ভবভূতি ভট্টাচার্য
১
“গল্পের আগের গল্প”
নির্নিমেষ তাকিয়ে আছেন প্রৌঢ় জ্ঞানতাপস সুদূর ঐ পর্বতশৃঙ্গের দিকে। উনি জোন্স, স্যর উইলিয়ম জোন্স। কাল: ১৭৮৪-র ৫ই অক্টোবর। স্থান: ভাগলপুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। সেকালে দূষণমাত্রা নেহাতই নগণ্য ছিল কিনা, তাই ভাগলপুরের মতো সমতল থেকেও হিমালয়ের উত্তুঙ্গ শৃঙ্গ দৃষ্টিগোচর হতে পারত। বন্ধুবর জেমস রেনেল ওই শৃঙ্গটির নেপালি নাম ‘চোমো লাহরি’ই বজায় রেখেছিলেন। তিব্বতে ওই শৃঙ্গ বা অঞ্চলটি ‘চোমোলাঙমা’ (পুণ্যাজননী) নামে পরিচিত। এইটিই কি বিশ্বের উত্তুঙ্গতম পর্বতশৃঙ্গ? বিশ্বের সর্বোচ্চ হিসেবে তখনও য়ুরোপ জানত বা মানত দক্ষিণ আমেরিকার আন্ডিজের চিম্বোরাজো শৃঙ্গকে (২০,৭০০ ফিট)। কিন্তু ঋষি জোন্স ওই চোমো লাহরি শৃঙ্গকেই বিশ্বের সর্বোচ্চ হিসেবে মর্যাদা দিলেন তাঁর রোজনামচায়। এতে ‘বিজ্ঞান’ হয়তো কম ছিল, দূরদৃষ্টি ছিল অসামান্য। কারণ, সুধীসমাজ ঋষি জোন্সের বিজ্ঞানস্বল্পতাকে প্রশ্ন করেনি, বরং এই সত্য প্রমাণের সূত্র ঢুঁড়তে লেগে গেল।
###
যেমন, জোন্সের ভাবশিষ্য হেনরি টমাস কোলব্রুক। ভারততত্ত্ববিদ, সংস্কৃতজ্ঞ। জোন্সের পরে কলকাতার ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’-র হাল ধরেন উনিই। তাঁর জ্যাঠতুতো দাদা কর্নেল রবার্ট কোলব্রুক, যিনি পরে ভারতের সার্ভেয়র জেনারেল হন। রবার্ট ঘুরতেন, হেনরি লিখতেন। ১৮০৪-এ শত লস্করের বহর নিয়ে মস্ত মস্ত বজরায় ও হাতি-উটের পিঠে জরিপের কাজে বেরোন রবার্ট। উত্তরভারতের সমভূমি তখন জঙ্গলাকীর্ণ, ব্যাঘ্রসংকুল। রবার্ট কোলব্রুক অবিশ্যি আনন্দে মশগুল থাকতেন। জরিপ তাঁর কাছে যত না কর্তব্য, তার চাইতে বেশি যেন বনভোজন। সঙ্গে প্রিয়তমা পত্নী ও ন’টি সন্তান। উনি গোরক্ষপুর-পিলভিত থেকে মেপে চোমো লাহরি শৃঙ্গকেই বিশ্বের সর্বোচ্চ বলে ঘোষণা করেন। তার ভিত্তিতে ভ্রাতা হেনরি লন্ডনের নামী ‘কোয়ার্টার্লি রিভিউ’ পত্রিকায় লিখে পাঠালেন। তাঁরা অবশ্য ‘আবেগ বেশি, বিজ্ঞান কম’ বলে সেই নিবন্ধ ছাপেননি, আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেন। বস্তুত, মাউন্ট এভারেস্টকে (২৯,০২৯ ফিট) সর্বসম্মতভাবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের স্বীকৃতি পেতে তখনও অপেক্ষা করতে হবে আরও প্রায় অর্ধশতাব্দী, প্রয়োজন হবে এক বাঙালী গণিতবেত্তার স্বেদবিন্দুর; যদিও তার আগে প্রায় পঞ্চাশ বছরব্যাপী এক রাজসূয় যজ্ঞের দরকার পড়বে। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা নির্ণয় তাই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বস্তুত ‘গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’-র ভারতব্যাপী মহাযজ্ঞের এক বাই-প্রডাক্ট হল এ’। আর নামকরণ? এ’ শৃঙ্গ জর্জ এভারেস্ট কখনও চোখেও দেখেননি, হিমালয় পর্বতমালাই তিনি দেখেন কর্মজীবনের উপান্তে এসে মাত্র কয়েকবছরের জন্য। ‘সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ থেকে তাঁর সেবানিবৃত্তির (১৮৪৩) তেরো বছর পরে হিমালয়ের ১৫তম শৃঙ্গটি বিশ্বের সর্বোচ্চ বলে স্বীকৃত পেল, খৃ ১৮৫৬। নামকরণটি তাঁর উত্তরসূরী কর্নেল এন্ড্রু ওয়ের উদ্যোগে। গণনায় বাঙালি ডিরোজিয়ান রাধানাথের