শতাব্দী দাশ
মধ্যপ্রদেশের বিজেপি বিধায়ক আশ্চর্য এক সামাজিক সমাধান বাতলেছেন — লাভ জিহাদ ঠেকাতে দেশে বাল্যবিবাহ চালু করতে হবে আবার! স্বাভাবিক কারণেই, নানা স্তরে চলছে নিন্দা, বিদ্রূপ, সমালোচনা। বিজেপি-র তথাকথিত ‘বেটি বচাও’ প্রকল্পের মুখোশ খুলে গেল, এভাবে ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করছেন বিরোধীরা। নারীবাদী ও সমাজসেবামূলক সংগঠনগুলি স্পষ্টত বিরক্ত। সরকারি মুখপাত্রদের এক-একটি মন্তব্য এভাবে দেশকে এক-এক ঝটকায় পিছিয়ে দিচ্ছে, রাষ্ট্রসংঘের কাছে ভারতের ভাবমূর্তি কলুষিত করছে, বলাই বাহুল্য।
আন্তঃধর্মীয়, আন্তঃসম্প্রদায় বা অন্তঃগোত্র বিবাহের হিন্দুত্ববাদী নাম ‘লাভ জিহাদ’ কেন, কেন দুটি ম্লেচ্ছ, বিদেশি শব্দ দিয়ে হিন্দুত্বের ধ্বজাধ্বারীরা অ-সিদ্ধ বিবাহকে নামাঙ্কিত করলেন — এই প্রশ্নের উত্তর অজানা। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলির জেরে ‘লাভ জিহাদ’ বেশ প্রচলিত লব্জ। ভারতবর্ষে অনার কিলিং ক্রমবর্ধমান। খাপ ও সম্মান-হত্যার ইতিহাস নিয়ে এর আগে এই পত্রিকাতেই একটি নিবন্ধ লেখা গেছিল। এ’দেশে একবিংশ শতকে প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে খাপপ্রধানরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিরোধিতা করে। বলে, সম্মান হারানোর চেয়ে বরং তারা কন্যাসন্তান জন্মাতেই দেবে না। কিন্তু সাম্প্রতিক নজিরটি রাখলেন যিনি, তিনি গ্রামীণ খাপের মোড়ল নন। রীতিমতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত এম.এল.এ। মধ্যপ্রদেশের আগরের বিধায়ক শ্রী গোপাল পরমর।
বিধায়ক মহাশয়ের প্রত্যয়ী ভাষণের প্রতিপাদ্য ছিল — যখন ছেলে মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক থাকতেই তাদের বিয়ে স্থির হয়ে যেত, তখন সমাজ সুশৃঙ্খল ছিল। বর-বধূ পরস্পরকে চিনত না, এমনকি তাদের সম্মতিরও প্রয়োজন ছিল না। অথচ বিবাহ ছিল টেকসই, চিরন্তন। বর্তমানে, ছেলে-মেয়ের বিয়ের বয়সের অপেক্ষা করতে করতে তারা লায়েক হচ্ছে, তাদের পছন্দ অপছন্দ তৈরি হচ্ছে, তারা হয়ে উঠছে স্বেচ্ছাচারী। বিশেষত মেয়েরা পরিবারের নাক কেটে প্রেম-বিবাহ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে।
তিনি সদর্পে আরও দাবি করেন, তিনি নিজে এককালে বাল্যবিবাহ করেছিলেন। পরে পরিবারের মাথা তথা পিতা হিসেবে নিশ্চিত করেছিলেন, যাতে তাঁর সন্তানদের বিয়ে স্থির হয়ে যায় তারা বিবাহের বয়সে পৌঁছনোর আগেই। এই সনাতনী পদ্ধতি অনুসরণ করে তিনি ও তাঁর পরিবার ভালো আছেন, সুখে আছেন। সুতরাং লাভ-জিহাদ নামক বুনো ওলকে বাল্যবিবাহ নামক বাঘা তেঁতুল দিয়েই আটকাতে হবে।
