প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
ষষ্ঠ পর্বের পর
তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)
‘সুবর্ণরেখা’ মুক্তির প্রায় দীর্ঘ ৭ বছর পর আসে ‘তিতাস…’। সত্তরের দশকে সেই উত্তাল সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ অন্যধারার গল্প শোনাতেই যেন ঋত্বিক বেছে নেন — ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর মতো পূর্ব বাংলার নদীকেন্দ্রিক এই আখ্যানটিকে। সত্তরের সেই অস্থির সময়ে গোটা বাংলা যখন নকশাল আন্দোলনের আগুনে ধিকিধিকি জ্বলছে, সমাজের অন্ত্যজশ্রেণির গল্প শোনাতে ঋত্বিক ঘটক যা বেছে নেন, তা নিজেও সাহিত্যগুণে অনবদ্য। অথচ সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একদিকে বাঙালি দর্শক যখন মজে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ বা মৃণাল সেনের স্ফুলিঙ্গসম ‘কলকাতা ৭১’-এর মতন সিনেমায়, সেখানে অমর কথাসাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ যা ইতিমধ্যেই ছুঁয়েছে পাঠক-হৃদয়, অজানা সেই সব নদীনির্ভর গ্রামীণ শ্রেণিসংগ্রামের ইতিকথাই তখন হয়ে উঠেছে ঋত্বিকের অনন্য হাতিয়ার। আর বলার অপেক্ষা রাখে না এভাবেই ঋত্বিক ‘ঘরানা’র স্বতন্ত্রতা, মুনশিয়ানার নয়া মহাকাব্য একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিটির আরও একটি বড় ‘প্রাপ্তি’ ছিল ওপার বাংলার (বাংলাদেশ) একঝাঁক লোকশিল্পীদের ঐকতান। ছবিটি নির্মিত হয়েও ছিল বাংলাদেশি প্রযোজনায়। প্রযোজক ছিলেন হাবিবুর রহমান খান। গান গেয়েছিলেন শ্রীযুক্ত রথীন্দ্রনাথ রায়, লীনা হামিদ, আবেদা সুলতানা, ধর্মদাস বড়ুয়া, আবু তাহের ও ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর মতো লোকসঙ্গীত শিল্পীরা। ছিলেন দীপু মমতাজ, শীলু মমতাজও। ‘টাইটেল সং’-এ লালন ফকিরের বিখ্যাত রচনা ‘ওরে নৌকা রে পার’-এর মতো ভাটিয়ালি অঙ্গ নির্ভর বাউল গানটি গেয়েছিলেন প্রখ্যাত বাউল দেরাজউদ্দিন ফকির। এই সিনেমার যন্ত্র-পরিবেশনের (instrumental) দায়িত্বে ছিল ঢাকার বিখ্যাত আলাউদ্দিন লিটল অর্কেস্ট্রা। সহ সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন লিয়াকত হোসেন লাল্টু। সঙ্গীত গ্রহণে হারুণ অল রশিদ ও এ মজিদ। বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের সংগ্রহ তুলে দিয়েছেন প্রখ্যাত গবেষক হরলাল রায়। ‘তিতাস…’-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে এটিই সম্ভবত প্রথম ভারতীয় ছবি যা বাংলাদেশের প্রযোজনায় নির্মিত হয়। বাংলাদেশ ফিল্ম বোর্ডের ছাড়পত্রও পায় ‘তিতাস…’। নেপথ্য সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি বুড়ো জেলে মাঝি তিলকচাঁদের নাতিদীর্ঘ ভূমিকায় ঋত্বিকের অভিনয় আজও অবিস্মরণীয়।