অনস্বীকার্য অবদান ছিল। জর্জ এভারেস্টের নিজের কর্মকাল জুড়ে ছিল গোদাবরী-নর্মদা-যমুনার জঙ্গলাকীর্ণ সমতল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধব্যাপী এই ভারত-জরিপের কোনও পূর্ব-উদাহরণ নেই: আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়াও তখনও জরিপ করা হয়নি। শুরুর দিকে, ইংরেজ তখনও নেপোলিয়নের ডরে কাঁপছে। রেল-টেলিগ্রাফ-বাস্পীয়পোত আসার তখনও অনেক দেরি আছে। সেকালে শেকল-ত্রিদণ্ড দিয়ে ভারত মেপে ফেলার কল্পনাটাই ছিল যুগান্তকারী। কোনও বড় যুদ্ধে এত প্রাণনাশ হয় না, যত হয়েছিল সার্ভের এই কাজে: জঙ্গুলে জ্বর, ব্যাঘ্রদংশন ও সর্প-বৃশ্চিক-দংশন! এই সব নিয়েই আমাদের আজকের এই এডভেঞ্চার স্টোরি।
“THE GREAT ARC — The Dramatic Tale of How India was Mapped & Everest was named” by John Keay
Harper Collins
ISBN : 978-0-00-748117-0
২
“একটি সলিতা ও মানুষজন”
ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞান-স্থাপত্য…. কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে না ভারত তার উৎকর্ষ প্রদর্শন করেছে সারা প্রাচীন ও মধ্যযুগ ধরে? রামায়ণ-মহাভারতের কাল থেকে ভারতীয়দের ভূগোলজ্ঞান প্রশংসার্হ ছিল — শ্রীলঙ্কা-গোদাবরী-মণিপুর-হিমালয় জুড়ে। ইলাবৃতবর্ষ (পামীর মালভূমি), নিষাধপর্বত (হিন্দুকুশ), নিম্পুরুষবর্ষ (তিব্বত) — এ’সব চিহ্নিতকরণ প্রাচীন ভারতেই হয়েছে। কিন্তু মানচিত্র অঙ্কন? সম্রাট আকবর গঙ্গার উৎস সন্ধানে এক অভিযাত্রীদল পাঠালেন। তাঁরা ঘুরে এসে মুখে মুখে গল্প শোনাল বাদশাহ্কে, পথের কোনও ম্যাপ আঁকার বালাই নেই। নইলে, নানা উপঢৌকনের মধ্যে স্যর টমাস রো যখন সম্রাট জাহাঙ্গীরকে একখানি মানচিত্রও দেন, তা সম্রাট ফেরত দেবেন কেন? তাঁর রাজ্যে ওই বস্তু ‘পড়তে’ পারার লোক ছিল না!
রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে জরিপের এক অচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। ভারতে প্রথম নিয়মানুগ জরিপ করান আকবর বাদশাহের অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমল, ষোড়শ শতকে। সেই জরিপের পুঙ্খানু বিবরণ যদিও আমাদের কাছে আজ আর ধরা নেই, কিন্তু নামগুলো রয়ে গেছে, উদা. ২৪ পরগণা, উত্তর সরকার। তারও আগে একাদশ শতাব্দীতে চোলরাজ প্রথম রাজরাজ তামিলভূমি জরিপ করান বলে শোনা গেলেও তারও বিশেষ হদিশ আজ আর পাওয়া যায় না। পলাশি-বক্সারের যুদ্ধু জিতে রবার্ট ক্লাইব ভার দিলেন কর্নেল জেমস রেনেল (১৭৪২-১৮৩০)-কে নববিজিত রাজ্য মাপার, সাথী ছিলেন তাঁর ফরাসি ক্লদ মার্টিন (১৭৩৫-১৮০০), যাঁর দানে পরে ‘লা মার্টিনিয়র’ বিদ্যায়তনসমূহ গড়ে ওঠে। আসাম-সীমা থেকে আগ্রা পর্যন্ত জরিপ করেন কর্নেল রেনেল, যাঁকে ‘ফাদার অব ইন্ডিয়ান জিওগ্রাফি’ আখ্যায়িত করা হয়। এই সময়ে বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে চার্লস রেনল্ডস ও মাদ্রাজে কর্নেল কলিন ম্যাকেঞ্জিও উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই দক্ষিণ ভারতে উইলিয়ম ল্যাম্টন যে মানের কাজ শুরু করলেন, আগের আগের সব কাজকে ছেলেখেলার পর্যায়ে নিয়ে গেল তা। ভারতে সঠিক বৈজ্ঞানিক জরিপের কাজের পুরোধা এই ল্যাম্টন-সাহেবই। তাঁরই উত্তরসূরি হলেন স্যর জর্জ এভারেস্ট, যাঁর নামে শৃঙ্গটি।
