শুভাশিস রায়চৌধুরী
র্যানসমওয়ার। কদিন ধরে এই শব্দটা মার্কেটে খুব চলছে। এমনই তার প্রতাপ যে পরশুদিন পাশের বাড়ির কাকুর কম্পিউটার হ্যাং করে যেতে তার স্ত্রীকে জোরে জোরে বলতে শুনলাম,
–সব্বোনাশ হয়ে গেছে গো। র্যানসমওয়ার হয়েছে। এবার সব টাকা পয়সা শুষে নেবে।
–আহ তুমি থামবে? এরকম হ্যাং অনেকবার হয়েছে।
–আরে তখন তো র্যানসমওয়ার ছিল না। কাগজে পড়োনি, র্যানসমওয়ার বলে একটা ভাইরাস এসেছে আর সেটা পৃথিবীর সব কম্পিউটার থেকে টাকা শুষে নিচ্ছে।
এই যুগে সকলেই টেকনোলজির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবু কজনই বা সেটার খুঁটিনাটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? আর সেটা না হওয়াটা দোষেরও নয়, কী হবে বেকার এসব গুরুগম্ভীর জিনিসপত্র নিয়ে ভেবে? আমাদের পেটের দায়ে জানতে হয়েছে বলে জেনেছি। না হলে থোড়াই কেয়ার করতাম? তা এই র্যানসমওয়ার অনেকটা “দ্রিঘাংচু”-র মতো, যার মানে সকলে জানে না কিন্তু কনসিকোয়েন্স সম্বন্ধে সকলেরই ভাসা ভাসা আইডিয়া রয়েছে। তাই টুক করে একটু জেনে নেওয়া যাক র্যানসমওয়ার আসলে অশ্বপতি না অশ্বডিম্ব।
কম্পিউটার ভাইরাস আর ম্যালওয়ার এর মধ্যে একটা বেসিক তফাত আছে। ঐ স্কুলে রসায়নের বইতে পড়া ‘সব ক্ষার ক্ষারক কিন্তু সব ক্ষারকই ক্ষার নয়’-এর মতো। সেইরকমই ভাইরাস হল এক ধরনের ম্যালওয়ার, কিন্তু সব ম্যালওয়ারই ভাইরাস নয়। যেহেতু ভাইরাস হল ম্যালওয়ারের সাবসেট তাই ম্যালওয়ার নিয়েই বলা যাক।
ম্যালওয়ার হল একধরনের প্রোগ্রাম যেটা বাইরে থেকে এসে আপনার কম্পিউটারে ঢোকে। ঢুকে চারপাশটা দেখে নিয়ে নিজের কাজ, অর্থাৎ কম্পিউটারের বারোটা বাজানো, শুরু করে দেয়। ঠিক যেমনভাবে বাইরে থেকে ভাইরাস ঢুকে মানবশরীরকে নাজেহাল করে, একদম সেইভাবেই। তফাত হল শরীরে ভাইরাস ঢোকে খাবার, জল, বাতাস, ছোঁয়া ইত্যাদি থেকে আর কম্পিউটারে ম্যালওয়ার ঢোকে কোনও ই-মেল অ্যাটাচমেন্ট, ইন্টারনেটের কোন লিঙ্ক, ইনফেক্টেড সিডি, ডিভিডি, পেনড্রাইভ ইত্যাদি থেকে। বায়োলজিক্যাল ভাইরাসগুলোর যেমন অনেক ধরনের হয় তেমন কম্পিউটার ম্যালওয়ারেরও অনেক প্রকারভেদ আছে। কিছু ম্যালওয়ার এসে আপনার কম্পিউটারকে স্লো করে দেয়, কিছু ম্যালওয়ার এসে আপনার ডেটা নষ্ট করে দেয়, কিছু এসে আপনার গোপন ফাইলগুলো ঘেঁটে দরকারি তথ্য ঘেঁটে পাচার করে দেয় ইত্যাদি। তবে এখন যে ম্যালওয়ার বাজার কাঁপাচ্ছে সেটা অর্থাৎ ‘ওয়ানা ক্রাই’ এদের সকলের থেকে আলাদা এবং প্রচণ্ড রকমের ত্যাঁদড় একটা ম্যালওয়ার।
কী বললেন? ‘ওয়ানা ক্রাই’ কী?
