ধ্রুবজ্যোতি মুখার্জি
লালগড়ে মারা পড়া বাঘটি গত ক’দিন ধরে জনমানসে বেশ একটু জায়গা করে নিয়েছে। আলোড়ন তুলেছে বললাম না, অতিশয়োক্তি হয়ে যেত। ধর্ষণ-ফুটবল-পঞ্চায়েত ভোট-ভারতের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস আদি সিরিয়াস এবং সুস্বাদু পদের পাশে একটু চাটনির মতো জায়গা আর কি! তাও নেহাৎ বাঘ বলে, আর বিদেশ-বিভুঁয়ে বেঘোরে মারা পড়েছে তাই। নইলে হাতি-টাতি তো কতই মরে, এই তো সেদিন ট্রেনের ধাক্কায় গোটা চারেক মরল ঝাড়সুগুদাতে, লাইনের ওপর রক্তমাংসের পাহাড় হয়ে পড়ে রইল ঘণ্টা চার, ক’জন আর সে খবর রাখে? সুন্দরবনের আশেপাশের গ্রামে মাঝে মধ্যে বাঘ ঢুকে পড়ার খবর পাওয়া যায়, তা সেও এমন কিছু অফ-বিট ব্যাপার নয়। এ ব্যাটা বাঘ সিমলিপাল না সাতকোসিয়া না দলমা কোত্থেকে কে জানে লালগড়ের ঝাঁটি জঙ্গলে ঢুকে এসেছিল না জানি কত মাইল পথ পেরিয়ে, আর তারপর বনদফতরের অপদার্থগুলোকে দেড়মাস ধরে নাকানিচোবানি খাইয়ে অবশেষে (আহা রে!) কতগুলো জংলি, অশিক্ষিত আদিবাসীদের হাতে অকালে ফৌত হয়ে গেল, তাই একটু শৌখিন আফসোস আর কি। আবার রসিকতার উপাদানও বটে। ব্যাটাচ্ছেলে না কি মরার আগে জবানবন্দি দিয়েছে — ‘আমি তো পঞ্চায়েত ভোটে নমিনেশন ফাইল করিনি!’
এদিকে বাঘের টোপ বানাবার জন্য যে শ-আড়াই ছাগল কেনা হয়েছিল তারা নাকি গুমশুদা হয়ে গেছে। বাঘের পেটে না গিয়ে থাকলে গেল কোথায় এটাও ভাবার বিষয়। তার মাঝে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মন্তব্য করে বসেছেন এরকম অশৈলী ব্যাপারস্যাপার শুধু পশ্চিমবঙ্গেই হয়, আর সেই শুনে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এটা আদিবাসীদের অপমান। শিকার পরব-ফরব কিস্যু না, ওরা জঙ্গলে কেন্দুপাতা তুলতে গেছিল। বরং বাঘই ওদের দু’জনকে জখম করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে তার, কিন্তু বাঘ মারার কোনও প্রমাণ নেই। ঠিকই তো! সে যে সঙ্গীরিক্ত জীবন সইতে না পেরে সুইসাইড করেনি তার কোনও প্রমাণ আছে? তাছাড়া শাসক দলের জেলা সভাপতি তো বলেইছেন জঙ্গলপ্রান্তবাসী যে সমস্ত মানুষ বাঘ মারেননি, বা মেরে থাকলেও বেশ করেছেন, তাদের পাশে সরকার আছে।
সব মিলিয়ে কেস জমে ক্ষীর। বাঘের মৃত্যু বৃথা যায়নি — মহান মানবসভ্যতার কিছু সদস্যের জন্য মস্করা বা ইসসস করার খোরাক জুগিয়েছে, দুই মহান নেত্রীকে লড়িয়ে দিয়েছে, এবং এখনও তার সমস্ত রাজনৈতিক মাইলেজ বোধহয় ফুরিয়ে যায়নি।