###
১৭৯৯ খৃ.। সদ্য শ্রীরঙ্গপত্তনমে চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে ‘বাঘের বাচ্চা’ টিপু সুলতানকে হারিয়ে ‘দক্কন’ কব্জা করেছে বৃটিশ কোম্পানি। এবার তো তাহলে নববিজিত রাজ্য মাপতে হয়, ভাবল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি। কলকাতায় তখন বৃটিশ-‘নবাব’ রিচার্ড ওয়েলেসলি, গভর্নর-জেনারেল, ‘গভর্নর হাউজ’ (আজকের ‘রাজভবন’) বানানোর কাজে হাত দিয়েছেন! তাঁর ভাই আর্থার ছিলেন মহীশূর-মারাঠা যুদ্ধের সেনাপতি, পরে যিনি ওয়াটার্লুতে নেপোলিয়ঁ-জিতে ‘ডিউক অব্ ওয়েলিংটন’ নামে বিশ্বখ্যাতি পাবেন। কলকাতা থেকে জাহাজে মাদ্রাজ যাবার পথে একবার আর্থারের সঙ্গে পরিচয় হয় সদ্য কানাডাফেরৎ এক বিরলকেশ প্রৌঢ়ের। ইনিই উইলিয়ম ল্যাম্টন, ১৭৫৩-এ’ জন্ম ইয়র্কশায়ারে। ছোকরা বয়সে রাজার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে আমেরিকানদের স্বাধীনতা দমাতে গিয়ে বন্দি হন ল্যাম্টন ওয়াশিংটনের সেনাদলের হাতে। পরে মুক্তি পেয়ে কানাডার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জরিপের কাজে ব্যপৃত থাকেন। স্বশিক্ষিত মানুষ। জরিপের জটিল কাজ ও ক্যালকুলেশন কেউ শেখায়নি তাঁকে। নিজের চেষ্টায় পড়েলিখে ঘষেমেজে তৈরি হয়ে নেন। ১৮০২-এ’ মাদ্রাজে এই বিজ্ঞানসাধক উইলিয়ম ল্যাম্টনের হাতেই প্রতিষ্ঠা পেল “দ্য গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া” — যার ছত্রছায়ায় ভারত-মানচিত্রের মেরুদণ্ডের মতো দেড়হাজার মাইল ধরে কন্যাকুমারী থেকে উত্তুঙ্গ হিমালয় পরিমাপের কাজ চলেছিল অর্ধশতাব্দীব্যাপী!
শুরুয়াৎ তো হল, এবার তার আসল কাজটা হয় কীভাবে? একশ’ ফুট লম্বা এক ইস্পাত-শিকলের সন্ধান পাওয়া গেল কলকাতায় — বৃটিশরাজের উপঢৌকন হিসেবে তা চলেছে চিনসম্রাটের কাছে। সেটা হস্তগত করা গেল। কিন্তু, জরিপের কাজের প্রধান যে যন্ত্র, ‘থিওডোলাইট’, তা পাওয়া যায় কোত্থেকে? তার জন্য তো বিলেতে অর্ডার পাঠানো ছাড়া উপায় নেই। তাতে কী? পাঠাও অর্ডার। অর্ডার গেল। যন্ত্র আর আসে না আসে না। শেষটায় খবর পাওয়া গেল, যে বৃটিশ জাহাজে আসছিলেন তিনি, মরিশাসের কাছে তাকে কব্জা করেছে ফরাসিরা। অর্ধটনের সেই কিম্ভুতকিমাকার যন্ত্র দেখে ফরাসি সেনারা তো অবাক। এ’ আবার কোন্ নতুন শস্ত্র আমদানি করছে ইংরেজরা তাদের দমাতে? পরে অবশ্য যন্ত্রখানির আসল উদ্দেশ্য জানতে পেরে তাকে ফের প্যাক-ট্যাক করে ‘উইদ বেস্ট কমপ্লিমেন্টস টু দ গভর্নর অব ম্যাড্রাস’ বলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এইবার শুরু হল আসল কাজ। পঞ্চাশবর্ষীয় যুবক ল্যামটনের উৎসাহে উদ্বুদ্ধ পুরো টিম। উনি ছিলেন এক পিতৃসম ব্যক্তিত্ব আবার স্বভাবে শিশুর মতো সরল। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন অনুজদের; গোটা টিমের ভালোমন্দের খোঁজখবর রাখতেন। আর দিনের কর্মশেষে ক্যাম্পে বসত কোরাস গানের আসর ও চুটকিলে। তবে, কাজের মানের সঙ্গে কণামাত্র আপোষ করা ল্যামটনের ধাতে ছিল না। একটা উদাহরণ, সেই ছেনি-হাতুড়ি-শেকলের কালে উনি মাদ্রাজ বেসলাইনের ২০০ মাইল যা মেপেছিলেন আজকের স্যাটেলাইট ছবির সঙ্গে তার ফারাক মাত্র ৩.৭ ইঞ্চির!
