জলকে চল… জলকে চল…

সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

এই সব সময়ে রাত ওই চুপি চুপি ছোটবেলায় ভিডিও হলে দেখা রাগী অমিতাভ্-এর মাথার থেকেও অনেক অনেক বেশি লম্বা। অযত্নের নোনা ছাপ লাগা জানলার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল জড়োসড়ো আকাশের ওম ধরে রাখতে গিয়ে কোঁচড় ভরে নেওয়া মহাজাগতিক জ্যোতিপুঞ্জ। জরাজীর্ণ দরজায় ছালে ঘসটা খেয়েও ছিঁড়ছিল না নাছোড়বান্দা শীতের ঠান্ডা একটা পর্দা, শুধু বারবার নদীর থেকে বয়ে আসা একটা কান্নার ভারি ঢেউ ঝাপটাচ্ছিল ওর দাওয়া জুড়ে।

সেই গোঙানির থেকে অল্প দূরে, রাতের বুকে একটা আগুন জ্বেলেছিল লক্ষ্মী। সেই কুণ্ডলী ঘিরে আগুনের তাতে গলে গলে যাচ্ছিল শীতের শক্ত চোয়াল। কড়াইয়ের বুকে তখন ভালোবাসা মেখে ঘুরপাক খাচ্ছে নৈশভোজ। আর তার চারপাশে গোল্লা হয়ে বসে আছে গুল্লি আর ছোটকু। লালচে আলোয় ভারি স্তিমিত উজ্বল সেই দুটো মুখ।

আর সেই উত্তাপ থেকে একটু দূরে সন্তপর্ণে জবুথবু হয়ে নিজের মধ্যে গুটিয়ে বসে আছে শীতল। এই নিয়ে তিন দিন মধু নিতে বেরোয়নি নৌকো নিয়ে, দাওয়ায় বসে সোঁদর গাছের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বিড়িতে বড় বড় চিন্তার টান দিচ্ছে সে এখন। সেই তিক্ত কটু গন্ধে বাতাসের শ্বাসও বন্ধ হয়ে আসছে। খুব মৃদুস্বরে, যা কেবলমাত্র দম্পতিরাই শুনতে পায় এমন ভাবে লক্ষ্মী ডাকে, ‘খেতে দিব এখুনুই। খুব খিদে পেয়েসে?’

শীতল অদ্ভুতভাবে মাথা নাড়ে বা নাড়ার চেষ্টা করে, বিগত তিন দিন ধরে লক্ষ্মীর বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তরেই সে এরকম করে আসছে। বাইরে বেরোনোর নাম নেই, এমনকি সামনের মোড়ে বটগাছের গোড়া বাঁধিয়ে যে আড্ডা মারার জায়গা সেখানেও যাবার চেষ্টা করেনি একটা দিন। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছে, কেউ যদি কানটা বিড়ির গন্ধ সহ্য করেও তার মুখের কাছে আনে, শুনতে পাবে কামাল কামাল।

লোকটা না বেরোলে কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকে লক্ষ্মী, যে কটা মৌয়ালদের নৌকো বেরোয়, প্রায় মাসেই একজন না একজন ফিরে আসে না। শেষবার গেল কামাল, শীতলের জিগরি দোস্ত। তারপর থেকেই থম মেরে গেছে মানুষটা। সবাই এক লাইনেই চলছিল, এর মধ্যে কখন এসে, মামা শিকার তুলে নিয়ে গেছে, বাঁদররাও টের পায়নি গাছে বসে। তিনদিন বাদে পড়ে ছিল একটু চাঁদির হাড় আর গোড়ালির ভুক্তাবশেষ। তাই তুলে এনে গোর দেবার ব্যবস্থা হয়। এখনও সেই পথে গেলে চোখে পড়বে সাদা কাপড় মুড়িয়ে রাখা জায়গাটা, নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে যেখান থেকে বাঘে তুলে নিয়ে গেছিল। একটা কাফনের মতো হাহুতাশ বুকে পত পত করে উড়ছে সেটা।