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ একটি আদ্যন্ত লোকাখ্যান। মেঘনা-তিতাস পাড়ের জেলে, মালো ও গ্রামীণ সমাজের মানুষদের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের গল্প। বলাবাহুল্য, এমন একটি সিনেমার সঙ্গীতও যে লোকসঙ্গীত নির্ভর হবে না, এমনটি অপ্রত্যাশিত। সিনেমা সঙ্গীতের বিচারে ‘তিতাস…’ অনেকাংশেই পথিকৃৎ। এই সিনেমায় শুধু বুড়ো জেলে তিলকচাঁদের ভূমিকায় অভিনয়ই নয়, প্রথম কোনও সিনেমায় সুরযোজন করতে অবতীর্ণ হলেন ঋত্বিক ঘটক। ‘তিতাস…’-এ চিত্রনাট্য লেখার পাশাপাশি নেপথ্য বা আবহ সঙ্গীতে (Background score/theme) হাত পাকালেন তিনি। এই ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালকের ভূমিকায় এলেন সেনিয়স মাইহার ঘরানার বিখ্যাত সরোদিয়া ও ঘটক-ঘনিষ্ঠ উস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান। এর আগে বাহাদুর হোসেন শুধু ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’তে সঙ্গীতই দেননি, তাতে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ও (cameo) করেছেন। পূর্ববাংলার লোকগীতি, পদ, কথা ও লোকসঙ্গীতে খাঁ সাহেবের পণ্ডিতিয়ানার কথা ঋত্বিক জানতেন। এই একই বিষয়ে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন ঋত্বিক নিজেও। ‘তিতাস…’-এর মতন Rural Documentation সামলাতে তাই দুই বন্ধু, সতীর্থ একসাথে এর হাল ধরলেন।
ছবির প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় ছোট্ট বাসন্তী ধান বা চাল ঝাড়ার একটি অতিকায় ছাতা ঘোরাচ্ছে। এই দৃশ্যের নেপথ্যে একটি ময়মনসিংহ গীতিকার যা কিনা গ্রামীণ বিবাহ সঙ্গীত, তার প্রয়োগ করেছেন ঋত্বিক। ছোট্ট বাসন্তী ও তার মায়ের কথোপকথনের এই দৃশ্যটিতে ‘বিবাহ সঙ্গীত’ যথেষ্ট অর্থবহ। পরবর্তী কালে ঘুরে ফিরে একাধিকবার উঠে আসবে এই বিয়ের গান। একটু একটু করে বাসন্তী বড় হচ্ছে। কিশোরীবেলা ছাড়িয়ে যৌবনের দিকে বাড়াচ্ছে পা। একদিন তার বিয়ে হবে। সেই ভাব বোঝানোর জন্যই দৃশ্যের নেপথ্যে ঋত্বিকের এমন অশ্রুত পূর্ববঙ্গীয় বিবাহ সঙ্গীতের প্রয়োগ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
দ্বিতীয় দৃশ্যে চোখে পড়ে আদিগন্ত তিতাস। সেখানে সারি সারি নৌকার সমাহার। গোকর্ণঘাট গ্রামের মালোপাড়ার জেলেদের মাছ ধরার নৌকা। নদীর পাড়ে বসে কথা বলছে ছোট্ট বাসন্তী ও রামপ্রসাদ। রামপ্রসাদ ব্যথিত। বাসন্তীর কাছে তার মেয়ে দুর্গার চলে যাওয়ার কথা সে বলে। বাসন্তী যে তারও মেয়ের মতো। দুই অসমবয়সী মানুষের মধ্যে পিতা-কন্যার আবেদন বোঝাতে ব্যাবহার হয় বাঁশি। বড় করুণ, বিচ্ছেদের সুর তার। অনাদিঅন্ত তিতাসের দুঃখ যেন ঝরে পড়ে সেই বাঁশির সুরে।
