সুশোভন ধর
Il n’y a pas un seul film qui montre des problèmes ouvriers ou étudiants tels qu’ils se passent aujourd’hui, il n’y en a pas un seul, qu’il soit fait par Forman, par moi, par Polanski, par François, il n’y en a pas. Nous sommes en retard. Nos camarades étudiants nous ont donné l’exemple en se faisant casser la figure il y a une semaine. Il ne s’agit pas ici de continuer ou de ne pas continuer à voir des films pour l’instant, il est évident que nous devons projeter et voir le plus de films possible, et que c’est là notre but. Aujourd’hui ou demain, il ne s’agit pas de ça, il s’agit de manifester avec un retard d’une semaine et demie la solidarité du cinéma sur les mouvements étudiants et ouvriers qui se passent en France. La seule manière pratique de le faire est d’arrêter immédiatement toute projection.
—Jean-Luc Godard
একটাও ছবি নেই যা শ্রমিক ও ছাত্রদের সমস্যার কথা বলে, সমাজে কী ঘটছে তা দেখায়। এই নিয়ে ফরমান, আমার, পোলনস্কির বা ফ্রঁসোয়ার কোনও ছবি নেই। আমরা সময়ের থেকে পিছিয়ে পড়েছি। এক সপ্তাহ হল আমাদের ছাত্র কমরেডরা নিজেদের মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে আমাদের পথ দেখিয়েছে। এখানে প্রশ্নটা এই নয় যে এখন আমরা ছবি দেখব, না দেখব না। এটা পরিষ্কার যে আমাদের যথাসম্ভব ভাল ছবি দেখাতে এবং দেখতে হবে। এটাই আমাদের লক্ষ্য। আজ ও আগামীকালের প্রশ্নটা আরও ভিন্ন। দেড় সপ্তাহ দেরি হলেও চলচ্চিত্র শিল্পকে ফ্রান্সে চলমান ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর জন্য রাস্তায় নামতে হবে। আর এর একমাত্র কার্যকরী উপায় হল সমস্ত ছবি দেখানো অবিলম্বে বন্ধ করা।
—জঁ-লুক গোদার
১৯৬৮ সালের মে মাসে ফ্রান্সে বসন্তের ঝোড়ো দিনগুলিতে উত্তাল আন্দোলনের সমর্থনে, কান চলচ্চিত্র উৎসব বন্ধ রেখে, রাস্তায় ছাত্র ও শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর ডাক দিয়ে জোর গলায় এই কথাগুলি বলেন জঁ-লুক গোদার। গোদারের এই বক্তব্যের পরে তাঁর পাশ থেকে আরেক দিকপাল চলচ্চিত্রকার, ফ্রঁসোয়া ত্রুফো দৃঢ়তার সাথে এই উৎসব বন্ধ করার ডাক দেন। চেক-আমেরিকান মিলোস ফরমান তাঁর ছবি তুলে নেন এই প্রদর্শনী থেকে।
আসলে বাতাস ভরে গেছিল বারুদের গন্ধে। সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের নঁতের ক্যাম্পাস থেকে শুরু হওয়া ছাত্র বিক্ষোভ চারিদিকে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। এর প্রভাবে শুধুমাত্র কান-এর উৎসব মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়নি, ফরাসি চলচ্চিত্র শিল্প ও রাজনীতিতেও বড়সড় পরিবর্তন আসে। একবিংশ কান চলচ্চিত্র উৎসব তার পূর্ব নির্ধারিত নির্ঘণ্ট অনুযায়ী ১০ই মে শুরু হয়। অন্যদিকে সেই সন্ধ্যায় প্যারিসীয় পুলিশ এক ছাত্র বিক্ষোভের ওপর হামলা চালায়। ২০,০০০ ছাত্র প্যারিসের রাস্তায় ফ্রান্সের শার্ল দ্য গোলের নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীল সরকারের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে পথে নেমেছিল। পুলিশের হামলায় আহত শয়ে শয়ে ছাত্রকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এর তিন দিন পরে, ২০ লক্ষ ফরাসি শ্রমিক ছাত্রদের সমর্থনে একটি সাধারণ ধর্মঘট ডেকে প্রশাসনিক কাজকর্ম ও পৌর পরিষেবা স্তব্ধ করে দেয়। এরপর কারখানা ও অফিস-কাছারি থেকে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী পথে নামার ফলে এই একদিনের হরতালের মেয়াদ বেড়ে অন্যদিকে মোড় নেয়।
