নির্মাল্য সেনগুপ্ত
১)
আজও সেই ঝনঝন করে শব্দটা হচ্ছিল জানলার পিছনে। বরুণ প্রথমে ভেবেছিল হাওয়া, কিন্তু ভ্যাপসা গুমোট গরমে দক্ষিণ দিকের জানলা দিয়ে যে নারকেল গাছটা দেখা যায়, তার একটা পাতাও নড়ছে না। এই নারকেল গাছটা বাঁজা, এত বড় হয়ে গেছে তবু আজ অবধি একটা ডাব ধরতে দেখেনি সে। শুধু শুধু গরমের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন অপেক্ষা করছে কারও গম্ভীর মুখে, কপালের ঘাম মুছে হাতঘড়ি দেখবে এখনই। চাঁদের আলো তাকে বিরক্ত করছে মাঝে মাঝে। তাকে খুশি করতে দু একটা বেনেবৌ পাখি এসে তার ডালে বসে কখনও। ডাল তো নয়, ওই পাতাই সব তার। যেন কোনও মানুষের কেউ নেই, অজস্র রাশি রাশি পাণ্ডুলিপি। রাগ হলে সেগুলো সে পুড়িয়ে ফেলে শীতকালে, আবার বর্ষা হলে চোখে চশমা এঁটে লিখতে বসে।
অন্যদিন এভাবেই নারকেল গাছটার দিকে তাকালে বরুণ ভাবুক হয়ে পড়ে। আজ চিন্তিত হল। হাওয়া নেই যখন, জানলায় আওয়াজ কেন হবে? গতকালও তার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে মাঝরাতে। সে খুব মন দিয়ে স্বপ্নে দেখছিল মৌসুমীকে। মৌসুমী বরুণের ভালোবাসা। বন্ধুদের ভাষায় তার ট্রু লাভ। বরুণ হাজার হাজার কবিতা লেখে মৌসুমীর জন্য। এই তো সেদিন ভৌতবিজ্ঞান ক্লাসে বসে বসে যেটা লিখল। “আশায় আশায় যাচ্ছে কেটে রাত, প্রেয়সী তবু দুপুরে ঝিম ধরে, ঘুমের মাঝে পাগল দিওয়ানা, তোমার জন্যে গুমড়ে কেঁদে মরে…” — তোমার বরুণ।
বরুণের কবিতার খুব নাম বন্ধুমহলে। সে খাতা থেকে একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে সমানভাবে দু ভাগ করে নিয়েছিল। তারপর একভাগে মুখের চিউইং গামটা জড়িয়ে ছুঁড়ে মারল স্কুলের পিছনের বাগানে, অন্যভাগে কবিতাটা লিখে, লাল কালি দিয়ে একটা হার্ট সিম্বল আঁকল। পলাশকে দিতে হবে, পলাশ তার পোস্টম্যান, তার ভালোবাসার দূত, তার চিঠি চালান করে মৌসুমীকে। বরুণ অপেক্ষা করে থাকে সেইদিনটার জন্য, যেদিন মৌসুমী উত্তর দেবে তাকে।
তা সেদিন রাতে বরুণের মনে দুষ্টু স্বপ্ন এসেছিল। আকাশে মেঘ করে এসেছে মণিকুন্তলা ঘাটের উপরে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, পিছনের হরি বাঁদীদের জঙ্গল থেকে একসাথে তিনটে ময়ূর ডেকে উঠল, নিজেদের প্রজাতিরই নাম ধরে। মৌসুমী স্নান করে উঠে আসছে। তার কামিজ জলে ভিজে সেঁটে গেছে গায়ে। সদ্য গজানো স্তনবৃন্ত দুটি ফুটে উঠেছে এম্ব্রয়েডারির কাজের মাঝখানে। সালোয়ারের নিচ থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে, মেঘ ডেকে ওঠে আবার, সঙ্গে কামুক ময়ূরের দল। মৌসুমী এগিয়ে আসছে তার দিকে। চারিদিকে এত জল, তবুও বরুণের গলা শুকিয়ে কাঠ, যেন কণ্ঠনালীতে কেউ গুচ্ছ বিচালি ভরে দিয়েছে