নাহার তৃণা
আজকাল মেয়েটা পথে নামলেই ওকে নিয়ে ফিসফিসানির দমকে বাতাস ভারী হয় খানিক। পাড়া প্রতিবেশী আর গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা নিতান্তই হাভাতে মানুষগুলোর এমন আচরণে এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে জোনাকি। যেহেতু সে মেয়ে, তাই কলঙ্কের সবটা দায় এখন জোনাকির একার। আসল দোষী ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবশ্য অপরাধীকে ধরার খুব একটা গরজও দেখায়নি প্রশাসন। কারণ অভিযুক্ত আসামী প্রভাবশালী বলয়ের একজন। কাজেই সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের আপাতত কোনও ভূমিকা নেই এই দায় থেকে জোনাকিকে মুক্তি দেবার। বরং প্রতিদিন সমাজবদ্ধ কিছু মানুষের কটূক্তি সয়ে সয়ে জীবন বয়ে যাবার অলিখিত একটা শাস্তি ওর উপর বাড়তি বোঝা হিসেবে দিনদিন জেঁকে বসছে। জোনাকি চাইলেও তাকে এড়াতে পারে না।
ঘটনার পরপর এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য জোনাকি হাঁসফাঁস করত। কতদিন রাতে গায়ের ওড়নাটা পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস তৈরি করেও শেষ মুহূর্তে থমকে গেছে। কেন সে অন্যের কৃত ঘৃণ্য অপরাধে নিজের জীবন শেষ করতে যাবে বোকার মতো! তার শিক্ষক বাবা মা তো তাকে এমন শিক্ষা দেননি। জোনাকির জীবনে ঘটে যাওয়া অনাহুত ঘটনার আকস্মিকতায় ওর মা বাবা খানিকটা হতবিহ্বল হয়ে পড়লেও, কোনও এক জানোয়ারের থাবার নীচে মেয়ের শ্লীলতাহানিতে তাঁরা যে আরও অনেকের মতো লজ্জায় কুঁকড়ে যাননি, সেটা রসালো খবরের খোঁজে ছুটে আসা কিছু সংখ্যক মিডিয়াকর্মীদের স্পষ্ট করেই জানানো হয়েছে। মেয়ের উপর সংঘটিত অন্যায়ের বিচার চান তারা, ব্যস। এমন দ্বিধাহীন স্পষ্ট উচ্চারণ আশা করেনি বোধহয় অনেকেই। নিপীড়িতদের চিরকাল কোঁকাতে দেখে অভ্যস্ত মানসিকতার এতটা যেন হজম হয়নি। পাড়া প্রতিবেশীর অধিকাংশই জলাতঙ্কে আক্রান্ত প্রাণীর মতো আচরণ শুরু করে এই পরিবারটির সাথে। প্রথমদিকে জোনাকির কলেজের শিক্ষার্থী বন্ধুরা যেটুকু প্রতিবাদ সমাবেশ সম্ভব, করেছে। এরপর কোনও এক রহস্যময় কারণে সবার সব প্রতিবাদ কেমন উবে গেল ভোজবাজির মতো।
এই সমাজ সংসার শুধুমাত্র হাশেমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোনাজাতউদ্দিন বা তার পরিবার নিয়েই তো নয়। বাইরের পৃথিবীটা এখন বড় নিষ্ঠুর, হিংস্র আর স্বার্থপরতায় ডুবে থাকে আপাদমস্তক। একটা অন্যায় ঘটতে দেখলে সেখানে মানুষ প্রতিবাদে এগিয়ে না এসে ‘বিপদ তো আর আমার নয় বাবা’ — বলে সরে থাকে আড়ালে। অথচ বাবার আজীবনের বিশ্বাস মানুষের পক্ষে সব সম্ভব। দরকার শুধু সময় মতো জ্বলতে জানা, প্রতিবাদে সামিল হওয়া। বাইরের পৃথিবীর অধিকাংশ মেরুদণ্ডহীন মানুষের কাছে অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেয়ে এমন ঘটনার মুখরোচক গল্প ঢের বেশি উৎসাহের বিষয়, এটা জোনাকি নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝে গেছে। বিপদের দিনে দীর্ঘদিনের সহকর্মীদের সেভাবে পাশে না পেয়ে মা-বাবাও হয়তবা সে সত্যিটা বুঝে গেছেন। তবুও, মেয়ের জন্য ন্যায্য বিচারের আশায় যথাসাধ্য চেষ্টায় লেগে আছেন এখনও।
জোনাকি আর বিচারের ধার ধারে না এখন। স্বার্থপর মানুষদের পক্ষে সব সম্ভব, এমনটাও আর ভাবে না সে। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, আশৈশব শেখানো এমন বিশ্বাস টলে গেছে তার। এখন জোনাকি বিশ্বাস হারানোর পাপ উজিয়ে প্রতিদিন কলেজ যায়। পেছনে রেখে যায় কিছু মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর রসালো কথার বুদবুদ।