শমীক ঘোষ
হেঁটে যাচ্ছে হাজার হাজার পা। চেনা-অচেনা মুখ। সারি সারি শরীর।
তাদের আশেপাশে অপ্রস্তুত পথচারীরা। মিডিয়া। ছবি উঠছে। ভিডিও। সোজাসুজি সম্প্রচার হচ্ছে টিভিতে।
৮ এপ্রিল, ২০১৮। মিছিল হাঁটছে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র দিয়ে। ধর্মতলা থেকে রবীন্দ্রসদন অবধি। মিছিলের প্রথম সারিতে বুদ্ধিজীবীরা। আর শেষ সারিতে বামফ্রন্টের নেতারা। মাঝে মানুষ। ভীষণ সাধারণ, আটপৌরে মানুষ।
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মিছিল। আসলে প্রতিবাদ করছেন রামনবমীর অস্ত্র-মিছিল আর ক’দিন আগের দাঙ্গার। কোথায় দাঙ্গা? পশ্চিমবাংলায়। তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক ‘সংস্কৃতির পীঠস্থান’ পশ্চিমবাংলায়। আঞ্চলিক মিডিয়া এই মিছিল দেখিয়েছে। রামনবমীর অস্ত্র হাতে তাণ্ডবও দেখিয়েছে। দেখায়নি দাঙ্গার দৃশ্য। দাঙ্গা শব্দটাই উচ্চারণ করেনি তারা। বলেছে পলিটিক্যালি ঠিক অন্য একটা শব্দ — গোষ্ঠীসংঘর্ষ। কোন গোষ্ঠী? কারা তারা? কাদের মধ্যে সংঘর্ষ? কে মারল কাকে?
পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন দেওয়ার সময় যে সংঘর্ষের ছবি হরদম দেখাচ্ছে সেই একই মিডিয়া তা কি তবে কোনও গোষ্ঠীর নয়? একা একা বিচ্ছিন্নভাবে মানুষ মারছে অন্য মানুষকে?
মিডিয়ার অবশ্য যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আছে — কিছু দেখালে যদি হিতে বিপরীত হয়? কিন্তু এই যুগে মিডিয়া তো খবরের একমাত্র ধারক ও বাহক নয়। আমরা সবাই ততক্ষণে জেনে গিয়েছি দাঙ্গা হচ্ছে আসানসোল ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা। সেই খবর এসেছে অন্য এক মিডিয়ার মাধ্যমে। তার নাম সোশ্যাল মিডিয়া।
রাষ্ট্র অবশ্য তাকে আটকানোর চেষ্টা করেনি এমন নয়। বন্ধ করে দিয়েছে গোটা আসানসোল ও তার আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ইন্টারনেট পরিষেবা।
কিন্তু তারপরেও ভাইরাল হয়েছে খবর। ভিডিও। আমরা জেনে গিয়েছি ইমাম রশিদির নামটাও। মিডিয়া বলে দেওয়ার আগেই। ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক অবশ্য তার কথাক’টা লিখেছে প্রথম পাতায়। নাম, ধর্মীয় পরিচয় না দিয়ে। যত শান্তির বাণীই দিন ইমাম রশিদি। তাঁর নাম ছাপা হলেই মনে হবে মুসলিমরা আক্রান্ত। সর্বভারতীয় মিডিয়া অবশ্য নাম দিয়েই লিখেছে। আমরা ইন্টারনেটে পড়েও নিয়েছি সেই সব।
কিন্তু বাংলার মিডিয়া, বোকা পাঠার মতো নিজের মুখটা শুধু আড়াল করে ভেবে নিয়েছে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিংবা হয়ত নিজের দায় অগ্রাহ্য করতে চেয়েছে।
দাঙ্গা! এই শব্দটার সঙ্গে প্রথমবার পরিচিত হই ১৯৯২ সালে। সেদিন ছিল ডিসেম্বর মাসের ছয় তারিখ। সেইদিন আরও একটা শব্দবন্ধ প্রথমবার শুনেছিলাম। ‘টু শ্যুট অ্যাট ফার্স্ট সাইট’। দাঙ্গা দমন করতে কার্ফিউ ঘোষণা করেছিল জ্যোতিবাবুর সরকার। গোটা দেশে দাঙ্গা আছড়ে পড়লেও তাই তুলনামূলক শান্ত ছিল এই বাংলার মাটি।