আমরা অবাক হইনি। আশা করিনি, তিনি বুঝবেন যে মেয়েদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বৃদ্ধির সাথে সমানুপাতে বাড়বে নির্যাতনমূলক সম্পর্কে না থাকার রোখ, বিয়ে না টেকার যা অন্যতম প্রধান কারণ। এক পিতৃতান্ত্রিক দেশের ততোধিক পিতৃতান্ত্রিক গোবলয়ের রাজ্য মধ্যপ্রদেশ। সে রাজ্য ভারতের তথা বিশ্বের মানচিত্রে বাল্যবিবাহ সহ অন্যান্য লিঙ্গবৈষম্যমূলক অপরাধের জন্য লাল অক্ষরে চিহ্নিত। সেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাল্যবিবাহ না হওয়াটাই অবাক-করা ঘটনা। পুরুষানুক্রমে গভীরে সেঁধিয়ে যাওয়া এ’রকম হাজার ভাবনারাশি সেখানে বিরল নয়। আন্তর্জালিক নিত্য প্রতিবাদ-মুখরতার ধরাছোঁয়ার বাইরে সেইসব প্রান্তর। তবে আন্তর্জালিক বাঙালি পাঠক হয়ত এই খবর শুনলে খানিক অবাক হবেন যে, বাল্যবিবাহে পশ্চিমবঙ্গও ইউনিসেফের বিচারে লাল কালিতেই চিহ্নিত আরেক প্রদেশ!
শ্রী গোপাল পারমরের বক্তব্য এক আশ্চর্য, অনভিপ্রেত সমাপতন এই কারণে যে, ইউনিসেফের সাম্প্রতিক রিপোর্টে সমাজকর্মীরা সবে খানিক স্বস্তির শ্বাস ফেলবেন ভাবছিলেন। রিপোর্ট বলছে, ২৫ মিলিয়ন বাল্যবিবাহ রুখে দেওয়া গেছে শেষ দশকে, বিশ্বজুড়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিয়ে আটকানো গেছে দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত ভারতে। ভারত বাল্যবিবাহে অগ্রণী তো বটেই, তদুপরি আয়তন-জনসংখ্যা ইত্যাদি মাথায় রাখলে ভারতে বাল্যবিবাহ হ্রাস করতে পারা মানে আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানেও বড়সড় হেরফের। ২০০৬ (৪৭% বাল্যবিবাহ) ও ২০১৬ (২৭% বাল্যবিবাহ) সালে নেওয়া পরিসংখ্যানের তফাত দেখে বাল্যবিবাহে উল্লেখযোগ্য হ্রাস সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন ইউনিসেফের কর্মকর্তারা। ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী ১৫.৩ মিলিয়ন মেয়ের আঠারোর নিচে বিয়ে হত ভারতে। ইউনাইটেড নেশনের ‘সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্ট গোল’-এর মধ্যে একটি প্রধান ‘গোল’ বা লক্ষ্য হল ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করা। কারণ বাল্যবিবাহ এমন একটি রোগ, সমাজ ও ব্যক্তির সার্বিক স্বাস্থ্যের উপর যার প্রভাব মারাত্মক ও বহুমুখী।
ইউনিসেফ বারবার মনে করাচ্ছে, যদিও ছেলে-মেয়ে উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাল্যবিবাহে, তবুও পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা আরও করুণ ভুক্তভোগী। বাল্যবিবাহ শিশুকন্যার ক্ষেত্রে এমন এক অভিজ্ঞতা, যা ইউনিসেফের মতে ‘has a life altering impact’। তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের স্থায়ী অবনতির জন্য তা দায়ী প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে। নানা যৌন রোগের শিকার হতে পারে মেয়েটি, যেহেতু তার সুরক্ষিত যৌন সম্পর্কের ধারণাই নেই কিশোরীবেলায় বা শৈশবে। সে মারা যেতে পারে অসংবেদী যৌনতার ফলে, প্রবল রক্তক্ষরণে। তার শিক্ষাজীবন শেষ করে দিয়ে বাল্যবিবাহ তার ও তার আগামী প্রজন্মের অশিক্ষা ও কুশিক্ষা নিশ্চিত করে।
