স্টেশন মাস্টার
আপনাদের সকলের শুভেচ্ছা ও সক্রিয় সহযোগিতায় চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েব-পত্রিকা তার প্রথম বছর পূর্ণ করল। ২০১৭-র মে মাসে সামান্য ক’জন সমমনস্ক বন্ধুর সম্মিলিত উৎসাহ ও উদ্যোগে যখন আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তখন দূরতম কল্পনাতেও ভাবা যায়নি, এত পথ এগনো যাবে। প্রতি সপ্তাহের নিয়মিত বিভাগ ‘লোকাল ট্রেন’-এর একগুচ্ছ লেখার মধ্যে দিয়ে সমসময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনাক্রমকে মূল্যায়নের চেষ্টা, প্রতি মাসের প্রথম দিনে নিয়মিত মাসিক বিভাগ ‘মেল ট্রেন’-এর মধ্যে সমকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির প্রধান বাঁকগুলিকে চিহ্নিত করার প্রয়াস, ও কোনও বিশেষ মুহূর্তকে আলাদা করে নথিবদ্ধ করার লক্ষ্যে বিশেষ সংখ্যার আয়োজন খুব কম কথা নয় – পরিকল্পনা হিসেবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী তো বটেই। শুরুতে ভাবাও যায়নি, এমন দুরূহ কাজ আমরা করে উঠতে পারব। যথাযোগ্য বিষয়গুলি চিহ্নিত করা, যথাযোগ্য লেখকদের খুঁজে বের করা, শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁদের দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া – যাঁরা কাগজ করেন, প্রত্যেকেই জানেন সে কত কঠিন কাজ।
শুরুতে এতকিছু সত্যিই ভাবিনি। অনেক শুভানুধ্যায়ী প্রশ্ন করেছেন পত্রিকার বাণিজ্যিক ভবিষ্যৎ নিয়ে – সঙ্গত প্রশ্ন সন্দেহ নেই, কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমলই দিইনি। পালটা বলেছি, লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র যদি হয় ভবিষ্যতের আর্থিক নিশ্চয়তার কথা না-ভেবে প্রাণের প্রবল ও অকুণ্ঠ প্রকাশের শক্তির ওপরে ভরসা রাখা, তা হলে আমরা ঠিক পথেই আছি।
শুরুতে এতকিছু সত্যিই ভাবিনি। অনেক শুভানুধ্যায়ী প্রশ্ন করেছেন পত্রিকার বাণিজ্যিক ভবিষ্যৎ নিয়ে – সঙ্গত প্রশ্ন সন্দেহ নেই, কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমলই দিইনি। পালটা বলেছি, লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র যদি হয় ভবিষ্যতের আর্থিক নিশ্চয়তার কথা না-ভেবে প্রাণের প্রবল ও অকুণ্ঠ প্রকাশের শক্তির ওপরে ভরসা রাখা, তা হলে আমরা ঠিক পথেই আছি। আর বাকি যেটুকু সমর্থন দরকার ছিল, তার অনেক বেশি পেয়েছি আমাদের লেখক ও পাঠকদের কাছ থেকে। কাগজ কেমন করা গিয়েছে, লেখার মান সর্বদা যথাযথ উচ্চতায় ধরে রাখা গিয়েছে কি না, সেসব তো পরের প্রশ্ন। সে পরীক্ষায় পাশ করা গেল কি না, আপনারাই বলবেন। আমাদের দিক থেকে কেবল এটুকুই বলার যে, আমরা চেষ্টায় ফাঁক রাখিনি। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য, আপনারা পাশে না-থাকলে এ কাজ সম্ভব হত না।
চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম পরিচয়ে ওয়েব-পত্রিকা হলেও, যেহেতু চারিত্র্যে তা লিটল ম্যাগাজিনেরই সমগোত্রীয়, তাই বর্ষপূর্তি সংখ্যার মূল বিষয়-ভাবনার কেন্দ্রে থাকবে লিটল ম্যাগাজিনই – এমন একটি ভাবনা আমাদের দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। কিন্তু সংখ্যার পরিকল্পনা করতে গিয়ে প্রথমেই তৈরি হল যে সঙ্কট – লিটল ম্যাগাজিনের কোন দিকটিকে আমরা ধরতে চাইব। তার অনিয়মিতির ঔদ্ধত্য? তার ক্ষণস্থায়িত্বের গৌরব? তার প্রথাবিরোধী পথচলার স্পর্ধা? তার প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার হিরণ্যমুখ? নাকি, একইসঙ্গে তার অজস্র তরুণ লেখক ও তাঁদের লেখনীকে ধারণ করার সপ্রাণ প্রসারতা? ভাবতে বসে টের পাওয়া গেল, আসলে কোনও একটি নয়, বরং এর সবক’টি মিলেমিশেই ছোট পত্রিকার সামগ্রিক পরিচয়।