১৯৯২ সালের সেই ছয় ডিসেম্বরে হাজার হাজার হিন্দু জনতা মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল অযোধ্যার এক প্রাচীন সৌধ। বাবরি মসজিদ। তাদের দাবি ওটা রামমন্দির। মোঘল সম্রাট বাবর নাকি সেই মন্দির ভেঙে ওই মসজিদ গড়েছেন। ওই মসজিদ নিয়ে বিবাদ ছিল বহু আগে থেকেই। সেই বিবাদের পরিসমাপ্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন তারা এক দিনেই। সংখ্যাগুরুর গায়ের জোরে। অবশ্য তারপরেও আসেনি সমাধান। আটকে গেছে সুপ্রিম কোর্টের মামলার হিমঘরে।
কিন্তু সেদিনের অ্যাজেন্ডা রামমন্দির ছিল না। অ্যাজেন্ডা ছিল ক্ষমতা দখল।
১৯৯১ সালে খুন হলেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী। তাঁর রাজনীতিও ছিল সংখ্যালঘু তোষণের। শাহবানুর মামলায় সুপ্রিম কোর্টকে সাংবিধানিক ভাবে টপকে আইন পাশ করিয়েছিলেন সংসদে। রাজীব মারা গেলে একের পর এক মিলিজুলি সরকার। বছর বদলালে প্রধানমন্ত্রীও বদলায়। এক দল নয়, বহু দলের জোট, যাঁদের আদর্শের মিলের চেয়ে অমিল বেশি। ফুঁসছিলেন বিজেপির নেতারা। তাঁদের মনে হচ্ছিল ক্ষমতা দখল অসম্ভব।
ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ১৪.২ শতাংশ। ১৬.৬ শতাংশ তফশিলি জাতি আর ৮.৬ শতাংশ তফশিলি উপজাতি। আর এর বাইরে ওবিসি কত তার স্পষ্ট কোনও পরিসংখ্যান নেই। তবে মোটামুটি মত হল ৪১ শতাংশ। এর বাইরে ব্রাহ্মণ্যবাদী উঁচুবর্গের হাতে রইল হ্যারিকেন। তাহলে ওই সংখ্যালঘু মুসলমানরাই ঠিক করে রাজা হবে কারা। কখনও দলিতদের সঙ্গে মিশে। কখনও ওবিসিদের সঙ্গে। মণ্ডলায়ন পরবর্তী সেই যুগে পিছড়ে বর্গরাও এককাট্টা। ব্রাহ্মণ্যবাদ মেনে নেবে না তারা। গোটা দেশের প্রধান অঞ্চলেই ভোট হয় জাতপাতের সমীকরণ মেনে।
তাহলে কীভাবে জিতবে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি? লালকৃষ্ণ আদবানি রথ বার করলেন। সেই রথের পিছু নিল দাঙ্গা। যদি গোটা দেশেই মুসলিম জনসংখ্যাকে বিপদ হিসাবে বোঝানো যায় তাহলেই একমাত্র এককাট্টা হতে পারে হিন্দু ভোট। তাই করা হল। আর এই আদবানির রথ আটকে দিলেন লালু প্রসাদ যাদব। মূর্খ গাওয়ার লালু। কারণ খুব সহজ। তিনি নিজে যে জেতেন মুসলিম-দলিত সমীকরণেই।
শুধু লালু কেন? মুলায়ম, মায়াবতী আরও অনেকেই এই একই মুসলমান-দলিত সমীকরণের ভরসায় জিতে এসেছেন। মুক্ত অর্থনীতির এই বাজারে এর সঙ্গে বিজেপি গায়ে লাগিয়ে নিল উন্নয়নের তকমা। তার সঙ্গে ভারতের দলিত নেতাদের দুর্নীতির বিরোধিতা।
কয়েক হাজার বছর ধরে ক্ষমতায় না থাকা পিছড়ে বর্গ সরকারের স্বাদ পেলে দুর্নীতি করবেই এই সহজ হিসাব বুঝতে রাজি নয় ভারতের আমজনতা। ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রামরাজ্যের স্লোগান মেনে নিতেও বিন্দুমাত্র অসুবিধা হল না তাদের।
এর সঙ্গে যুক্ত হল গোটা সন্ত্রাসবাদের হাওয়া। মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী এই বোধ গোটা বিশ্বেই জাঁকিয়ে বসতে লাগল। ভারতে তো বটেই। ফায়দা তুলল বিজেপি। প্রায় একদশক পরে। ক্ষমতায় এলেন অটল বিহারী বাজপেয়ির সরকার।
কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী বিজেপির ক্রমান্বয়ে মুসলমান ও দলিত বিরোধিতা ক্রমশ ফাটল ধরাল হিন্দুত্বের জবরদস্তি ঐক্যের। ক্ষমতার পালাবদল হল।
এইসময়েই অন্য এক মডেল নিয়ে এল গুজরাত। জাতপাতের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া গুজরাতি সমাজে চিরকাল প্রভাব পটেলদের। তারাই চিরকাল মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এসেছেন। নরেন্দ্র দামোদরভাই মোদি, ওবিসি। পটেল কেশুভাইকে সরিয়ে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসিয়েছে সঙ্ঘ। জাতপাত থেকে হিন্দুত্বের রাজনীতিতে উত্থানের সুযোগ করে দিল সেই দাঙ্গাই। গুজরাতের রাজনীতিতেও পাকাপাকি জায়গা করে দিল অ-পটেল মোদিকে। আর গুজরাতে মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ৯ শতাংশ। ফলে হিন্দু ভোটের অনেকটাই এক করতে পারলে ভোটের পাটিগণিতে তাদের তেমন কোনও প্রভাব থাকে না।
আর নিজের ক্ষমতা দখলের পরই সেই হিন্দুত্ববাদী শক্তিকেই কোণঠাসা করে দিলেন মোদি। তাঁর অ্যাজেন্ডা এখন উন্নয়ন। মুক্ত অর্থনীতির ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক কথিত ঝাঁ-চকচকে, চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন। তাই সাইডলাইনড হলেন প্রবীণ তোগাড়িয়ার মতো দাঙ্গার মুখ।
ভারতের সব থেকে দক্ষিণপন্থী রাজ্য গুজরাতের মানুষ সেই চোখ ধাঁধানো উন্নয়নই চান। চান দক্ষিণপন্থার মূল ধারক বড় ব্যবসাদাররাও। দাঙ্গার খারাপ ইমেজ মুছে মোদি হয়ে গেলেন বিকাশপুরুষ।
কিন্তু গোটা দেশের জাতপাতের রাজনীতিকে হারিয়ে হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রতিষ্ঠা হবে কীভাবে? রইল সেই গুজরাত মডেলই। দাঙ্গা আর মুসলমান বিরোধিতার হাওয়াই একত্রিত করতে পারে এই দেশের হিন্দুদের।
মুজফরনগরেও দাঙ্গা শুরু হল। উত্তরপ্রদেশে কিন্তু জনসংখ্যার প্রায় ১৯ শতাংশই মুসলমান। আর দলিত-মুসলিম সমীকরণের লাভ তোলা প্রধান দুই দল আসলে একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। মুলায়মের ভোটের অঙ্ক যাদব-মুসলমান আর মায়াবতীর ভোটের অঙ্ক দলিত-মুসলমান। বিজেপি কোনওদিনই মুসলমান ভোট পাবে না। প্রতিযোগিতা মুলায়ম-মায়াবতীতে। তাই বিজেপির উত্থান হলে কোণঠাসা মুসলমানরা যিনি সরকারে আছেন তাকেই ভোট দেবেন। বিরোধীরা মুলায়মের নাম তো দিয়েই দিয়েছেন মোল্লা মুলায়ম।
কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী বিজেপির মুখ এখন ওবিসি মোদি। ‘গুজরাত মডেল’জাত নয়া উদারবাদী অর্থনীতির ভাবমূর্তির জন্য তাঁকে প্রছন্ন মদত দিচ্ছে ভারতের তাবড় কর্পোরেট। বহু কোটি টাকার আচ্ছে দিনের বিজ্ঞাপন জনমানসে তার আশ্চর্য গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছে। এর সঙ্গে যোগ হল ডিমনিটাইজেশনের বড়লোক বিরোধী ইমেজ। হিন্দু ভোট একত্রিত করতে সব কটা তাস খেলে ফেলল বিজেপি। হেরে গেলেন মুলায়ম। মায়াবতী নিশ্চিহ্ন।