ওহ তাই তো! মিডিয়া তো র্যানসমওয়ার বলেই প্রচার চালাচ্ছে। আসল ম্যালওয়ারের নামটা কজনই বা জানিয়েছে মানুষকে! তবু জেনে রাখা ভালো, এখন যে ম্যালওয়ার নিয়ে এত চর্চা তার নাম মোটেই ‘র্যানসমওয়ার’ নয়। তার নাম ‘ওয়ানা ক্রাই’। র্যানসমওয়ার হল সেই সমস্ত ম্যালওয়ার যারা কম্পিউটারের মালিকের থেকে কম্পিউটার অথবা তার ভিতরের ফাইলগুলোর অ্যাক্সেস কেড়ে নেয় এবং ততক্ষণ অ্যাক্সেস দেয় না যতক্ষণ না কম্পিউটারের মালিক দাবী অনুযায়ী টাকা তাদের দিচ্ছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার একবার ভাবুন তো। পুরো হিন্দি সিনেমার ভিলেনের নায়কের কাছের মানুষকে কিডন্যাপ করে পয়সা চাওয়ার মতো কেস।
এই ধরনের ম্যালওয়ার প্রথম দেখা দেয় ১৯৮৯-এ। ডঃ জোসেফ পপ নামক এক ব্যাক্তি ‘এডস ট্রোজান’ নামের এক ভাইরাস তৈরি করেন যা আপনার কম্পিউটারে ঢুকে আপনাকে দেখাবে আপনার কিছু ফাইল নষ্ট হয়ে গেছে এবং সেটা উদ্ধার করতে গেলে আপনাকে 189$ দিয়ে একটা সফটওয়্যার কিনতে হবে। আসলে কিছুই না, আপনার সেই ফাইলগুলো হাইড করে রাখা হয়েছিল, পয়সা দিতেই আবার আনহাইড করে দেওয়া হল। খুব কাঁচা কাজ হলেও এটা র্যানসমওয়ারের প্রথম রেজিস্টার্ড কেস ছিল। তারপরে অনেক রকমের র্যানসমওয়ার এসেছে এবং তাদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা নাম আছে। যেমন রেভেটন, ক্রিপ্টোলকার, ক্রিপ্টো ওয়াল ইত্যাদি। সেই রকমই এখন যে শর্মা হিট করেছে তার নাম ‘ওয়ানা ক্রাই’। তাহলে গোদা বাংলায় ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াল যে ‘ওয়ানা ক্রাই’ একটা ম্যালওয়ারের নাম, যার টাইপ হল ‘র্যানসমওয়ার’।
এবার জেনে নেওয়া যাক ‘ওয়ানা ক্রাই’-এর ঠিকুজি। বাকি ম্যালওয়ারগুলোর মতো এই বাবাজিও কোনও ইমেলের অ্যাটাচমেন্ট হিসাবে এসে আপনার কম্পিউটারে সিঁধোবে। আপনি না বুঝে যেই সে অ্যাটাচমেন্টটা খুললেন ওমনি ইনি নিজের ব্যাগপত্তর খুলে জামা-কাপড়, জুতো-মোজা, ব্রাশ-পেস্ট, তেল-সাবান নিয়ে একেবারে গুছিয়ে সংসার করতে বসবেন আপনার কম্পিউটারে। আপনার সমস্ত ফাইলগুলোকে আটকে রাখবে তালা চাবি দিয়ে, অর্থাৎ টেকনিক্যাল ভাষায় এনক্রিপ্ট করে ফেলবে। যেমন ধরুন আপনি নিজে একটা নতুন ভাষা তৈরি করলেন যেটায় জলকে বলা হয় কনিয়াক, মাটিকে বলা হয় বাহুবলী, বাতাসকে বলা হয় দামোদরভাই, আগুনকে বলা হয় জয়াপ্রদা, আকাশকে বলা হয় চমনবাহার ইত্যাদি। আপনার কাছে বাংলা ভাষার প্রতিটা শব্দের একটা অন্য প্রতিশব্দ আছে এবং সেগুলো আপনি একটা গাব্দা ডায়রিতে লিখে রেখেছেন। এবার আপনি সেই সমস্ত শব্দ দিয়ে যদি রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলী’ অনুবাদ করে ফেলেন তাহলে সধারণ মানুষ কি তা পড়ে বুঝতে পারবে? একেবারেই পারবে না। তবে আপনার সেই ডায়রিটা কারও হাতে পড়ে গেলে তা থেকে সে অনায়াসে আসল ‘গীতাঞ্জলী’ নিংড়ে বের করে আনবে। এখানেও ঠিক একই ব্যাপার হয়। আপনার ফাইল-ফোল্ডারের যাবতীয় তথ্য একটা সিক্রেট ল্যাঙ্গুয়েজে অনুবাদ করে নেওয়া হয় যাতে আপনার কম্পিউটার তা আর পড়তে না পারে। এটাকেই বলে ‘এনক্রিপশন’। এবার সেই সিক্রেট ল্যাঙ্গয়েজের ট্রান্সলেটরটা হাতে পেলে আপনার কম্পিউটার সেটা ব্যাবহার করে আবার সব ফাইল-ফোল্ডারের যাবতীয় তথ্য পড়তে পারলে তাকে বলে ‘ডিক্রিপশন’। তা সেই সিক্রেট ল্যাঙ্গুয়েজের ট্রান্সলেটরটাই এখানে চাবি, যা দিয়ে আপনার লক হইয়ে যাওয়া ফাইলগুলো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। সেটা না পাওয়া পর্যন্ত আপনি আপনার ডেস্কটপে ফ্যাল ফ্যাল করে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবেন না। এই ম্যালওয়ার আপনার সেই ডেস্কটপে একটা নোটিশ ছেপে দেবে যার বয়ানটা অনেকটা এরকম–
“উপ্স!! কাকা তোমার দরকারি ফাইলপত্তর সব লক হইয়ে গেছে!!“
প্রশ্নঃ আমার কম্পিউটারে কী হয়েছে?