অন্যদিকে সেই অশিক্ষা-কুশিক্ষাই আরও শক্ত করে লিঙ্গবৈষম্যের ভিত — আরও অনেক বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, ভ্রূণহত্যা ঘটায়, ঘটিয়ে চলে। লিঙ্গবৈষম্য একদিকে বাল্যবিবাহের কারণ। অন্যদিকে বাল্যবিবাহই লিঙ্গবৈষম্যকে মুছে যেতে দেয় না। অর্থাৎ, লিঙ্গবৈষম্য এবং নিরক্ষরতা — উভয়েই বাল্যবিবাহের যুগপৎ কারণ ও ফল। নিরক্ষরতার মাধ্যমে পরিবার তথা সম্প্রদায়ের দারিদ্রও চিরন্তন হয়। দারিদ্রের হাত ধরে আসে অপুষ্টি, আসে শিশুমৃত্যু, এবং আবারও, আরও অনেক বাল্যবিবাহ।
সমাজকর্মীরা এমনকি বাল্যবিবাহ আটকাতে প্রত্যন্ত প্রদেশে জনসংযোগের জন্য ব্যবহার করেন পিতৃতান্ত্রিক ভাষাই। মা পরিণত ও সুস্থ না হলে সুস্থ সন্তান প্রসব করবে কী করে? মা শিক্ষিত না হলে কী করে শিক্ষিত হবে তার ছেলে? নারীকে সন্তানধারণের যন্ত্র হিসেবে নিশ্চয় চিহ্নিত করা হয় এই আদান-প্রদানে। কিন্তু একটি মেয়ের খেলাধুলোর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার মধ্যে যে অসংবেদনশীলতা, তা বুঝতে ভারতীয় জনসাধারণের এখনও ঢের দেরি। অগত্যা ভবিষ্যতের পুত্রসন্তানের সুস্থতা আর শিক্ষার জিগির তুলে বাল্যবিবাহ-বিরোধী ক্যাম্পেইন চালাতে হয়।
বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বধূ-নির্যাতনের হারও অনেক বেশি। যৌন নির্যাতন বা বৈবাহিক ধর্ষণের হার ১৫-১৯ বছরের মেয়েদের মধ্যে ১৩%। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে তা ১০% মতো। শারীরিক-মানসিক নির্যাতনও চলে অপরিসীম। রাজস্থানের রিঙ্কু দেবী ইউনিসেফের প্রতিনিধিদের বলেছিল, সে ‘নারীগুঞ্জন’ নামক স্বনির্ভরতা ও নারীশিক্ষা-প্রসার গোষ্ঠীর সদস্য হয়েছিল বাবাকে রাজি করিয়ে। রোজ যেত ক্লাস করতে। কিন্তু বালিকা বয়সে বিয়ের পর শাশুড়ি ‘নারীগুঞ্জন’-এ যেতে দিতে রাজি হলেও, স্বামী বলেছিল, “ওখানে পড়তে বা হাতের কাজ শিখতে গেলে ঠ্যাং ভেঙে দেব।” রিঙ্কু দেবী — এখন আঠারো ছুঁই ছুঁই — ফিরে চলে এসেছিল বাবার বাড়ি। কিন্তু সবাই কি ফিরতে পারে? ফেরার রাস্তা খোলা থাকে কি? কেরলের একটি মেয়েকে পুড়িয়ে দিয়েছে তার বর, এই সপ্তাহের খবরেই প্রকাশ। অপরাধ ছিল, একইরকম এক স্বনির্ভর গোষ্ঠী, নারী-ক্ষমতায়ন ও বয়স্ক-শিক্ষা গোষ্ঠীতে যোগদান করা। এই নির্যাতন, মারধর, কাজে বাধাদান তো প্রত্যাশিতই। মেয়েকে ছোট বয়সে বধূ হিসেবে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যই তো শুরু থেকে শাসনের মাধ্যমে তাকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের উপযুক্তভাবে গড়েপিটে নেওয়া, ‘ডিসিপ্লিন’ করা। শিশু বা কিশোরীকে বেঁধে ফেলা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে ‘ডিসিপ্লিন’ করার চেয়ে সহজতর।
বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে মেয়েকে বেচে দেওয়ার, পাচার করে দেওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। ট্র্যাফিকিং-এর সাথেও বাল্যবিবাহের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। এমনকি ধর্ষণ করে, তারপর শরীরের অঙ্গ বেচে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
পণপ্রথাও পরোক্ষ কারণ বাল্যবিবাহের। ভিটে-মাটি চাটি হয়ে যাওয়ার ভয়ে বাবা-মা যখনই এমন পাত্র পান যার খাঁই অপেক্ষাকৃত কম, তখনই কন্যাদান করেন তড়িঘড়ি। বুঝতে চান না, খাঁই কম হওয়ার থাকতে পারে কোনও গোপন কারণ। খোঁজও নেন না, মেয়েটির পাচার হয়ে যাওয়ার বা অর্গান-চুরির র্যাকেটে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কতটা।
বিহারের বিতিয়া জেলায় পাঁচ থেকে আট বছরের মধ্যে মেয়ের বিবাহ স্থির না হলে নাকি দোজবরে, বিপত্নীক, ডিভোর্সি ছাড়া জামাই জোটে না — জানিয়েছেন মেয়েদের বাবামা। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের অনতিদূরে দুদিয়া গ্রামে বিয়ে হয় মোটামুটি ওরকমই বয়সে। তারপর ঋতুমতী হওয়া পর্যন্ত অবশ্য মেয়ে বাপের বাড়ি থাকে। রজঃস্রাব শুরু হলেই তাকে সন্তান-ধারণক্ষম ধরে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার চল। কিন্তু বাপের বাড়ি থাকার কালেও ‘স্বামী’ এসে বালিকার সাথে থাকতে পারবে কিনা, ‘বৈবাহিক যৌনতার অধিকার’ ফলাতে পারবে কিনা, তা নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে আছে বিভিন্ন নিদান।
‘Violation of child rights’ বলে বাল্যবিবাহকে স্পষ্টতই চিহ্নিত করেছে ইউনিসেফ, বহু আগেই। কিন্তু তাতে বিধায়ক মহাশয় সহ পিতৃতান্ত্রিক মুরুব্বিদের খুব কিছু যায় আসে না। হিন্দুত্ববাদী দলের বিধায়কের মন্তব্যের ভিত্তিতেই না হয় এমন মিথ মন থেকে আশু মুছে ফেলা যাক যে, শুধু মুসলিম সম্প্রদায়েই বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে হিন্দুরাও আদৌ পিছিয়ে নেই এ ব্যাপারে। বরং ভারতের জৈন, বুদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ে বাল্যবিবাহের প্রকোপ বেশ কম। তপসিলি জাতি উপজাতির মধ্যে এর হার বেশি, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে। রাজস্থান, অন্ধ্র প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ইত্যাদি রাজ্যের ৬৪০টি বিভিন্ন জেলার অবস্থা বেশ সঙ্কটজনক বাল্যবিবাহের নিরিখে।
২০১৭ সালের অক্টোবরে, সর্বোচ্চ আদালতের ঐতিহাসিক রায়ে নিজের আঠারো বছরের কমবয়সী স্ত্রীর সাথে সঙ্গমও ধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ২০০৬-এর ‘প্রহিবিশন অফ চাইল্ড ম্যারেজ আইন’ অনুযায়ী বাবা-মা বা উদ্যোগী আত্মীয়ের এক লাখ টাকা জরিমানা ও দু বছর জেল হতে পারে বাল্যবিবাহের আয়োজন করলে। যদিও আইন এড়িয়ে ঘটে যাওয়া বাল্যবিবাহ, অর্থাৎ ২১ বছরের কমবয়সী ছেলেদের বা ১৮ বছরের কমবয়সী মেয়েদের বিবাহ, কোর্ট নাকচ করে না সচরাচর। তবে প্রয়োজনে মামলা করা যেতে পারে ডিভি আইন, ২০০৫ অনুসারে। এছাড়া পক্সো, ২০১২ তো আছেই অপ্রাপ্তবয়স্কদের যৌন নিগ্রহ ঠেকাতে, সেটিও ব্যবহার করা যেতে পারে। আছে ২০০০ সালের জুভেনাইল জাস্টিস আইন। অর্থাৎ আইনত বাল্যবিবাহে অংশগ্রহণকারী ও আয়োজককে একাধিক উপায়ে ‘স্যু’ করা যায়।
