হারুণ রশিদ
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের প্রথম ইংরেজি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন চট্টগ্রামের রজনী রঞ্জন সেন।
তথ্যটি অন্তত আমাকে চমকে দিতে পেরেছিল। কেননা চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে আমার সামান্য কিছু পড়াশোনা আছে দাবি করলেও রজনী রঞ্জন সেনের নামটিও আমি কখনও শুনিনি। অথচ শতবর্ষ আগে তিনিই প্রথম রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন চট্টগ্রাম থেকে। ১৯০৭ সালের জুন মাসে দুদিনের জন্য চট্টগ্রাম সফরে এলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাড়িতেই একমাত্র সাহিত্য সভাটি করেছিলেন।
বর্তমানে চট্টগ্রামের কোথাও তাঁর নাম নিশানা না থাকলেও নোবেল কমিটির কাছে তাঁর সেই অনুদিত ছোটগল্পের ইংরেজি পুস্তকটি এখনও সংরক্ষিত আছে এবং অনুবাদক হিসেবে তাঁর নামটিও রবীন্দ্রনাথের কীর্তির পাশাপাশি শোভা পাচ্ছে নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে।
এসব তথ্য হয়তো কেউ কেউ জানে, আমার কাছে অজানা বলে আমি খুব কৃতজ্ঞ বোধ করেছি তাঁর কাছে যিনি ব্যাপারটা মাটি খুঁড়ে বের করেছেন। রজনী রঞ্জন সেনকে আমাদের সামনে নতুন করে উপস্থাপন করেছেন নিভৃতচারী লেখক ও গবেষক মাসুদ করিম। তিনি কিভাবে রজনী রঞ্জন সেনের খোঁজ পেলেন সেই বিবরণটি লিখেছেন এই ব্লগে :
http://nirmanblog.com/masudkarim/10910
সেই লেখায় তিনি যেটা দিয়ে উপসংহার টেনেছেন তা হল :
আমার অনুসন্ধানের কাজ শেষ, এখন আমি দুটো জিনিস চাই, কেউ আমাকে Nobel bibliotek থেকে রজনী রঞ্জন সেনের বইটি জোগাড় করে দিক, পড়ি, আর কেউ এই কৃতী মানুষটির ভিটেমাটি জন্ম মৃত্যু কীর্তির খোঁজখবর নিয়ে জানাক আমাদের।
গবেষক মাসুদ করিমের এই ইচ্ছেটা পুরণ হবে বলে আশা রাখি। তাছাড়া রজনী রঞ্জন সেনের মতো একজন কৃতী মানুষের নাম ইতিহাস থেকে মুছে যাওয়া উচিত নয়।
যদিও রজনী রঞ্জন সেনের ভিটেমাটি কিংবা তাঁর জীবনকর্ম সম্পর্কে এখনও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি, তবু তাঁকে নিয়ে সৃষ্ট হওয়া কিছু আলোচিত বিষয়ের সন্ধান আমরা পেয়ে যাই Satish Barbuddhe সম্পাদিত ২০০৭-এ দিল্লি থেকে প্রকাশিত Indian Literature in English : Critical Views পুস্তকে।
এই পুস্তকে Dr. S L Paul-এর Rabindranath Tagore’s Prose and Drama : An Evaluation of His Literary Contribution to South-Asian Studies নামক সুলিখিত প্রবন্ধে রজনী রঞ্জন সেন সম্পর্কে কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়।
তাতে দেখা যাচ্ছে ১৯০৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গল্পের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের ব্যাপারে রজনী সেনকে অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই অনুবাদটি চট্টগ্রামের মিন্টো প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল কবির নোবেল প্রাপ্তির কয়েক মাস আগে ১৯১৩ সালের শুরুতে। গীতাঞ্জলির পর এটিই ছিল রবীন্দ্র সাহিত্যকর্মের দ্বিতীয় ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ। এই কপিটি সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিল, এবং সুনামের পাশাপাশি সমালোচনারও বিষয় হয়ে উঠেছিল একসময়।
বইটির প্রকাশ সম্পর্কে Indian Literature in English : Critical Views গ্রন্থে যা বলা হয়েছে :
Tagors first collection of short stories in English translation appeared in 1913, a few months before the announcement of the Nobel Prize. Not much is known about translator Rajani Ranjan Sen, a pleader and a lecturer in law in Chittagong College. But he certainly was not either close to Tagore or a known literary figure in Bengal. Although translations of short stories of Tagore had began to appear from 1902 onwards, Sen was the first to think of putting them together in a book. He asked for Tagore’s permission around 1909 and the book came four years later. Despite its limitations, the book played positive role in the projection of Tagore before the western readership. It may be mentioned here that this book was acquired by the Swedish Academy.
