বল্লরী সেন
কবিতার মুহূর্ত হয় না৷ মুখের ভাষার লজ্জাবস্ত্র ফেলে যেই তার দিক ভুল হয়, যতটা যাওয়ার পর মালুম হয়, সবটাই মিথ্যা, দীর্ঘ গুমরানো দ্বিতীয় তৃতীয়, প্রহরের হুঁশিয়ারি শোনেনি কখনও৷ থৈ থৈ কষ্টের ওপর কসাই হয়ে তাকে লিখতে হয়৷ এ পর্যায়ে আমাদের আলোচ্য সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গের কবি ও কবিতা৷
হাতে-গোনা নোঙরের সাহায্যে জাহাজ বাঁধেন পৃথ্বী বসু। ‘দশমিক’ পত্রিকায় সম্পাদনা করে চলেছেন বিগত চার বছর ধরে। নিজের কবিতাই নয়, অন্য বই ছাপার স্বপ্ন নিয়ে তৈরি হয়েছে দশমিক প্রকাশনাও। ২০০৫-এ প্রকাশিত অনির্বাণ দাশের ‘এসো’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোল দশমিক থেকে ২০১৭ সালের বইমেলায়। ছাত্রের তকমা ঘুচিয়ে আরও ছোট বয়স থেকেই পত্রিকা সম্পাদনার বিচিত্র সম্ভারে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। আর কবিতা? তাঁর লেখা এক আদ্যন্ত অসুখের মায়া। পড়তে বসলে মনে হয়, হোক, তবু অসুখ যেন না শেষ হয়। আর্বানিটির পরে যতদূর আমরা পৃষ্ঠাগুলির মধ্যে, অক্ষরের রাজত্বের মধ্যে বাস্তবকে টুকরো করে অন্য নির্মাণে যেতে পারি — পৃথ্বী তাঁর পাঠকের টেবিলে রোজনামচা বদলে দিতে জানেন। জানা রাস্তা, তাও মনে হবে কখনও আসিনি, বা হয়ত দেখিনি ভালো করে। জলেরও অন্য ব্যাধি আছে। পাশের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা কালো মেঘের বুনোট, বৃষ্টির সম্ভাবনা সত্ত্বেও ফিরে যাচ্ছে। শব্দকে অসম্ভব কমিয়ে এনে ছাঁকতে ছাঁকতে যেন সব-ই গলে বেরিয়ে গেল তলায়। তাই বহুপঠনে বহুবিধ আপ্যায়ন থাকে কবিতায়। কবির বক্তব্যের সারল্যে তাঁর শব্দার্থের প্রচলিত বিন্যাস একটু করে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে পাঠকের কাছে শুধু এক রশ্মি পৌঁছে যায়। শব্দের বিপরীতে, অন্য পিঠে কবিতাটি প্রকৃত নির্মিতি পায়, তখন ক্রমে লাইনের পর লাইন কবি বাচ্যার্থকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। ধীর পায়ে অলংকার বা অন্ত্যমিল ছাপিয়ে বালির ভিতর থেকে কবি বার করে আনেন প্রতিমা।