পাড়ার লোকে বলত নামেও শীতল, কামেও শীতল। কিন্তু, ও না বেরোলে ঘর চলবে কেমন করে ও জানে না। এই সময় শহর থেকে টুরিস পার্টি আসে লঞ্চ বোঝাই হয়ে। ওকে ঝন্টুবাবু বলে গেছিল ওর লঞ্চে ফাইফরমাস খাটার জন্য। খাওয়া দাওয়া, সাথে নগদ ২০০ টাকা দিনে। কিন্তু শীতলের নড়নচড়ন নেই। বাওয়ালীর কাজ শুরু হবে এসময়, কিন্তু সেখানেও যাবে না শীতল।

মাঝখানে একদিন বলল ফেনা জমিয়ে চুন জমানোর কাজ করবে। কিন্তু জোংড়াখুটাদের মতো ওই কাজে ওর বিশেষ জ্ঞানগম্যি নেই, তাই পয়সা বিশেষ কিছুই আসবে না, বলে সেখানেও গেল না।

কামালের দেহটা যে লোকটার মাথার ভিতর গেড়ে বসে যাচ্ছে ক্রমশ তা ভালোই বুঝতে পারছে লক্ষ্মী।

রান্না করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল বারবার লক্ষ্মী। বারুইপুর থেকে সাতদিনের জন্য তার বাড়িতে এসেছিল বোন সরো। তার বর ব্যবসার কাজে শিলিগুড়ি গেছে দিন পাঁচেকের জন্য। সেই সুযোগে দিদির বাড়িতে নিজের সুখ দুঃখের সাতকাহন বুনতে এসেছে নিজের দস্যিটাকে নিয়ে। দুঃখের নকশি কাঁথা তো নয় খুশিতেই আছে বোন, তা তার ফোলা ফোলা মুখ দেখেই আন্দাজ পাওয়া যায়। এই মেয়েটার সাথে বছর পাঁচেক আগে, লাল কাপড় জড়ানো কান্নায় চোখ মুখ ফোলা বরের নৌকায় উঠে যাওয়া সিড়িঙ্গি মেয়েটাকে আর মেলাতে পারে না লক্ষ্মী। কিন্তু যাই হোক, বোনের এত সুখ দেখে নিজের বুক চিনচিন করে ওঠে না বললে বনবিবি রাগ করবেন। তবু, সে হিংসে করে না নিজের বোনকে, ছোটবেলা থেকে দুই পিঠোপিঠি বোন যে দস্যিপনা করে এসেছে, আজ তার খুশিতে নিজেকে আহত করার মতো গরীব নয় সে। শুধু প্রতিবার যতক্ষণ না শীতল নৌকা থেকে ফিরে দেখ বউ কী এনেছি বলে বাইরের বেড়ায় নিজের বিড়িগন্ধ হাত না রাখে নোনা ভয় কুরে খায় ওর সংসার ছাউনি, বুকের খোঁদল। এই নিয়ে রোজ বেঁচে থাকা, খুব ক্লান্তির তবুও নেশার। তাও নিজের সোয়ামির জন্য একবার সুযোগ মতো বলতে হবে বোনকে যদি দোকানে একটা চাকরি দিতে পারে।

দুদিন পরে দুই জনে আশ মিটিয়ে চান করছে পুকুরে, মাছরাঙ্গার হট্টগোল ছাড়া আওয়াজ নেই বিশেষ কোথাও। সবজে জলে চিত সাঁতারে আকাশ দেখছিল, এমন সময় ওর মুখে জল ছিটিয়ে নাকে মুখে জল ঢুকিয়ে দিল শয়তান বোন। তবে রে, বলে ওকে ডুবকি খাওয়াবে, এমন সময় ওর নজর পড়ল সরোর পায়ের আঙ্গুলের দিকে, কী সুন্দর একটা সাপ যেন পায়ের মাঝ আঙুলকে জড়িয়ে ধরে লাল পাথুরে চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই। ওম্মা কী সুন্দর রে এটা! বলে অবাক হয়ে গেল লক্ষ্মী। লাজুক হাসি হেসে বোন বলল এটা ও দিয়েছে রে এনে। বলেছে পায়ের আঙুল সুন্দর হলে রাতে ওর খুব সোহাগ করতে ইচ্ছে করে। দেখে আর চোখ ফেরাতে পারে না লক্ষ্মী, ও জিনিসের দাম নিশ্চয় প্রচুর। শেষমেশ লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলে দামটা কত রে?