তা সত্ত্বেও টিভি সিরিয়ালে বাল্যবিবাহের রমরমা, বিধায়কের অকুতোভয় উক্তি প্রমাণ করে, শুধু আইনের মাধ্যমে ২০৩০-এর মধ্যে বাল্যবিবাহ নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যকে ছোঁয়া যাবে না। ইউনাইটেড নেশন-এর ‘সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্টাল গোল’ অধরাই থাকবে শুধু আইনমুখী সংস্কারসাধনে জোর দিলে। বরং দরকার সার্বিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পথকে মসৃণ থেকে মসৃণতর করতে হবে, যা রাষ্ট্রের তথা নাগরিকের দায়িত্ব। একটি মেয়েও যাতে ‘ড্রপ আউট’ না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। নিরক্ষরতার সাথে বাল্যবিবাহের সম্পর্ক আমরা আলোচনা করেছি। প্রশ্ন হল, স্কুলে এসে মেয়েটি সঠিক শিক্ষা পাবে তো? তার পরিবারের মতো তার স্কুল, তার শিক্ষক, তার সিলেবাস — সবাই মিলে তার মাথায় ঢুকিয়ে দেবে না তো ‘বিবাহই নারীজীবনের মোক্ষ’ বা এরকম নানা আবর্জনা? শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার সে জন্য। দরকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে, স্বনির্ভরতা প্রকল্প, নারীশিক্ষা প্রকল্প, বয়স্কশিক্ষা প্রকল্প বা এরকম বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এমন জনসংযোগ গড়ে তুলতে হবে যাতে মেয়েরা নিজেরাই রুখে দেন সন্তানতুল্যদের বিবাহ, বিবাহসম্ভাবনা দেখলেই প্রতিটি শিক্ষিকা যাতে বুক দিয়ে আগলে রাখেন প্রতিটি বালিকাকে। চোখ খোলা রাখলে আশেপাশে, যাতায়াতের পথে, স্কুলে-কলেজে চিনে ফেলা যায় সেই মেয়েদের, যারা হারিয়ে যেতে চলেছে। প্রথমে কদিন শাঁখা সিঁদুর পরে ব্রীড়াবনত যাতায়াত ক্লাসে, তারপর উধাও হয়ে যাবে যারা! আশার কথা, প্রায়শই আজকাল মেয়েরা স্থানীয় মানুষ তথা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাহায্যে নিজেরাই বিয়ের আয়োজন ভেস্তে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে সরাসরি সাহায্য নেওয়া যেতে পারে চাইল্ডলাইনের (১০৯৮ ডায়াল করে)। স্থানীয় থানাও খবর পেলে তৎপরতা দেখায়, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে।
‘এলাটিং বেলাটিং’ খেলায় রাজা ‘একটি বালিকা’ চাইলেই ছিল ‘নিয়ে যাও, নিয়ে যাও, নিয়ে যাও’ বলে রাজার পছন্দের বালিকাকে যূথের থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার দস্তুর। এত সহজে, খেলাচ্ছলে, অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেব আমাদের মেয়েদের?
খুব ভালো লেখা। তথ্য ও যুক্তিতে পাঠককে ঋদ্ধ করে।