অনাদরের সঙ্গে। এই খরা একমাত্র কী মেটাতে পারে বরুণ জানে। তা হল মৌসুমীর ঠোঁট। কোনও প্রসাধনী সামগ্রী ছাড়াই চেরিফলের মতো ফুলো ফুলো ওই অধর, একমাত্র তার নির্যাসেই বরুণের তৃষ্ণা মিটবে। সে একটু সাহস করে এগোল। মৌসুমী দাঁড়াল তার সামনে। সে আরেকটু বেপরোয়া হয়ে দু হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল পেন্সিলের শিসের মতন সরু হয়ে আসা মৌসুমীর কোমর। আস্তে আস্তে দূরত্ব যত কমছে, বরুণ স্পষ্ট শুনতে পারছে তার বুক থেকে তীব্রবেগে উঠে আসছে ঝর্ণার স্রোত, এক্ষুনি তার আলজিভ, টাগরা, মাড়ি সব ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাবে।
ঠিক সেই সময়ে জানলার শার্সিতে কেউ ঝনঝন করে আওয়াজ করল। সমস্ত দৃশ্যপট ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে গেল নিমেষে। অসম্ভব বিরক্তিতে চোখে মেলে পিচুটি বাছতে বাছতে পিছনে তাকাল বরুণ। নির্ঘাত বাবা ফিরেছে। চারদিন পর হুঁশ হয়েছে তার।
এখানে একটু জেনে রাখতে হবে বরুণের বাবা অমল সাঁপুইয়ের কথা। বরুণের বাবা অমল, বয়স ওই সাঁইত্রিশ খুব বেশি হলে। ওদের বংশের একটা অদ্ভুত ব্যাপার, সবাই খুব কম বয়সেই ধেড়ে হয়ে যায়। মানে সাতেই সতেরো, আবার বুড়িয়েও যায় খুব তাড়াতাড়ি। বরুণ এখন সবে চোদ্দো, তাকে বাইশ বছরে সুঠাম পুরুষ মনে হয়। আর অমলকে দেখতে লাগে ষাট। অথচ তার ভরা যৌবন এখনও সর্বাঙ্গে লেগে থাকার কথা।
অমল মদ্যপ, মাতাল। সপ্তাহে সাত দিন দুবেলা করে মদ না খেলে তার দুঃখ হয়। সে বিশাল দুঃখ, মনে হয় পাহাড় ফেটে পড়ছে মনের মধ্যে। অমল আছাড়িপিছাড়ি খায়। মাটিতে উটপাখির ন্যায় মুখ গুঁজে চোখের জলে কাদা করে ফেলে। দু হাতে ঘাস ছিঁড়ে এনে “একী হল ভগবান আমার…” বলে বিলাপ করতে থাকে। গ্রামের লোক প্রথমে সহানুভূতি দেখাত, এগিয়ে এসে অমলকে ধরে তুলে নিয়ে যেত বাড়ি। আজকাল শুধু হাসাহাসি হয়। সবাই বলে, ও হল মদ খাওয়ার ছুতো। নিজেকে বোঝানো যে এবার মদ না খেলে চলবে না। এমন কান্নার পরই অমল চলে যায় চৈতিপাড়ায়। সেখানে বিশাল বাংলা মদের শুঁড়িখানা। গ্রামের লোকের ধারের খাতা চলে। অমলের অবশ্য কোনও মাসেই বাকি পড়ে না। যেমন করে হোক, টাকা মিটিয়ে দেয়। তাই সেখানে অমলের খুব খাতির। এছাড়া তার কান্না দূর দূর অবধি ফেমাস। কানাঘুঁষো শোনা যাচ্ছে অমলের কান্না শোনা নাকি মঙ্গল। কোন বাড়ির ছেলে ওই কান্না শুনে ইস্কুলে গিয়ে দেখে সে ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে। তাই জমিদার চক্রবর্তীবাবু ঠিক করেছেন ছেলের সামনের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় অমলকে বাড়ি এনে কাঁদাবেন।
বরুণ এসে দরজা খুলল। ওই যে, তিনি। নারকেল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছে আকাশে। বরুণ ডাক দিল, “বাবা…”