[Indian Literature in English : Critical Views, Satish Barbuddhe, page 61-62]
মজার ব্যাপার হল রবীন্দ্রনাথ রজনী রঞ্জন সেনকে বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশের আগে অনুমতি দিলেও নোবেল প্রাপ্তির দুবছর পর পুনর্মুদ্রণের সময় আপত্তি করেছিলেন। কবির নোবেল প্রাপ্তির বছর দুয়েক পর ১৯১৫ সালে বইটির চাহিদা বৃদ্ধি সাপেক্ষে রজনী রঞ্জন সেন দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। তখন রবীন্দ্রনাথ সেটি প্রকাশে বাধা দিতে চেয়েছিলেন বলে জানা যায়।
তাঁর এই মত পরিবর্তনের পেছনে কাজ করেছিল তাঁর অনুরাগী সাহিত্যিকদের কিছু বিরূপ মন্তব্য। যার মধ্যে একজন ছিলেন বিখ্যাত শিল্পবোদ্ধা সমালোচক Rothenstein, যিনি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অন্যতর অনুবাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় রমানন্দ চ্যাটার্জি সম্পাদিত মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত পোস্টমাস্টার গল্পের অনুবাদ। কিন্তু রজনী রঞ্জন সেনের অনুবাদটি সম্পর্কে বলেছিলেন : “…translation of your stories those recently published are too monstrously ill done for words.”
এই কারণে রজনী রঞ্জন সেন যখন দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করার উদ্যোগ নেন, তখন কবি সেটাকে আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোনও কারণে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। তবে এই চেষ্টার পেছনে আরও একটি কারণ ছিল আমেরিকান খ্যাতনামা প্রকাশক ম্যাকমিলান।
নোবেল প্রাপ্তির বছর দুয়েক পর ম্যাকমিলানও রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অনুবাদ প্রকাশের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল এবং সঙ্গত কারণে কবিও চেয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত কোনও প্রকাশনী থেকে মানসম্পন্ন অনুবাদ প্রকাশিত হোক। তাই কবি তখন মরিয়া হয়ে নতুন কোনও অনুবাদকের সন্ধান করেছিলেন এবং সম্ভবত ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর পছন্দের অনুবাদক। কিন্তু সময় কম ছিল বলে সেটি সম্ভব হয়নি।
শেষমেষ রজনী রঞ্জন সেনের অনুবাদটিই নোবেল লাইব্রেরিতে স্থায়ী আসন গেড়ে থাকল। সেই অনুবাদ গ্রন্থের প্রিন্টার্স পাতাটি সম্প্রতি নোবেল লাইব্রেরি থেকে পাঠানো হয়েছে মাসুদ ভাইয়ের কাছে।
তবে মাসুদ করিম তাঁর অনুসন্ধান আপাতত সমাপ্ত ঘোষণা করলেও তিনি অপেক্ষা করছেন রজনী রঞ্জন সেনের সেই অনুবাদ গ্রন্থটির একটি সম্পূর্ণ পাঠের। যা নোবেল কমিটির কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়তো সম্ভব হবে না। তাই তিনি ভারতের কোনও লাইব্রেরিতে সন্ধান করতে চান, যদি সেই দুর্লভ সংগ্রহ কোথাও থেকে থাকে। নিদেনপক্ষে কারও কাছে যদি একটি স্ক্যান কপিও মেলে তাতেও তিনি বাধিত হবেন।
আমার বিশ্বাস বাংলাদেশে না হলেও ভারতের কোনও লাইব্রেরিতে এই গ্রন্থের সন্ধান মিলতে পারে। কিংবা কারও পুরোনো বুকশেলফে অনাদরে পড়ে আছে ধুলিমাখা শতবর্ষ প্রাচীন একটি গ্রন্থ। যেখানে মলিন হলদেটে পাতায় শিরোনামগুলো সাজানো থাকবে এভাবে :
Glimpses of Bengal Life, (Short Stories from the Bengali of Rabindranath Tagore) Author : Rabindranath Tagore Translated by : Rajani Ranjan Sen Published by : Minto Press, 1913 Distributed by : Natesan & Co, Madras Length : 240 pages