সময় পেরোয়। পরের দৃশ্যে দেখা যায় গ্রাম শুকদেবপুরে দোলযাত্রা উৎসব। সেখানে উপস্থিত কিশোর ও সুবল মালো। শুকদেবপুরের খলাতে দোল খেলার জন্য সকলের আমন্ত্রণ পড়ে এবং বাঁশিরাম মোড়লের গাঙের রায়ত হিসেবে কিশোর-সুবলরাও ডাক পায়। এই দৃশ্যে দেখা যায় দোলপূর্ণিমা তিথি উদযাপনে গ্রামের মেয়েরা দল বেঁধে নাচছে। রাধাকৃষ্ণর পুজা মাথায় রেখে নেপথ্যে ব্যবহৃত হয়েছে রাস-কীর্তন। সাথে বাজে সেতার, বাঁশি। দোল খেলার সময় তরুণীরা কিশোরকে রঙ মাখায়। কিন্তু তাকে রঙ মাখাতে গিয়ে একটি অবিবাহিতা তরুণীর হাত কাঁপতে থাকে। দোলের অনুষ্ঠান চলার সময় মেয়েটির সঙ্গে কিশোরের চোখাচোখি হয়। হঠাৎই পার্শ্ববর্তী বাসুদেবপুরের জোতদারের লোকেরা ওখানে আক্রমণ চালায় পুরনো গণ্ডগোলের রেশ ধরে। একজন আক্রমণকারী ওই তরুণীর দিকে অগ্রসর হয়, কিশোর তাকে বাঁচাবার জন্য এগিয়ে যায়। মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে গেলে কিশোর মেয়েটিকে পাঁজকোলা করে নিয়ে মেয়েটির মার কাছে নিয়ে যায়। তার ঠিক আগের মুহূর্তে দুজন দুজনের দিকে তাকায়। দুই যুবক-যুবতীর এই আকস্মিক মিলনের তীব্রতা বোঝাতে বেজে ওঠে সরোদের ঝালা। গ্রামের মোড়লের তাগিদে বিয়ে হয় দুজনের। ছোট্ট কুঁড়েঘরে হয় মাল্যদান। নেপথ্যে শোনা যায় জনপ্রিয় সিলেটি প্রচলিত বিয়ের গান — ‘লীলাবালি লীলাবালি ভর যুবতী সইগো কী দিয়া সাজাইমু তরে’। মূলত পূর্ববাংলার বিয়ে বাড়িতে লীলাবালি গানের সমাদর হিন্দু, মুসলিম উভয় সমাজেই। অথচ আমরা অনেকেই জানি না এ গানের ইতিহাস। এই জনপ্রিয় গানটির জনক কে সেই ব্যাপারে নির্ভুল কোনও তত্ত্ব নেই। কেউ কেউ মনে করেন গানটা রাধারমণের। কারণ গানটা ধামাইল বা ধুমাইল প্রকৃতির অর্থাৎ বিয়েবাড়িতে ছেলেমেয়েদের ধামাইল নাচের সাথে গানটা গাওয়া হত। আর গানের মধ্যে ধামাইল গানের জনক শ্রী রাধারমণের সুরের প্রভাব পরিলক্ষিত। তবে অধিকাংশ পণ্ডিতদের মতে ‘লীলাবালি’ গানটি সিলেট অঞ্চলের প্রচলিত গান। যা যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। ফলত এই বিবাহ ও পরে ফুলশয্যা দৃশ্যের নেপথ্যে এই গানের ব্যাবহার প্রশংসনীয়। তার সাথে বৃন্দাবনী সারং রাগে সরোদের মূর্ছনা আলাদা মাত্রা আনে। রাত কাটে। ভোর হয়। সকালের আলোয় ‘রাই জাগো রাই জাগো’ প্রভাতি সঙ্গীত শোনা যায়। ভৈরবী রাগের প্রয়োগে এই গানের রেশ মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতন।
নতুন বউকে নিয়ে কিশোর বাড়ির পথে যাত্রা করে। কিন্তু নৌকা যাত্রাপথে দুর্যোগের মধ্যে পড়ে, শেষে তারা নয়া গাঙের খাঁড়িতে নৌকা বাঁধে। এখানে একটি দৃশ্যে দেখা যায় নৌকায় বাউল গান হচ্ছে। এই দৃশ্যেও লালনের একটি বিশ্রুত পদ ব্যাবহার করেন ঋত্বিক।
রাতের বেলা সবাই যখন ঘুমোচ্ছে সেখানে হঠাতই জল-ডাকাতের হানা হয়। ডাকাতরা কিশোরের বউকে তুলে নিয়ে যায়। মান বাঁচাতে নতুন বউ জলে ঝাঁপ দেয়। কিশোর তাকে বাঁচাতে পারে না। সদ্যবিবাহিত বউকে হারিয়ে রাগে-দুঃখে পাগল হয়ে ওঠে সে। এই দৃশ্যে সেই টালমাটাল পরিস্থিতি বোঝাতে সমবেত বেহালা, চেলো ও মেলোকর্ডের ব্যাবহার করেছেন ঋত্বিক। এবং তা যথাযথভাবে।