তার মনে হল অমল যেন একবার পিছন ফিরে দেখল তাকে। তারপর টলতে টলতে এগিয়ে গেল মণিকুন্তলা ঘাটের দিকে।
“সেরেছে, মাতাল অবস্থায় পুকুরের দিকে যায় কেন!” বরুণ পিছু নিল অমলের।
গুমোট আবহাওয়া। ঝিঁঝিপোকার কনসার্টে কান পাতা দায়। কোথায় যাচ্ছে অমল? বরুণ ডাক দিল আবার। ঝুপ করে যেন একটা শব্দ হল।
বরুণের আরও মিনিট পাঁচেক সময় লাগল ঘাটে পৌঁছতে। হাওয়া না থাকায় পুকুরের জল একদম স্থির। যেন কেউ একটা বিশাল আয়না লাগিয়ে গেছে গ্রামের মধ্যিখানে। জলের উপর অন্য পাশ ফিরে কালপুরুষ শুয়ে আছে।
বরুণ কিচ্ছু দেখতে পেল না সেখানে।
২)
পরের দিন সকালে মানপুরে রটে গেল কাঁদুনে অমল রাত্রিবেলা নেশার ঘোরে জলে ডুবে মারা গেছে।
পুকুরপাড়ে ভিড় করেছে গ্রামের বড় মাথারা। সেখানে আসে বলরাম সামন্ত, হরি নাপিত, অজয় বাগচি, জয়ন্ত সেনাপতি প্রমুখরা। এরা এই গ্রামের পঞ্চায়েতের লোক। বলরাম সামন্ত হল মোড়ল।
বলরাম বলল, “পুলিশ না আসা অবধি কেউ যেন জলে না নামে। অনেক ব্যাপার থাকে এতে, কীসব ফরেন টেস্ট, খুন না অ্যাক্সিডেন্, জানতে হবে তো আগে। এই নিতাই, খোঁজ দিয়েছিস থানায়?”
নিতাই বলরাম সামন্তের ডান হাত। সর্বক্ষণ মাথা নিচু, মধ্যমার নখ খুঁটছে, উসকোখুসকো চুল। সে সেই ভঙ্গিমাতেই দাঁড়িয়ে থেকে মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ কত্তা, সে তো সেই সকালেই দিয়ে এসেচি। তবে পুলিশের সময়, তার কি কোনও ঠিক আছে! বাবুদের যখন মর্জি হবে, আসবেন।”
জয়ন্ত সেনাপতি মাথা নাড়িয়ে বলল, “এই তো দেশের অবস্থা। এরপর বডি ফুলে উঠে নিজেই ভেসে যাবে। আর টেস্ট করে কি কিছু লাভ হবে তখন? যা ওজন হবে, শ্মশানে নিয়ে যেতে তখন আমাদের ঘাড়ব্যথা।”
হরি নাপিত বলল, “আমি ভাবছি পোলাটার কী হবে। এমনিতেই মা মরা ছেলে, ওই একরত্তি বয়স, দেখতে বড় হলে কী হবে। বগলের লোমও গজায়নি বোধহয়। ওর দায়িত্বও তো এবার আমাদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল।”
বলরাম সামন্ত ভ্রূ কুঁচকে বলল, “সে নিতে হবে বইকি। কেউ যদি না এগিয়ে আসে আমিই নেব।” বলরামের চোখ চকচক করে উঠল। সে সন্তানহীন। তার বউয়ের বহুদিনের শখ একটা ছেলের। অমল মোদোমাতাল হলে কী হবে, ছেলেটা ভালো হয়েছে। পড়াশুনা করে, বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করলেও বয়ে যায়নি এখনও। সে শুনেছে ছোঁড়া নাকি আবার কবিতা লেখে। সাহিত্যের দিকে বলরামের বরাবরের ঝোঁক। তাকে ঘরে তুলতে পারলে তাদের বরবউয়ের ভু দিনের আশ মেটে। চোদ্দো তো এমন কিছু বয়স নয়। নিজের মতো করে গড়ে তুলতে পারবে।
অজয় বাগচি বলল, “অমল যে ইটভাটায় কাজ করত সেখানে খোঁজ দেওয়া হয়েছে?”