গুরুজনেরা বলেন যে কোনও ঘটনা বুঝতে চাইলে তার স্থান-কাল-পাত্র বিচার করা দরকার। আসুন, সে চেষ্টা করা যাক। প্রথমে স্থান। লালগড় এলাকার জঙ্গল যারা চোখে দেখেছেন তারা জানেন যে এ নেহাৎই ঝাঁটি জঙ্গল। কাঁকরঢাকা লাল মাটির ওপর শাল আর ইউক্যালিপটাস বাদ দিলে সেরকম কোনও বড় গাছ নেই। গাছের তলায় ঝোপঝাড়ও সেভাবে নেই। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া আর পুরুলিয়া মিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ‘জঙ্গলমহল’ আসলে অনেকাংশেই নবীন এবং দক্ষিণবঙ্গে সোশ্যাল ফরেস্ট্রির সাফল্যের পরিচয়বাহী। বহুদিন ধরে বন কেটে উজাড় করে দেওয়া ঊষর মাঠে আশির দশকে সোশ্যাল ফরেস্ট্রির সেই সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ রাজ্য বনরক্ষা কমিটি ১৯৯২-৯৩ সালে পেয়েছিল জে পল গেটি ওয়াইল্ডলাইফ কনজার্ভেশন প্রাইজ। ম্যানমেড বন্যার মতো ম্যানমেড ফরেস্ট। বেচলে দাম পাওয়া যাবে এমন গাছই বেছে নেওয়া হয়েছিল শুধু। ইউক্যালিপটাস আর আকাশমণি যেমন। স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গল এখানে মানুষের বসতি আর চাষের জমি দিয়ে খণ্ডিত। হরজাই জঙ্গলে অনেক প্রজাতি বেঁচে থাকতে পারে, গড়ে উঠতে পারে একটা বেশ পরিপুষ্ট বাস্তুতন্ত্র। দক্ষিণবঙ্গের বেশিরভাগ জঙ্গলেই সেরকম বাস্তুতন্ত্র অনুপস্থিত।
মজার কথা, সবুজায়নের এই সাফল্যের দাম দক্ষিণবঙ্গকে অন্যভাবে চোকাতে হয়েছে। নব্বইয়ের দশক থেকে এই সবুজের গন্ধে গন্ধে দলমার হাতির দল নেমে আসতে শুরু করেছে, তারা পেয়ে গেছে শরৎ শেষের পাকা ফসলের স্বাদ। দলমাও তো আর আগের দলমা নেই। মানুষী সভ্যতার অধিকার ও দাবি সেখানেও বিস্তৃত হয়েছে। ক্রমশ ছোট হয়েছে হাতিদের চলাফেরার বৃত্ত। খাবারও কমে এসেছে নিশ্চয়। এদিকে দক্ষিণবঙ্গে এলে মিলবে দিনে গা ঢাকা দেওয়ার মতো জঙ্গল, আর রাতে গ্রামে আর গ্রামের পাশের ক্ষেতে দামালপনা করতে পারলেই খাবার। অতএব গত আড়াই দশক ধরে একটু একটু করে দক্ষিণবঙ্গের বাসিন্দা হয়ে পড়েছে প্রায় শ’খানেক হাতি। এদের মোড অফ সারভাইভাল গুণ্ডাগর্দি। ফলত, এই এলাকায় এখন চলছে চূড়ান্ত ম্যান ভার্সাস ওয়াইল্ড সংঘর্ষ। দু’পক্ষই ক্রমশ নাচার এবং হিংস্র হয়ে উঠছে।
হাতিদের দেখানো পথেই এবার এসেছে বাঘ। এসে তো পড়েছে, কিন্তু খাবেটা কী? নামে জঙ্গল হলেও একটা গোটা বাঘকে এমনকি টেম্পোরারি শেল্টার দেওয়ারও দম নেই এ অঞ্চলের। যথেষ্ট প্রে-বেস নেই তো! তার ওপর বাঘ আবার দিকভ্রষ্ট এবং সন্ত্রস্ত। ধরে নেওয়া যেতে পারে লালগড়ের জঙ্গলে এসে পড়ার পর থেকে খাদ্য অন্বেষণ আর আত্মগোপন করার জন্য বাঘটিকে প্রায় রোজই এলাকা বদলাতে হয়েছিল। অতএব, শুধু গাফিলতি নয়, বন দফতরের ব্যর্থতার পেছনে দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলের প্রকৃতিও একটা কারণ।