এরপর দেখা যায় নতুন বউ বেঁচে আছে। অচৈতন্য অবস্থায় নদীর পাড় থেকে তাকে উদ্ধার করে জেলেরা। সময় কাটতে থাকে দ্রুত। তিতাসের পাড়ে বাড়তে থাকে নৌকার ভিড়। তরঙ্গায়িত নদীতে নিস্তরঙ্গ জীবনের সারি বোঝাতে বাঁশির ব্যাবহার অতুলনীয়। ঋত্বিক এখানে বাঁশিতে অসম-ত্রিপুরা লোকগীতি অবলম্বনে “গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা” গানটির সুর ব্যাবহার করেছেন। পরবর্তীকালে ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে যা জনপ্রিয়তার মধ্যগগন ছোঁবে। এই বাঁশির সুরের মধ্যে দিয়েই সময় এগিয়ে চলে। নতুন দিনের ঘটে আবির্ভাব। অন্ধকার ছাপিয়ে।
সময় এগিয়ে চলে। অনন্তের মা এখন বাসন্তীর সই। সুখ দুঃখের সাথী। একই গ্রামে বসবাস তাদের। এক দৃশ্যে দেখা যায় রামপ্রসাদ ও অনন্তের মার কথোপকথন। রামপ্রসাদ জানেন না এই তার উন্মাদ ছেলের হারিয়ে যাওয়া বউ। অনন্তকে দেখে তিনি স্নেহার্দ্র হয়ে পড়েন। বলেন তার দুঃখের কথা। নেপথ্যে আবারও বাজে সরোদ।
দেখা যায় গাঁয়ে পুজো হচ্ছে। ভগবতীর পুজো। এই দৃশ্যে সরোদের সাথে ঢাকের একটি অসামান্য দ্বৈতবাদন ব্যবহার করেছেন ঋত্বিক। বাসন্তী এসে অনন্তের মাকে রামপ্রসাদের বাড়িতে পুজোয় নিয়ে যায়। এখানে নেপথ্যে অতুলপ্রসাদের মিশ্র রাগাশ্রিত ‘উঠো গো ভারতলক্ষী’র সুর মূর্ছনা ব্যবহৃত হয়েছে যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
সময় বয়ে চলে দ্রুত। দেখা যায় বাসন্তীকে। সে আর ছোট নেই। শরীরে রমণীয় প্রকাশ থাকা সত্ত্বেও, অদৃষ্টের ফেরে সে এখন বিধবা। কম বয়সে মৃত স্বামীর কষ্ট, নানা গঞ্জনা, অপমান নিয়ে সে বেঁচে আছে। সে কিশোর-সুবলেরই গাঁয়ের মেয়ে। অন্যদিকে দেখা যায় কিশোরকে। সদ্যবিবাহিত বউকে চোখের সামনে তিতাসে তলিয়ে যেতে দেখে সে এখন সম্পূর্ণ উন্মাদ। সেই মানসিক দুর্দশা বোঝাতে সরোদের মূর্ছনাই শেষ আশ্রয়। অবশ্যই তা করুণ সুরে। এর মধ্যে দেখা যায় মাঝিদের উদ্ধার করা কিশোরের সেই বউ এখন অনন্ত নামের একটি ছেলের জননী। মাঝিরা তাকে গ্রামে ছেড়ে ফিরে যায়। তাদের সেই বিদায়বেলায় পিলু রাগে সরোদের মূর্ছনার সার্থক প্রয়োগ করেছেন ঋত্বিক।
রামপ্রসাদের বাড়িতে আচমকাই মুখোমুখি হয় পাগল কিশোর ও অনন্তের মা। তারা যে আসলে হারিয়ে যাওয়া স্বামী স্ত্রী তা তারা জানে না। উন্মাদ কিশোরকে খেতে দিতে যায় সে। কিশোর তাকে মারতে উদ্যত হয়। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে সে থমকে যায়। বহুযুগ পরে স্বামী স্ত্রী মুখোমুখি হয়। কিশোর তার বউকে চিনতে পারে না। কিন্তু এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করে দুজনেই। নেপথ্যে ধ্বনিত হয় — ‘লীলাবালি লীলাবালি’ বিয়ের গানটি। সাথে যোগ হয় সরোদের অপার্থিব মূর্ছনা। বউকে আলতো ছুঁয়ে কিশোর পালিয়ে যায়।