###
ত্রিকোণমিতির সাহায্যে কী করে করা হত এই মাপজোক? ধরা যাক্, কখগ একটি ত্রিভুজ। ভূমি খগ-র দূরত্ব শিকলমেপে জেনে নিয়ে এবার বিন্দু-খ ও বিন্দু-গ থেকে শীর্ষ ক-এর দূরত্ব এবং কোণ-কখগ ও কোণ-কগখ মেপে নেওয়া হত থিওডোলাইট যন্ত্রখানি কোনও উচ্চস্থানে বসিয়ে নিয়ে। এ’ভাবে বাহু কখ ও বাহু কগ-এর দৈর্ঘ্য পাওয়া গেলে এবার, ধরুন, কগ-কে ভূমি ধরে নিয়ে নতুন ত্রিভুজ কগঘ-র মাপন ঐ একই পদ্ধতিতে করা যাবে। এবং করা যেতে থাকবে যদ্দিন না সারা ভারতের দৈর্ঘ্য মাপা শেষ হচ্ছে ত্রিভুজে ত্রিভুজে! শুধু উত্তরদক্ষিণ দ্রাঘিমা বরাবরই নয়, পুবপশ্চিমে কলকাতা-বোম্বাই অক্ষাংশেরও জরিপ হয়, যার একটা বড় অংশ নবীন এভারেস্ট করেছিলেন ল্যামটনের ছত্রছায়ায়। এইভাবে অদৃশ্য ত্রিভুজে ত্রিভুজে ছেয়ে গেল সারা ভারতবর্ষ। প্রোথিত হল ইউনিয়ন জ্যাক ভারতমায়ের সারা অঙ্গে অঙ্গে।
ল্যামটনের আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল। পৃথিবী যে গোল তদ্দিনে সভ্যবিশ্ব তা মেনে নিয়েছে, কিন্তু ‘কেমন’ গোল বা ‘কতটা’ গোল? বলের মতো না ডিমের মতো না পেয়ারার মতো? পৃথিবীর এই গড়ন নিয়েই হল ‘ভূগণিতবিদ্যা’ (geodesy বা geodetics) যা ছিল ল্যামটনের বিশেষ উৎসাহের বিষয়, এবং ভারতের মেরুদণ্ডব্যাপী ৭৮ ডিগ্রি দ্রাঘিমার গা-ঘেঁষে এই ১৬০০ মাইলের জরিপ করলে ভূপৃষ্ঠের গড়নটাও পাক্কা জানা যাবে। হ্যাঁ, জানা গিয়েও ছিল। এই ভূগণিতবিদ্যাটা বড্ড জরুরি। এর দ্বারাই না আজ জানা যায় মাউন্ট এভারেস্ট সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হলেও ভূকেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ আন্ডিজের চিম্বোরাজো-ই। এমনটা হয় যেহেতু পৃথিবী কমলার মতো গোল, বলের মতো নয় — উত্তর-দক্ষিণ সামান্য চাপা।
যাহোক, এবার খরচখরচার প্রসঙ্গ। প্রথম আপত্তিটা উঠেছিল মাদ্রাজের সরকারি ইংরেজ অফিসারদের থেকেই। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, “এই মাদ্রাজ থেকে বাঙ্গালুর যেতে আমি তো পালকি আর ঘোড়া খুঁজব যারা পথটা চেনে। তার জন্য এত কাঁড়িকাঁড়ি টাকা খরচ করে ম্যাপ বানানোর দরকারটা কী পড়ছে?” এই না হলে পাক্কা আমলা?! ভাগ্যিস আর্থার ওয়েলেসলি নিজে বিজ্ঞানটা কম বুঝতেন বলে বন্ধু ল্যামটনের মেধার ওপর ভরোসা করেছিলেন ও ঐ আমলাদের পাত্তা দেননি!
দেশীয় মানুষজনের কাছ থেকেও কম আপত্তি আসেনি।
“ওই ইংরেজ বেটাচ্ছেলেরা আমাদের মসজিদ-মন্দির মাড়িয়ে মাড়িয়ে টঙে উঠে যাচ্ছে। যন্তোর বসাচ্ছে। অপবিত্র করছে। ওদের দূরবীণে, দেখেছ, মানুষ-বাড়িঘর উল্টোউল্টো দেখায়? তাহলে, কোন্না পোশাক ভেদ করে নাঙ্গা দেহও দেখা যায়? ঘরোয়ালির আব্রু বলে বাকি কিছু কি রইল আর? তওবা তওবা!” গ্রাম্য পঞ্চায়েতের এ’সব কথায় পাত্তা দেবে জিটিএস GTS (Great Trigonometrical Survey)? রামঃ! এই বৃটিশ ঔদ্ধত্য পরে আরও বেশি করে ফুটে বেরোয় এভারেস্ট যখন সার্ভেয়র-জেনারেল হয়ে এলেন, ল্যামটনের পরে। আগ্রা সেক্টরে তখন কাজ চলছে, দৃষ্টিতে বাধা পাওয়ার কারণে সম্রাট আকবরের সমাধির এক গম্বুজ এরা ভেঙে ফেলে দেয়। কে বাধা দেবে? আকবরের নাতবৌমার ভাগ্য ভালো যে জর্জ এভারেস্টের লোকজন তাজমহলের টঙে যন্তর চড়ায়নি ত্রিভুজ মাপতে! এর অনেক আগে, ল্যামটনের কালে ১৮০৯-এ’, তাঞ্জোরের রাজরাজেশ্বর মন্দিরের চুড়োয় থিওডোলাইট বসাতে গেলে তা দড়ি ছিঁড়ে পড়ে ও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ল্যামটন অবশ্য সমগ্র দায় নিজস্কন্ধে নেন ও নিজের খরচে নতুন থিওডোলাইট আনানোর বন্দোবস্ত করেন। আর যে একাগ্রতায় ছয় মাস ধরে নিজের তাঁবুতে বসে ভগ্নযন্ত্রটি সারান তিনি, তা ছিল এক সাধকের সাধনার সমতুল — লিখেছেন তাঁর অনুজসাথী।
