ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
আসলে আসিফার মৃত্যুতে আমাদের কিছুই যায় আসে না। ও আসলে আসিফা, না আশিফা, আমি তাও তো জানি না সঠিক। আসলে, আমাদের পরিশীলিত সংস্কৃতিতে একটা আট বছরের বাচ্চার সাদা কাপড়ে জড়ানো থ্যাঁতলানো মাথা — বিশেষ করে তার জীবদ্দশায় নেওয়া সুন্দর ফুটফুটে ছবিটার পাশে — বড়জোর একটু বেমানান ঠেকে। তার থেকে মনে একটু অস্বস্তি, আর কিছু বেশি নয়, তাই না? আসিফা চলে গেছে জানুয়ারি মাসে। এই সদ্য চার্জশিট ফাইল হবার হইচইতে তার মুখটা বারংবার ভেসে আসছে আমাদের নিউজফিডে। ওই সময়ও খবর বেরিয়েছিল। আমরা হয় দেখিনি, নয় তেমন গুরুত্ব দিইনি। এখন নতুন করে ওর বড় বড় উজ্জ্বল চোখদুটো দেখে আমাদের অন্তরাত্মা হয়তো একটু কষ্ট পাচ্ছে। তবে সামনে পয়লা বৈশাখের আনন্দ, তারপর আইপিএল জমে উঠলে ঠিক হয়ে যাবে সব।
গুরুত্ব দেবার কথাও নয় বোধহয়। চারধারে যেভাবে মহিলাদের — যাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ ছোট ছোট মেয়েরা — ওপর চড়াও হচ্ছে পুরুষকারের প্রতিমূর্তিরা, ধর্ষণ করে নৃশংসভাবে দু’ভাগ করে ফেলছে শরীর, গায়ে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, বা যোনির মধ্যে এমনভাবে ঢুকিয়ে দিচ্ছে রড যাতে শরীরের ভিতরের যা কিছু তাও বাইরে বেরিয়ে আসে, তাতে আসিফার ঘটনাটা আরও একটা ঘটনা ধরে নেওয়াই স্বাভাবিক। এসবই তো স্বাভাবিক আজকাল, তাই না? উন্নাওয়ের মেয়েটা অবশ্য মরতে চেয়েও প্রাণে বেঁচেছে। বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গর আর তার সঙ্গীরা শেষরক্ষা করে উঠতে পারেনি।
আসিফার কথায় ফেরা যাক। আসিফা কেমন করে মরল তা নিয়ে পুলিশের চার্জশিটে স্পষ্ট লেখা আছে। এই দুঃসময়ে কার্যনির্বাহী পুলিশকর্তা তাঁর দল নিয়ে যে সাহস এবং সততার সঙ্গে কাজ করেছেন তার জন্য তাঁকে আমরা সম্মান জানাব। আসিফাকে ওই খুনি আর ধর্ষকেরা কেমন করে মারল তা বিস্তারে বলতে ইচ্ছা করে না। সে-বিবরণ ভয়ঙ্কর। তবে কেন মরতে হল আট বছরের বাচ্চাটাকে, তা নিয়েও স্পষ্ট লেখা আছে ওই চার্জশিটে।
তার আগে বলে নেওয়া দরকার, আমাদের মতন রুচিশীল ও মননশীল মানুষ যারা, তাঁদের অনেকেই মনে করেছেন এবং করছেন, যে আসিফার মৃত্যু নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। কিন্তু এ-ঘটনাও আসলে দেশের নানান প্রান্তে ঘটে-চলা ঘটনাগুলোর মধ্যেই একটা ঘটনা, এবং সে মুসলমানের মেয়ে বলেই তাকে নিয়ে এত হইচই এবং রাজনীতি হচ্ছে। এই দলের একজন মানুষের নাম আপনাদের বলব। তিনি এই রচনাটির লেখক।
মহম্মদ ইয়ুসুফ পুজওয়ালা, মানে আসিফার বাবা, একজন যাযাবরগোত্রীয় মানুষ সে-কথা আপনারা এতদিনে জেনে গেছেন। তাঁর সম্প্রদায়ের নাম বকরওয়াল। হয়তো বকরিওয়ালা শব্দের থেকেই এই নামের উদ্ভব। এই বকরওয়ালদের মধ্যে একজন পদ্মশ্রী খেতাবভূষিত মানুষ ছিলেন, যার নাম মহম্মদ দিন জাগির। ১৯৬৫ সালের অপারেশন জিব্রল্টারের মাধ্যমে কাশ্মীরকে ছিনিয়ে নিতে পাকিস্তানি সেনারা সীমান্ত পার করে এ-দেশে ঢুকে পড়লে তা মহম্মদের নজরে আসে, এবং তিনি সেই ঘটনার কথা ভারতীয় সেনার কানে তোলেন। বাকি কথা ইতিহাসে লেখা আছে। মহম্মদ পদ্মশ্রী পেলেও সে-খেতাব তাঁর সম্প্রদায়ের কোনও কাজে লাগেনি। ‘কাশ্মীরি হমেঁ ট্রাইবল সমঝতে হ্যাঁয়, অওর জম্মু হমেঁ মুসলিম’, এই আক্ষেপ তাঁদের।
বকরওয়ালদের বলা যেতে পারে কাশ্মীরের ‘দলিত’ শ্রেণির মানুষ। শীতে এই বকরওয়ালেরা নেমে আসে জম্মুতে, আর শীত কাটলে চলে যায় উঁচুর দিকে।
কিন্তু এই বকরওয়ালদের নিয়ে জম্মুর মানুষের মনে একটা অসন্তোষ দানা বাঁধছে, কতদিন ধরে, তা জানি না অবশ্য। এঁদের ধারণা, এই বকরওয়ালেরা এসে জম্মুর ‘ডেমোগ্রাফি’ বদলে দিচ্ছে। সোজা বাংলায় বলতে গেলে, মুসলমানের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে হিন্দুদের জম্মুতে! কাশ্মীর তো একেই মুসলমানের, তার উপর জম্মুও তাঁদের হয়ে গেলে হিন্দুরাষ্ট্রের গায়ে ফোসকা পড়ে যাবে না?