অন্য এক দৃশ্যে, ক্ষুধার্ত অনন্ত ও তার মায়ের জন্য খাবার আনে বাসন্তী। সই’র প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়ে অনন্তের মা। আবারও বেজে ওঠে সরোদ। দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধুর বন্ধুত্বের স্বাক্ষ্যরূপে।
আরেক দৃশ্যে দেখা যায় দোলযাত্রা হচ্ছে তিতাসের পাড়ে। বাজে হোলির সুর। শোনা যায় সিলেটি বিয়ের গান। উন্মাদ কিশোর, তার বউ অনন্তের মা’কে আবির মাখিয়ে দেয়। বেজে ওঠে বৈষ্ণব-অঙ্গের কীর্তন। যেন রাধাকৃষ্ণ’র মিলন। আবেগের বশে উন্মাদ কিশোর তার বউকে কোলে তুলে নেয়। ঠিক যেমনটি নিয়েছিল বিয়ের আগে জোতদারদের হামলা থেকে অচৈতন্য প্রেয়সীকে বাঁচাতে। কিশোর আবেগে তার বউকে কোলে তুলে নিয়ে পালায়। তার দেহ স্পর্শ করে। অনন্তের মা’ও স্বামীর স্পর্শ চিনতে পারে। একই আবেগে ও আবেশে ধরা দেয় সে’ও। দুটি অতৃপ্ত মানুষের এই সামান্য সুখের মুহূর্তটি সম্পূর্ণতা পায় সরোদের ঝালা মূর্ছনায়। কিন্তু লোকেরা ধরে ফেলে তাদের। পাগলকে শিক্ষা দিতে তারা চড়াও হয় কিশোরের উপর। চলে গণপিটুনি। অচৈতন্য দুটি মানুষ পড়ে থাকে তিতাসের পাড়ে। প্রচণ্ড মারে গুরুতর আহত ও মৃত্যুপথযাত্রী কিশোর জল খেতে চায়। অনন্তের মা কাপড় ভিজিয়ে তার মুখে জল দিতেই সে তার বউকে চিনতে পারে। অন্তিমসময়ে ‘বউ’ বলে ডেকে প্রাণত্যাগ করে। এক মুহূর্তের জন্য ‘লীলাবালি’ গানটি বেজে ওঠে। সেই শোকে মারা যায় অনন্তের মা’ও। তার নিস্পন্দ শরীর গড়িয়ে পড়ে তিতাসের বুকে। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে অবশেষে মিলিত হয় দুজনে। নেপথ্যে বেজে ওঠে বাঁশির তীব্র সুর। বৃষ্টি নামে তিতাসের পাড়ে।
কিশোর ও অনন্তর মা’র মৃত্যুতে একটি অধ্যায় শেষ হয় ‘তিতাস…’-এর। অনন্ত এখন অনাথ। তার একমাত্র আশ্রয় মাতৃসমা বাসন্তী যাকে অনন্ত মাসি বলে ডাকে। বাসন্তীও অনন্তকে সন্তানস্নেহে লালন করে। বাসন্তীর সাথে বৃষ্টির মধ্যে মৃত মায়ের ঘাটকাজ সারে অনন্ত। কিন্তু মাকে সে ভুলতে পারে না। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে বাসন্তীর সাথে ঘরে ফেরার পথে অনন্তর নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। সে যেন দেখতে পায় তার মা ফিরে এসেছে। তার দিকে তাকিয়ে আছে স্নেহার্দ্র চোখে। দেখতে দেখতে হঠাতই যেন তার মায়ের আদলে সাক্ষাৎ মা ভগবতীকে দেখতে পায় অনন্ত। বিহ্বল দৃষ্টিতে তার মায়ের এই অদ্ভুত রূপ সে দেখে। এই দৃশ্যের নেপথ্যে পুজোর ঢাক ব্যবহার করেন ঋত্বিক। তার সাথে মন্দ্রস্বরে বেজে ওঠে সরোদ। মিয়াঁ মল্লার রাগে সরোদের সেই মূর্ছনা দৃশ্যটিকে পরিপূর্ণতা দেয়।
