স্বপ্নজিৎ কুণ্ডু
–ভগবানে বিশ্বাস করেন?
–ভগবান, সুপারহিরো, সব কিছুতে।
–সেকি মশাই! এসবে কেউ বিশ্বাস করে নাকি? সবই তো গল্প।
–না।
–নয়? জানেন বিজ্ঞান…
–ভগবান, অতিমানব কিভাবে জন্মায় জানেন?
–কীভাবে আবার? অং বং কাগের ঠ্যাং ভাবনাচিন্তা থেকে।
–না। একজন মানুষ তার কর্মের জোরে হয়ে ওঠে অতিমানব, আরাধ্য। তার কর্মই তাকে দেয়, ঈশ্বরের স্থান।।
#
–আজ সেই ভাত আর তরকারি? একটু বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছিল যে। নিদেনপক্ষে একটু চাউমিন।
–আজ দুপুরটা খেয়ে নে। আমি এত কষ্ট করে রান্না করলাম।
–ধুস! আচ্ছা…..
বাইরে প্রচণ্ড গরমের সাথে লড়াই করে এই ফিরলেন। তার শরীরের ঘাম চুঁইয়ে পড়ছে বিরিয়ানির প্যাকেট থেকে। ছেলেটা কী সুন্দর তৃপ্তি করে খাচ্ছে, দেখলে মন ভরে যায় তার।।
#
–কোলে নাও না।
–আজ নয়, আমার শরীর দিচ্ছে না।
–প্লিজ, আমি আর পারছি না হাঁটতে।
–আচ্ছা আয়।
শেষ শক্তিটুকু এক হয়, ভালোবাসার জন্যে। ছোট্ট মেয়েটা আজ অনেক হেঁটেছে।।
#
অতিনাটকীয় হয়ে গেল? তা হোক। কিন্তু কিছু গল্প থাকে, কিছু নাটক থাকে, যা সাধারণ বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে যায়। আর তার পেছনে অতি নামের ফিল্ডারটা তাড়া করে। এসব তো আর এক দুই রানের খেলা নয়। বিশেষ করে এই মানুষটা সচারচর এক দুইতে খেলার নয়।
আচ্ছা শুনুন। কী পড়ছেন? এই যে আমি যা লিখলাম তা আপনি পড়েই চলেছেন, তা সেটা কী? আচ্ছা আপনি যা পড়ছেন, তা আমি কীভাবে লিখলাম জানেন? না। জানার কথা নয় সাধারণত। কিছু কিছু মুহূর্তে জানতে পারেন, যখন আপনি নিজেও কলম ধরেন ভালোবাসার মানুষটার জন্যে। বা ঠোঁটের ডগায় কথাগুলো যখন ঠেলাঠেলি করে ব্যাট করতে নামার জন্যে, আর আপনি রাশভারি কোচের মতো তাদের ধমক দেন। এবার বুঝুন, আমার অবস্থা কতটা সঙ্গীন। মানুষটাকে যে ভালোবাসতাম। আর আজীবন বাসব। কাল যখন চলে গেল, তখন একটা সার সত্যও বুঝে গেলাম।
জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে।।
#
শুরুটা ভালোভাবে হয়নি ডিভিলিয়ার্সের। নিজের প্রথম টেস্ট সিরিজে সেঞ্চুরি, তারপরে খরা। কিন্তু রাখে হরি মারে কে। মেঘের আড়াল থেকে সূর্য উঁকি দিল, তারপর প্রকাশ্যে আনল তার তেজ। সে কী রূপ, সে কী ভয়ঙ্কর সুন্দর! যেন মগ্ন নটরাজের তাণ্ডব, যেন ঝড়ের দিনে প্রকৃতির দুর্দম নৃত্য। এক শিল্পী, ব্যাটের টানে আঁকতে চেয়েছিল তার গল্প। এক বাদক, সেতারের টানে যে তৈরি করেছিল সঙ্গীতের মূর্ছনা। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার আওয়াজ ছিল তার ব্যাটিং, বসন্তের মিঠে রোদে কোকিলের কুহুতান ছিল তার ব্যাটিং। আর সেই কুহুতান মনে করাত কতটা দুর্বল আমরা, কতটা নশ্বর, কতটা ক্ষুদ্র। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম সেই অতিমানবের দিকে, শ্রদ্ধায় মাথা হত নত। এই দেবতাকে খালি ভালোবাসা যায়, সম্মান দেওয়া যায়।
