নাহার তৃণা
রাতের স্টেশনের রহস্যময়তা কেমন এক গা ছমছমের গল্প সাজিয়ে যায় আপনমনে। কাজ অকাজের অবসরে সামান্য সময়ের জন্যে এমন গল্পে ডুব দিতে মন্দ লাগে না। নির্ধারিত সময়ের আগেই আজকের টার্গেট খালাস হয়ে যাওয়ায় মুখলেসের ডেরায় গিয়ে রাতটা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েই পৌঁছে যাই স্টেশনে। এ অঞ্চলে এবারই প্রথম আসা। অচেনা স্টেশনে আমি অভ্যস্ত। ট্রেন আসতে মিনিট চল্লিশেক লেট হবে। স্টেশন মাস্টারের ঘর থেকে মাত্রই খবরটা নিয়ে এসে আয়েশ করে একটা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে ট্রেনের অপেক্ষায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলোর প্রতি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকি। প্রতিটা মুখ, একটা গল্প বহন করে চলেছে সন্তর্পণে। আমি সেসব গল্প পড়বার গভীর কৌতূহলে শকুন চোখে তাকাই। রাতের সাথে স্টেশন, বাসস্টপের কোথাও যেন একটা গভীর আঁতাত আছে।
দিনের আলোতে যে মানুষের মুখে লেগে থাকতে দেখি নিরাসক্তের কাঠিন্য, রাতের অন্ধকার আর স্টেশনের এই শুনশান পরিবেশে সেই মুখের ভূগোলে ফুটে ওঠে এক অজানা ইতিহাস। আমি সেই ইতিহাসের মুগ্ধ পাঠক। তাই রাতের নিঝুম স্টেশন বা বাসস্টপ আমার পছন্দের। জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাওয়া অপার্থিব রাতে অচেনা এক স্টেশনের উদ্দেশ্যে ঝিকঝিক শব্দ তুলে চলে যাওয়া ট্রেনের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই দেখি, নজরকাড়া মায়াবী মুখের এক মেয়ে অপলক তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। হাত খানেক দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন মানব মানবী ছাড়া আশেপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। বেঞ্চগুলোতে শুয়ে বসে থাকা মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে খুব নীচু গলায় আলাপে মগ্ন। চাওয়ালা বুড়ো খুব মনোযোগ দিয়ে এঁটো কাপ ধুয়াধুয়ি সেরে নিচ্ছে। বুকের ভেতর গুড়গুড় শব্দ টের পেলাম। ভেতরের ঘুমন্ত পশুটা নড়েচড়ে জানান দিল তার অস্তিত্ব। আমি যথাসাধ্য দ্রুততার সাথে মুখে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলাম সহজাত ভালোমানুষি। রিনরিনে মিষ্টি গলায় খুব কাছ থেকে যখন সে জানতে চাইল ধারেকাছে সস্তার কোনও হোটেলের খোঁজ আমার জানা আছে কিনা, বুঝে নিতে কষ্ট হল না মেয়েটিও আমার মতো আগন্তুক এই অচেনা শহরে। আমি তার নিরাপদ আশ্রয়ের ভরসা হতে পারি। কিংবা নিজেই হতে পারি তার জন্য বিপদের কারণ।
আমি মেয়েটার গলার ওড়নার ফাঁকে চেইনটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করার পর আঙুল তুলে পাশের অন্ধকার গলির দিকে নির্দেশ করে বললাম — কাছেই একটা সস্তা এবং ভালো হোটেল আছে।
মেয়েটা আমার পিছু পিছু আসছে। গলির অন্ধকারে ঢুকে আমি মেয়েটার পাশাপাশি হাঁটছি। কয়েক কদম যাবার পর কোথা থেকে আরও দুজন উদয় হল আমাদের দুজনের দুপাশে। খানিক পর মেয়েটা হঠাৎ আমার গলায় তার ওড়নাটা পেঁচিয়ে দেবার সাথে সাথে দুজন দুপাশ থেকে টানতে শুরু করলে বুঝে ফেললাম শিকার উল্টে গেছে।