নিতাই একইভাবে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, দাদা গেছে। ওই ফিরল বলে। সাইকেল নিয়ে গেছে। সকালেই যা রোদ্দুর উঠছে, এই জ্যৈষ্ঠ মাসটা বড্ড জ্বালায়।”
এমন সময় পিছনে শোরগোল শুনে ঘুরে দাঁড়াল সবাই। নিতাইয়ের দাদা দামোদর দৌড়তে দৌড়তে আসছে ধুলো উড়িয়ে।
“আরে অমল তো ফিরে এসেছে! কে বলল জলে পড়েছে? দিব্যি এসে দাওয়ায় বসে দাঁতন করছে।”
সবাই বিস্মিত চোখে হাঁটা দিল অমলের বাড়ির দিকে।
অমল বাড়ির উঠোনে বসে গতকালের বাসন নিয়ে মাজতে বসেছিল। আশেপাশের প্রতিবেশীরা তাকে ঘিরে আছে। সে কাউকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না যদিও। বলরামরা পৌঁছল সেই সময়ে।
“কী হে! কোথায় ছিলে তুমি এই কদিন?”
অমল একমনে বাসন মাজতে মাজতে বলল, “মাতালের কী আর থাকার জায়গার অভাব হয় মোড়ল? পড়েছিলাম কোথাও একটা। হুঁশ ফিরতে চলে এলাম।”
“কাল রাতে তুমি বাড়ি ফেরোনি? তোমার ছেলে তো তোমাকে দেখেছে।”
“ওর অল্প বয়স, ঘুম চোখে কী দেখতে কী দেখেছে। আমার তো ঘুম ভাঙল আজ সকালে।”
“তোমার ছেলে কই?”
“আমিও তো খুঁজছি তাকে এসে। শুনলাম আমি মরে গেছি ভেবে তাকে তার মামাবাড়ির লোক এসে নিয়ে গেছে। লোক পাঠিয়েছি। চলে আসবে একটু পরে।”
বলরাম সামন্তের তাও সন্দেহ মিটল না। সে বলল, “ঘাটের দিকে গেছিলে নাকি কাল রাতে?”
অমল এবার মাথা তুলে অল্প এসে বলল, “গেলেই বা। মরিনি যে দেখতেই তো পাচ্ছেন? নাকি বিশ্বাস হচ্ছে না? চিমটি কেটে দেখবেন?”
আর কেউ কথা বলল না কোনও। সবাই যেন অমলের ফিরে আসায় অল্প হতাশই হল। তাদের চিরাচরিত একঘেয়ে জীবনে অনাত্মীয়ের মৃত্যু অনেকটা উৎসবের মতন। দাহ করা থেকে শুরু করে মৃতের বাড়ি গিয়ে তার লোকদের সান্ত্বনা দেওয়া, শ্রাদ্ধশ্রাদ্ধাধি, সবকিছুতে হাত লাগিয়ে দিব্যি পনেরোটা দিন ব্যস্তভাবে কেটে যায়। এমন একটা বিনোদন হাতছাড়া হওয়ায় সবাই বেশ মুষড়ে পড়ল।
সবথেকে বেশি ধাক্কা খেল বলরাম সামন্ত। তার সন্তানলাভের ইচ্ছে এবারেও পূর্ণ হল না। ভেবেছিল বাড়ি ফিরে বউকে বেশ চমকিয়ে দেবে কথাটা পেড়ে। আহ্লাদে তার বউ তাকে সারাদিন আদরে মাতিয়ে রাখবে। অমলের এই প্রত্যাবর্তন তাকে অসম্ভব পীড়া দিচ্ছে। সবাই এগিয়ে গেলেও সে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
অমল কিন্তু আর কথা বাড়াল না। সে একমনে বাসন মাজায় রত রইল। এরপর তাকে ভাত বসাতে হবে।
বরুণ মামাবাড়ির জানলা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল মাঠের দিকে। তার মনে এই সময়ে দুঃখ হওয়ার কথা, কেঁদে ভাসানোর কথা। বাপ মরা তো চাট্টিখানি কথা নয়। তার বন্ধুরা সকাল থেকে ঘুরঘুর করছে চারিদিকে। তার মামী কাউকে ঢুকতে দেয়নি ঘরে। জানলা দিয়েই সহানুভূতির চাউনি দেখিয়ে তারা মাঠে চলে গেছে। বরুণও ভাবছিল তার একবার ডুকরে ওঠা উচিত কিনা। কিন্তু তার খালি মৌসুমীর কথাই মনে পড়ছে। মৌসুমী কি জানে খবরটা? সে এর আগে ভেবেছে, যদি কোনওদিন তার বাবা মারা যায়, তার দুঃখতে মলম লাগাতে কি তার কাছে আসবে মৌসুমী? সেই দিন এসেছে আজ। আজ কি আসবে? এলে কী করবে বরুণ?