কাল। হয়তো বন দফতর আর ক’দিন পরে বাঘটাকে খুঁজে পেয়ে যেত, কিন্তু কালের গেরোয় এ সময় দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলে জঙ্গলে আদিবাসীরা দল বেঁধে ঢোকে শিকার করতে। বৈশাখী পূর্ণিমাতে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে শুধু এ রাজ্য নয়, ওড়িশা আর ঝাড়খণ্ড থেকেও হাতে টাঙ্গি, দা, বল্লম, ধামসা, ঘণ্টা নিয়ে সাঁওতালরা আসে দিশুম সেঁদরা পালতে। সারাদিন শিকার, পরে শিকারের মাংস নিয়ে গণভোজন, মেলা হয়, মহুয়ার বান ডাকে। আর চৈত্রের মাঝামাঝি সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় শিকার পরবের প্রস্তুতি লালগড়, পিড়াকাটা, ধেড়ুয়া, গোয়ালতোড় বা রসকুণ্ডু এলাকাতে। সাঁওতালরা নানা মাপের দলে হাতে অস্ত্র নিয়ে পিচঢালা রাস্তার দুদিকে নতুন পাতায় ছাওয়া শালের জঙ্গলে ঢুকে যায়, ভাগ্য ভালো থাকলে সারাদিন চেষ্টার পর খরগোশটা-শুয়োরটা মেরে আনতে পারে। টুটাফুটা ঐ জঙ্গলে আমি-আপনি সারাদিন ঘুরলেও কোনও জানোয়ার দেখতে পাব কি না সন্দেহ, কিন্তু সাঁওতালরা পায় এবং একবার পেলে আর ছাড়ছুড় নেই। বাঘঘুরা-তে বাঘটি তেমনই একটি দলের সামনে পড়ে যায় বলে খবরে প্রকাশ। দলের দু’জন আহত হওয়ার পরে এই শিকারিরা বাঘটিকে যে মেরে ফেলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আপনার বাড়ির পাশে বাঘ ঘুরে বেড়ালে আপনিও কণ্বমুনির মতো অহিংস থাকতে পারতেন না। নিজেরা হাতে সড়কি টাঙ্গি নিয়ে বাঘ মারতে পারতেন না বলে বন দফতর আর পুলিশের নম্বর ঘোরাতেন এই যা তফাৎ।
এবার পাত্র। একদিকে জঙ্গলের রাজা বাঘ, পৃথিবীর ‘ক্যারিশম্যাটিক মেগাফনা’র অন্যতম সদস্য, উল্টোদিকে জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের আদিবাসী মানুষ। ড্যানিয়েল ক্যুইন-এর ‘ইশমায়েল’ পড়েছেন? আমরা যারা মানুষের সর্বগ্রাসী সভ্যতাকে মেনে নিয়েছি তাদের ক্যুইন বলছেন Takers। আর পৃথিবীর নানা পকেটে যে সব গোষ্ঠী এই সভ্যতাকে এড়িয়ে অথবা পুরোপুরি না মেনে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে তারা Leavers। ভারতের আদিবাসী গোষ্ঠীগুলি যদিও নিজেদের Leaver সংস্কৃতি পুরোপুরি বজায় রাখার মতো পরিসর পায় না তবুও অন্তত কিছু ক্ষেত্রে অতীতের অভ্যাস থেকে তারা বেরিয়েও আসতে অক্ষম। এই শিকার পরব তেমনই একটি অভ্যাস। ক্ষতিকর, কিন্তু মানেকা গান্ধী যাই বলে থাকুন না কেন এই সমস্ত মানুষকে জঙ্গলে ঢুকতে বা শিকার করতে মানা করার নৈতিক অধিকার ভারত রাষ্ট্রের অথবা আমাদের মতো তথাকথিত সভ্য ও শিক্ষিত মানুষের নেই। ভুলব কেমন করে যে এ দেশের বনসম্পদ হু হু করে কমে আসছে, হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক প্রজাতি, মানুষের সাথে কলিশন কোর্সে এসে পড়ছে যে বা যারা তাদের জন্য একটাই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে — সাবাড় করো — আর এ সব কিছুর জন্য আসল দায় আমাদের! আমাদের বিদ্যুৎ চাই, আকরিক চাই, খাবার চাই, অসময়ের সবজি এবং গ্রীষ্মকালে শীত চাই — তাই!