ঐ যে বললাম, তোমার কম্পিউটারের সব দরকারি ফাইলপত্তর লক হইয়ে গেছে। এবার তুমি সময় নষ্ট করে সেগুলো আনলক করার চেষ্টা করতে পারো কিন্তু তাতে লাভ বিশেষ হবে না। ঐ চাবি খোলার তালা একমাত্র আমাদের কাছে আছে। সেটা ছাড়া আর কিছু দিয়েই ঐ ফাইলগুলো খোলা যাবে না। তাই বেশি পোঁয়াপাকামি করে লাভ নেই।
প্রশ্নঃ আমি কি আমার ফাইলগুলো ফেরত পেতে পারি?
কেন পাবে না ফেরত? নিশ্চয়ই পাবে। তবে তার জন্য আমাদেরকে 300$ দিতে হবে। নিচের লিঙ্কটা ব্যাবহার করে আমাদের টাকাটা বিটকয়েন মারফত পাঠিয়ে দাও, তারপর চাবি নিয়ে তালা খুলে ফাইল ফেরত পাও।
ও হ্যাঁ, তোমার কাছে মাত্র তিনদিনের সময় আছে। তার মধ্যে টাকা না পেলে আমরা সব ফাইল উড়িয়ে দেব। তাই একটু জলদি করো কাকা!!”
সত্যিই! হ্যাকাররা, যারা এই ‘ওয়ানা ক্রাই’ বানিয়েছে তাদের রসবোধের তারিফ না করে উপায় নেই। তা এই হল গিয়ে ‘ওয়ানা ক্রাই’। যার পুরো নাম ‘ওয়ানা ডিক্রিপ্টর’ অর্থাৎ লক হয়ে যাওয়া বা এনক্রিপ্ট হয়ে যাওয়া ফাইলগুলোকে যে ডিক্রিপ্ট করে। যার কম্পিউটারে এই ম্যালওয়ার ঢুকল তার কান্না ছাড়া আর উপায় নেই বলেই মূল নাম ছোট করে ‘ওয়ানা ক্রাই’ নাম।
এতটা পড়ার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগবে যে বিটকয়েন কী। তা এটা নিয়ে বলতে বসলে আবার আরেকটা দিন লাগবে। এটা বরং পরেরবারের জন্য তোলা থাক। এখন শুধু এটুকুই বলি যে এই বিটকয়েন এমন একধরনের পেমেন্ট মেথড যা কেউ ট্র্যাক করতে পারে না। কেউ মানে কেউই নয়, তা সে যত বড়ই হুব্বা হোক না কেন। তাই এসব কুকর্ম করার জন্য হ্যাকারদের ফেভারিট হল বিটকয়েন।
একটা সময় ছিল যখন সকলে টেকনোলজির দাসত্ব এইরকমভাবে করত না। ব্যাপারটা ধীরে ধীরে হয়েছে। যত দিন গেছে, মানুষ আরও জেনেছে, আরও শিখেছে, নতুন নতুন অ্যান্টিভাইরাস এসেছে যা আপনার কম্পিউটারকে ছুটকো ছাটকা ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিয়েছে, কিন্তু এত সবের মধ্যেও একটা জিনিস এক্সপোনেনশিয়ালি বেড়েছে আর সেটা হল হ্যাকারদের মেধা। এমন এমন প্রোগ্রাম লিখে ফেলেছে তারা যা সামলানো অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যারের কম্ম নয়। তাই যত দিন গেছে বেড়েছে সাংঘাতিক সব কম্পিউটার ভাইরাসের আক্রমণ। তবে শেষ করার আগে এটুকুই বলি যে, এই ‘ওয়ানা ক্রাই’ নামক র্যানসমওয়ার কেবলমাত্র উইন্ডোজ সিস্টেমকেই হ্যাক করতে সক্ষম হয়েছে। লিনাক্স বেসড অপারেটিং সিস্টেমের সিকিওরিটি এতই পোক্ত যে সেখানে বাবাজীবন হুল ফোটাতে পারেনি। তাই হ্যাকাররা যতই মেধাবী হোক না কেন, বাবারও যে বাবা থাকে এটা তারই প্রমাণ।
লেখাটার জন্য ধন্যবাদ। কাজের জিনিস পড়লাম একটা।
ধন্যবাদ ঋতব্রতবাবু।
বাঃ জরুরী লেখা অনেক সহজে বুঝে গেলাম !
ধন্যবাদ দেবীকা দেবী।
Cool !!! A complex topic has been explained in simple words for common people…Good Job, Brother.