এ’তো বাহ্য। আসল আপদ আসত দিনের পর দিন গোদাবরী-নর্মদার গহন জঙ্গলে অমানুষিক পরিবেশে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাওয়ায়: ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বর, বিষাক্ত বিছে ও সাপ, প্রবল বর্ষণ ও জ্বলন্ত গ্রীষ্ম! কত লস্কর যে বাঘের পেটে গেছে তার লেখাজোকা কৈ? তারা একবার অমানুষিক পরিবেশে কাজ করতে অস্বীকার করায় লেফটেনান্ট এভারেস্ট প্রকাশ্যে চাবুক মারেন। এভারেস্ট নিজে দু’বার কঠিন জ্বরে পড়ে দীর্ঘ ‘সিক লিভ’-এ’ ঘরে ফিরে যান। যদিও আশ্চর্য, এতদিন জঙ্গলে জঙ্গলে কাজ করেও এভারেস্ট নিজে কোনওদিন বাঘের সামনে পড়েননি! কুলিদের ব্যাঘ্রভীতিকে তাই কর্মবিমুখতার বাহানা বলতেন। আর তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত যে বাঘ বাঘকে চেনে, তাই কখনও মুখোমুখি হয় না। এই সব আপদের মধ্যেই এগিয়ে চলেছে ট্রায়াঙ্গুলেশনের কাজ — একটার পর একটা অদৃশ্য ত্রিভুজে বাঁধা পড়েছে ভারতবর্ষ। এ’যে ছিল বৃটিশ রাজশক্তির প্রতীক, তার সিংহের থাবা, রাজার (বা রানির) ইজ্জতের সওয়াল! কত গ্রাম যে উজাড় হয়েছে, কত শস্যহানি, কত লক্ষ বৃক্ষছেদন হয়েছে, হয়েছে কত স্থানীয় রাজের অসম্মান — ইতিহাস সে-সব লিখে রাখেনি। এক বৃটিশ ঐতিহাসিক তাই ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের এক কারণ হিসেবে একে চিহ্নিত করেছেন। বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হতে এই ‘ত্রিদণ্ড’-র (theodolite) ভূমিকাও বড় অল্প ছিল না! দেরাদুনের ‘সার্ভে অব ইন্ডিয়া’-র সদর দফতরে আজও সেই শেকল, সেই হাফ-টনি থিওডোলাইট অতি সযত্নে রক্ষিত রয়েছে।
৩
“একটি প্রস্থান, একটি আগমন”
১৮১৮-র ক্রিশমাসের পরের দিন ‘বক্সিং দিবসের’ রঙিন উৎসব চলছে হায়দ্রাবাদে কর্নেল উইলিয়ম ল্যামটনের গৃহে, যেদিন ভৃত্য ও অধীনস্থদের বাক্সে বখশিস দেবার রীতি। উল্টে ‘বস্’ পেলেন এক বখশিস: টগবগিয়ে জুরিগাড়ি ছুটিয়ে এক শ্মশ্রুগুম্ফ সুমণ্ডিত আঠাশ বছরের যুবকের প্রবেশ। নাম জর্জ এভারেস্ট, নিয়োগপত্র পেশ করলেন: চাকুরিতে যোগ দিতে এসেছেন। শুরু থেকেই ‘গুরুশিষ্যের’ একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধা-প্রতিযোগিতার সম্পর্ক ছিল। এভারেস্ট মুখে ল্যামটনকে শ্রদ্ধা করলেও নিজেকে জাহির করার বাসনাটাই তাঁর মনে প্রবলতর ছিল। ডা. ভয়েসি-ডি’পেনিং-রোসেনরোড-অলিভারের মতো ল্যামটনের অধীনে প্রায় বিশ বিশ বছর কাজ করা সহযোগীদের ‘দো-আঁশলা’ বলে হেয় করতে শুরু করেন জর্জ। ল্যামটনও চেয়েছিলেন তাঁর পরে জর্জ নয়, তাঁর অনুজসাথী ড. ভয়েসি সার্ভেয়র-জেনারেল হয়ে আসুন। গুরুশিষ্যে গোড়া থেকেই তাই ছিল এক প্রতিযোগিতার ভাব। ল্যামটন তখন দক্ষিণ থেকে আরেকটু উত্তরে নাগপুর সেক্টরে উঠে এসেছেন, সেখানে চলছে কাজ। এভারেস্ট কলকাতা-বোম্বাই এক্সিসে। কে আগে শেষ করতে পারে এসাইনমেন্ট? কঠোর পরিশ্রমে ল্যামটনের শরীর ভেঙে এসেছে, বয়স সত্তর। এর