বোন ও ততটাই লজ্জায় মাথা নামিয়ে দামটা বলে। খুব দ্রুত হিসেব করে ফেলে লক্ষ্মী, আগের তিনমাসে মোটামুটি যত টাকা তাদের সংসার খরচে গেছে তার প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু, বাজারে নেহাত একটা ইমিটেশন কি গড়াতে পারবে না এরকম দুটো। একটু পয়সা যদি জমাতে পারে শুধু।

কার কীসে কখন মন লাগে কেউই কি বলতে পারে, পোশাকহীন পাগলি খালি পুঁটলি শিকল আঁকড়ে উবুড় হয়ে ভ্রূণভঙ্গি নিয়ে পড়ে থাকে গাছতলায়। আর তার হল এই পায়ের আংটির শখ।

বোন চলে গেছে প্রায় পাঁচদিন হল, বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার। পুঁচকেটার দৌড়াদৌড়ি আর অবাধ্যতার দাগ বাড়ি থেকে ঝাপসা হয়নি এখনও। আর স্পষ্টতর হয়ে আছে তার চোখের সামনে খেলা করে বেড়ানো সাপমুখ আঙটি।

পয়সার কথা ভাবতেই আবার চোখ পড়ল শীতলের দিকে, মানুষটা এমনিতে এত ভালো। মারধর করে না ওই গীতার বাপের মতো, এক বিড়ি আর মাঝেমধ্যে দলে পড়ে অল্পবিস্তর গাঁজা ছাড়া অন্য নেশাও নেই তেমন। সে বিয়ে করে খুশিই আছে বলতে হবে এই বারো বছরের সংসারে। কিন্তু, পয়সাকড়ির ভাঁড়ার শূন্যই প্রায়। ওকে বলে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই, নিজের শখের এই একটা টুকরো সে নিজেই ব্যবস্থা করবে যেমন করে হোক।

আলপনার মার কাছ থেকে একটা ভালো খবর পেয়েছে সে, পুকুরে বাসন ধোবার সময়। মাঝেমধ্যেই বাজারের হাল হকিকত জানতে এদিক সেদিক গল্প জমায় লক্ষ্মী। তার সেই প্রচেষ্টা বৃথা যায় না, আলপনার মা গোপন খবর ভাঙে। সম্প্রতি শহরে কাজ পেয়েছে সে, ঘণ্টা প্রতি টাকা। তাই ঔদার্য নিয়েই সে জানায়, বাগদার মীনের দাম বেড়েছে হঠাৎ। উত্তরের মিলে ঠিকঠাক যোগান দিতে পারলে ভালো পয়সা। লক্ষ্মী জানে ওখান থেকে বড় বড় ভেরি হয়ে তারা সাগর পার করে ফুটে উঠবে অন্য কারও খাবার টেবিলে। এও নিশ্চিন্ত হয় যে ঠিকাদার আলপনার মায়ের পরিচিত, ঠকাবে না। নদীতে ভোর ভোর গেলে সবথেকে সুবিধে, এর পর মীনগুলো আরও গভীরে চলে যায়। হিসেব করে নিয়েছে সে, ভাগ্য ভালো থাকলে আজকে হাতে দুটো পয়সা আসবে। মনে মনে বনবিবিকে দুটো মোরগ উত্সর্গ করে সে।

রাত যেন কাটছেই না, রাতে গুল্লিকে বলে দিয়েছে সকালবেলা ভাইকে দেখে রাখতে জলের ধারে যেন না যায়। আর বাপকেও দেখে শুনে রাখতে, শীতলকে না বলেই যাবে সে। কিছুতেই বউকে জলের ধারে যেতে দেয় না শীতল। সাধে কি ওর বন্ধুরা আড়ালে ওকে মাগখ্যাপা বলে ডাকে! শুধু রান্নাঘরে তেলকালিমাখা শূন্যগর্ভ বাসনকোসনগুলো কিরম খালি চোখে তাকিয়ে দেখে চারপাশ।

তারপর যাত্রা শুরু হয় তার। দূরের থেকে পাখিদের জেগে ওঠার আওয়াজ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাতাসে জাড় ভাঙেনি, শনশনে সংশয়ী হাওয়ার তীর তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে চায়। আর চটচটে কাদা মাটিতে লক্ষ্মীর ব্যাকুল পায়ের ছাপ আঁকা হতে থাকে, পরপর। ধারালো শূলো সুযোগমতো রক্তের আলতা পরায় চামড়াকে। দূরে ধূসর তটরেখা থেকে ডাক আসে, সখী জলকে চল, জলকে চল।

