স্টেশন মাস্টার
পৃথিবীর কত ভাগ রক্ত আর লাশ?
উইকিপিডিয়া বলছে, সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় ষাটটা যুদ্ধ চলছে। কোথাও বেশি মানুষ মরছে, তো কোথাও তার থেকে কম।
তবে এই সময়ের খবরের কাগজে বা টিভির পর্দায় চোখ রাখলে সবথেকে বেশি চোখে পড়ছে যে দেশের থেঁতলে যাওয়া শিশুর শরীর, তার নাম সিরিয়া। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে সভ্যতার উন্মেষ হয়, সিরিয়া ছিল তার অন্যতম। লাল-সবুজ বর্ণাঢ্য পতাকার এই দেশ এখন একটা ধূসর ধ্বংসস্তূপের, লাশের পাহাড়ের নাম।
সিরিয়া এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবথেকে যুদ্ধদীর্ণ দেশ হলেও, এর প্রতিবেশীরাও খুব ভালো নেই। ধ্বংসের শুরু হয়েছিল ইরাক দিয়ে। সেই আগুন প্রথমে ধীরে পরে দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়েছে লিবিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া ইত্যাদি দেশে। ভৌগোলিকভাবে এরা সকলেই মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশ।
ইরাক প্রায় শেষ হয়ে যাবার মুখে, ডিসেম্বর ২০১০-এ মিশর অশান্ত হয়ে ওঠার পর থেকেই এই অঞ্চলের অবস্থার এই আমূল পরিবর্তন। পশ্চিমী দুনিয়া একে আখ্যা দিল গণতন্ত্রের লড়াই, আর নাম দিল আরব বসন্ত। বসন্তের এই বজ্রনির্ঘোষে জ্বলে উঠল মানবসভ্যতার শৈশবের উদ্যান।
আরব বসন্তের সাত বছর অতিক্রান্ত করে কী পেলাম, তার হিসাব করতে গিয়ে শঙ্খবাবুর যে পংক্তি আমাদের মনে এল, এবারের রিজার্ভড বগির লেখাগুচ্ছকে সেই নামেই ডাকতে চাইলাম — আজ বসন্তের শূন্য হাত।
আরব বসন্তের সাত বছর অতিক্রান্ত করে কী পেলাম, তার হিসাব করতে গিয়ে শঙ্খবাবুর যে পংক্তি আমাদের মনে এল, এবারের রিজার্ভড বগির লেখাগুচ্ছকে সেই নামেই ডাকতে চাইলাম — আজ বসন্তের শূন্য হাত।
যদিও এই বজ্রনির্ঘোষে আর তার আগুনের ঝলকানিতে আমাদের গায়ে এতটুকু আঁচ লাগছে না, তবু আমরা এই সংখ্যার মূল ভাবনা হিসাবে কেন বেছে নিলাম এই বিষয়কে? এ-প্রসঙ্গে দু-এক কথা না বললেই নয়।
এত মানুষের মৃত্যু আমাদের বিচলিত তো করছেই। খবর পাচ্ছি, কেবলমাত্র সিরিয়াতেই নাকি মারা গিয়েছেন প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি সাধারণ মানুষ। ঘরছাড়া হয়েছেন আরও অনেকে।
এ ছাড়াও দেখছি, সুলভ খবরের সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট নামক আশ্চর্যন্ত্রটি থেকে ভেসে আসা তথ্য বলছে, কিচ্ছু মিলছে না। উইকিলিকস বলছে এইসব দেশে অস্ত্র ও অর্থ পাঠিয়ে আমেরিকার বাধানো লড়াইয়ের কথা। আমেরিকার সরকারি তথ্যে বা ভাষণেও তার একরকম সমর্থন দেখা যাচ্ছে। সবথেকে বড় কথা, এক দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য অন্য একটা দেশ এসে সেই দেশের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে — কলিযুগে দাঁড়িয়ে এমন ত্যাগস্বীকারের কাণ্ডটাও কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে। আমাদের একটা উদ্দেশ্য, সুতরাং, প্রচলিত ন্যারেটিভকে অপ্রচলিত বা অল্পপ্রচলিত তথ্য দিয়ে যাচাই করে নেওয়া। এই চেষ্টায় আমরা সাহায্য পেয়েছি ইতিহাসবিদ বিজয় প্রসাদ, অধ্যাপক টিম অ্যান্ডারসন, আল জাজিরার সাংবাদিক অর্ণব নীল সেনগুপ্ত, প্রতিভা সরকার — মানে আমাদের প্রতিভাদি, প্রতীপ নাগ ও সুশোভন ধরের। এঁদের সকলের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। অগোচরে থেকে আমাদের সাহায্য করেছেন ইরানের সেয়েদ মোহাম্মাদ মারনদি ও সিরিয়ার মারিয়া সাদেহ। তাঁদেরও অকুন্ঠ ধন্যবাদ।
এর বাইরেও একটা উদ্দেশ্য আছে। আর এই উদ্দেশ্যের পিছনে যে কারণটা আছে, তা হয়তো আমাদের অনেকেরই একটা ব্যক্তিগত শঙ্কা। আমাদের সন্ততির ভবিষ্যতের ভাবনার থেকে যে শঙ্কার জন্ম হচ্ছে। আমাদেরই শরীরের ভিতরে যে লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গকে সভ্যতার নামে, অগ্রগতির নামে আমরা বাসা বাঁধতে দিয়েছি এতদিন ধরে, তাদের দংশনের বুঝি সময় হয়ে এল। এদের কাছে নিজেদের সম্পূর্ণ সমর্পণ করার আগে একবার অন্তত হিসেব করে নিই আমাদের সম্মিলিত পাপের। আমাদের কপালে জমে ওঠা স্বেদবিন্দু থেকেই জন্ম নিক এজেন্ট অরেঞ্জ কবিতাগুচ্ছ।
আমাদের এই বারো নম্বর সংখ্যায় সৃষ্টির পাতাগুলো রয়েছেই। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অন্যগদ্য, অণুগল্প আছে অন্যান্যবারের মতই। আছে ধারাবাহিক রচনাগুলি এবং বইপত্রের কথা জানার ও আলোচনা হওয়ার হুইলার্স স্টল। আমরা স্মরণ করেছি সদ্যপ্রয়াত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-কে। তাঁর সঙ্গে আমরা মনে রেখেছি প্রয়াত অধিকাররক্ষাকর্মী জাভেদ আবিদিকে, যিনি ভিন্নসক্ষমতার মানুষদের রুটিরুজির দাবীতে সোচ্চার থেকেছেন আজীবন। আমরা স্মরণ করেছি অকালপ্রয়াত সাহিত্যিক সোহরাব হোসেনকেও।
সম্প্রতি বিশ্ব নাট্য দিবস অতিক্রান্ত হল। সেই উপলক্ষে এবারের স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে রাখা হল উৎপল দত্ত ও মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের দুটি রচনা।
এই সংখ্যা, এবং সমস্ত সংখ্যা মিলিয়ে আমাদের কাজ আপনাদের ভালো না লাগলে আমাদের ফেসবুক পেজে অবশ্যই জানান। ভালো লাগলেও।
অলমিতি…