‘‘আমার সমস্ত রাগ বাষ্প হয়ে উড়ে যায় মেঘে/সেই মেঘ কোনদিন দূত নয়, দূতী নয় স্থানু/নিজের তাগিদে যদি ছুঁয়ে আলো পাহাড়ের কোলে/রাগ নয়, রাগ নয়, আসলে তা সারল্য জলের’’ — স্বীকারোক্তিমূলক বাংলা কবিতায়, কাব্যভাষা নিঃশব্দে প্রাকৃতিক বৃত্তিগুলি আয়ত্ত করে নিয়েছে। তারুণ্যের স্পর্ধার বদলে এই গভীর বাউল স্বভাব তাঁকে অনেকের থেকে আলাদা করে রেখেছে। ‘এইমতো দেখা হওয়া ভালো’, খইয়ের ভিতরে ওড়ে শোক’ ‘বারান্দায় রোদ নেই আর’ কবিতাগুলির সাথে কিছুতেই রফা হয় না আমাদের। ‘বোধের শ্মশানে তুমি পড়ে থাকা চেতনার হাড়’ বলামাত্র ‘তুমি’কে বাইরে কোথাও খুঁজতে হয় না। বোঝা যায় সে আর কেউ নয়, পুরাতনী গানের সমীপে ভেসে-আসা আমারই কেউ, যাকে বুকের ভিতর কখনও উঁকি মারতে দেখে ফেলি। কবিতার অন্তিমে আবার প্রথমে ফিরিয়ে দেন কবি — সঙ্গে সঙ্গে এ পর্বের লেখাতে শুরু বা শেষ থাকে না, আদ্যন্ত একটি তেজস্ক্রিয় দাবানলে সব পুড়িয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে প্রথম ছত্রে শব্দার্থ শেষ হয়ে নিভে থাকে। তখন প্রত্যেক পাঠকই আগুনমাফিক, প্রত্যেক ইন্দ্রিয় সমিধসদৃশ। আভ্যন্তরীণ বিশ্রম্ভালাপে কবি এক অন্তহীন ভূগোলের দিক খুঁজে দেন, যা সারাজীবনে হয়তো কোনওদিন পাবার কথা নয়। ‘পিপাসার্ত’ কবিতায় -–
আমায় কবিতা ছোঁয়, আমাকে পাথর করে রাখে
তারপর তুমি ছুঁলে, পাথরের মাঝখানের জল
তোমার শরীরে আমি জল হয়ে ঢুকে পড়ি, নদী —
তখন কবিতা ছুঁলে, নদী বানভাসি, জল বাড়ে…
দশম সংখ্যা মাস্তুল, নাম হয়েছে ‘দুর্গা’। “ঋতু ও রাগের কথা মাথায় রেখে এই সংখ্যার নাম দেওয়া হল দুর্গা।” বলেছেন সম্পাদক। আকাশ গঙ্গোপাধ্যায় এ পর্বে গদ্যপদ্য ছাড়াও অনুবাদ, গল্প, উপন্যাস প্রকাশ করেছেন।
পত্রিকা সম্পাদনা, প্রকাশনা ও নিজের লেখালেখির ব্যস্ততায় আড়াল খোঁজেন আরেকজন। আকাশ গঙ্গোপাধ্যায় মশাই। ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ২০১৪। নিজের লেখালেখির শুরু ২০১২ থেকে। একটি বই ও দুটি পুস্তিকার দখল নিয়ে অবিরত নতুন কবিকে সনাক্ত করতে উত্সুক আকাশের কবিতা সম্বন্ধে দু চার কথা বলা দরকার। আখ্যান না থাকার গল্প আছে তাঁর কলমে, যা প্রতি স্তবকে ভেঙে যাচ্ছে। সদা ক্রিয়াশীল একটি স্পন্দন, ঈষৎ অপাঙক্তেয় মনে হলেও শব্দকেই আঁচড়ে চলেছে ভেতরে। ক্রমান্বয়ী দৃশ্যসংযোজনার পর, আকস্মিক শেষ লাইনে এসে তিনি দুম করে মুখ ফিরিয়ে নেন। সেই মুহূর্তটিই কবিতার এক বিস্তার রেখার উল্টোপথে নতুন করে লেখাটিকে পড়তে শেখায় — ‘একটা দুটো উদ্বেগী ঢেউ ভাঙল পায়ের কাছে,/বারান্দারও চারটে কোণা অন্য কিছু বলে।