এমন সময় বিজন দৌড়তে দৌড়তে এসে ঢুকল ঘরে। তারপর সবাইকে অবাক চেঁচিয়ে বলল, “বরুণ, শিগগিরি বাড়ি চ। তোর বাপ ফিরে এয়েচে…”
৩)
‘রাজকুমার তঞ্জন তখন অসম্ভব ভয়ে কাঁপছে। চিরকালই সে নির্ভীক, বহু যুদ্ধে যাওয়ার আগে, মায়ের পা ছুঁয়ে তাঁর সজল চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছে, “বীরের মায়েরা কাঁদে না, তাতে সন্তানের অমঙ্গল হয়। তার বীরত্বকে ছোট করা হয়। হাসতে হাসতে শত্রুর হাতে মৃত্যুবরণ করব।” যদিও আজ তঞ্জন বুঝতে পারছে যে মৃত্যু অত সহজ নয়। মৃত্যু মর্মান্তিক এবং ভয়াবহ। চোখের সামনে তাই আগত মৃত্যুকে দেখে সে ভয় পেয়েছে ভীষণ।’
বরুণ বইটা বন্ধ করে হ্যারিকেনটা নিভিয়ে দিল। দরজার সামনে উড়ছে সাদা মুরগির পালক। সকালে অমল কিনে এনেছিল বাজার থেকে। নিজেই কেটে, ধুয়ে, মশলা মাখিয়ে রাঁধল। অন্যদিন সে বরুণের সাহায্য চায়। আজ কিচ্ছু বলেনি। বরুণ অবাক হল মাংসের স্বাদ দেখে। যেন কোনও শহরের রেস্তোরার শ্রেষ্ঠ বাবুর্চির হাতে বানানো। তার বাবা এমনিতে অত্যন্ত পানসে রাঁধে। ছিবড়ের মতো মাংস, মশলার গন্ধ নেই, শুধু ঝাল আর ঝাল। আজ আঙুল চাটতে ইচ্ছে করছিল। বরুণ সকাল থেকে ভাবছে জিজ্ঞেস করবে, সেদিন রাতে অমল কী করছিল মণিকুন্তলা ঘাটে। বরুণ স্পষ্ট দেখেছে অমলকে, কিছুতেই তার এমন ভুল হতে পারে না।
অমল এখন ঘুমোচ্ছে। একটা আধফাটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর ময়লা লুঙ্গি পরে, অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বরুণ কনুইয়ে ভর করে ঝুঁকল জন্মদাতার দিকে। অন্ধকার ঘরে শুধু জ্যোৎস্নার সহানুভূতি, সেই আলোয় সে জরিপ করতে থাকল অমলের সর্বাঙ্গ। নাক, কান, বুকের লোম, পায়ের আঙুল। সব।
হঠাৎ সে বিস্মিত হয়ে গেল। অমলের ঘাড়ের লাল রঙের জড়ুলটা উধাও। কষ্টিপাথরের মতো চামড়ায় লাল জড়ুলটা নির্লজ্জের মতো লেগে থাকত। অমল বলেছিল জন্মদাগ, আজ নেই।
বরুণের খুব ভয় লাগল। তবে কি সেদিন অমল মরে গেছে? সত্যিই জলে ডুবে মরে গেছিল তার বাবা? তাহলে এ কে? কে শুয়ে আছে তার পাশে? কে তাকে মাংস রেঁধে খাওয়াচ্ছে? তার বাবা সেজে তার কাছে এসেছে কেন?
পরের দিন ভোর হতেই বরুণ ছুটল দিলীপের বাড়ি, তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। বেরনোর সময়ে সে দেখেছে, উঠোনে বসে অমল কাঠ কাটছে নির্বিকার মুখে। ঘাড়ের জড়ুলটাও ফিরে এসেছে রাতারাতি।
দিলীপ সব শুনে বলল, “এ তো বেশ চিন্তার ব্যাপার দেখছি। তোর কাঁদুনে বাপের বেশ নেবে কেন কেউ? তোর বাপেরই ভূত ফিরে আসেনি তো?”
বরুণ মাথা নেড়ে বলল, “তাই যদি হবে, জড়ুল থাকবে না কেন রাতে? সকালে আবার ফিরে আসবে কেন?”