আগে কেউ তাঁকে একদিনের তরেও অসুস্থ হয়ে কর্মবিরতি নিতে দেখেনি। ওয়ার্ধার নিকট হিঙ্গনঘাটের তাঁবুতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন মাঘমাসের অসহ্য জঙ্গুলে ঠান্ডায়। সম্ভবত, তাঁর টিউবারকুলোসিস হয়েছিল, শেষের দিকে অসম্ভব কাশতেন। ৮ই জানুয়ারি প্রাতে তাঁবুতে ঢুকে ভৃত্য এসে ল্যামটনকে চিরনিদ্রায় শায়িত দেখে। সালটা ১৮২৩। বীরের মতো মৃত্যু নয়? যে মাঠ-ঘাট-জঙ্গল জরিপ করা ছিল তাঁর সাধনা, তার বুকেই চিরশয়ন। সমাধিখানি অবশ্য আজ অতি কষ্টে খুঁজে পেতে হয়, পাশেই এক পাবলিক ইয়ুরিনাল রয়েছে কিনা! হায় ভারত! ল্যামটন ছিলেন জোন্স-কোলব্রুক-ম্যকেঞ্জি ঘরানার পুরনোকালের ইংরেজ। ভারতকে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। বিবাহ করেন এক দক্ষিণী মুসলিম রমণীকে, যাঁর গর্ভে তিনটি সন্তানের জন্ম। তিনজনকেই স্বীকৃতি দেন ও ব্যাপটাইজড্ করেন। বড়জন তো দশ বছর বয়সেই বাপের পিছুপিছু শেকল হাতে ঘুরত বনে বনে।
ল্যামটনের প্রস্থান, এভরেস্টের আগমন: শুরু হল আসল জর্জ এভারেস্ট যুগ (১৮৩৩-১৮৪৩): ‘শোণিতের স্রোতে’ তিনি মুছে ফেলেন ল্যামটনের ‘অপেশাদারি’ কর্মধারা। দেড়-দু’ দশকের সহকারীরা চাকুরে ছেড়ে দিতে থাকেন। যাঁরা রয়ে গেলেন তাঁরাও নতুন অধিকর্তার ব্যবহারে তিতিবিরিক্ত। জিভে তাঁর হুল, কলমে বিষ। আবার অসম্ভব টাস্ক-মাস্টার, কাজটা অসাধারণ ভালো বোঝেন। তাঁকে যে একসঙ্গে অনেকগুলো টাস্ক সারতে হবে: সার্ভের পেছনে সরকারের অকাতর ব্যয়কে মান্যতা দিতে হবে, তাঁর নিখুঁত কাজের সুনাম বজায় রাখতে হবে, আর সর্বোপরি তাঁর পর্বতপ্রমাণ অহমিকাটিকে উচ্চে রাখতে হবে! এভারেস্ট তাই কাজ করতেন ভারতে, দৃষ্টিটা থাকত ইউরোপে: সেখানকার বিদ্বজ্জন কী চোখে দেখছে তাঁর কাজ? সত্যিই বিশ্বমানের কাজ করেছিলেন জর্জ সাহেব। নামটা কেউ ‘এভারেস্ট’ উচ্চারণ করলে ক্ষিপ্ত হতেন, ‘এভ্রিস্ট’ বলতে হবে। কী ফের! ভুল উচ্চারণটাই জগৎবিখ্যাত হয়ে রইল। তাঁর নামে শৃঙ্গটির নামকরণ না হলে আজ কে চিনত জর্জ এভারেস্টকে?
বস্তুত, ১৮২০-র দশকের গোড়াতেও ল্যামটন বা এভারেস্ট কেউই কল্পনা করতে পারেননি যে সার্ভের এই ত্রিকোণমিতির কাজ ভারতীয় সমভূমি ছেয়ে একদা উত্তুঙ্গ হিমালয়ও স্পর্শ করবে। কিন্তু এ’সময়ে কর্নেল স্লিম্যানের ঠগীদমন উত্তরভারতে ট্রায়াঙ্গুলেশনের কাজ সহজ করে দেয়, যদিও এর কাজ সেখানকার গ্রামে গ্রামে কী আতঙ্ক ও সন্দেহের সৃষ্টি করেছিল, সেকথাও স্লিম্যান উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কলকাতার কোম্পানির বড় কর্তাদের চোখে এভারেস্ট হিরো ছিলেন যে! ১৮৩২-এর জানুয়ারিতে আজকের বি টি রোডের ওপর এক টাওয়ার বানিয়ে (আজও আছে) কলকাতার তাবড়দের সামনে হাতেকলমে দেখিয়ে দিলেন কী করে ট্রায়াঙ্গুলেশনের কাজ হয়। হাজার লোকের মেলা! সার্ভের তরফ থেকে এলাহি প্রাতঃরাশের ব্যবস্থা। এশিয়াটিক সোসাইটির তৎকালীন বড়কর্তা জেমস প্রিন্সেপ তো অভিভূত! ডেভিড হেয়ার ছাত্রদের নিয়ে দেখাতে গেছেন সে-কর্মকাণ্ড। ফলত, বহুপ্রতীক্ষিত অর্থ মঞ্জুর হল। রাধানাথ শিকদার তখন হিন্দু কালেজের শেষবর্ষের ছাত্র; গুরু ডিরোজিও ভগ্নহৃদয়ে দেহ রেখেছেন অতি সম্প্রতি। আর, তার দু’মাস আগে কলকাতা থেকে মাত্র বিশ মাইল দূরে ‘বাঁশের কেল্লা’-য় ইংরেজকে কঠিন লড়াই দিয়ে শহীদ হয়েছেন তিতুমীর!