পটভূমি
যদিও বাতাসে বিদ্রোহের সুবাস আগে থেকেই ছিল কিন্তু ১৯৬৮ সালে পৌঁছে সমস্ত বিক্ষোভ-বিদ্রোহ যেন বিস্ফোরণে পরিণত হয়েছিল। একইসাথে এতগুলি চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা এর আগে কবে দেখা গিয়েছিল বলা মুশকিল। ভিয়েতনামের গেরিলাদের মার্কিন দখলদারি বাহিনীর ওপর বড়সড় আক্রমণ যা টেট অফেন্সিভ নামে খ্যাত… মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসী প্রদেশের মেমফিস-এ সাফাই কর্মীদের নাগরিক অধিকার ও মর্যাদার দাবিতে যুগান্তকারী লড়াই… কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অবরোধ… ভিয়েতনামের সমর্থনে লড়াই গোটা বিশ্বে বিশেষ মাত্রায় পৌঁছে যাওয়া… পোল্যান্ডের ওয়ারশায় ছাত্র বিদ্রোহ… প্রাগ-বসন্ত… তুনিশিয়ায় হাবিব বুরগিবার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ… মেক্সিকোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্ষোভ… গণতন্ত্র ও শিক্ষা-ব্যাবস্থাকে বি-উপনিবেশীকরণের দাবিতে যুব বিদ্রোহ… জাপানের টকিয়োতে ছাত্র ও কৃষকদের আন্দোলন… পূর্ব-পাকিস্তানের মুক্তি আন্দোলন… এবং, ভারতের কৃষক আন্দোলন ও নকশালবাড়ি।
তবে গুণগতভাবে সমস্ত কিছু ছাপিয়ে গিয়ে ফ্রান্সের আন্দোলন এমন একটি পর্যায়ে উন্নীত হয় যে সেদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গৃহযুদ্ধ এবং বিপ্লবের ভূত দেখতে শুরু করে। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি শার্ল দ্য গোল গোপনে কয়েক ঘণ্টার জন্য ফ্রান্স ছেড়ে পালিয়ে যান এবং রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কয়েকদিনের জন্য হলেও প্রশ্নের মুখে পড়ে। মে ৬৮ ফরাসি সমাজের উপর এমন প্রভাব ফেলে যা দশকের পর দশক ধরেও অব্যাহত থাকে। এবং ফ্রান্স ছাড়া অন্যত্রও এই সময়টিকে ইতিহাসের একটি সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নৈতিক পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ বলে ধরা হয়।
ছয়ের দশক ধরেই গোটা পৃথিবীর মতো ফ্রান্সেও প্রধানত যুবসমাজের মধ্যে ব্যপক অসন্তোষ বিরাজ করছিল। এর কারণ ছিল একাধিক। ভিয়েতনামের ওপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের প্রতিবাদে উত্তাল ছিল ফ্রান্স। মাথায় রাখতে হবে যে আলজিরিয়ার রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, যা ফরাসি যুবমানসে বিরাট ছাপ ফেলে, শেষ হয়েছিল মাত্র ছয় বছর আগে, ১৯৬২ সালে। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াইয়ের জের ধরে নিপীড়নের বিরুদ্ধে ন্যায়ের প্রশ্ন তুলে ফরাসি ছাত্র-যুব সমাজ কার্যত সামজিক কাঠামো নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন তুলতে শুরু করে।
ফ্রান্সের ছাত্র সমাজের একাংশ সামাজিক সংকীর্ণতা ও গতানুগতিকতা নিয়ে কিছুদিন ধরেই ফুঁসছিল। রক্ষণশীল শিক্ষাব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্র ভর্তির পদ্ধতি, অপ্রাপ্তবয়স্কতার সংজ্ঞা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষ করে শহুরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র ও ছাত্রীদের মধ্যে অবাধ মেলামেশার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা, ইত্যাদি নিয়ে ছাত্রসমাজের ভেতরে ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল। ১৯৬৭ সালের মার্চে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের নঁতের ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের হস্টেলে ছাত্রদের যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাঁধে। গড়ে ওঠে ২২শে মার্চের আন্দোলন।