/আঠায় মোড়া আয়না জানে কালকে রাতের কথা,/কে ধুয়েছে রক্ত ফোঁটা তাদের চোখের জলে।’ সেইভাবেই পুরনো পত্রিকার আদল ছাড়িয়ে, তৈরি হল ‘মাস্তুল’। নিজেদের মতো প্রকাশনার আদ্যক্ষর শেখা ও বন্ধুরা মিলে এমন একটি কাজে নেমে পড়ার সঙ্গেই তাঁর নিজের লেখাও সূচনা ২০১৩ ‘কবি সন্মেলন’-এ। দশম সংখ্যাটিতে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস, অপ্রকাশিত কবিতার বই, পাঠপ্রতিক্রিয়া, ইতিহাসকেন্দ্রিক গদ্য, কবিতার সমালোচনা ও কবিতা তো আছেই। এ ছাড়া অনুবাদ, অন্য গদ্য, গদ্য ও গল্পও সাজিয়ে নিয়েছে ‘মাস্তুল’।
এবার এসে পড়লাম ‘সদর স্ট্রিটের বারান্দা’য়। প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় তেরোজন কবির কবিতার অনুবাদ নিয়ে ভরে উঠেছে পৃষ্ঠাগুলি। সম্পাদক ঈশানী বসাক। শেষ মলাটে লেখা আছে ‘বারান্দা যেখানে শেষ সেখানে শুরু হয় রাস্তা। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বদলে যায় পাড়া। প্রত্যেক পাড়ার আলাদা আলাদা গন্ধ। আলাদা আলাদা পৃথিবী। আপনি দেখেন নতুন পাড়া, নিজের মনে অনুবাদ করেন তার পরিচয়।’ কবিদের ছোট একটি কবিপরিচয় আছে শুরুতেই, বাঁ হাতে রইল সূচি। মীরা চক্রবর্তী, মৌলিনাথ বিশ্বাস, দেবব্রত কর বিশ্বাস, দোলনচাঁপা চক্রবর্তী, শুভঙ্কর দাশ, মিতুল দত্ত, পার্থপ্রতিম ঘোষ, ভবঘুরে এবং ঈশানী নিজে অনুবাদ করেছেন। ভারতীয় কবিতার এক ঝলক এই মানচিত্রে ধরা দিয়েছে। অরুণ বালকৃষ্ণ কোলাতকরের ‘একজন বৃদ্ধ ভিখারী’ কবিতায় –
তোমার অস্বস্তি হচ্ছে এবার, আকাশ দেখছ তুমি
দেখছ বুলেট বাঁধা গর্তের
মতো অন্ধকার তার চোখ
দেখছ তার চামড়ার বলিরেখা
কেমন ফাটল চিহ্নের মতো
ছড়িয়েছে সারা শরীরে…
কিংবা চিনু মোদী যখন বলেন — ‘তুমি নিছক ছুঁয়ে দিলেও/আমার অনুভূতিরা সব অবশ হয়ে যায়’ — নতুন এক ভারতবর্ষকে দেখে বিস্ময় জাগে আমাদের।
শুভদীপ চক্রবর্তীর ‘ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া সব ঢেউগুলো’ জল ও গতিকেন্দ্রিকতাকে প্রশ্ন করেছে। কবিতা সাজানোর বিন্যাসে বোঝা যায় ‘জলযান ভেঙে যাবার পরেও/কোষে কোষে শিকড় ছড়িয়ে যায়/কোনও কোনও যাত্রীর।’ তাই ‘৪’ কবিতার পরেই আসে — ‘ফুটপাথ, সে তো ক্রমেই লম্বা হয়ে যাচ্ছে!’ ডাঙ্গা ও জল, রিক্সা ও জাহাজ, নীল চিঠি বনাম নীল সমুদ্র, তরঙ্গ ও সমবেত মস্তিষ্কযাত্রার এই বহুমাত্রিক চলা কবির এ পর্বের পুস্তিকার মূল ধরন। কিন্তু এর পরেও পরীদের নেমে আসার গল্প কোথাও কি সত্য? ‘রাতের ট্রেন চলে যায় সব পরীদের নিয়ে–’।
সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘তরুণ কবির স্পর্ধা’ পর্বের আর একটি কবিতাবই ‘যেটুকু পাতার শব্দ’। লেখক অরিন্দম ভূঞ্যা। ছাব্বিশটি কবিতার সংযোজনে পুস্তিকা বিন্যস্ত করা হয়েছে। ‘পদযুগল’ শিরোনামের প্রথম লেখাটির অংশ —
আমাদের কাদামাটির হৃদয়, নীচু খড়ের চাল, ঝিরঝিরে
এক পশলা বৃষ্টি, এসব সে নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছে
দু-হাতে নটে শাকের বীজ, বারোজনের হেঁসেল, আমরা অবাক হইনি
গাভীর মতো শান্ত দুটি হাত, নিঃশব্দে ভরে দিয়েছে
আমাদের পেয়ালা, তৃপ্ত হয়েছি আমরা জানতেও চাইনি
তার উপবাস, মঙ্গল কামনার ফুল সে কীভাবে
সুউচ্চ প্রশাখা থেকে চয়ন করলএ সংসার তার কিছুই জানে না।
চিত্রকল্পে, খুদে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে হেঁসেলের ভিতরে ডুবে থাকা মানুষের রসনার তরঙ্গ তাঁর কবিতায় যেভাবে অর্থনৈতিক অনটনকেও একটি রেখাচিত্রে প্রতিস্থাপন করেছে — তা কবিতার অন্য অন্য রকম পাঠ তৈরি করে, কবির দৃশ্যসজ্জার অভিনবত্ব ভাষার নতুন উঠোন খুলে দেয়, ছত্র নির্মাণ করে শব্দকে মুছে ফেলে কবি কেবল আলোর বিন্দুগুলিকে মুছে দিতে পারেন। দৃশ্যকে ব্যক্তিগত দৃষ্টিপাতে ভিন্নমাত্রিক স্তরে তুলে ধরা কবির একটি বিশেষ ক্ষমতা। ‘অন্ধকার বিষয়ক’ কবিতাটি এরকম —
নিভিয়ে দাও
সন্ধ্যার মুখাগ্নি করা শেষ প্রদীপটিও…
গর্ভিনী চাঁদের রাত, ঈষৎ পুড়িয়ে যাক তোমাকে।
কী হবে জমিয়ে রেখে কাচের ভেতরে বিদ্যুৎ?
নিঃস্ব হয়ে ফিরে যাও জন্মের অতীত সংগম
সেই অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে দেখো–
ফুটে উঠেছে অসংখ্য আলোর ফুলদানি
সে আলোয় তুমি আর চাঁদ, দুজনে অদৃশ্য হয়ে যাবে….
জলজ পঙ্কের ঘন পাতার ভেতরে প্রতিটি শব্দ নিরন্তর জেগে থাকে। ফ্লুওরেসেন্ট আলোর ঠিকরানো ফুলকি নিয়ে কবির ভাষা ও রীতির আয়োজন। এর ঠিক পরে কবি লিখে ফেলেন সেই অমোঘ আত্মভোলা লাইনটি যা পড়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রাখতে হয়। শব্দকে নিঃশব্দ বয়ানে হাত নেড়ে ইশারায় কবি কি ডেকে নেন? কবিতার আগাগোড়া একটি মাত্র দীর্ঘ রাত্রির সিনেমাটোগ্রাফি। আর কথক যেন ক্রমশ অভিনেতা হয়ে যান। স্তানিস্লাভস্কি যেমন বলেন যে লেখকও লেখার মধ্যে প্রবেশ করে, অভিনয়ের একেকটি বৃত্তে নিজে জড়িয়ে পড়েন, তেমনি। ‘ফুল’ ‘ধান’ ‘পাখি’ ‘শহর থেকে ফিরছি’ কবিতাগুলির অন্তর্গত একটি সুদূর নিবিড়তা বহমান। প্রকৃতির নিজের হাতে গড়ে উঠেছে ছোট্ট গৃহস্থালি — যেমন ‘মত্স্যজীবী’ কবিতায় কবি বলেছেন — ‘সমুদ্র ডেকেছে এই বেলা–/চোখে তার ধূপগন্ধী বৃষ্টিবালিকার চুল ওড়ে।