এবার উত্তরভারত জয়। হাতি-উট-বাজরার কাফিলা মস্ত মস্ত যন্ত্র নিয়ে পাঁচ মাসে পৌঁছল কলকাতা থেকে দেহ্রাদুন হয়ে মুসৌরি। এবার শিখরে!!
৪
“সর্বোচ্চে চিরপ্রশান্তি”
এতক্ষণে আমাদের গল্পের শেষ পর্যায়ে পৌঁছনো গেছে। হিমালয় ও তার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ!! দেখুন, ইতিহাসের কী লীলা, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রবল তাপে দগ্ধ হতে হতে ট্রায়াঙ্গুলেশনের কাজ শেষ হল হিমালয়ের বরফঢাকা শৃঙ্গে এসে; ভূপৃষ্ঠের মসৃণ বক্রতা (smooth curvature) মাপা যার লক্ষ্য ছিল তার পরিসমাপ্তি সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গে; আর জর্জ এভারেস্ট, যিনি এক ডেসিমালের এক-ষষ্ঠাংশের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিমাপ নিয়ে সারাজীবন মাথা ঘামিয়ে এলেন তাঁর নাম কিনা জুড়ে রইল বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের সঙ্গে!!
১৮২০-র দশকে আন্ডিজকে হঠিয়ে হিমালয় মান্যতা পেলেও নন্দাদেবীকেই (২৫,৪৭৯ ফিট) তখনও সর্বোচ্চ মানা হত। ল্যামটন-কালের মহারথী জোসেফ ওলিভার-উইলিয়ম রোসেনরোডরা এবার হিমালয় মাড়িয়ে মাড়িয়ে তচ করতে লাগলেন সর্বোচ্চের খোঁজে। জেসুয়া ডি’পেনিং কলকাতার আপিসে বসে রাধানাথ সিকদারকে রিক্রুট করলেন ‘কম্পিউটর’ (গণনাকারী) হিসেবে, মাসিক বেতন ৩০ টঙ্কা। জর্জ এভারেস্ট এদ্দিনে মুসৌরির উপকণ্ঠে ‘হাঁথিপাঁও’ গ্রামে এক বাংলো কিনে এসে বসলেন, যেটা আজও বিরাজমান। উত্তরাখণ্ড সরকার সম্প্রতি তাকে সারিয়ে-সুরিয়ে এক টুরিস্ট স্পট বানিয়েছে। এই প্রথম হিমালয় দর্শন জর্জের: ৪২ বছর বয়সে, সন ১৮৩২। আদর করে জর্জ বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘আর্কেডিয়া’, কারণ ভারতের ‘দ্য গ্রেট আর্ক’ মাপা হচ্ছে যে।
সেই রবার্ট কোলব্রুকের সহকারী উইলিয়ম ওয়েব কিন্তু তখনও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় হিমালয়ের ছানবিন চালিয়ে যাচ্ছেন, পরে তাঁর সঙ্গী হলেন ক্যাপটেন জন হজসন। ১৮১৪-৪৫-এর নেপাল-যুদ্ধ জিতে গাড়োয়াল-কুমায়ুঁ তখন ইংরেজ কোম্পানির হস্তগত হয়েছে কিনা — কাজটা সুবিধের হল। ‘ট্রিগোনোমেট্রিকাল সার্ভে’-র বাইরে হলেও ওয়েব-হজসনের নিরন্তর প্রচেষ্টা বিনা হিমালয়ের নতুন নতুন শৃঙ্গ আবিষ্কার অধুরা থেকে যেত।
ওয়েব-হজসনের সঙ্গে আরও ছিলেন জেমস হার্বার্ট, ১৮১৯-এ যিনি প্রথম হিমালয়ের বেসলাইন মাপেন। ‘পিক ১৫’ নামে হিমালয়ের উচ্চতম শৃঙ্গ পরিমাপের প্রয়াস তখন চলেছে। কিন্তু রাধানাথের ক্যালকুলেশন ছাড়া ‘পিক ১৫’-র সর্বোচ্চতার নিরঙ্কুশ প্রমাণ অসম্ভব ছিল। যদিও ওয়ান ফাইন মর্নিং অধিকর্তা এন্ড্রু ওয়ের ঘরে লাফ মেরে ঢুকে রাধানাথ ‘স্যর, আমি বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আবিষ্কার করে ফেলেছি’-বলে যে গল্পটা চালু আছে, সেটা গপ্পই। কারণ, ১৮৫১-এ মি. ওয় তখন