দিলীপ একটু ভেবে বলল, “বললি না জন্মদাগ? আমি শুনেছি জন্মদাগের মতন মরলেও দাগ হয়। সব মড়ার একটা দাগ থাকে গায়ে যা বেঁচে থাকতে ছিল না। তোর বাপ মরে গিয়ে থাকলে ওরও ওই দাগ থাকবে। খুঁজে দেখ।”
বরুণ বাড়ি ফিরে আসে। এসে মনমরা হয়ে তাকিয়ে থাকে বাঁজা নারকেল গাছটার দিকে। কতদিন হয়ে গেল সে কবিতা লেখে না। স্কুল থেকে ফেরার পর খেলতে যাওয়া সে ছেড়ে দিয়েছে। এই সময়ে সে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে একমনে। নয়ত চোখ বন্ধ করে, অন্ধকারের উপর বাইরে থেকে এসে চোখের পাতায় পড়া আলোর তৈরি অতিপ্রাকৃত রঙ উপভোগ করে। এই সময়েই তার সারা শরীর জুড়ে তৈরি হয় মৌসুমীকে ছোঁয়ার ইচ্ছে। মৌসুমীর মুখের উপর আঙুল বুলিয়ে তার মুখবিবরকে রপ্ত করতে ইচ্ছে করে। শুধু মুখ নয়, সারা দেহ, যেন সে দেখতে পায় না চোখে। স্পর্শ করেই সে চিনতে চায়। সব গল্প জানতে চায়।
কিন্তু এই কদিন ধরে সে এসব বিলাসিতার সময়ই পাচ্ছে না। তার সামনে এখন এক বিশাল রহস্য, তার আপনজন হয়ে ঘরে ঢুকে বসে আছে। সে এখন চুপিচুপি চলে গেছে ঘরের পিছনে, কলপাড়ে। অমল স্নান করতে এসেছে। বরুণ লক্ষ করেছে অমল রোজ দুপুরে কোথাও চলে যায় আর ফেরত আসে তার স্কুল থেকে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরে। তখন তার এক হাতে থাকে শাকপাতা, অন্য হাতে একটা মুরগি, দুই পায়ে দড়ি বাঁধা অবস্থায় ঝোলে। অমলের হাঁটু অবধি কাদায় মাখামাখি থাকে। সে ঘরের দোরে মুরগি এবং শাকের আঁটিগুলো নামিয়ে রেখে চলে যায় স্নান করতে।
আজ বরুণ লুকিয়ে চলে গেল তার বাবাকে দেখতে। তাকে আজ দেখতেই হবে মৃত্যুদাগ রয়েছে কিনা।
অমল মগে করে জল তুলে ঢালছে গায়ে। পরণের গামছা জলে ভিজে সেঁটে গিয়ে পুরুষাঙ্গের অবয়ব ফুটে উঠেছে। বরুণ দেখল তার বাবার বুড়োটে ভাবটা উধাও। বুকের পেশিগুলো পুরুষ্টু হয়েছে অনেক। ঊর্ধ্ববাহুও স্ফীত। শুকিয়ে আসা শরীরে কেউ যেন হাওয়া ভরে দিয়েছে।
তখনই সে দেখতে পেল দাগটা, পিঠ আর কোমরের সন্ধিস্থানে। কমলালেবুর সাইজের দাগ, নীল গোলাপের মতো ফুটে রয়েছে।
৪)
বরুণ শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছিল। অমল তার একমাত্র ধূসর রঙের প্যান্ট পরে এদিক ওদিক খুঁজছিল কিছু। বরুণ আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কোমরে কী হয়েছে?”
“কী হবে?”