সময় গড়ায়। পরবর্তীকালে জেলে বনমালীর সাথে পরিচয় ও সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে অনন্তর। একটি দৃশ্যে সে বনমালীর সাথে যাওয়ার বায়না করে। কিন্তু বনমালী তাকে নেয় না। ছোট্ট অনন্তকে ফেলে সে চলে যায়। অনন্ত জলে পড়ে যায়। জলে বসেই বনমালীর চলে যাওয়া দেখে। যেন তার একমাত্র মুক্তির জায়গা তার থেকে দূরে সরে যায়। বনমালী বলে সে ফিরে আসবে, তবু অনন্ত ভগ্নচিত্তে জলেই বসে থাকে। এই দৃশ্যে আবারও বাঁশির করুণ সুর ব্যবহার করেন ঋত্বিক। অন্য একটি দৃশ্যে মায়ের চিতাভস্ম তিতাসে ভাসায় অনন্ত। এই দৃশ্যেও করুণ বাঁশির সুরটি মনকে ব্যথিত করে। অনন্ত যেন ঘোরের মধ্যে চলে যায়। স্বপ্নের মতো যেন দেখতে পায় সে তার মা’কে নৌকে বেয়ে কোন অজানায় পাড়ি দিচ্ছে। কিন্তু আবারও মা’র পরিবর্তে সাক্ষাৎ দেবী ভগবতীকে দেখতে পায় অনন্ত। তার এই hallucination-এর দৃশ্যে বাঁশি বেজে ওঠে। সার্থকতা পায় দৃশ্যটি।
রাতে ছোট অনন্তকে সাথে নিয়ে শোয় বাসন্তী। মা মরা ছেলেকে বাসন্তী সান্ত্বনা দেয়। বলে তার মা আশেপাশেই আছে। সে তাকে দেখছে। মৃত্যু কোনও শেষ নয়, আরেকটি শুরু মাত্র। এই কথোপকথনে আবারও সেই বাঁশির শব্দের ব্যবহার শোনা যায়। অনন্ত আবারও আচ্ছন্ন হয় পড়ে। ঘোরের মধ্যে যেন দেখতে পায় ভগবতীরূপী তার মা’কে। দেখতে দেখতে তার মায়ের মুখ, দেবী ভগবতীর ও বাসন্তীর মুখ মিলেমিশে এক হয়ে যায়। এখানেই মাতৃত্বের পরিপূর্ণতা প্রকাশ পায় এই দৃশ্যে। মঙ্গলারতি শুরু হয়। বেজে ওঠে ঘণ্টা। পুজোর গন্ধ নিয়ে ঘর ভরে ওঠে ধোঁয়ায়। যেন চরাচরবিস্তৃত মাতৃত্বের জয়গান। বাসন্তী পরমস্নেহে মা মরা অনন্তকে বুকে চেপে ধরে।
এদিকে অনন্তকে নিয়ে ক্রমেই অশান্তি বাড়তে থাকে বাসন্তীর বাড়িতে। তার মা বাবা চায় না অনন্ত সে বাড়িতে থাকুক। কিন্তু বাসন্তী রাজি হয় না কিছুতেই। একদিন বাসন্তী ও তার মায়ের মধ্যে অনন্তকে নিয়ে প্রবল বচসা হয়। ধ্বস্তাধস্তিতে মা ও মেয়ে দুজনেই আহত হয়। রাগের মাথায় অনন্তকে তাড়িয়ে দেয় বাসন্তী। অনন্ত পালিয়ে যায়। বৃষ্টির মধ্যে একটি ভাঙা নৌকায় সে আশ্রয় নেয়। বাসন্তী তার ভুল বুঝতে পেরে অনন্তকে ফিরিয়ে আনতে পিছুপিছু দৌড়ায়, কিন্তু ধরতে পারে না। দুঃখে ভরে ওঠে তার চোখ। এই দৃশ্যেও বাঁশি ও সরোদের মূর্ছনা মন ছুঁয়ে যায়। দেশ রাগে বাঁশির সুর ছড়িয়ে পড়ে বিস্তৃত চরাচরে।
অন্য দৃশ্যে অনন্তকে দেখতে পায় বাসন্তী। কিন্তু বাসন্তীকে সে অভিমানভরে অগ্রাহ্য করেছে। রাগে, দুঃখে ফুঁসে ওঠে বাসন্তী। তার মনের সেই অস্থিরতা দেখাতে এই দৃশ্যে সরোদের ঝালার অংশ ঘুরে ফিরে আসতে থাকে গোটা ফ্রেম জুড়ে।
