সদানন্দ সিংহ
সত্যি কথা বলতে কি, ত্রিপুরা যে ভারতের এক অঙ্গরাজ্য এবং আগরতলা যে ত্রিপুরার রাজধানী — একথা উত্তর-পূর্ব ভারতের বাসিন্দাদের বাইরে দেশের অন্যান্য প্রদেশের অনেক লোকই জানেন না। বহুবার অন্যান্য প্রদেশের বাসিন্দারা অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন, ত্রিপুরা, সেটা কি ইন্ডিয়ার বাইরে? পশ্চিমবঙ্গেও কয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আগরতলা কি ত্রিপুরার ভেতরে না বাইরে? তাই লিটিল ম্যাগাজিন সম্পর্কে আলোচনার আগে ত্রিপুরা সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলা দরকার।
ভারতের স্বাধীনতার আগে এবং পরে ত্রিপুরা ছিল একটা রাজন্যশাসিত প্রদেশ। দেববর্মন বা দেববর্মা পদবীধারী মঙ্গোলয়েড জাতির লোকেরা ত্রিপুরায় রাজত্ব করতেন। রাজারা ছিলেন মাণিক্য উপাধিধারী। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীন হল, সেই বছরই ত্রিপুরার মহারাজা বীর বিক্রম দেহত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরার নাবালক মহারাজা কিরীট বিক্রম কিশোর দেববর্মনের পক্ষে তাঁর মাতা কাঞ্চনপ্রভা দেবী রাজ্য পরিচালনা করতেন। একসময় পাকিস্তানিপন্থীদের দ্বারা ত্রিপুরা অশান্ত হয়ে উঠলে ১৯৪৯ সালে নাবালক রাজার পক্ষে কিরীট বিক্রমের মাতা কাঞ্চনপ্রভা যোগদানপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে ভারতে যোগদান করেন।
বর্তমানে ত্রিপুরার সরকারি ভাষা দু’টো — বাংলা এবং ককবরক। বাংলাভাষীরাই ত্রিপুরায় সংখ্যাগুরু। অন্যান্য যেসব ভাষায় এখানে সাহিত্যচর্চা হয় সেগুলির নাম ককবরক, মণিপুরি, চাকমা এবং মগ। সুতরাং ত্রিপুরার লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ত্রিপুরার বাংলা এবং অন্যান্য ভাষীদের লিটিল ম্যাগাজিন নিয়েই আলোচনা দরকার। কিন্তু এখানে আমি শুধুমাত্র ত্রিপুরার বাংলা লিটিল ম্যাগাজিন নিয়েই আলোচনা করছি।
ত্রিপুরা এমন একটা জায়গা যেখানকার আকাশ বাতাস পাহাড় বন সব পশ্চিমবঙ্গ থেকে একটু আলাদা ধরনের। এখানকার পাহাড়-সমতলের জীবনসংগ্রামের কঠিন বাস্তব মূলত সর্বহারাদের প্রতিকৃতি। একদিকে সাধারণ পাহাড়ি লোকদের কৃচ্ছ্র জীবন, আরেকদিকে উদ্বাস্তুদের বাঁচার লড়াই, সব মিলেমিশে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে যায় এখানকার জীবনধারা। সাহিত্যেও এখন তা প্রতিফলিত। যদিও একসময় সারা ভারতের এবং পশ্চিমবঙ্গে যেসব সাহিত্যের আন্দোলন হয়েছিল তা ত্রিপুরাতেও পৌঁছেছিল।
১৯২৪ সালের আগে ত্রিপুরা থেকে ছ’টি সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানা যায়। এর মধ্যে তিনটির নাম ‘বঙ্গভাষা’ (সম্পাদনা: সুরেশচন্দ্র দেববর্মা), ‘অরুণ’ (সম্পাদনা: পণ্ডিত চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ), ‘ধূমকেতু’ (সম্পাদনা: মহেন্দ্র দেববর্মা)। তারপর মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্যের সময়ে ১৯২৪ সাল থেকে লিটিল ম্যাগাজিনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রকাশ হতে শুরু করে ‘রবি’ কাগজ। যুগ্ম সম্পাদনায় ছিলেন মহারাজ কুমার নরেন্দ্র কিশোর দেববর্মা এবং পণ্ডিত কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণ। কিশোর সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতির মুখপত্র ছিল এই ত্রৈমাসিক ‘রবি’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় এই ‘রবি’ কাগজে নিয়মিত লিখতেন।
