আউটসাইডার, মার্সেউ এবং মিথ অফ সিসিফাস

তথাগত দাশমজুমদার

 

নিউজফিডে কাম্যুর আউটসাইডার উপন্যাসের পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা লেখা দেখে এই কথাগুলো মাথায় এল। আউটসাইডার এক অদ্ভুত উপন্যাস, পড়তে শুরু করলে প্রথমেই যেটা হবে, সেটা হল নায়কের ওপর রাগ, মায়ের মৃত্যুতেও একজন কী করে এত নিস্পৃহ থাকতে পারে? মায়ের কফিনের সামনে ধোঁয়া ওড়ানো যায়? কী স্বার্থপর। উপন্যাস এগোতে থাকে আর আমরা দেখি যে নায়ক শুধু আজকের জন্য বাঁচে কোনরকম মূল্যবোধের তোয়াক্কা না করেই। সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়মের তোয়াক্কা না করে সে বাঁচে নিজের কাছে সৎ থেকেই। যে অনুভূতি তার নেই, শুধু লোক দেখানোর জন্য সেই অনুভূতির অভিনয় সে করতে পারে না, আর ঠিক সে কারণেই মায়ের মৃত্যুতে তার চোখ ভেজে না। কিন্তু যে অনুভূতিগুলো তার আছে সেই অনুভূতিগুলোর ব্যাপারে সে কিন্তু অত্যন্ত সৎ, হয়তো প্রকাশের উপায় অন্য, লোকে ভুল বোঝে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে নিজের ভেতরে খুঁজে পায় শান্তি কারণ সে নিজের কাছে সৎ। নানান ঘটনাপ্রবাহ তাকে বাধ্য করে একজনকে খুন করতে, কিন্তু সেই খুনের কারণ একটাই, প্রচণ্ড গরমে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো। এটা শুনলে আমাদের হয়তো মনে হবে যে এ তো ছেঁদো যুক্তি, কিন্তু তখন মনে পড়বে যে পিস্তলটা দিয়ে সে খুন করেছিল সেটা তার কাছে ছিল তার বন্ধুকে আত্মহত্যা করতে না দেওয়ার জন্য। কিন্তু বিচারালয়ে নায়ককে খুন করার চেয়েও বেশি দোষ দেওয়া হয় তার তথাকথিত অনুভূতিহীনতাকেই।

আর ঠিক এসময়েই, উপন্যাসের শুরুতে নায়কের ওপর তৈরি হওয়া রাগ, ঘৃণার বদলে ধীরে ধীরে পাঠকের মনে তখন তৈরি হতে শুরু করে নায়কের প্রতি অন্যরকম একটা সমবেদনা। ঠিক এর পরেই উপন্যাস থেকে ধীরে ধীরে ট্রিটিজ হয়ে ওঠে বইটি। জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে বসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকার সময়ে নায়কের সামনে আসেন এক যাজক, যিনি নায়ককে দিতে চান ঈশ্বরের সন্ধান। কিন্তু নায়ক উপেক্ষা করে পরলোকের সুখের আশ্বাস, কারণ সে যে বাঁচে বর্তমানের নিশ্চয়তায়, সে নিশ্চয়তা মৃত্যু হলেও।