একটি দৃশ্যে অনন্ত গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। বিদায়বেলায় বাসন্তী নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে অনন্ত’র চলে যাওয়া দেখে। রাগে, অভিমানে সে মুখ খারাপ করে। নেপথ্য সঙ্গীতে সরোদের ঝালার পাশাপাশি বাউলগান — ‘পোড়ারমুখী কান্দিস নি তুই আর’ গানটি মনে ছাপ ফেলে যায়। অন্য একটি দৃশ্যে তিতাসের পাড়ে লম্বা নারকেল গাছ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে জোতদার মগন সর্দার। সেই দৃশ্যেও উঠে এসেছে সরোদের তীব্র মূর্ছনা।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমার শেষ দৃশ্যে উল্লেখনীয় হল তিতাসের বুকে বাইচ বা নৌকাদৌড় প্রতিযোগিতা। এই দৃশ্যে অধুনালুপ্ত একাধিক বাইচ বা নৌকাদৌড়ের গান ব্যবহার করেছেন ঋত্বিক। এই সব ‘ক্রীড়া সঙ্গীত’ আজ হারিয়েছে বিস্মৃতির অতলে। অধিকাংশ একাধিক দেবদেবীর নামে মানত করা গান। সেখানে বহুদিন পর অনন্ত’র সাথে দেখা হয় বাসন্তীর। হয় মনোমালিন্য। এর মধ্যেই চলে বাইচ প্রতিযোগিতা ও তার গান। এরপরেই বাসন্তীদের মালোপাড়ার গ্রাম আক্রমণ করে লোভী জোতদারেরা। বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় তাদের লেঠেল বাহিনী। আবারও বাজে সরোদ। বিচ্ছেদের সুরে। ঘরহারা হয় সকলে।
সময় কাটে। জোতদারদের অত্যাচারে খালি হয়ে যায় মালোপাড়া বিকর্ণঘাট। প্রবল দারিদ্র চারিদিকে। সবাই গ্রাম ছেড়ে পালায়। অধিকাংশই আসামের চা বাগানে মজুরের কাজ নেয়। কিন্তু গ্রাম ছেড়ে যায়নি বাসন্তী ও তার পরিবার। গাঁয়ের পথ ধরে একা হাটতে দেখা যায় বাসন্তীকে। সরোদের মূর্ছনায় ভেসে ওঠে দেশ রাগ। এদিকে একসময় দেখা যায় জল সরে যাচ্ছে তিতাসের। চরাচর জুড়ে জাগে শুকনো খটখটে তিতাসের চর। জলের প্রবল অভাব। তেষ্টায় মারা পড়ছে সবাই। কিন্তু বাসন্তী হাল ছাড়েনি। ভেঙে পড়েনি। লড়াই জারি রাখে। অন্যদিকে জোতদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে জেলেরা। শুরু হয় লড়াই। এই লড়াই অস্তিত্ব সংগ্রামের। মাঝি ও জোতদারদের লড়াইর দৃশ্যে ঋত্বিক দৃশ্যটিকে বাস্তবায়িত ও টানটান করে তুলতে তবলা লহরা ব্যবহার করেন।
সিনেমার একেবারে শেষদৃশ্য ধরা পড়ে আরেকটি সাংগীতিক চমক। সে দৃশ্যে দেখা যায় তৃষ্ণার্ত, দুর্বল ও অনাহারক্লিষ্ট বাসন্তীকে। সে তিতাসের বালি খুঁড়ে জল তুলে আনে অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু জল খেতে পারে না। ক্লান্ত অবসন্ন দুর্বল দেহে সে লুটিয়ে পড়ে তিতাসের পাড়ে। আধো ঘুমে, আধো জাগরণে সে দেখতে পায় দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মধ্যে দিয়ে এক বালক ভেঁপু বাজাতে বাজাতে চলেছে। তার মুখ অনন্তর মতো। বাসন্তীর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
অর্থাৎ এখানেই শেষ নয়। বরং নতুন করে চলার পথের আরম্ভের ইঙ্গিতবাহক ওই তালপাতার ভেঁপুর আওয়াজ। এখানেই তিতাসের সার্থকতা। এভাবেই পরিপূর্ণতা পায় ‘তিতাস…’-এর সাঙ্গীতিক যাত্রা।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)