লোকল ট্রেনের ভেন্ডর

অভিজিৎ পাল

 

গরমকালে জল সাথে রাখাটা খুবই দরকার।ডিহাইড্রেশন জীবনটাই শেষ করে দেয়।কলেজ যাওয়ার দেড় ঘন্টার পথে একলিটার জল তো চোখের পলকেই শেষ হয়ে ঘাম দিয়ে বেরিয়ে যায়।তা কিছুদিন আগে একটু বেলার দিকে বেরিয়েছি,ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা।লোকজন ঝিমুনির সাথে শিয়ালদহ অবধি জিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টায়।কেউ বিড়ি ফুঁকছে,কেউ তাস পিটে চলেছে নিবিষ্ট মনে।আমার জলটা মোটামুটি দমদম ছাড়তে ছাড়তেই প্রায় শেষ।বিধাননগর পেরোনোর পর জলতেষ্টায় কাতর হয়ে পড়েছি,তার আগে ওই লু বওয়া প্রচন্ড গরমের মধ্যে ধোঁয়াও খেয়েছি।ঘামে নাকাল অবস্থা,গ্রীষ্মস্নাত আমি একটু জলের জন্য বাস্তবিকই এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছি যদি কোনে সহৃদয় আমার তেষ্টা মিটিয়ে পুণ্যার্জনের পথ প্রশস্ত করে।ভেন্ডরে ওঠা ব্যাপারী কাকাদের কাছে জল চাইতে কেমন লাগে কারণ ওদের হাড়ভাঙ্গা মেহনতে জলের যোগানটা আমার থেকেও বেশী দরকার বোধহয়।অতএব শিয়ালদহ অবধি নিজের মনকে শান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া উপায় রইল না।

ইতিমধ্যে ট্রেনটা এসে কারশেডের কাছে দাঁড়িয়েছে প্ল্যাটফর্মের ডিরেকশন পাওয়ার জন্য।বিধাননগর থেকে যে দুএকজন বোঁচকা নিয়ে উঠেছিল তাদেরই একজনকে দেখলাম কাপড়ে মোড়ানো বড় বোতল বের করে ঢকঢক করে জীবন পান করছে আকন্ঠ।আমি অসহায়ের মত মুখে চেয়ে আছি দেখে ওই মানুষরূপী অবতার আমায় বলল ‘কি বাবু?জল খাইবেন নাকি?’..আমি একটু অপ্রস্তুতের হাসি হেঁসে বললাম ইয়ে মানে পেলে ভালোই হয়।কাকুটা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল ‘দ্যাহেন কত্তা,বুইঝাতাসেনই যে আমাগ ধম্ম আলাদা।এই লইয়া আবার কিসু ঘইট্যা গেলে তহন আবার গাইলমন্দ কইরবেননি’!আমি হতবাক,কি বলব বুঝতে পারছি না,আসলে আমরা তো মানুষের মনুষ্যত্বের থেকে তার জাত,তার ধর্ম এসব দিয়েই বিচার করি,নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখি।প্রতক্ষ্যে বা পরোক্ষে এই প্রবণতা কমবেশী অভ্যাস করি আমরা।খানিক দমে গেলাম যেন,গলাটাও শুকিয়ে গেছে কিন্তু এই ধাক্কাটা হজম করতে সময় লাগল যেন।’মুসলমান’ নাম না জানা কাকুটা জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল ‘খাইয়া লন বাবু,ঠান্ডা আসে অহনও।আসল কথা কি জানেন,আপনারা কন জল আর আর আমরা কই পানি।পানি তো উপরওয়ালার মেহেরবানি।’হুইসেল দিয়ে ট্রেনটা শিয়ালদহ ঢুকলো,গন্তব্যে এসে নামবার তাড়া লাগল স্বাভাবিকভাবেই।ওই তথাকথিত ‘নীচুতলার’ লোকটা ভিড়ের মধ্যে বোঝা মাথায় মিলিয়ে গেল…..

Be the first to comment

আপনার মতামত...