পরবর্তীকালে প্রকাশিত হতে থাকে ‘সমাচার’ কাগজ, যার সম্পাদনায় ছিলেন অনিল ভট্টাচার্য।
তবে ত্রিপুরার আধুনিক সাহিত্যের প্রথম লিটিল ম্যাগাজিন হচ্ছে ‘গান্ধার’ সাহিত্যপত্র। ১৯৬২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘গান্ধার’। যুগ্মসম্পাদনায় ছিলেন কল্যাণব্রত চক্রবর্তী এবং অজয় রায়।
তারপর সত্তর দশক থেকে আজ পর্যন্ত অনেকগুলি লিটিল ম্যাগাজিন বের হয়েছে এবং হারিয়ে গেছে। সবগুলির হিসেব আমার কাছে নেই। আমার কাছে যেসব লিটিল ম্যাগাজিনের নামগুলি আছে সেগুলির উল্লেখ এখানে করছি। এটা হয়তো সম্পূর্ণ তালিকা নয়।
১) নান্দীমুখ, সম্পাদক: স্বপন সেনগুপ্ত।
২) পৌণমী, সম্পাদক: নিলিপ পোদ্দার।
৩) সমকাল, সম্পাদক: অমিতাভ দাশগুপ্ত।
৪) ব্রততী, সম্পাদক: কল্যাণ গুপ্ত এবং পূর্ণেন্দু গুপ্ত।
৫) জোনাকি, সম্পাদক: পীযুষ রাউত।
৬) হাল, সম্পাদক: তপন দাশগুপ্ত।
৭) আয়োজন, সম্পাদক: বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী।
৮) উদয়, সম্পাদক: অনাদি ভট্টাচার্য।
৯) আজকাল, সম্পাদক: সুজিত রঞ্জন দাশ।
১০) বিলাপ, সম্পাদক: সদানন্দ সিংহ।
১১) শব্দস্নান, সম্পাদক: সন্তোষ রায়।
১২) আলোকবর্ষ, সম্পাদক: কৃত্তিবাস চক্রবর্তী।
১৩) প্রতীকী, সম্পাদক: সুবিনয় দাশ।
১৪) মুক্তিবোধ, সম্পাদক: সন্তোষ রায়।
১৫) মুখাবয়ব, সম্পাদক: দেবব্রত দেব।
১৬) শাব্দিক, সম্পাদক: সন্জিৎ বণিক।
১৭) নীল ক্যাকটাস, সম্পাদক: সদানন্দ সিংহ।
১৮) জ্বালা, সম্পাদক: দিলীপ দাস।
১৯) সৈকত, সম্পাদক: মানস পাল।
২০) রানার, সম্পাদক: মিতা দাশ।
২১) সকাল, সম্পাদক: ফুলন ভট্টাচার্য।
২২) স্বকাল, সম্পাদক: প্রদীপ চৌধুরী।
২৩) রাজধানী আগরতলা, সম্পাদক: সমীরণ রায়।
২৪) সমতল, সম্পাদক: দেবানন্দ দাম।
২৫) প্রান্তর, সম্পাদক: বিনয় পাল।
২৬) পদক্ষেপ, সম্পাদক: দুলাল ঘোষ, অনুপ ভট্টাচার্য, দীপক দেব।
২৭) সাঁকো, সম্পাদক: নকুল রায়।
২৮) ধ্বনিপ্রান্তর, সম্পাদক: নকুল রায়।
২৯) কাকলি, সম্পাদক: চুনি দাশ।
৩০) ঝিনুক, সম্পাদক: বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী।
৩১) কিশোরবার্তা, সম্পাদক: রজতবরণ চক্রবর্তী।
৩২) চাঁদের পাহাড়, সম্পাদক: পার্থসারথি চক্রবর্তী।
৩৩) শঙ্খচিল, সম্পাদক: প্রীতম ভট্টাচার্য।
৩৪) শিশুমহল, সম্পাদক: সমীর পাল।
৩৫) বাইসন, সম্পাদক: সমরজিৎ সিংহ [পরবর্তীকালে দীপঙ্কর সাহা]
৩৬) অনার্য, সম্পাদক: রসরাজ নাথ।
৩৭) বুনোঘাস, সম্পাদক: পুলকেন্দু চক্রবর্তী।
৩৮) অশ্রুত, সম্পাদক: মৃণাল কান্তি দেবনাথ।
৩৯) একুশ শতক, সম্পাদক: শুভব্রত দেব।
৪০) অমিতাক্ষর, সম্পাদক: অমিত দে।