এ-মাসের সংখ্যা, অর্থাৎ মে মাসের মেল ট্রেন-এর প্রসঙ্গে আসি। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম পরিচয়ে ওয়েব-পত্রিকা হলেও, যেহেতু চারিত্র্যে তা লিটল ম্যাগাজিনেরই সমগোত্রীয়, তাই বর্ষপূর্তি মেল ট্রেন-এর মূল বিষয়-ভাবনার কেন্দ্রে থাকবে লিটল ম্যাগাজিনই – এমন একটি ভাবনা আমাদের দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। কিন্তু সংখ্যার পরিকল্পনা করতে গিয়ে প্রথমেই তৈরি হল যে সঙ্কট – লিটল ম্যাগাজিনের কোন দিকটিকে আমরা ধরতে চাইব। তার অনিয়মিতির ঔদ্ধত্য? তার ক্ষণস্থায়িত্বের গৌরব? তার প্রথাবিরোধী পথচলার স্পর্ধা? তার প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার হিরণ্যমুখ? নাকি, একইসঙ্গে তার অজস্র তরুণ লেখক ও তাঁদের লেখনীকে ধারণ করার সপ্রাণ প্রসারতা? ভাবতে বসে টের পাওয়া গেল, আসলে কোনও একটি নয়, বরং এর সবক’টি মিলেমিশেই ছোট পত্রিকার সামগ্রিক পরিচয়। আর, এর বাইরে, তার আরও এক প্রধান পরিচয় তার সংখ্যাবাহুল্য ও বহুমাত্রিকতা। অসংখ্য একফর্মা-দু’ফর্মা-তিনফর্মা-চারফর্মার কৃশকায় কাগজ – এপার ও ওপার বাংলা থেকে, অসম থেকে, ত্রিপুরা থেকে, দিল্লি-মুম্বাই থেকে, এমনকী দূর বিদেশ থেকেও নিয়মিত এবং অনিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে, কোনওটি কয়েকদিন বা কয়েকমাস চলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কোনওটি বা তুলনায় বেশি আয়ুস্মান – কিন্তু প্রতিটিই একক তাদের নিজস্ব চরিত্রবৈশিষ্ট্যে, গুরুত্বপূর্ণ তাদের ভূমিকায়। অনেক ভেবে তাই স্থির করা গেল, একইসঙ্গে চেষ্টা করা হবে তার এই বিশালত্ব ও বিষয়বৈচিত্রকে ধরার, এবং একটি বিশেষ কালপরিসরে কাগজগুলি কীভাবে তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে তা-ও খুঁজে দেখার। সেই ভাবনারই ফসল এই সংখ্যার রিজার্ভ্ড বগি।
সেই প্রসঙ্গেই মনে পড়ল টিএস এলিয়টের ‘দ্য ফোর কোয়ার্টেট্স’-এর তৃতীয় কবিতা ‘দ্য ড্রাই স্যালভেজেস’-এর অমোঘ, বহুশ্রুত পংক্তিটির কথা। “The sea has many voices, many gods and many voices”। মনে পড়ল, কবি শঙ্খ ঘোষের অনুবাদে সমুদ্রের এই বহুমাত্রিক স্বরময়তা কীভাবে রূপ পেয়ে উঠেছে “বহুল দেবতা, বহু স্বর” শব্দবন্ধটির মধ্যে। এলিয়ট বা শঙ্খ ঘোষ, দু’জনের কারুরই অনুমতি না-নিয়েই আমরা স্থির করলাম এ-ই, একমাত্র এটিই হতে পারে আমাদের এই বিভাগের সার্থক নাম; যেহেতু বিপুল এক অনেকান্ততার মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই অনেকেরই খোঁজ আমাদের।
বাংলা লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে বহুবছর ধরে অক্লান্ত গবেষণা করে চলেছেন যে মানুষটি, সেই সন্দীপ দত্তকে তাঁর অসুস্থতার মধ্যেও রাজি করানো গিয়েছে একটি সাক্ষাৎকারের জন্য, সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সুস্নাত চৌধুরী। এছাড়া এই বিভাগে লিখেছেন মলয় রায়চৌধুরী, সুমন গুণ, সর্বজিৎ সরকার ও বল্লরী সেন। দুই বাংলার প্রধান ওয়েব-পত্রিকাগুলিকে নিয়ে লিখেছেন দুর্জয় আশরাফুল ইসলাম। এরই পাশাপাশি, ত্রিপুরা, উত্তরবঙ্গ ও রাঢ় বাংলা থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনগুলির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সদানন্দ সিংহ, সুবীর সরকার ও উজ্জ্বল মাজী। এমন দাবি করি না যে, বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের সামগ্রিক চিত্রটি আমরা ধরতে পারলাম এই নিবন্ধগুচ্ছের মধ্যে, কিন্তু সামগ্রিকতার একটি আভাস অন্তত রইল অবশ্যই, সেটুকুই আমাদের তৃপ্তি।