জেন্টেলমেন্স গেম নামক ধর্মের এক আব্রাহাম, যার শক্তি অপার। সে অফ স্টাম্পের বাইরের বলকে হাঁটু গেড়ে বসে লেগ সাইডের বাউন্ডারি দিয়ে উড়িয়ে দেবে। সে তার ভক্তদের মুখে হাসি ফোটাবে জাদুকাঠির ছোঁয়ায়, বদলে প্রণামী নেবে প্রাণখোলা আশীর্বাদ। দুনিয়া তাকে মনে রাখবে তার শক্তির জন্যে, তার শৌর্যের জন্যে। কিন্তু এই ভগবান আবার আমার কাছে একটু আলাদা। হাজার শব্দের মাঝে ধ্রুপদী সঙ্গীতের মতো আলাদা, হরেক গয়নার মাঝে কপালে ছোট্ট টিপটার মতো অন্যরকম। তার ব্যাটিং সেই দক্ষ নাচনীর মতো, যার পায়ের ছন্দ ঢেউ তোলে প্রশংসার সমুদ্রে। বা সেই বাউলের সুরের মতো, নৌকার বৈঠার আওয়াজ যার সঙ্গীতের সাথে মিশে তৈরি করে মাদকতা, যে মুগ্ধতা নদীতে জোয়ার আনে, আনে ভাঁটা। চাঁদ আর একটু কাছে আসত, একটু ঝুঁকে দেখত। আর পূর্ণিমার আলোয় সেজে উঠত ব্যাটিং-এর তাজমল। তাকিয়ে দেখত শাহজাহান, তাকিয়ে দেখতাম আমরা। পেছনে গুপি বাঘা গেয়ে উঠত,
দেখো রে… নয়ন মেলে,
জ-গ-তের বা-হা-র।।
#
একেবারেই কি ফুলেঢাকা পথ? তা কি আর হয় মশাই, এদিক ওদিকে কাঁটা থাকবে, তবেই না শিল্পীর সৌন্দর্য। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, যে ছোট টিমদের একটু বেশিই ভালোবাসতেন। অনুযোগ আছে, যে বড় টুর্নামেন্টে কদাচিৎ জ্বলে উঠেছেন। ধমক আছে, কেন টি২০ চুটিয়ে খেলেছেন, কেন নিজের ইচ্ছেমতো শেষ দিকে দেশের হয়ে মাঠে নামতেন, বেখেয়ালি অগোছালো অবিন্যস্তভাবে পোশাক পরার মতো ঠিক করতেন তার গতিবিধি। মেজাজ আসল রাজা হতে পারে, কিন্তু এহেন মেজাজকে অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু তাতে কার কী, তার কী। ভাঙের নেশায় বুঁদ মহাদেব তখন নিজের জগতে বুনে চলন স্বপ্নের জাল, মারাদোনার মতোই ঠোঁটের কোণায় চুরুট জ্বালিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দেন বিদ্রূপদের মুখে। আর, তারপর ঘুরে তাকিয়েছিলেন। সেই তাকানোতে ছিল রাগ, সেই দৃষ্টিতে ছিল প্রতিজ্ঞা। ভারত দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট সিরিজে দলের প্রধান কাণ্ডারী, দক্ষিণ আফ্রিকা অস্ট্রেলিয়া সিরিজে একা হাতে শেষ করলেন প্রতিপক্ষকে। নানা সময় দেখিয়েছেন রুদ্রমূর্তি, আবার দরকারে বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া দিয়েছেন তার দলকে। যেমন এডিলেডের সেই ২২০ বলে করা ৩৩, ফাফ ডু প্লেসিসের সাথে দেড় দিন ব্যাট করে টেস্ট ম্যাচ বাঁচানো। বা দিল্লিতে করা ২৯৭ বলে এক অতিমানবীয় ৪৩, আমলার সাথে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভারতীয় আক্রমণকে ঠেকিয়ে রাখার বিফল মনোরথ। আবু ধাবিতে সেদিন সাউথ আফ্রিকার স্কোর ৩৩ রান তিন উইকেটের বিনিময়, যখন ব্যাট হাতে নামলেন সুপারম্যান। যখন তিনি ফিরে আসছেন, আফ্রিকার স্কোর ৫৮৪, আর তিনি নিজে ২৭৮ রানে অপরাজিত। অথবা মাত্র ২৪ বছর বয়সে পার্থে সেই মহাকাব্যিক অপরাজিত ১০৬, যার ওপরে ভর করে দক্ষিণ আফ্রিকা ৪১৪ রানের পর্বত অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। আর মুগ্ধ হয়েছি আমরা, বারবার। তার সব দোষ ত্রুটি নিয়েই তাকে ভালোবাসেছি, কারণ খুঁত না থাকলে যে আর প্রেমে পড়া যায় না।।