হাতজালি ছিঁড়ে গেছে অনেকদিন আগেই, তাই নিজের কাপড়টা দিয়েই কাজ চালায় ও। কালো জলের ওপর ততক্ষণে সোনালী সর পড়ে, কনকনে বরফ জল তারই মাঝে নিজের মনে ঘূর্ণি কাটায় ব্যস্ত। ওই দূরে দু একটা লঞ্চের আনাগোনা শুরু হচ্ছে, হাতে টানা নৌকোগুলো কচ্ছপের মতো উল্টে রয়েছে আশেপাশে। মাথার ওপর চাঁদ মীনের মতো চকচক করছে ধীরে ধীরে আকাশের ইস্পাতে মিশে যাবার অপেক্ষায়। নৌকার পাটাতনে রাখা জ্যালজেলে বস্তার মতো কুয়াশার আচ্ছাদন ফেঁড়ে লাল বল আস্তে আস্তে ভেসে উঠছে গরান ঝোপের মাথায়। জলে মিশে যাচ্ছে জল, বহমান সময়ের জল এ ঘাটের থেকে ও ঘাট হয়ে নদী থেকে সমুদ্রে মিশে যেতে চলেছে মহাকালের টানে। শুধু সে যেন ওই দূরে মাছের অপেক্ষায় লম্বা ঠোঁট পাখিগুলোর মতো দাঁড়িয়েই আছে, সেই কবে থেকে।

দূর দিয়ে একটা টুরিস ভর্তি লঞ্চ থেকে ঘুম ভাঙার উল্লাস চিত্কার ভেসে ওঠে, একটু দূরে শুধুই জলের রাজ্যপাট যেখানে সেখানে জলের এমন সময় তিন রং। বাইরের লোকেদের ভালো লাগারই কথা। ইস, বোকা সোয়ামিটা যদি এসময় লঞ্চের কাজটা নিত! লক্ষ্মী বিক্ষুব্ধ মন সরিয়ে আনে জলের বিন্দুতে।

প্রথম খেপে মন্দ ওঠেনি মীন। তার চোখের সামনে সাপের চোখ দুটো আবার চকচক করে উঠল। সামনের মেলাতেই আংটিটা কিনবে লক্ষ্মী, মেয়ের জন্যেও একটা কিনবে। ছেলেটার জন্য কী নেওয়া যায়, কী নেওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই পরের খেপটা ফেলল জলে। জলের অভিঘাতে কুচি কুচি হয়ে কেটে যাচ্ছে ঘোলা জল, ঠান্ডায় পাটা যেন অসাড় হয়ে আসছে। আরও যেন ফর্সা লাগছে পাটা, ইস এই মাঝ আঙ্গুলে একটা পাথর বসানো আংটি কী সোন্দর লাগবে। মনে হয় চারিদিক থেকে আলোর আংটিরা জল ঘিরে নাচতে থাকে, তার আঙুলের স্পর্শ নিয়ে। জল বাড়ছে এবার অল্প অল্প। একটু নজর আর ভাগ্য ভালো থাকলে দু একটা ভাঙান বা খল্লা মাছ যদি পাওয়া যায় তাহলে খুশির উপরি, বেশ কয়েকদিন হল মাছ জোটেনি বাড়িতে।

এমন সময় পায়ে একটা ছোট্ট ধাক্কা মতন লাগল তার। পায়ের কাছ থেকে নড়াচড়ায় ছিটকে গেল দু একটা কালো মাছ, পাঙ্গাস নাকি ঠিক ঠাহর হয় না ঘোলা জলে। পাটা কেমন সুড়সুড় করছে যেন। অল্প জলের ওপরে তুলতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারল লক্ষ্মী। মাঝের দুটো আঙুলের জায়গা, অর্থাৎ সেখানে আঙুল থাকা উচিত ছিল বটে তবে এখন আর নেই। সেই জায়গা থেকে, আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে রক্তের লালচে ধারা আর আংটির মতো পাকিয়ে যাচ্ছে পাশের আঙুলে।

আর নিজেদের স্বভাবসিদ্ধ ক্ষিপ্র ঝটিকা আক্রমণের পর ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে তখন কামটগুলো, স্বপ্ন সীমা ছেড়ে আর একটু দূরে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...