কাগজ সম্পাদনার কাজ যখন শেষ, তখনই খবর এল, প্রয়াত হয়েছেন শ্রী অশোক মিত্র। বামপন্থী অর্থনীতির পুরোধাপুরুষ, যাপনে ও চেতনায় আনখশির কমিউনিস্ট অশোক মিত্র, যিনি আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন জীবনের ছাপ কীভাবে চেতনাকে গড়ে এবং চেতনার ছাপ কীভাবে জীবনকেও, অর্থনীতি ও রাজনীতির কর্মকাণ্ডের বাইরে ছিলেন দুর্মর সাহিত্যমনস্ক ও কবিতাপ্রেমী এক মানুষ, এবং বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই আশ্চর্য ক্ষুরধার কলমের অধিকারী। তাঁকে স্মরণ না-করে আমাদের এই সংখ্যা কোনওমতেই সম্পূর্ণ হত না। পত্রিকার সমস্ত কাজ থামিয়ে দিয়ে আমরা তাই যোগাযোগ করি এমন দু’জনের সঙ্গে যাঁরা তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন। আমাদের সৌভাগ্য, কবি যশোধরা রায়চৌধুরী ও অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবল ব্যক্তিগত শোকের মধ্যেও আমাদের জন্য কপি প্রস্তুত করে দিয়েছেন। এছাড়া সদ্যপ্রয়াত কবি বেলাল চৌধুরীকে স্মরণ করেছেন তাঁর অনুজপ্রতিম কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, এবং অমিয়ভূষণ মজুমদারের জন্মশতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন গল্পকার বিপুল দাস।
অমিয়ভূষণ মজুমদারের একটি নিবন্ধও আমরা এবার প্রকাশ করেছি আমাদের স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে।
এর বাইরে মেল ট্রেন-এর দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যায় রইল গল্প, অণুগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অন্যগদ্য, হুইলার্স ও ধারাবাহিক-সহ সমস্ত নিয়মিত বিভাগ।
পরিশেষে জানাই, কাগজের প্রথম বর্ষপূর্তিতে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন আমাদের প্রিয় লেখক ও পাঠকদের অনেকেই। সেখানে যেমন রয়েছে পিঠ-চাপড়ানো অভিনন্দন, তেমনই রয়েছে ভবিষ্যতের জন্য অমূল্য পরামর্শও। তেমনই কিছু বার্তা আমরা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম। সামনের গোটা বছরটায় আপনাদের এই আদর আমাদের সঙ্গে থাকুক, শক্তি দিক।
ভাল থাকবেন…
কথাগুলি বলেই ফেলি… বলব বলব করে আর ঠিক কোথায় বলব ভাবতে ভাবতে দেরি হয়ে যাচ্ছিল। তারপর ভাবলাম এবার তো নতুন সংখ্যাই বেরিয়ে যাবে!
কথা হল, আপনাদের ‘বহুল দেবতা বহু স্বর’ পড়লাম। পড়ে ব্যোমকে গেলাম বস্তুত। মানে এরকম গতানুগতিক আবার একই সঙ্গে ইন্টারেস্টিং কোনও কিছু অনেকদিন পড়িনি। একটু ভেঙে বলি। লেখাগুলি খুবই ফ্ল্যাট এবং গতানুগতিক। নতুন কিছুই প্রায় পাওয়া যায় না। যেগুলি ইনফর্মেটিভ লেখা, যেমন অঞ্চলভিত্তিক পত্রিকার খোঁজখবর, সেগুলি তো আলাদা। বল্লরীদেবীর লেখাটিকেও আমি এই গোত্রে ধরে নিচ্ছি। উনি নতুন কবিদের সুলুক দিয়েছেন। কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা ঘটল লেখাগুলি শেষ করার পর। এই যে, বাংলা পত্রিকার জগতের যে বৈশিষ্ট্য বা উন্মোচন ধরতে চাওয়া হয়েছিল বলে আমার মনে হয়েছে, সেটা ধরা গেল না, যথেষ্ট যোগ্য মানুষেরা কলম ধরা সত্ত্বেও, এ কীসের লক্ষণ? পত্রিকার জগতের হালের দিশাহীনতারই নয় কি? সত্যিই কি উন্মোচন কিছু হচ্ছে কোথাও? নাকি সবই স্রোতে গা ভাসানো? যদি হয়েও থাকে, সে এতই বিক্ষিপ্ত এবং প্রান্তিক যে আলোচনাতেই আসার মতো নয়! আমার কিন্তু তাই মনে হয়। এবং আপনাদের এই ‘বহুল দেবতা বহু স্বর’ সেটাকেই যেন আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আপনাদের প্রচেষ্টা সার্থক মশাই। আপনাদের পড়ি নিয়মিত। আপনাদের সেই বিক্ষিপ্ত বা প্রান্তিক একজনই মনে হয়। আরও একটা সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন আমাদের বেশ নৈর্ব্যক্তিকভাবে। অভিনন্দন নেবেন…