সর্বজিৎ সরকার
আমরা ওরা নই। কিন্তু আমরা কারা? এই শুরু হল দ্বিখণ্ডিত হওয়ার প্রস্তুতি পর্ব। প্রথমে ‘ওরা’ বা ‘ওদের’কে শনাক্ত করা। তারপর ওদেরকে জরিপ করে নেওয়া। তারপর ওদের চারিত্রিক এবং ব্যবহারিক বৈশিষ্টকে আমাদের থেকে আলাদা করে দেখা। এবং শেষে এই অবস্থানে পৌঁছনো যে ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না’। অতএব, অস্বীকার করো। অবাধ্য হও। প্রতিরোধ করো। প্রশ্ন তোল, রুখে দাঁড়াও। স্পষ্ট করে বলো, আমি তোমাকে মানছি না।
তো এই যদি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার পূর্বশর্ত হয় তাহলে এখান থেকে দুটো দৃষ্টিকোণ পাচ্ছি। এক, আমরা, যারা প্রতিবাদের রাস্তায় যাচ্ছি, তারা মনে করছি আমরা ওই অপর-এর দ্বারা ভিকটিমাইজড, মানে আমরা সরাসরি তাদের হাতের ভিকটিম। অর্থাৎ, ওই ‘ওরা’ আমাদের থেকে বেশি ক্ষমতাবান এবং আমাদের স্বাধীন ভাবনা ও কাজকে ওরা নিয়ন্ত্রণ করে।
এবং দুই, আমরা, মনে করি চেতনাগতভাবে, বা আত্মশক্তির নিরিখে, আমরা ওদের থেকে সুপিরিয়র। উচ্চতর জীব। আমাদের ভাষা, শৈলী, প্রয়োগ, আমাদের লেখালিখির উপস্থাপনা, সবটাই ‘ওদের’ থেকে আলাদা। উন্নত।
এই একই সাথে নিজেকে ভিকটিম ভাবা এবং নিজেকে সুপিরিয়র ভাবার ফলে যুবা বয়সে আমদের অনেকেরই একটা স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল অ্যান্টি এস্ট্যাবলিসমেন্টের দিকে ঝুঁকে পড়া। সময়টা ছিল আশির দশক। ফলে তার আগের পঞ্চাশ, ষাট বা সত্তরের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস, নতুন ভাবনাকে গ্রহণ করবার আগ্রহ, পুরনোকে ভেঙে নতুন কিছু বলব, এই সব স্পর্ধার ঐতিহ্যের অবশিষ্ট, কিছুটা হলেও রয়ে গিয়েছিল। থাকাটা স্বাভাবিক ছিল। দরকারিও ছিল। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেই কারণেই হাংরি আন্দোলন, শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন, বা এরকম অনেকগুলি সাহিত্য আন্দোলনই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইতিহাস তাদেরকে অস্বীকার করতে পারবে না।
আমি যে সময়ে লিখতে আসি সেটা আশির শুরুর দিকে। এটা মনে রাখতে হবে যে এই বাংলায় বামপন্থা তখনও পুরোপুরি দুর্নীতির রাস্তা ধরেনি। বিশ্বায়ন শব্দটা তখনও মানুষের কাছে অপরিচিত। খোলা বাজার ব্যাপারটা যে কী সেটা সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা তখনও নেই। যৌথ পরিবার ভাঙতে শুরু করলেও তখনও অবধি তার মৌলিক যোগাযোগ আর বিনিময়টা অনেকাংশেই থেকে গেছে। ইন্টারনেট কী বস্তু জানা নেই। মিডিয়া সর্বগ্রাসী হয়নি। ভোগ্যপণ্যের এমন জগত জোড়া আয়োজন তখনও মানুষ চোখে দেখা দূরে থাক, কল্পনাতেও ভাবেনি। কনজিউমারিসম জিনিসটা খায় না মাথায় মাখে লোকের জানা নেই। এক কথায়, মানুষ তখনও ঠিক ‘পণ্যজাতক’ হিসেবে নিজেকে ভাবতে শেখেনি। এবং সমকালীন সময়টাও ঠিক এখনকার মতো করে ‘ঘেঁটে’ যায়নি। ঘেঁটে শব্দটা ইচ্ছাকৃতই ব্যবহার করলাম। আজকের সময়টা সব অর্থেই নিউজ/ফেকনিউজের দোলাচলে দিশাহীন। বিভ্রান্ত। পূর্বাপরহীন। ফলত ‘ঘেঁটে’ যাওয়া।