খেলার দুনিয়াতে এর আগে অনেক বড় খেলোয়াড় এসেছেন। মারাদোনা, পেলে, গ্যারিঞ্চা আপামর ভক্তদের নয়নের মণি। আধুনিক যুগে ফেডেরার, বা মেসি। এদের সাথে কেন এ বি ডিভিলিয়ার্সকে একাসনে বসাব, যেখানে ক্রিকেটের বিস্তার এই খেলাগুলোর তুলনায় কম। কারণ, একটি জায়গায় এনারা সবাই একই সূত্রে গাঁথা। প্রত্যেকেই বসেছেন পুজোর বেদিতে, সর্বশক্তিমানের সিংহাসনে। তাদের পরিশ্রমের ঘাম আর নিরন্তর লড়াইতে মাটিতে শুকিয়ে যাওয়া প্রতিটা রক্তবিন্দু নিয়ে গেছে তাদের সাফল্যের শিখরে, একাকার হয়ে গেছে সেই প্রতিদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দাঁতে দাঁতে চেপে লড়াই করা মানুষগুলোর জেদ, যারা চায় তাদের কাছের মানুষদের হাসিমুখ দেখতে, আনন্দ দিতে। দিনের শেষে রণক্লান্ত শরীরটা টেনে নিয়ে যখন বাড়ি ফেরে, তখন অগণিত ঈশ্বরের ছায়া পড়ে এই পৃথিবীর বুকে, বেজে ওঠে শঙ্খধ্বনি।
ভগবান সুপারহিরো তারা জন্মায় না। মানুষ তার কর্মের জোরে হয়ে ওঠে ভগবান, সুপারহিরো। আর সেই সুপারহিরোরা স্বপ্ন দেখতে শেখায়, বাঁচতে শেখায়। বেঞ্জামিন তাদের কাছে এক বাস্তব, যারা গতানুগতিকভাবে পথ চলতে চায় না, তাদের কাছে এক স্বপ্ন, যারা একটু অন্যরকম। যারা বাকিদের দেখানো বহু ব্যবহৃত পথে চলবে না, বরং তৈরি করবে তাদের নিজের রাস্তা। যে রাস্তা অদেখা, অজানা। কিন্তু সমস্ত সমালোচনার ঝড় শেষে যেখানে আসবে শান্তি, এক নতুন ঔজ্জ্বল্যের আলো, ঠিক যেমন ডিভিলিয়ার্স করেছেন তার ব্যতিক্রমী শটের মাধ্যমে, পাল্টে দিয়েছেন ক্রিকেট ব্যাটিং-এর সংজ্ঞা। এবং তাতেও হতে হয়েছে অনেক বিপত্তির সম্মুখীন, ক্রিকেট ধর্মের গোঁড়া পুরোহিতেরা বক্র চোখে তাকিয়েছিলেন, নিদান দিয়েছিলেন চলবে না। কিন্তু মাটি ঠেলে ছোট্ট চারা মাথা তুলবেই, আপন খেয়ালে অল্প অল্প করে বেড়ে উঠে। অধর্মের ধর্ম বাসা বাধে তার ডালে, বিতাড়িতরা স্থান পায় তার কোটরে। কিছু মানুষ থাকে, যারা একটু অন্যভাবে কিছু করার চেষ্টা করে। আর গল্পের শেষে রূপকথার মতোই সমস্ত বাধা পেড়িয়ে গোটা বিশ্বের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় তারা। এবিডি তাদের একজন।
ইতস্ততভাবে পা বাড়ানোর আগে হাত যে শক্ত খুঁটি খুঁজে বেড়ায়, এবিডি তার একজন।।
#
–যাই তাহলে?
–যাই বলতে নেই, বলো আসি।
–এলাম।
আজ, গোধূলির পড়ন্ত আলোয় মিলিয়ে যাচ্ছে তার পায়ের ছাপ। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, ভালো থেকো।।