সিদ্ধার্থ দত্ত
–সাধুবাবা, কীসের জন্যে আপনি এই কৃচ্ছ্রসাধন করেন?
গ্রামের বাইরে বটতলায় বসে ধুনি জ্বালিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে তাঁর সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন। লোকজন ভয়েভক্তিতে এড়িয়ে যায়। রক্তাম্বর, রক্তচক্ষু, ত্রিশূল, রুদ্রাক্ষের মালা সব মিলিয়ে নিঃসন্দেহে ভীতিকর। কেউ প্রশ্ন করেনি কোনওদিন। আজ হঠাৎ এই নবীন ছোকরাটি কোত্থেকে এল। শুধু আসা না, একেবারে মূলাধার ধরে টান মেরে বসেছে। ওং, হ্রীং, ক্রীং বলে বাজখাঁই একটা আওয়াজ ছাড়তে গিয়েও থমকে গেলেন। ছোকরাকে একটা যুতসই জবাব না দিতে পারলে গ্রামের লোকের বিশ্বাসভঙ্গ হবে। গালিগালাজও করতে পারে। না না, সে বড় অপমানের!
–হঠাৎ এ প্রশ্ন করছিস যে বড়? তোর সাহস তো কম নয়, অ্যাঁ!
ছোকরাটি মহা ফিচেল, সে নড়বার পাত্র নয়।
–না মানে বলছিলাম যে, যে কোনও সাধনারই তো একটা সিদ্ধি আছে, তা আপনি সাধুবাবা, আপনার সাধনপথের গন্তব্য কী?
–ব্যোম শঙ্কর, সে কথা আমি তোকে কেন বলতে যাব রে হতচ্ছাড়া?
–বলতে চাইলে বলবেন, তবে না বললে গ্রামের মানুষ ভুল বুঝতে পারে! যা দিনকাল।
গাঁজার ঘোরটা কেটে যাচ্ছে। নাঃ, ছোকরাটা বড় জ্বালাচ্ছে।
–শোন, এভাবে তো হয় না, কাল রাত দুপহরে আসিস, জবাব দেব।
রাত নিশুত। ধুনির আগুনের চোটে দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। নিভিয়ে দেবারও জো নেই। গুরুবাক্য আর মশা দুইয়ের বিরুদ্ধে যাওয়া মুখের কথা না। কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠল। ঝোলা থেকে একটা হরতুকি মুখে দিলেন। কষায় স্বাদে মুখ ভরে গেল! মন্ত্রপূত হরতুকি। সহজে খান না, তবে ছোকরার করা প্রশ্নগুলো ভেতরে কিলবিল করছে।
রাত বাড়ে। সাধুবাবা টের পান মুখে ফেলা হরতুকিটা কেমন বেখাপ্পা আচরণ করছে। একবার ভেতরে ঝাঁকি দিচ্ছে, পরক্ষণেই সারা শরীর বেয়ে শীতল স্রোত নেমে আসছে। থু থু করে ফেলে দিতে গেলেন, গেল না! সাধুবাবার চোখের সামনে বটগাছটার মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। একটা পাখিও ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল না, ডেকে উঠল না। অথচ বটগাছটা দাউ দাউ জ্বলছে। সাধুবাবা আস্তে আস্তে ঝোলা থেকে হরতুকিগুলো বার করে মাটির ওপর সার দিয়ে সাজাতেই অদ্ভুত একটা নীল আলো ছড়িয়ে পড়ল। সেই আলোকে নতজানু হয়ে প্রণাম করলেন। হরতুকিগুলো মাটি থেকে কুড়িয়ে মুঠোর মধ্যে নিতেই, শরীর জুড়ে কাঁপন। ঝড় উঠল বুঝি। তারপর সেই বটগাছ, রক্তমাংসের শরীর সেই দুরন্ত হাওয়ায়, নিশুতি রাতের মধ্যে ধুলোর মতো মিলিয়ে যেতে লাগল।