/এসময় বিপন্ন সাহসী/মাঝদরিয়ায়/ঘরে তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী/বালিশের অঙ্কদেশে মাথা রেখে কাঁদে।’
সুপ্রিয় মিত্রের গদ্যের ভেতর নস্টালজিয়ার নতুন এক শব্দময় কাকলিময় সুড়ঙ্গপথ আছে। স্মৃতির ব্যথিত আত্মপ্রকাশে তিনি কখনও দুপুরের ট্রেনের কথা বলেন, অনাথ জঙ্গলে ‘সবুজ পাতা’ বা ‘কমলা ফুলের গন্ধ’ হয়ে থাকার কথা বলেন — তখনও, দুটি ক্ষেত্রেই শব্দ ও স্তব্ধতার সংকেত থাকে। চোখে দেখা দৈনিক বাস্তবের মৌলিক ছবি দিয়ে তৈরি হয় তাঁর অন্তরের বিশ্বাস ও ভাবনার দুনিয়া। তাই তথাকথিত মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্টাল কবিতার নামাঙ্কন না করে, তাঁর কবিতার বইয়ের নাম হল: ‘ধরে নেওয়া যাক’ এবং ‘এসেছ জন্মপক্ষী দোহাই’। ‘কাকতাড়ুয়ার ঘুম পেয়েছে’ কবিতার শুরু এইভাবে; ‘যাকে খুন করার জন্য ভালোবাসাই যথেষ্ট’ তার কথা দিয়ে। ‘গাছ গায়ের গন্ধ বোঝে। স্থির বিশ্বাস। ছয় সাত মাস যাওয়ার পর থেকে, সামনে দিয়ে গেলে দেখতে লাগলাম, আশেপাশে তিলমাত্র হাওয়া নেই, কিন্তু ওই গাছটির পাতা নড়ছে।’ ২০১৭তে প্রকাশিত দ্বিতীয় বইটির উৎসর্গের পাতায় কবি বহুজন্মের প্রবাহের কথা বললেন। বলা যায়, তাঁর স্মৃতির আবীরে জন্মান্তরের ছাই মিশে থাকে। ‘মুঠোবদ্ধ হয়, জল পড়ে, কালি হয়,/লেখা হয়…/আবার সে ফিরে যায় উৎসর্গ পাতায়…।’ নীলকণ্ঠ প্রকাশন, ভদ্রকালী, হুগলি থেকে প্রকাশিত দুটি পুস্তিকার মলাটবন্দি অভিজ্ঞতা এইভাবে সময়কে নিজের আস্তিনে-পকেটে-জুতোর ফিতেয় গুটিয়ে এনেছে। তাই ‘ইহজন্ম পরজন্ম ভাগ করা চারমাথা মোড়’ পার হয়ে শহর তাঁকে কত রাস্তা, ‘কত গলির পেখমে’ ঘুরিয়ে মারে। নেশায় ফটোগ্রাফার, সাদাকালো ছবিতেই তিনি আলোতে অন্ধকার চিনে নিতে পারেন। কবির পরবর্তী বইয়ের জন্য শুভেচ্ছা।
সর্ভানু দাশগুপ্তের কবিতার বই বেরিয়েছে ২০১৭-তে। ‘ইংলিশ ক্যালেন্ডার আর লম্বা বারান্দা’। পিতৃবিয়োগ হয়েছে ২০১১ সালে, তার গহন শোকের প্রতিলিপি কবিকে সমস্ত ভাঙনের রং বদলে দেয়। হাসপাতালের গন্ধ, ডাক্তারখানা, ইথারের গন্ধ, যেন কবিতায় ঝাঁঝালো এক মিথ। ‘শবকথা’য় কবি বলেন —