এই ভয় অমূলক হলেও ভাবনাটা ভয়াবহ রকমের সত্যি। পুলিশের চার্জশিট বলছে — ষাট বছরের সনজি রামের আসল মতলবটাই ছিল কিছু একটা ঘটিয়ে বকরওয়ালদের ভয় দেখানো, যাতে তারা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। সে-ই ঠিক করে আসিফাকে মারবে। এই মতলবে সে সঙ্গী হিসেবে পায় স্পেশাল পুলিশ অফিসার দীপক খাজুরিয়াকে। আসিফাকে ধরার পর রামের ভাগনে, তার জিগরি দোস্ত মন্নু, রামের ছেলে এবং দীপক খাজুরিয়া — এরা সকলে বিভিন্ন সময়ে ধর্ষণ করে আসিফাকে, কয়েকদিন ধরে। এমন আঁট যোনি কি আর সহজে পাওয়া যায়?এর মধ্যে রামের ছেলে রামের ভাগনের কথায় মেরঠ থেকে চলে আসে মজা লোটার আশায়। রয়েসয়ে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে এই ক’দিন খাবার বলতে সে পেয়েছে শুধু কড়া কড়া ঘুমের ওষুধ। সকলের লালসা চরিতার্থ হলে প্রথমে গলা টিপে মারার চেষ্টা করা হয়েছে। তাতে কাজ না হওয়ায় আসিফার ওড়না গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে তাকে মারা হয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে শেষকালে মাথায় দু’বার পাথরের আঘাত করে কাজ সাঙ্গ করা হয়েছে। আসিফার সুন্দর মুখটা হয়ে গেছে রক্ত-মাংসের দলা। আসিফার মৃত শরীরপিণ্ড নিয়ে আসিফার পরিবার তাঁদেরই কেনা জমিতে কবর দিতে এসেও হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডাদের দ্বারা বিতাড়িত হয়েছেন। বাধ্য হয়েছেন পাশের গ্রামে চলে যেতে, শিশু আসিফার ছিন্নভিন্ন দেহ নিয়ে।
She that was too young to be a bride was old enough to be a martyr, and that too in an age when men were faltering in faith, and even hoary heads grew wearied and denied our God.
অ্যাগ্নেস ছিল রোমের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। নিজের কুমারীত্ব সে অর্পণ করেছিল যিশুতে। সেই অপরাধে রোমের প্রিফেক্ট সাম্প্রোনিয়াসের রক্ষীরা তাকে নগ্ন করে হিড়হিড় করে রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল পতিতালয়ে, প্রথম লক্ষ্য তার কুমারীত্ব নষ্ট করা। তারপর বহু অত্যাচার, এবং অবশেষে হত্যা। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল বারো, বা তেরো। উপরের কথাগুলো হিম টু সেন্ট অ্যাগ্নেস থেকে ধার করলাম।
নিজের মানবধর্মে আস্থা না-রাখা মানুষেরা, যাদের কেউ কেউ আমাদের দেশের নেতা, তারা চেষ্টা করেছিল আসিফা-হত্যার চার্জশিট ফাইল করার থেকে পুলিশকে আটকাতে। আসিফার হত্যাকারীদের সমর্থনে, তারা নির্দোষ এই কথা বলতে পথেও বেরিয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টির দুই নেতা — চৌধুরী লাল সিং আর চন্দর প্রকাশ গঙ্গা। এরা ছিল হিন্দু একতা মঞ্চের মিছিলের মাথায়। বিজেপির রাজ্য সভাপতি অবশ্য দোষীদের ঘোর শাস্তি চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, এবং বলেছেন ওই মঞ্চের সঙ্গে বিজেপির কোনও যোগ নেই। আজ জানলাম, মধ্য প্রদেশের বিজেপির প্রধান নন্দকুমার সিং চৌহান বলেছে এ নাকি পাকিস্তানের কাজ! আমাদের হিন্দুহৃদয়সম্রাট সম্ভবত নীরব। তাঁর এক মন্ত্রী রাহুল গান্ধীর নিন্দেমন্দের উত্তরে উলটে মনে করিয়ে দিয়েছেন আমেঠির এক ঘটনার কথা।
তবে সনজি রাম আর তার দলবল যা চেয়েছিল তা হতে চলেছে। রাসানা গ্রাম থেকে পাততাড়ি গুটোচ্ছে আসিফার পরিবার। অথচ তারা এখনও জানে না, ওই সুন্দর মেয়েটাকে — নিজের দুই মেয়েকে দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাকে দত্তক নিয়ে আসা হয়েছিল — ছাড়া তাদের হারাবার আর কিছু নেই…
দ্য হিম টু সেন্ট অ্যাগ্নেসের থেকে আরও —
‘Its fire would quench one’s faith; its flame would put out my light. Strike, strike me, and the stream of my blood shall extinguish these fires.’
They strike her to the ground? and as she falls, she gathers her robes around her, dreading, in the jealous purity of her soul, the insulting gaze of some lewd eye.
Alive to purity even in the act of death, she buries her face in her hands; and kneeling on the ground, she falls as purity would wish to fall.
আসিফা, অসভ্য যাযাবরের আট বছরের মেয়ে অবশ্য এতকিছু জানত না। অপরাধ এমন হয়, এই কথাও কি ভাবতে পেরেছিল সে?