তো এরকম একটা সময়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, বিশেষ করে সাহিত্যের ক্ষেত্রে, নির্ণয় করাটাই বেশ দুরূহ। আশির দশকেও এমনটা ছিল না। সে সময়ে বৃহৎ বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলিকে ও তাদের লেখকগোষ্ঠীকে মূলত প্রতিষ্ঠান ভাবা হত। ভাবাটা ভুল ছিল। বেশ অর্বাচীনও ছিল। পিছন ফিরে তাকালে সে কথা স্পষ্ট বুঝতে পারি। কিন্তু সেটা কথা নয়। কথা এইটা যে, অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিন সেই সময়ে এবং নব্বই বা তার পরের দশকেও মূল ধারার সাহিত্যের বাইরে দাঁড়িয়ে নতুন কথা, নতুন লেখা প্রকাশ করব, এই ইচ্ছেটা রাখতেন। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার একটা অন্তর্লীন ধারা কিছুদিন আগে অবধিও প্রবাহিত হত। সেটা হয়ত আগের মতো অত সোচ্চার হত না, কিন্তু অনুচ্চারিত হলেও হত।
ইদানীং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা-র এই ধারাটা আর সেভাবে চোখে পড়ে না।
প্রতিষ্ঠান কী, বা কেমন, বা তার চরিত্র কী, কীভাবেই বা সে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে, এসব নিয়ে এখন খুব কম লিটল ম্যাগাজিনকে কথা বলতে দেখি। দু একটা পত্রিকা বাদ দিলে বেশিরভাগ পত্রিকাতেই পাঁচমিশেলি লেখাই প্রকাশিত হয়। সেখানে কাগজের আলাদা কোনও চরিত্র আমি খুঁজে পাই না। এমন কোনও লেখা খুঁজে পাই না যা ক্ষমতার কেন্দ্রের সামনে বেয়াড়া প্রশ্ন তুলে আনছে।
তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে প্রতিষ্ঠান বলে আর কিছু নেই! ক্ষমতাকেন্দ্র বলে আর কিছু নেই? নিয়ন্ত্রণ ও অবদমন বলে আর কিছু নেই। সব ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ, সব নিজস্ব ভাবনা, সব স্বতন্ত্র লিখন, সব প্রশ্নের উচ্চারণের স্বাধীনতা এসে গেছে?
না, আসেনি। এর বিপরীতটাই বরং সত্যি। কিন্তু সে কথায় পরে আসছি।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান বলতে শুধুমাত্র কয়েকটা বাণিজ্যিক পত্রিকাকে বোঝায় না। বরং এর উলটোটাই সত্যি। বিশ্বায়ন পরবর্তী পণ্যসমাজে, যেখানে লয়্যাল বা বিশ্বস্ত পাঠক সম্প্রদায় বলে আর কিছু নেই, থাকা সম্ভবও নয়, সেখানে নতুন পাঠককে আকর্ষণ করার জন্যেই নতুন ধারার, নতুন ধাঁচের লেখককে প্রকাশ করাটা ক্রমশই জরুরি হয়ে উঠছে। কেননা পাঠকই চাইছেন নিত্যনতুন স্বাদবদল করতে।
তাহলে তো আর সমস্যাটাই নেই! তাহলে আবার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কেন?
এই কেনর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের আর একবার এই লেখার শুরুতে যেতে হবে।
দ্বিখণ্ডিত এক চেতনা। একদিকে ভিকটিম। অন্যদিকে সুপিরিয়র। একদিকে আমি অপর এক ক্ষমতার শিকার। অন্যদিকে আমি সেই ক্ষমতার থেকে উন্নত এক সত্তা। যদি এই দ্বিখণ্ডিত চেতনাই মূল আধার হয় তাহলে সেই প্রেক্ষিত থেকেই আরও একটা ভাবনার জন্ম হয়। সেটা এই যে, আমার পরিচয় নির্ভর করছে ওই অপর বা ‘অন্য’র অস্তিত্বের মধ্যে দিয়ে। সহজে বললে, আমি তুমি নই। কিন্তু আমি যে আমিই এটা প্রমাণ করার অন্য কোনও পথ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি বা তোমাকে, অর্থাৎ আমার থেকে আলাদা এক ‘অপর’কে চিহ্নিত করে তবেই আমি নিজেকে চিনতে বা চেনাতে শিখছি। অন্যভাবে বললে, আমি, যে স্বতন্ত্র, যে নিজের মতো, সে ওই ‘অন্যের’ সাপেক্ষে নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করছে। তার মানে এক অর্থে আমি সারভাইভর। কোনওক্রমে বেঁচে গেছি। কিন্তু সেই বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যায় যদি আমি নিজেকেই না প্রশ্ন করতে পারি। কে আমি? কোথায় আমার ঘর? আমার দেশ কোনটা?