আর ঠিক সেখানেই উপন্যাসটা পড়ার সাথে সাথে জরুরি হয়ে পড়ে কাম্যুর মিথ অফ সিসিফাস বইটিকে মাথায় রাখা। উপন্যাসের নায়ক মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে যেন মনুষ্যজন্মের অসারতাকেই তুলে ধরে। মনুষ্যজন্ম আসলে যে অর্থহীন, উপন্যাসের নায়ক সেটাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান নয়, মরণ একটি অনিবার্য ঘটনা, কিন্তু সে ঘটনা ঘটবে বলে এই মুহূর্তর জীবনটা কিন্তু ব্যর্থ হয় যায় না। আর সে কারণেই কাম্যুর মিথ অফ সিসিফাসের অ্যাবসার্ড হিরোর মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে আউটসাইডার উপন্যাসের নায়ক। সদ্যমৃত মায়ের কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ও কফি খাওয়া উপভোগ করতে করতে, মার শেষকৃত্যর পরের দিনই সমুদ্রসৈকতে যৌনসঙ্গম উপভোগ করতে করতে, বন্ধু রেমন্ডের (যে আদতে একজন লম্পট) মাধ্যমে সে যেন এটাই বোঝাতে চায় যে আসলে বিদ্রোহ, বিপ্লব, প্যাশন, স্বাধীনতা সবই আসলে অর্থহীন, অ্যাবসার্ড। একমাত্র সত্য হল প্রবলভাবে বেঁচে থাকা, আর বেঁচে থাকাকে ভালোবাসা।

এক অ্যাবসার্ড হিরোর মতোই মার্সেউ চিরডিট্যাচড, কোনও ঘটনাবলির অংশ হওয়ার চেয়ে দূর থেকে পর্যবেক্ষক হওয়াই তার কাছে শ্রেয়। প্রেমিকা মেরি যখন বিয়ের প্রস্তাব দেয়, সে বলে যে যদিও সে ভালোবাসে না, কিন্তু বিয়ে করতে তার আপত্তি নেই। এমনকি মার্সেউ যখন খুন করছে, তখনও যেন সে সেখানে নেই, ঠিক যেন সে সিনেমার পর্দায় দেখছে যে সে কাউকে গুলি করছে।

একদম শেষে যাজক যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছে, মার্সেউ আবিষ্কার করছে জীবনের পরম সত্যকে।
সে বলে উঠছে, “And I felt ready to live it all again too. As if that blind rage had washed me clean, rid me of hope; for the first time, in that night alive with signs and stars, I opened myself to the gentle indifference of the world. Finding it so much like myself—so like a brother, really—I felt that I had been happy and that I was happy again.”

আর ঠিক এই জায়গাতেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে মিথ অফ সিসিফাস। মানব অস্তিত্বের আদিমতম সত্য হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে কোনও একটা কার্যকারণ সম্পর্কের, জীবনের মানের খোঁজ করা, কেউ তাকে খোঁজার চেষ্টা করে ঈশ্বরজিজ্ঞাসার মধ্যে, কেউবা আবার বিজ্ঞানের মাধ্যমে। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের তো কোনও দায় নেই মানুষকে জীবনের মানে বোঝানোর, তাই ব্রহ্মাণ্ডের আপাত অনিশ্চয়তা আমাদের কখনও ক্রুদ্ধ করে, কখনও বা করে ভীত। তখন সব জিনিসকেই মনে হয় অর্থহীন, এসকালেটরে চড়া একদল মানুষকে তখন মনে হতে পারে যে তারা রোবট ছাড়া কিছু নয়। দূরবর্তী কোনও গাছকে তখন মনে হতে পারে সেটি আদতে একটি জড়বস্তু যা আদতে কোনও কারণ ছাড়াই সেখানে আছে। আর এই অনুভূতিই জন্ম দেয় কাম্যুকথিত অ্যাবসার্ডের, আর এই অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকা অ্যাবসার্ড মানুষই হল আউটসাইডার উপন্যাসের মার্সেউ। ঠিক যেন গ্রীক পুরাণের সিসিফাস, যে প্রতিদিন একটা পাথর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে তোলে যাতে সেটা আবার নেমে আসতে পারে। কিন্তু পাহাড়ে ওঠার লড়াই আর গড়িয়ে পড়ার হতাশার মধ্যেই থেকে যায় এক মুহূর্তের এক আনন্দ, যা পাওয়া যায় পাথরটা ওঠানোর ঠিক পরে আর পাথরটা গড়িয়ে নামার ঠিক আগে। সেই একমুহূর্তের জন্যই তো বেঁচে থাকা, মার্সেউও বাঁচত সেরকম মুহূর্তগুলোর জন্যই।

 

 

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...