বিদ্রোহের সূচনা
এর এক বছর পরে, ১৯৬৮ সালের ২০শে মার্চ, ভিয়েতনামের যুদ্ধের প্রতিবাদকারীরা নঁতেরে গ্রেফতার হওয়ার পর ড্যানিয়েল কোহেন-বেনডিটের নেতৃত্বে প্রশাসনিক ভবন দখল করে নেয় বিদ্রোহী ছাত্ররা। তারাই ছিল ২২শে মার্চের আন্দোলনের প্রাথমিক উদ্যোক্তা এবং ১৯৬৮-র ছাত্র বিদ্রোহেরও প্রতীক। পরের সপ্তাহগুলিতে দক্ষিণপন্থীদের সাথে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। অক্সিদঁ বলে একটা অতি উগ্র-দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক গোষ্ঠী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধিতায় মাঠে নামে ও ডাক দেয় যে ফরাসি সমাজকে বলশেভিক কীটদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা পরবর্তীকালে বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী দলে যোগদান করেন ও অনেকে মন্ত্রীও হন। মে মাসের গোড়ার দিকে নঁতের-এর ডিন পিয়ের গ্রাপ্পাঁ ছাত্র অসন্তোষের অজুহাতে বিশ্বাবিদ্যালয় বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে বিদ্রোহী ছাত্রদের শায়েস্তা করতে বিশেষ রায়ট পুলিশ ও আধা-সেনা “মোবাইল জঁন্দার্মারি” তলব করেন। তাঁর এই পদক্ষেপ বারুদে আগুন লাগায়।
নঁতের থেকে আন্দোলন সরবনে চলে আসে। ৩রা মে কয়েকশো ছাত্র নঁতের-এর আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে সংহতির ডাক দেয়। প্রশাসন এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি খালি করার নির্দেশ দেওয়ামাত্র কার্তিয়ে লাত্যাঁ-এর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর জুড়ে পুলিশ ছাত্রদের তাড়া করে বেড়ায়। এরপর রাত অবধি পুলিশের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষ চলে যাতে বহু ছাত্র আহত হয় এবং ৬০০ জনকে পুলিশ আটক করে। ১২ জন নেতৃস্থানীয় ছাত্রকে দুই থেকে চার মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং আরও ৮ জনকে জেলে আটকে রাখা হয় যা ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে।
৬ই মে কার্তিয়ে লাত্যাঁ অঞ্চলে এক বড় বিক্ষোভ প্রদর্শনের ডাক দেওয়া হয় কমরেডদের মুক্তির দাবিতে। বহু তরুণ শ্রমিক এই কর্মসূচিতে যোগ দেন এবং ১০ই মে অবধি একের পর এক বিক্ষোভ চলতেই থাকে। দ্য গোলের ক্ষমতা প্রদর্শন, পুলিশি অত্যাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দিকে দিকে আওয়াজ উঠতে থাকে। পুলিশের আক্রমণে বিক্ষোভকারীরা নিরুৎসাহিত না হয়ে আরও বেশি সংখ্যায় রাস্তায় নামতে শুরু করে।
ব্যারিকেডের রাত্রি
১০ই মে দিনের শেষে একটি বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী এবং বিশেষ করে হাইস্কুলের ছাত্রদের পুলিশ ঘিরে ফেললেও দঁফের-রশরো চত্বর থেকে কার্তিয়ে লাত্যাঁ অবধি বিক্ষোভ চলতেই থাকে। রায়ট পুলিশের আক্রমণ সত্ত্বেও দিকে দিকে ব্যারিকেড গড়ে ওঠে। পুলিশের হাজার আক্রমণও তাদের দমাতে পারেনি। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও ব্যারিকেড চলতে থাকে পরের দিন অবধি। ১১ই মে দেখা যায় যে ৩৬৭ জন ছাত্র গুরুতর আঘাত পেয়েছে এবং আরও ৭২০ জন কমবেশি আহত হয়েছে।