কৃষিভিত্তিক সভ্যতা গড়ে ওঠার সময় থেকেই মানুষ নিজেকে সেরা প্রাণী বলে চিহ্নিত করেছে। বাকি প্রাণী এবং উদ্ভিদকুল শুধুই তার প্রয়োজনে সৃষ্ট বলে ধরে নিয়েছে এবং সেই মর্মে বানিয়ে নিয়েছে গালভরা সব গল্প। সে হল বিচক্ষণ প্রভু, বাকি সব কিছু, এমনকি এই পৃথিবীও, তার অধিকৃত। রাখলে সেই রাখবে, মারলে সেই মারবে। মোট কথা, আর কেউ টিকে থাকুক বা চুলোয় যাক মানুষকে বাড়তে হবে এবং সব মানুষকে ভালো রাখার স্বপ্ন দেখাতে হবে। কখনও বাইবেলের কিংডম কাম, কখনও বা দাস ক্যাপিটালের রাষ্ট্রহীন সমাজের ইউটোপিয়ায় বুঁদ হয়ে সে দাসত্ব করেই যাবে Taker সংস্কৃতির। ভাবতে থাকবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, যাবেই।
আমার বোন কিছুদিন আগে কলকাতার একটা বড়সড় রেসিডেনসিয়াল কমপ্লেক্সে হেল্প ডেস্ক এক্সিকিউটিভের কাজ করত। ওর কাছে শুনেছিলাম একবার নাকি ওই কমপ্লেক্সের ভেতর লিলি পুলে (প্রকৃতির কাছে থাকতে হবে না!) একটা সাপ এসে সেঁধিয়েছিল। বাসিন্দাদের কেউ সেটি দেখে ফেলেন এবং তারপর হেল্প ডেস্কে একটার পর একটা কল আসতে থাকে — এরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে বাল-বাচ্চা নিয়ে কী করে থাকা যায়! সাপটিকে অবিলম্বে স্থানান্তরিত করা হোক বা মেরে ফেলা হোক। সিকিউরিটির লোকজন শেষমেশ দ্বিতীয় পথই নিয়েছিল। নেহাতই নিরীহ একটি ঢোঁড়া সাপ মারা পড়েছিল। বলতে পারব না সেই নির্বিষ ডুণ্ডুভ মৃত্যুর আগে লাঠিসোঁটা হাতে আধুনিক রুরু-দের কাছে নিজের দোষ কী জানতে চেয়েছিল কিনা। যদি সম্ভব হয় তাহলে লালগড়ের বাঘটিকে ওই ঢোঁড়া সাপটির সাথে একই পংক্তিতে রাখুন, তবেই তার মৃত্যুর প্রেক্ষিতটি স্পষ্ট হবে।
Quite a thorough and detailed approach to the subject , evidently an indepth study and lot of research has gone into it, being witty and compact adds to its richness! I usually ‘ve a difficult time maintaining interest or reading till the end of Bengali tales or articles, as not being quite as much conversant with the Bengali script or text as i would ‘ve liked to, but read this at a stretch, overall, an interesting read.
Just that I beg to demur on two points, it has been mentioned that ‘dharshon’ as you term it in Bengali hogged the limelight, agreed it was in the news in a way, at the same time, I can’t disagree more as I was aghast at it being met by the typical( though this time it had bypassed all levels of goriness or brutality and I ‘m not talking of just one incident here) conspicuous silence (of my esteemed friends since the topic is usually regarded as a taboo subject in our society), the apathy and the ‘turning a blind eye’ of certain sections of society cosied in the confines of their comfortable apartments or AC cars, since the presumption is it can’t happen to us, so why bother, is it ? Or rather it has become a daily affair, so why take the trouble to be vocal, isn’t it?Or given a communal touch and categorised as party related propaganda and politics!!!
Secondly, somewhere I agree with one of the commenters on your post, cdn’t the festival be celebrated by the tribal community symbolically , exempli gratia , just like the Durga ‘pujo’ custom of the sacrificial goat ritual is substituted or honoured by cutting open a bottlegourd !? Though the author mentions that unfortunately the tiger was killed, but the action was incidental which means it was not exactly intentional,I can’t fully accept the implications of the latter part of the statement. Somewhere, you too have sympathised and expressed regret on it being sacrificed at the altar of the hunting game!On the same logic why are we ranting or so dead against Salman Khan indulging in poaching activities?!! The tiger can’t exactly be categorised as an extant species,it is on the verge of extinction, an endangered species,unless we give thought to protecting it, one day our national animal ‘ll remain as just that, a titular symbol!