৪১) সংশপ্তক, সম্পাদক: দিলীপ দাস।
৪২) শায়ক, সম্পাদক: মাধব বণিক।
৪৩) সামলালায়, সম্পাদক: চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং এবং অপন দাশ।
৪৪) চিত্রপট, সম্পাদক: অপন দাশ।
৪৫) সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী, সম্পাদক: সমরজিৎ সিংহ, প্রবুদ্ধসুন্দর কর, দুলাল গোষ।
৪৬) নীহারিকা, সম্পাদক: শুভ্রজিৎ ভট্টাচার্য।
৪৭) আকাশের ছাদ, সম্পাদক: সমিতা ধর বসু ঠাকুর।
৪৮) মানবী, সম্পাদক: কল্যাণী ভট্টাচার্য।
৪৯) মেঘরোল, সম্পাদক: বৃন্দা নাগ।
৫০) কালক্রম, প্রদীপ সরকারের তত্ত্বাবধানে।
৫১) পূর্বমেঘ, সম্পাদক: রামেশ্বর ভট্টাচার্য।
৫২) বাংলা কবিতা, সম্পাদক: প্রবুদ্ধসুন্দর কর।
৫৩) কাগজের নৌকা, সম্পাদক: প্রদীপ মজুমদার।
৫৪) নান্দনিক, সম্পাদক: শুভেশ চৌধুরী।
৫৫) স্বতন্ত্রমেধা, সম্পাদক: নকুল রায়।
৫৬) অনন্তকরণ, সম্পাদক: শুভেশ চৌধুরী এবং অনন্ত সিংহ।
৫৭) জলজ, সম্পাদক: সন্তোষ রায়।
৫৮) পাখি সব করে রব, সম্পাদক: সেলিম মুস্তাফা।
৫৯) কীর্ণকাল, সম্পাদক: চিরশ্রী দেবনাথ।
৬০) দৈনিক বজ্রকণ্ঠ [ব্লগজিন], সম্পাদক: রাজেশ দেবনাথ
৬১) ঈশানকোণ [ওয়েবজিন], সম্পাদক: সদানন্দ সিংহ।
৬২) ভাষাসাহিত্য, প্রধান সম্পাদক: কল্যাণব্রত চক্রবর্তী, বর্তমান সম্পাদক: কৃত্তিবাস চক্রবর্তী।
ভাষাসাহিত্য প্রসঙ্গে কিছু উল্লেখ করা দরকার। ভাষাসাহিত্য হচ্ছে ভাষা ট্রাস্টের সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক মুখপত্র। ভাষাসাহিত্যের প্রধান সম্পাদক বাদে মূল আরেকজন সম্পাদক থাকেন যার দায়িত্বে থাকে ভাষাসাহিত্য। এই মূল সম্পাদক দু’বছর পরপর নির্বাচিত হন ভাষা ট্রাস্টের মেম্বারদের দ্বারা। ভাষা ট্রাস্টের সদস্য-সদস্যারা হলেন কল্যাণব্রত চক্রবর্তী, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, দিলীপ দাস, কৃত্তিবাস চক্রবর্তী, প্রদীপ সরকার, বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী, সদানন্দ সিংহ, অশোকানন্দ রায়বর্ধন, অলক দাশগুপ্ত, সন্তোষ রায়, মাধব বণিক, লক্ষ্মণ বণিক এবং কাকলি গঙ্গোপাধ্যায়। শুধুমাত্র অলাভজনকভাবে সাহিত্যসেবা করার উদ্দেশ্য নিয়ে ভাষা ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল লেখক-কবিদের বই প্রকাশ করে বিপণন করে লেখক-কবিদের হাতে বই বিক্রির টাকা তুলে দেয়া এবং ভাষাসাহিত্য ম্যাগাজিন বের করা। ২০০৪ সাল থেকে এখনও ভাষাসাহিত্য বেরুচ্ছে। আর ভাষা প্রকাশনীর বই এখন পর্যন্ত দু’শ অতিক্রম করে গেছে। এছাড়া ভাষা ট্রাস্টের পক্ষ থেকে প্রতি দু বছর অন্তর একজন কবি-সাহিত্যিককে ভাষাসম্মান দিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে যার আর্থিক মুল্য পঁচিশ হাজার টাকা। নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে শুধুমাত্র সাহিত্যসেবন করার উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীর আর অন্য কোথাও এমন ট্রাস্ট গঠিত হয়েছে কিনা জানা নেই।
পত্রিকাগুলি সম্পর্কে জানতে পারলে আরও ভালো লাগত।