সমস্যা হল যে ওই দিন পর্যন্ত ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি (PCF) এবং তাদের নেতৃত্বাধীন ট্রেড-ইউনিয়ন CGT আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। তারা শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও আন্দোলনরত ছাত্রদের সমর্থনে দ্য গোলের বিরুদ্ধে খোলাখুলি রাস্তায় নামার বদলে হাজার রকমের প্যাঁচ কষতে থাকে। তাদের অজুহাত ছিল যে দ্য গোল, তাঁর পুলিশ ও মালিকদের সম্মিলিত শক্তির বিপরীতে এই লড়াই টিকবে না। কমিউনিস্ট পার্টির আমলাতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দ সুবিধাবাদী অবস্থান নিয়ে শ্রমিকদের ও বামপন্থী জনগণকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে চেয়েছিল। এমনকি তাঁরা শুরুতে খোলাখুলিভাবে ছাত্র-আন্দোলনের বিরোধিতা করে ও তার বিপক্ষে দাঁড়ায়। বিক্ষোভকারীদের “নঁতের-এর পাগল”, “উস্কানিদাতা”, ইত্যাদি বিশেষণে অভিযুক্ত করা হয়। PCF-এর এক বড় মাতব্বর জর্জ মার্শে ঘোষণা করেন: “এই ভুয়ো-বিপ্লবীদের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করতে হবে কারণ এরা কার্যত দ্য গোল এবং বড় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করে।” তিনি শ্রমিকদের এইসব “বড়লোক বাপের বেটা-বেটি” এবং সর্বোপরি “জার্মান নৈরাজ্যবাদী” ড্যানিয়েল কোহেন-বেন্ডিট-এর ব্যাপারে সাবধান হতে বলেন। কিন্তু এর উলটো প্রভাব পড়ে। কুৎসার ফলে PCF-এর যুব সদস্যের একাংশ বিপ্লবী বামপন্থীদের দিকে যেতে শুরু করে।
কিন্তু এই আন্দোলনের প্রতি লোকজনের সহানুভূতি ক্রমবর্ধমান ছিল, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে। পুলিশি হামলা ও নিপীড়নের নিষ্ঠুরতা, বিশেষ করে ব্যারিকেডের রাতের ঘটনা সারা দেশ জুড়ে প্রবল অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল। সরকারি বেতার সম্প্রচার অন্য কথা বললেও, মানুষ রেডিও লুক্সেমবার্গ এবং ইউরোপ নং ১ দ্বারা সরাসরি সম্প্রচার শুনে আবেগরুদ্ধ ও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। ইতিপূর্বে ফ্রান্সের শ্রমিকদের কাজের সময় ও পরিবেশ নিয়ে মালিকশ্রেণি ও রাষ্ট্র প্রভূত চাপ সৃষ্টি করে যার জেরে শ্রমিকদের নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা হয়েছিল। দ্য গোলের শক্তির বিরোধিতা করে এত বড় আন্দোলনের মধ্যে বহু ক্ষুব্ধ শ্রমিক আশার আলো দেখতে পান। বিক্ষোভকারীদের দৃঢ় মানসিকতার জন্যই PCF এবং CGT দ্বারা পরিবেশিত দ্য গোলের শক্তিশালী রাষ্ট্রের তত্ত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
এবং ১১ই মে রাতেই CGT বাধ্য হয় দু’দিন পরে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিতে কারণ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বহু শ্রমিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের কারখানা ও কর্মস্থলেও আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন। CGT নেতৃত্বের উদ্দেশ্য ছিল যে এই সাধারণ ধর্মঘটের মাধ্যমে দিকে দিকে গড়ে ওঠা স্বতঃস্ফূর্ত শ্রমিক আন্দোলনগুলির রাশ নিজেদের হাতে নিয়ে এসে সেগুলিকে স্তিমিত করা। কিন্তু ১৩ই মে সমস্ত হিসেবনিকেশ বদলে দেয়। ওইদিনের ধর্মঘট ও বিক্ষোভের সাফল্য ফরাসি শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। ধর্মঘটে অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব এবং গোটা ফ্রান্সের অর্থনীতি মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে।
বিপ্লবী চিন্তা-চেতনার পুনরুজ্জীবন