এই মডেলেরই অন্য একটা রূপ দেখা গেল অসমে। যেখানে শুধু মুসলমান নয়, অসমিয়া জাতীয়তাবাদে ভর করতে বিজেপি ব্যবহার করল সংখ্যালঘু বাঙালিদের প্রতি বিদ্বেষকেও।
কিন্তু রণনীতি বলে শুধু ঘাঁটি অঞ্চল নয়, দীর্ঘমেয়াদি হতে গেলে নতুন অঞ্চলও জুড়ে নিতে হয় রাজত্বে। আজকের ঘাঁটি কাল দুর্বল হয়ে গেলে যাতে সহজেই তাকে সরিয়ে নেওয়া যায় নতুন কোনও জায়গায়।
পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় আসন ৪২টা। উত্তরপ্রদেশের ৮০টা আর মহারাষ্ট্রের ৪৮টার পরেই। এই ৪২টা আসনই বিজেপির আনচার্টেড টেরিটরি। অর্থাৎ এইখানে শুধু বাড়তে পারে বিজেপি। কমতে নয়।
পশ্চিমবঙ্গে ২৭.১ শতাংশ মুসলমান। গোটা ভারতের মুসলিমদের পরিসংখ্যানের থেকে বেশি। তফশিলি জাতি ২৩ শতাংশ। প্রথাগতভাবে বড়লোকের দল কংগ্রেসকে হারাতে মার্ক্সবাদী বামেরা অন্য এক নীতি নিয়েছিল। পিছড়ে বর্গকে আলাদা করে না ধরে মধ্যবিত্ত ও গরিবদের ধরা। তাদের রাজনীতিতে দলিত রাজনীতির তেমন কোনও ভূমিকাও ছিল না। ক্ষমতার মসনদে থাকতে তারা মধ্যবিত্তের স্বার্থরক্ষা করে গিয়েছে। আর গরিবদের দিয়েছে স্বর। ভূমিসংস্কার গ্রাম্য জনজীবনে তাদের অন্য জায়গা করে দিয়েছে।
বিজেপির উত্থানের পর থেকেই তারা হয়েই গিয়েছিলেন মুসলমানদের মসিহা। কিন্তু দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের ক্ষমতা তাদের দুর্বিনীত করে তুলেছিল। রিজওয়ানুর রহমানের ঘটনার পর মুসলমানদের মনেও তাদের নিয়ে সন্দেহ। সাচার কমিটির রিপোর্টও বলছিল মুসলমানদের জন্য রামপন্থীদের বিরোধিতা ছাড়া তেমন কিছু করেনি তাঁরা।
হঠাৎ শিল্পায়ন করার দুর্দান্ত বাসনা তাদের গ্রামীণ চাষিদের থেকে দূরে সরিয়ে দিল। আর মধ্যবিত্ত এমনিতেই সর্ববিরাজমান দুর্বিনীত পার্টিতন্ত্র নিয়ে বিরক্ত। ক্ষমতা বদল হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গেও।
দুর্বল বামেদের পশ্চিমবঙ্গে শুরু হল নতুন এক প্রক্রিয়া। উত্তর ভারতের মতো এইখানেও এল দলিত মুসলমানের নতুন সমীকরণ। ২০১৬-এর নির্বাচনে বর্তমান শাসকদলের ভোটের শতাংশ ৪৪.৯। ২০১১ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে এটা ছিল যথাক্রমে ৩৯ এবং ৩৯.০৩ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ২৭.১ শতাংশ ভোটের একটা বড় অংশ পকেট পুরলেই এটা হয়। এই রাজ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম তফশিলি জাতি নমশুদ্রদের খুশি রাখতে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতি বর্তমান শাসকের মনোভাবই বুঝিয়ে দেয় নতুন সমীকরণ।
কিন্তু ৪২টা লোকসভা আসনের এই পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা বাড়ানোও ভীষণ দরকার বিজেপির। এত বৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যার রাজ্যে সারদা-নারদার দুর্নীতির ইস্যু তেমনভাবে প্রভাব ফেলতে পারবে না। তাছাড়া বুদ্ধিমান মমতা বন্দোপাধ্যায় বুঝে গিয়েছেন ডোল দেওয়ার সারসত্য। বিশ্বব্যাংকের টাকায় গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গেও উন্নতি হয়েছে যথেষ্ট। অতএব তাঁর ক্ষমতা দখল আটকায় কে?