পতাকা দিয়ে ঢেকে ফেলা হল নিথর দেহ
ও তোমার ভাই নয়, কে বলেছে ও তোমার ছেলে
গোধূলির নাম এখন ভয়, এর মধ্যেই ভুলে গেলে
কথনস্বরে বিষাদের বদলে আলুথালু ক্ষোভ ও সমসাময়িক হিংসার প্রতিবাদ। চতুর্দিকের হানাহানির মধ্যে তাই ‘এই শব, তোমাদের কেউ নয়!’ অথচ এই জিঘাংসার মধ্যে তিনি চমৎকার ফুল ফোটার শব্দ পান, ‘মায়ের চশমার কাচ দেখি, মেটাই সাইরেনের খিদে’ — মন্দির-হাসপাতাল সব মিলেমিশে যায় এভাবেই। এ বছর প্রকাশ পেল কবির দ্বিতীয় বই ‘অবসন্ন ক্রিসমাস’। কিন্তু প্রকৃত শুরু আরও আগে। ২০১৪ সালে প্রকাশ পেয়েছে ‘নূপুরিকা’। এটি তাঁর প্রথম স্বাক্ষর, প্রথম উচ্চারণ। কবি এ বইটিকে ভুলে যেতে চান, কিন্তু প্রবাহের এক অস্পষ্ট আগুনরেখা এক লহমা আমাদের জাগিয়ে তোলে — তা হল যেখানে, কবি নিজেকে চিনতে পারেন না। নিজেই তখন তিনি আলগা হয়ে ‘লাজুক আলোয় মাখা নক্সার জেদ’ দেখেন, চুপ করে চেয়ে থাকেন নিজের ধ্যানমগ্ন অন্য শরীরে।
প্রবেশপথের উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে
ধ্যানে উপবিষ্ট শঙ্খপুরুষ,
তবুও দাঁড়াই, চুপটি করে
অলংকারহীন স্নানের অবসরে,
নিজেকে অচেনা লাগে তোমার কাছে
দেখি লাজুক আলোয় মাখা নক্সার জেদ
শঙ্খপুরুষ মগ্ন ধ্যানে
স্নানাগারে প্রবেশ নিষেধ।–নূপুরিকা-৬
‘রাবণ’ প্রকাশ করেছেন দীপ্তপ্রকাশ চক্রবর্তীর ‘শীত তারা বিভূষিতা’। ‘চার’ গ্রীষ্মের কবিতায় হারিয়ে যাওয়া গতিধারা ফেরত পাওয়া যাচ্ছে। ‘ঢেউয়ের ফিরিয়ে-দেওয়া বাবার চটিজোড়া/ঢেউ লেগে আছে/বাবা সমুদ্রে/বাবা এখন বালিতে/বাবা এখন হ্রদের জন্মের কাছাকাছি…।’ বর্ণের বিচিত্র বিন্যাসে গ্রীষ্মের নদী আঁকেন, শ্মশান বা লোকালয় তখন বাতাসে মিলিয়ে যায়। সূচিপত্রে মোট চার ভাগে লেখাগুলি সজ্জিত। এর মধ্যে ‘সেলুন সিরিজ’টি অনবদ্য। কবি বলেন —
সব সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যেতে পারি এখুনি
না দ্বিধা, না তর্ক, না অভিমান
আর কেউ না জানুক তুমি জানো
ওই শ্রাবণমেঘে অঙ্কুশ আছে…
অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনারীতি কখনও এক বদলে যাওয়া বয়ানকে ডায়েরির মতো ধরে রাখে। নিজেকে খাক করে, নিজের পুরনো ক্ষতকে সেলাই করা ও না করতে পারার ভেতরে তার কলম দ্রুত এগোতে থাকে। ‘অকিঞ্চন’ সেইরকম একটি কবিতা। তবু তাঁকে বলতে হয় — ‘সেলাইয়ের দাগগুলোই/আমাদের আকাশ হতে দেয়নি।’ তাই সে বিপন্নতাকেই তিনি বলেন ‘মানুষ’। ‘মুখের গহ্বর থেকে,/যদি দেখো ঝাঁকেঝাঁকে/উঠে এল… উড়ে গেল পাখি…/জেনো সে আমারই শবদেহ।’