ছাত্র যুবদের বিদ্রোহ স্ফুলিঙ্গের কাছ করেছিল। এর পরের কয়েক সপ্তাহে ধর্মঘটের পাশাপাশি, প্যারিস, বিশেষ করে সরবন এবং কার্তিয়ে লাত্যাঁয় বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ-উদ্দীপনা দেখা যায়। বহু নতুন ধরনের ভাবনা-চিন্তার উন্মেষ ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও শ্রমিক, যুবক ও এমন কি যারা অল্পবয়সী নন, তাঁরাও একত্রিত হয়ে চর্চা-আলোচনা চালিয়ে গেছিলেন এই পৃথিবীকে নতুন করে নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে। হাজার হাজার আলোচনা শুরু হয়েছিল রাস্তার এক কোণায় কিংবা শুধুমাত্র একটি পোস্টারের সামনে। এই যুবকদের একটি বড় অংশ, কেবল ছাত্ররাই নয় তরুণ শ্রমিকদের একাংশও, বিপ্লবী চেতনা উপলব্ধি করেছিল। একের পর এক সফল ধর্মঘট তাদের এই শিক্ষাই দেয় যে শ্রমিকশ্রেণি লড়াই-আন্দোলনে নামলে কীভাবে চারিদিক নাড়িয়ে দিতে পারে। তাদের সম্মিলিত প্রয়াস কীভাবে এক প্রবল পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের মুখোস খুলে অসহায়ত্ব তুলে ধরতে পারে।
আন্দোলনের ফলাফল হয়ত রাস্তায় নামা ছাত্র-যুব-শ্রমিকদের সম্পূর্ণ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি কারণ বামপন্থী দলগুলির নেতারা গোলের তৈরি সাধারণ নির্বাচনের ফাঁদে পা দিয়ে বিক্ষোভ-আন্দোলনে জল ঢেলে দেয়। তারা শুরু থেকেই এই “ঝামেলার” হাত থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছিলেন এবং তার ফলেই সমস্ত আন্দোলন, ধর্মঘট, লড়াই-সংঘর্ষ, আত্মত্যাগ, ইত্যাদি হয়তো অল্প দামে বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু এই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা, যা একটি গোটা প্রজন্মের মধ্যে অন্য চেতনার জন্ম দিয়েছিল তা আজও প্রাসঙ্গিক।
মে ৬৮-র আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল না শুধুমাত্র পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে এক নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। জনসাধারণের চেতনার স্তর, তাদের লড়াই করার মানসিকতা, মালিক-কর্তৃপক্ষ ও সরকারের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে চকিত প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা এবং কেবলমাত্র কথায় নয়, সম্মিলিত লড়াইয়ের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজকে চ্যালেঞ্জ জানানো — এই ছিল তার লক্ষ্য।
আজকের সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদী আগ্রাসনের মুখে প্রয়োজন জনগণের বিপ্লবী ঔদ্ধত্যের প্রদর্শন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও কর্তৃত্বকে দৃঢ়তার সাথে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আরও উন্নত ব্যবস্থা স্থাপন করা এবং আপোষহীনভাবে শ্রমজীবী মানুষ সহ অন্যান্য নিপীড়িত অংশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আগামীদিনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পথে এগিয়ে যাওয়া।
মে ৬৮ দেখিয়েছে যে মানুষের সৃজনশীল লড়াইয়ের মাধ্যমে সমাজের শ্রমিকশ্রেণি সহ সমাজের অন্যান্য শোষিত অংশের অধিকার কায়েম করা যায়। জন্ম দেওয়া যায় দ্বৈত ক্ষমতার। পুঁজিবাদী ব্যাবস্থাকে সত্যি সত্যি চ্যলেঞ্জ জানানো যায়। সেই কারণেই মে ৬৮ প্রসঙ্গে আলোচনা অতীত দিনের চর্বিতচর্বণ নয়। ওই আন্দোলন আজও আমাদের স্বপ্ন দেখায়। বলে বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি তোলো।
অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও জরুরী একটি লেখা…