দেহ্রাদুন হেড-কোয়ার্টার্সে আর রাধানাথ কলকাতায়। তাছাড়া, রাধানাথ ছিলেন সার্ভের বহু কমপ্যুটারের একজন এবং এই রাজসূয় যজ্ঞের অন্যতম এক পুরোহিত মাত্র। যদিও প্রধান এক পুরোহিত তিনি। এভারেস্টের মত কড়া বস্-ও রাধানাথের তারিফ করতেন এবং একবার যখন উনি সার্ভের কাজ ছেড়ে বাঁধা-মাইনের সরকারি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকুরিতে যোগ দিতে চান, ছাড়েননি তাকে। হ্যাঁ, আরেকটা মজার তথ্য হচ্ছে, হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আবিষ্কার নিয়ে মাতামাতি চলছে — এ’খবরকে আমলই দেননি এভারেস্ট। উনি তখন ভাবছেন তিব্বত-চিন-সাইবেরিয়া মাড়িয়ে উত্তরমেরুর গায়ে রাশিয়ান নোভা-জেমব্লা দ্বীপ পর্যন্ত ‘দ গ্রেট আর্ক’-কে টেনে নিয়ে যেতে পারলে কেমন হয়? এই না হলে অতিমানব, অনন্য-সাধারণ?! একটা শৃঙ্গ, সেটা সর্বোচ্চ কিনা, সেটা যাচাই করাটা এভারেস্টের কাছে অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হয়েছিল, যেমন পরে মনে হয়েছিল নিজের নাইটহুড পাওয়াটাকে (১৮৬১)। শেষাবধি, ১৮৫৬-তে শৃঙ্গের নামখানি যখন বিশ্বমান্যতা পেল তদ্দিনে জর্জ এভারেস্ট পেনশন নিয়ে ঘরে বসে গেছেন, পঞ্চান্ন বছর বয়সে বিয়ে করেছেন সাতাশ বছরের এমা উইং-কে ও ছয়টি সন্তানের জনক হয়ে তাদের শেখাচ্ছেন ধর্মকর্ম এবং লগারিদম, পাশাপাশিই। লন্ডনে তাঁর পড়শি ও বন্ধু তখন ডেভিড লিভিংস্টোন ও মাইকেল ফ্যারাডে। ধর্মবিশ্বাসে এভারেস্ট ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন, অস্কার ওয়াইল্ড বা কামাল আতাতুর্কের মত একজন ফ্রিম্যাসন — খৃস্টের ক্রুশ নয়, কম্পাস ও স্কেল যে-ধর্মের চিহ্ন।
১৮৬৬-তে লন্ডনে মহাপ্রয়াণ, ৭৬ বছর বয়সে।
আশ্চর্য নয় তাই, যে শৃঙ্গটির নামকরণকালে এই শব্দাবলী গ্রথিত হল: “শৃঙ্গটির নাম জর্জ এভরেস্টের নামেই দেওয়া যায় কারণ আমাদের সকলের মধ্যে তিনিই নক্ষত্রের আরেকটু কাছাকাছি থাকার যোগ্য”! সারাজীবন রেস্টলেস থেকে প্রয়াণে এভারেস্ট (চিরস্থির) হয়ে আছেন সেই মানুষটি।
পুনঃ — বইটিতে একটি বড় প্রমাদ চোখে পড়েছে: জর্জ এভারেস্টকে ‘ইংলিশ’ বলে চালানো হয়েছে। উনি কিন্তু জাতে ‘ওয়েলশ্’ ছিলেন। বৃটিশদের জাত্যাভিমান এমনই যে, উদা. কোনও আইরিশকে ইংলিশ বললে আজকের দিনেও হয়ত সে ডুয়েলে আহ্বান জানিয়ে বসতে পারে। পরশুরামের ‘উলটপুরাণ’ স্মরণ করুন।
ভাল লাগলো। ভবভূতি ভট্টাচার্যের লেখার প্রসাদগুণ, তথ্য সমাবেশ ইত্যাদি নিয়ে আমি কিছু বললে সে সূরজ কো দীয়া দিখানা হবে।
কিন্তু বিধাতার যে নির্দয় আঘাতগুলি ভারতকে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে, সেগুলির তাৎক্ষণিক বেদনা ছাপিয়ে, তাদের সূদূরপ্রসারী প্রভাবের যথাযথ মূল্যায়ন… এই ইতিহাস সচেতনতাকে কুর্ণিশ।
এরকম আঘাত হয়তো আরো আসবে, তবেই আমার দেশ “সেই স্বর্গে” একদিন জাগরিত হবে, এই আশাবাদে আবার আস্থা রাখলুম এই লেখার ভরসায়।