একটি বেনারসী সান্ধ্যবিভ্রম
অশক্ত শরীর একটা অজুহাত মাত্র। কাছে যাওয়ার। যে-কোনও শেকলকেই অস্বীকার করতে জানে, তাই এই রাস্তা তোমার টলমল পা থেকে অনায়াস শুষে নিতে পারছে দ্বিধা। আর তুমি তোমার আত্মীয়প্রবণতাকে দিচ্ছ বিদেশি ভাষার আবডাল। বুঝে ফেলছ, এই যে সমবেত কোলাহলে অষ্টপ্রহর ডুবে থাকা, এ আসলে সভ্যতার মতোই পুরনো এই শহরের বুকের অসহ নৈঃশব্দ্য লুকিয়ে রাখার এক ব্যথিত চেষ্টা। অবাক হচ্ছ না আর, যখন দেখছ, শহরটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা লাস্যময়ী বিপজ্জনক গলিগুলো দেখতে অবিকল তোমার অনিশ্চয়তার মতো। এমনকি, যা নিতান্তই তোমার স্বভাববিরুদ্ধ, নিঃশব্দে ক্ষমা করে দিচ্ছ সেইসব সিঁড়ির ধাপকে, যারা শুধুমাত্র বিচ্ছেদকেই দীর্ঘায়িত করতে শিখেছে।
এবং শেষমেশ পৌঁছে যাচ্ছ, কাছে। স্পর্শের তিলক এঁকে নিচ্ছ যাবতীয় শরীরী স্নেহস্থানে। মনে রাখতে চাইছ না যে তার পোশাকি নাম ‘নদী’। শুধু, ছুঁয়ে থাকতে থাকতে নবজন্ম বহতা হয়েছে তোমার।
কী আর এমন প্রাগৈতিহাসিক, বলো? তরঙ্গকে ‘মা’ বলে ডাকতেই তো শিখিয়েছিল সভ্যতা।
কবিতাটি অমর্ত্যর উৎকর্ষ চিনিয়ে দেয়। সম্পর্কের দ্বিখণ্ডিত বিপরীতমুখীনতা একটু করে ভেঙে যাচ্ছে, তাই কবিতাটি অন্ত্যমিল বর্জন করেছে। ছোট তীরের মতো বাক্য। কিন্তু সংলাপ, যা একক ও অপরজনের সক্রিয় উপস্থিতির চিহ্নসমেত একটির-পর-একটি তার সশব্দ এগিয়ে আসা যুগিয়ে দেয়। পূর্ণচ্ছেদ দেওয়ার পরেও কথা থাকে। অর্থাৎ কথা বলা একদিনের নয় — অনেক সপ্তাহ-মাস ধরে এভাবেই উত্তরহীন থেকেও এগোয়। অনিশ্চয় গতিচিহ্ন ধারণ করে কথক পাহাড়ের গায়ে কঠিন হলেও পা আঁকড়ে উঠবার চেষ্টা করেন। যেন তিনি কবি নন, কবি আর কেউ। সিঁড়ির ধাপের যে প্রসঙ্গ আনা হয়েছে, তা ভাবের দিকে যেমন, রূপের দিকেও তেমনি সক্রিয়। শেষ অংশে এসে কেবল কবি ভর করেন, ভাষা প্রমাদ গোনে তাঁর বদলে যাওয়া আপ্তমরণে। ‘এবং শেষমেশ পৌঁছে যাচ্ছ, কাছে। স্পর্শের তিলক এঁকে নিচ্ছ যাবতীয় শরীরী স্নেহস্থানে।’ অনুবেদনে এইখান থেকে আবার আমাদের চোখ চলে যায় কবিতাটির শুরুতে। দেখি নতুন কোনও শব্দ। পুরনো পদ যেন নতুন প্রাণের চিৎকারে এখন মুহূর্তলীন আবেশে আত্মহারা।
মনোগ্রাহী আলোচনা