প্রতিষ্ঠান আমাকে ব্রাত্য করেছে। পরিত্যাগ করেছে। দূরে ঠেলে দিয়েছে। নির্বাসন দিয়েছে। আমি নির্বাসিত। আমার কণ্ঠস্বর আর কারও কাছে পৌঁছয় না। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা-র অভিমুখ আমি চিনি। কিন্তু এককভাবে বা কয়েকজন মিলে একত্রিত হয়ে তার বিরোধিতা করব কী উপায়ে সেটা আমার জানা নেই। পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে যেখানে, ক্রমশই লিটল ম্যাগাজিন অথবা, আর একটু বিস্তৃত করে দেখলে, সমাজের বেশিরভাগ সচেতন মানুষের এই অবস্থান অনেকটাই যেন আপোষকামী। এক অর্থে পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
তবু অস্বীকারের কিছু কণ্ঠস্বর তো আজও শোনা যায়। বিচ্ছিন্নভাবে উঠলেও কিছু কিছু বিরোধিতার উচ্চারণ তো আজও প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে ধাক্কা মারে।
কিন্তু আজকের এই বিশ্বব্যাপী পণ্যসভ্যতা জানে কীভাবে এই স্বতন্ত্র স্বরকেও সমাজের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করাতে হয়। ক্ষমতার যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত, সে জানে অস্বীকারের, ভিন্নমতের, বহুস্বরের এই বিক্ষোভকে যদি মূল স্রোতের সাথে মিলিয়ে দিতে হয় তাহলে তার নির্দিষ্ট কয়েকটা পন্থা আছে।
এক, তাকে সারাক্ষণ নজরে রাখো (এটিএম-এ যাই অথবা রেস্তোঁরায়, ব্যাঙ্কে অথবা আদালতে, সবখানেই আমি সার্ভিলেন্স ক্যামেরার অধীন)। দুই, জনগণের সামনে তাকে উপস্থিত করো একটা স্পেকটেকেল হিসেবে। সে একটা শো মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। তিন, প্রয়োজনমতো তাকে চুপ করিয়ে দাও, ঠেলে দাও নীরবতার দিকে। চার, তার ইতিহাসকে নিজের মতো করে পালটে দাও। পাঁচ, প্রতিষ্ঠানের যে নিজস্ব অর্ডার বা ব্যাবস্থাবিধি আছে তার থেকে সরিয়ে রাখো, দূরে রাখো তাকে।
এই সব পন্থাই একটা দিকে ঠেলে দেয় মানুষকে। সেটা নির্বাসন। তার আর কোনও নিজস্ব ভূমি নেই। একদিকে সে যেমন নিজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাস থেকে বিচ্যুত, অন্যদিকে সে নিজের কোনও দেশও খুঁজে পায়নি। ফলত সে চির নির্বাসিত। নিঃসঙ্গ। অনিকেত।
আজকের শিল্পীর কাছে, লেখকের কাছে, আজকের লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের কাছে, নির্বাসিতের এই অবস্থানকে চিহ্নিত করাটা জরুরি। এ কথাটা বোঝা জরুরি যে প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকেই তাঁকে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে কাজ করতে হবে। কাজটা কঠিন। আপাত অসম্ভব। তবু এটাই একমাত্র রাস্তা। তাঁর কাজ অবিরত প্রশ্ন তোলা। বেয়াড়া প্রশ্ন। যে প্রশ্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলে। যে প্রশ্ন তার নিজের আর তার সামনে দাঁড়ানো প্রতিষ্ঠানের, দুজনেরই অবস্থান নিয়ে বিতর্কিত ভাবনা বলতে পারে। আর এভাবেই ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে সত্য বলবার একটা ধারা ক্রমশ নিজেকে জায়গা দিতে পারে। কোথাও তার জায়গা না থাকলেও এই শব্দের ভুবনে, এই প্রকাশের পরিসরেই সে তার নিজের জায়গা খুঁজে পাবে।
আর এভাবেই হয়ত, এডওয়ার্ড সাইদ যেমন বলেন ঠিক সেভাবে, আজকের লেখকের/লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের কাজ হবে এটাই যে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ন্যারেটিভের পাশাপাশি এমন অনেক বিকল্প ন্যারেটিভের সন্ধান করবেন যা ইতিহাসের আরও অনেক দৃষ্টিকোণ খুলে দিতে পারে। এই নির্বাসের সময়ে দাঁড়িয়ে এই বহুস্বর রচনা করা আর প্রচলিত ইতিহাসকে সাবভার্ট করা, এটাই তার একমাত্র অস্ত্র যে।