“ওই যে দাগ…”
“কোথায় দাগ?” অমল একমনে প্যান্টের ভিতরে জামা গুঁজতে ব্যস্ত থাকল। বরুণ বুঝে গেল সে এখন কিছুই উত্তর দেবে না। তারপর আবার রাতে, সে ওই দাগটা খুঁজে পাবে না আর। জানতেই হবে তাকে আজ, জানতেই হবে।
অমল বেরোনোর মিনিট পাঁচেক পর রওনা দিল বরুণ, তার পিছু পিছু।
আজ ভীষণ রোদ্দুর। এমন রোদেই পথগুলো যেন অসম্ভব নিষ্ঠুর হয়ে পড়ে। সব রঙ উঠে যাওয়া, শক্ত পাথুরে জমি তেঁতে উঠে যন্ত্রণা দিতে চায়। আরও আরও বেশি করে চটির ভিতর গরম কাঁকড় ঢুকে যায়। পথের দুধারে ঝলসে যাওয়া ঘাস, তার পাশে শুকনো নয়ানজুলি, গাছের পাতা থেকে শুরু করে গরুবাছুর, সবাই বিমর্ষ এবং ক্লান্ত খুব। বরুণ তার মধ্যে পিছু নিয়ে চলেছে অসীম কৌতূহলে।
অমল প্রথমে গেল গ্রামের প্রান্তের একটা বাড়িতে। ছোট্ট মাটির বাড়ি, অমল ঢুজে গেল ভিতরে। এই বাড়িটা কার জানে বরুণ, সতীশ মাইতির বাড়ি এটা, যার মেয়েকে গত বছর ডাইনি সন্দেহে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
পড়শির বাড়ি যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা নয় কোনও। কিন্তু কাঁদুনে অমল কেন যাবে সতীশ মাইতির বাড়ি? লোকে সতীশ মাইতিকেও সন্দেহের চোখে দেখে। তুকতাক জানে সতীশ, তার মেয়ে রাধা বাপের মন্ত্রতেই দীক্ষিত ছিল। যার দিকে তাকাত, তার গোটা পরিবার দুদিনের মধ্যে উঠে পড়ত চারদোলায়।
বরুণ সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অপেক্ষা করছিল বাইরে দাঁড়িয়ে। রোদের দাপট কমতেই চায় না। ঘাম হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে গায়েই, ধুলোর সঙ্গে মিশে সারা গা চ্যাটচ্যট করছে। রাস্তার কুকুরগুলো ধুঁকছে। এই সময় তার স্কুলে বসে বাগানের দিকে মুখ করে কবিতা লেখার কথা।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর অমল বেরোল। এগোল আরও। একবারও পিছন ফিরে তাকায়নি। গ্রামের রাস্তায় তো আর শহরের মতন গাড়িঘোড়া চলে না। প্রায় এক মাইল অবধি সবকিছু স্পষ্ট চোখে পড়ে। বরুণ অনেকটা তফাতে থাকলেও ধরা পড়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু অমলের যেন কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপই নেই। তার যেন গন্তব্য স্থির।
এভাবেই ইটভাটা হয়ে, বাজার হয়ে, বেগুনক্ষেতের চাষীর সঙ্গে গল্প করতে করতে আরও ঘণ্টাদুয়েক কাটিয়ে ফেলল অমল। বরুণ ভাবল এই পিছু নিয়ে আর লাভ নেই। তার থেকে সে চলুক চৈতিপাড়ায়, মদের ঠেকে।
দোকান ভর্তি খদ্দের, হাতে প্লাস্টিকের গ্লাস এবং পাঠার নাড়িভুঁড়ি দিয়ে তৈরি করা ঘুগনি হাতে নিয়ে কাঠের বেঞ্চিতে লাইন দিয়ে বসে আছে সবাই। কেউ কেউ খুব ঝামেলা করছে, কেউ সুখ দুঃখের গল্পে মগ্ন, একদল নিন্দে করছে পাড়াপ্রতিবেশীর, অনেকে আবার একা। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে চুমুক মারছে ঝাঁঝালো তরলে। বাইরে সারা গায়ে ধুলো মেখে ঘুমোচ্ছে অনেকে, তাদের ডিঙিয়ে বরুণ ভিতরের কাউন্টারের কাছে গেল। নতুন মুখ দেখে কাউন্টারে বসা গোপাল অবাক হল একটু। এই বয়সেই ছোঁড়া ধরে ফেলেছে নাকি!
বরুণ মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমার বাবা আজ এসেছিল?”
গোপাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “বাবা? কে তোমার বাবা?”
“অমল, অমল সাঁপুই।”
“ঝোড়ো অমল না কাঁদুনে অমল?”
“কাঁদুনে অমল।”
“ওহ না, অমলদা তো আসে না অনেকদিন হল। আমি তো শুনেছিলাম সে পুকুরে ডুবেছে নাকি…”
বরুণ উত্তর দিল না কোনও। বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল।
বেলা গড়িয়ে বিকেল হল, তবু গরম কমল না। রোদের তেজ একটু কমেছে বটে, তবে গরম হাওয়ার হলকা এসে ধাক্কা মারছে এখনও। বরুণ দেখল পলাশ তার দিকেই ছুটে ছুটে আসছে।
“বরুণ বরুণ, তোর কপাল তো খুলে গেল রে!”
