগুনে পুড়ে তৈরি হওয়া এই খাঁটি সোনার মানুষগুলো তাদের এই ভূমিকা বদলকে চিরস্থায়ী করতে চায়। সাম্রাজ্যবাদী ও মৌলবাদী শক্তিগুলি সে পথে আরও কত প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...