মুসলিম ভোটে দাঁত ফোটানো যাবে না কোনওদিন সে কথা জানে বিজেপি। কিন্তু এত বড় মুসলমান জনসংখ্যার রাজ্যে মুসলিম বিদ্বেষের রাজনীতি হিন্দু ভোটকে একত্রিত করতে পারলেও পারে। ‘ম্লেচ্ছ’, ভেজাল আর্য বাঙালিদের রাজ্যে তারা তাই নিয়ে আসছে রামের রাজনীতি।
মুসলিম ভোট বিজেপি না পেলেও পেতে পারে বামরা। কিন্তু বিজেপির উত্থান হলে সে ভোট এককাট্টা হবে বিজেপির বিরুদ্ধে যার জেতার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি তার ভোটবাক্সে। ফলে বিজেপির উত্থান হলে আসলে লাভ শাসক দলেরই।
রামরাজ্যের দাঙ্গা-মডেল তাই ঢুকে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিও এখন দলিত-মুসলমান সমীকরণের। তাই রাজ্যের নানা জায়গায় দাঙ্গা পরিস্থিতি দেখছি আমরা। আরও দেখব ভবিষ্যতে।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ইতিহাস এই রাজ্যে তো ছিলই। ’৪৭ পরে সেই দ্বন্দ্ব ছিল হিন্দু-মুসলমানের বদলে রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের মধ্যে। কিন্তু তার প্রতি চিরকালই নিস্পৃহই থেকেছে বাংলার ‘বিদ্বৎসমাজ’। আজকের পঞ্চায়েত ভোটের প্রবল গণ্ডগোলের বাজারেও কিন্তু তেমন কোনও প্রতিবাদ করেননি তাঁরা। হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব তো সেই ভোট রাজনীতির সংঘর্ষেরই অন্য এক মডেল।
দীর্ঘ বামশাসনে ড্রয়িং রুম থেকে শোবার ঘরে লুকিয়ে থাকা উচ্চবর্ণের মুসলিম বিদ্বেষও আজ বেরিয়ে পড়েছে বাইরে। জমে উঠেছে মুসলিম বিদ্বেষের নতুন এক ডিসকোর্স।
পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমান গোষ্ঠী সংঘর্ষ তাই ক্রমশ আরও বাড়বে।
আর হয়ত এইখান থেকেই উদ্ভব হবে এক বাঙালি জিগনেশ মেওয়ানির। শ্রী চৈতন্যের মতো ব্রাহ্মণ না, তিনি হয়ত হবেন দলিতই।
মিছিল-নগরী বুদ্ধিজীবিদের নয়, মিছিল দেখবে দলিত আর মুসলমানের। শুরু হবে পিছড়ে বর্গের ক্ষমতায়নের নতুন এক ইতিহাস। হয়ত সেইদিন পশ্চিমবঙ্গ তার প্রথম পিছড়ে বর্গের মুখ্যমন্ত্রীও পাবে।
মুশকিল হচ্ছে এ শহরে পার্কসার্কাস রাজাবাজার ও স্তব্ধ হয়ে গেছে । প্রথম টা বিদেশে কোরআন অবমাননার অভিযোগ, দ্বিতীয়টা বিনা টিকিটের মাদ্রাসা ছাত্র দের গ্রেপ্তারের অভিযোগে। অস্ত্র বেরিয়েছে যথেষ্ট, দোকান পাট ভাঙচুর হয়েছে, আমরা তখন ধৃতরাষ্ট্র মোড এ ছিলাম। আবার আসিফা বানো কে মনে রাখিনি কিন্তু প্রয়োজন মত ইমাম রশীদ কে দেবতার আসন দিচ্ছি ( সংগত কারনেই যদিও) । বিভিন্ন উৎসবের আগে টাইমিং অনুযায়ী মা দুর্গা কে বেশ্যা, বিবেকানন্দ র সাথে নিবেদিতা র থ্রি সাম এসব নিয়ে ‘শিক্ষিত’ বাঙ্গালীদের মন্তব্যের কোনো প্রতিবাদ করিনি বরং ইন্ধন দিয়েছি। সাধারণ মানুষ হঠাৎ আজ বিজেপি অভিমুখী হলো কেন সে প্রশ্ন করতে গেলেই চাড্ডী ট্যাগ মারা ছাড়া বামপন্থী রা ঠিক কি করেছেন এবং করবেন সে ব্যাপারে নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায় , যখন দেখি উমর খালিদ বা জীগনেশ দের মতো বিভেদকামী (দেশ দ্রোহী বলাটা তো কমপ্লিমেন্ট হয়ে যাবে আবার)মানুষ ছাড়া তারা আজ আর কোনো রোলমডেল পাচ্ছেন না। এই কায়গা থেকেই তপন বা দিলীপ রা জমি টা পান। ভেবে দেখার অনুরোধ রইল
আচ্ছা, পল্লবগ্রাহীবাবু, এই পার্ক সার্কাস ইত্যাদি যা বললেন এবং সে নিয়ে বুদ্ধিজীবী বামপন্থী বা সরকারের যা যা সব ভূমিকা, এগুলো ঠিক কবে থেকে হল?
সুচিন্তিত, সময়োপযোগী একটি লেখা।