“কেন কী হয়েছে?”
পলাশ তার উঁচুনিচু দাঁত বার করে ঘাড় নাচিয়ে বলল, “মৌসুমী দেখা করতে ডেকেছে তোমায়, ডাক্তারবাড়ির গলিতে, যাও যাও, দঁড়িয়ে আছে। তোমাকেই খবর দিতে পাঠাল। ওহ শাহরুখ খান আজ চুমু খাবে মাধুরী দীক্ষিতকে…”
হঠাৎ বরুণকে অবাক করে ঠান্ডা হাওয়া এসে নাকেমুখে ঢুকে গেল। আকাশ ফাটিয়ে মেঘ ডেকে উঠল। আশেপাশের গাছপালা মাথা দোলাতে লাগল জোরে জোরে। পলাশ “সেরেছে” বলে দৌড় লাগাল বাড়ির দিকে।
উপরের দিকে তাকাতে তাকাতে বরুণ এগোচ্ছে। এতদিনের তার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে আজ। সত্যিই কি সে চুমু খেতে পারবে? মৌসুমী কি চুমু খেতে দেবে তাকে? বন্ধুরা বলেছে, চুমু খাওয়ার সময়ে বুকের দিকে নিয়ে যেতে হয় হাত, মেয়েরা তাতে আরাম পায়, চুমুর ঘনত্ব আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। যদি বৃষ্টি আসে? ভিজে জামাকাপড় দুজনের, টপ্টপ করে জল ঝরছে মৌসুমীর নাকের ডগা থেকে, বরুণের ঠোঁটের উপর এসে পড়ছে।
মণিকুন্তলা ঘাট পেরোনোর সময়ে বরুণ দেখতে পেল অমলকে। সে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে পুকুরপাড়ের দিকে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে এখন কুচকুচে কালো, যেকোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়বে মাটিতে। ঘাটে কেউ নেই এই মুহূর্তে, অমল এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকেই। এগোতে এগোতে সে জলে নেমে গেল হাঁটু অবধি। তারপর ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
এক ঘণ্টা কেটে গেছে। এখনও বৃষ্টি নামেনি। প্রত্যেকবার মেঘের গর্জনের সঙ্গে একসাথে ডেকে উঠছে অজস্র ময়ূর। বরুণ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অমলের দিকে। অমলের দুই পায়ে হাঁটু অবধি কাদা। সে বসে আছে ঘাটের কাছে, চুপচাপ। কোনওদিকে ঘাড় ঘোরাচ্ছে না।
আর এই উত্তেজনা ধরে রাখতে পারল না বরুণ। সে এবার এগিয়ে গেল। সোজা হেঁটে পাশে গিয়ে দাঁড়াল অমলের। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কে তুমি?”
উত্তর এল না কোনও।
“তুমি আমার বাবা নও। আমার বাবা মারা গেছে, এই পুকুরে ডুবে। সত্যি বলো কে তুমি?”
অমল উত্তর দিল না কোনও। বরুণ একটু ঝুঁকে দেখল অমলের চোখ দিয়ে দরদর করে জল ঝরছে, নিঃশব্দে কাঁদছে কাঁদুনে অমল। তার গলার কাছে লাল জড়ুল। কোমরের কাছের কাপড় ভিজে উঠে গিয়েছে। সেখানও কোনও দাগ নেই।
বৃষ্টি নামল সজোরে। মুষলবেগে বড় বড় জলের ফোঁটা নেমে এসে তপ্ত ধুলোর আস্তরণ ফুটো করে দিল। বরুণ বুঝল এর উত্তর নেই। কোনওদিনই পাওয়া যাবে না।
সেদিন রাতে বাজ পড়ে বাঁজা নারকেল গাছটা পুরো ছাই হয়ে গেল।
চমৎকার লাগল, নির্মাল্য। প্লট, ভাষা, চরিত্রনির্মাণ, গতি, সব।
ভালো লাগলো।
এ কী অত্যাচার বলেন দেখি! এতগুলো ছেঁড়া সুতো ধরিয়ে বললেন নিজের মতো করে বুনে নিতে… 🙁